#প্রিয়_প্রহর২
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব- ৮ (সব প্রকাশিত)
ধ্রুব আয়ানাকে ঠিক করে দাড়া করিয়ে বলে,
–দেখে শুনে চলবে তো! এখনি ব্যাথা পেতে। তোমার এই দৌড়া দৌড়ির স্বভাবটা আর গেলো না।
আয়ানা অশ্রুসিক্ত চোখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
–কেনো এমন করছো তুমি? আমার দোষ হলে বলে দেও আমি শুধরে নিবো। তাও চলে যেও না আমায় ছেড়ে।
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার তো কিছু করার নেই। তার জীবনটা অনিশ্চয়তার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। সে চাইলেও কিছু করার নেই। যদি ক্যান্সার নিরাময় না হয় তো একটা মেয়েকে বিয়ে করে জীবন নষ্ট করাটা হারাম হবে।
ইসলামেও আছে,
” কোনো পুরুষ নিজের অক্ষমতা, ভরন-পোষনে অক্ষম, দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তার জন্য বিয়ে সুন্নত না। কারো জীবন জেনে শুনে নষ্ট করলে সে গুনাহর ভাগীদার হবে। হ্যাঁ, যদি মেয়েটি জেনে শুনে বিয়ে করে তো ঠিক আছে তখন সমস্যা নাই।”
(ইউটিউবে একটা ইসলামিক ভিডিওতে শুনেছিলাম)
ধ্রুব বলে,
–ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ।
ধ্রুব মেঘ ও নীড়ের কাছে গিয়ে তাদের দুজনকে একত্রে জড়িয়ে ধরে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ঘুরে চলে যায়। আয়ানা সেখানেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ধ্রুবের চলে যাওয়া দেখে।
______
আরো এক সপ্তাহ চলে গেছে। ধ্রুব নিজের চিকিৎসা শুরু করছে। একটা কেমো দিয়েছে সে। স্কলারশিপ পেয়ে যেই হসপিটালে গেছে সেটাতে সে ডাক্তার ও সাথে হায়ার স্টাডি করছে তাই কিছু সুবিধা পাচ্ছে চিকিৎসার ক্ষেত্রে।
আয়ানা এখন কথা বলেই না প্রায়। হসপিটাল ও বাসা এই দুইটাতেই সে চুপচাপ।
শুভ্র নিজের কেবিনে বসে আছে। রোগী মাত্র দেখে একটু ফ্রি হয়ে বসেছে। তখন শুভ্রর কেবিনে শিলা আসে। শিলাকে দেখে শুভ্র মলিন হাসি দেয়। শিলাও বিপরিতে হাসি দেয়। শুভ্র বিষাদ কন্ঠে বলে,
–তোকে যেমন কাঁদিয়েছিলাম তেমনি আমিও কাঁদছি। একজনকে ভালোবেসে পাইনি। এরপর তার প্রতি অনুভূতিকে তালা বন্ধ ডায়েরিতে রেখে আরেকজনকে সবটা দিয়ে ভালোবাসলাম। আজ সেও নেই। কোথায় আছে জানা নেই। আয়ানা যা বললো তা যদি সত্য হয় বিশ্বাস কর আমি বাঁচতে চাই না। জার্মানিতে আমি খবর লাগিয়েছি যদি কোনো খোঁজ পাই তো। আমার ভিসা হতে সময় লাগবে। কোনো স্কলারশিপ বা হসপিটাল থেকে ডাক পেলে সময় কম লাগতো।
শিলা বলে,
–তুই আবার মেইল করে দেখ তো কোনো কিছু হয় কিনা? এখনি কর। দেখ হসপিটাল থেকে তোকে ডাক দেয় কিনা!
শুভ্র আবারো নিজের মেইল বক্স খুলে দেখে কাল রাত ৩ টায় জার্মানির এক হসপিটাল থেকে মেইল এসেছে। শুভ্রর চোখ খুশিতে চকচক করে উঠে। শিলাকে শুভ্র বলে,
–দোস্ত মেইল এসেছে। আমি অতি শিগ্রই যেতো পারবো জার্মানিতে।
শিলা কথাটা শুনে মুচকি হাসে। এরপর বলে,
–তাহলে এখন অথিরিটিকে জানা। জলদি যা। এক-দেড় সপ্তাহের মধ্যেই তোর ভিসা লেগে যাবে।
শুভ্র তাই করে। জলদি করে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। শুভ্র যাওয়ার পর শিলা কাউকে ফোন করে,
–তোমার শুভ্র বড্ড বেখায়াল। মেইল বক্স চেক করলে আমার কষ্ট করতে হতো না। অতিশীঘ্রই শুভ্র আসছে তার রৌদ্রিতা যেখানে প্রথম রোদের মুখ দেখেছো সেই দেশে।
ফোনের অপরপাশ থেকে মেয়েলি হাসির ছন্দময় ঝংকার শোনা যায়। মেয়েটি বলে,
–তার সাথে লুকুচুরি খেলতে ইচ্ছে করছে বড্ড! সে এলে আমি তাই করবো। তাকে ধরা দিয়েও অধরা থাকবো।
শিলা বলে,
–ভালোবাসাময় প্রতিশোধ নিবে তাইতো!
–একদম। নিবোই তো। এই রৌদ্রিতা কিছু ভুলে না। তার ভালোবাসা পাবার আগে আমায় যেটুকু ছটফট করিয়েছে আমি তার খানিকটা তো তাকে করাবোই। যা সহজলভ্য তার কদর থাকে না। আর যা বহু সাধনা করে পায় তা অমুল্য হয়।
হ্যাঁ, মেয়েটা আরোহী। ওই এক্সিডেন্টে আরোহীর মিসিং এসব আরোহী নিজে করিয়েছে। আরোহী যেখানে জব ও আবারো ইন্টার্ন প্লাস স্টাডি করছে সেখানের হেড সার্জন ও প্রফেসর আরোহীর পরিচিত তাই তাকে সব বলার পর সে প্রথমে মানা করলেও মেয়ের মতো আরোহীর কথা ফেলতে পারেনি। কিভাবে? কারন আরোহী ও আয়ানার জন্ম জার্মানিতে। আর ওদের জন্ম হয়েছে ওই হেড সার্জন ও প্রফেসরের ওয়াইফের অভজারভেসনে। তখন সেই ডাক্তার এসেছিলেন এটা দেখতো যে দুইটা জমজ ছেলের পর দুইটা জমজ মেয়ে সন্তান হয়েছে তাই। ডাক্তার দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন বিয়ের ১০ বছর পরেও।
তারা দুজনেই নীড়, মেঘ, আয়ানা ও আরোহীকে অনেক আদর করতেন। আরোহীদের বয়স যখন ৩ বছর তখন তারা সেখান থেকে দেশে ফিরে আসে। ওই ডাক্তার দম্পতির কাছে আরোহী বেশি থাকতো কারন আরোহী তো চঞ্চল।
আরোহীর কথার জবাবে শিলা বলে,
–একই মেডিকেলে যাবে তো তোমার নাম ও তোমাকে দেখলেই তো চিনে ফেলবে।
আরোহী বাঁকা হাসে তারপর বলে,
–উহুম। আমি আসার ফেস কভার করে রাখবো। আর আমি এখানে রৌদ্রিতা, আরোহী বা রুহি নামে পরিচিত না। এখানে ফিলিপ আঙ্কেল ও এনা আন্টি (হেড সার্জন ও তার ওয়াইফ) আমাকে ‘আয়রা’ নামে ডাকে। আমার মুশায়রা নাম থেকে ‘আয়রা’ ডাকে আর আয়ানাকে ‘আয়ানা’ ও ‘তারা’ নামেই ডাকতো।
শিলা উচ্ছাসিত গলায় বলে,
–যাক তোমার সবগুলো নামে কেউ না কেউ ডাকে।
আরোহী বলে,
–হ্যাঁ। মানুষকে তার প্রতিটা নামে ডাকলে মানুষটার খুব ভালো লাগে। আমারো লাগে। আয়ুকে তো পূর্বের (ধ্রুব) বাবা ‘মেহেরিমা’ নামে ডাকে। নিজের সবগুলো নাম শুনতেও ভালো লাগে। আচ্ছা বাই দা ওয়ে, আয়ুর কাহিনী কিন্তু বুঝলাম না! পূর্ব কি কারনে গেছে জানতে পেরেছো?
শিলা হতাশ শ্বাস ফেলে বলে,
–হ্যাঁ, আমাদের হসপিটলেই ডাক্তার ধ্রুব নিজের টেস্ট করিয়েছিলো। আমি জানতে পেরেছি আমার স্বামীর মাধ্যমে। তাকে বলেছিলাম খোঁজ নিতে। সে নিয়েছে। তখন জানতে পারলাম কেনো ধ্রুব আমেরিকায় গেছে। স্কলারশিপ তো পেয়েছিল আগেই তবে ডিলে করছিলো কিন্তু আচানক এতো বড় অসুখের কথা শুনে সে স্কলারশিপটা একসেপ্ট করে নিয়েছে।
আরোহী আঁতকে উঠে। তারপর বলে,
–কি হয়েছে পূর্বের?
শিলা বিমূঢ় হয়ে বলে,
–ব্লাড ক্যান্সার। সেকেন্ড স্টেজ। একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া। চিকিৎসাও করাচ্ছে আমেরিকায় সাথে জব ও হায়ার স্টাডি।
আরোহীর আঁখিযুগল সিক্ত হয়। রুদ্ধ হয়ে কন্ঠস্বর। যেই বোনকে সব সময় প্রোটেক্ট করেছে সবকিছু থেকে। আজ সেই বোনের এই সময় তার পাশে থাকতে পারছে না। জানে না কিভাবে তার বোন এই বিচ্ছেদ সহ্য করছে! নরম চুপচাপ মেয়েটি কিভাবে আছে! আরোহী জড়ানো গলায় বলে,
–আয়ু তো জানে না এটা তাইনা? এমনিতে ওর ধ্রুবের এভাবে ছেড়ে চলে যাওয়ার বিচ্ছেদ নিতে পারছে না তো ক্যান্সারের কথা কিভাবে সহ্য করবে!
শিলা নেত্রকোন মুছে বলে,
–জানি না। তবে আয়ানার জানা দরকার। ধ্রুব ও আয়ানা দুজনেই বিচ্ছেদ যন্ত্রনায় কাতর। ধ্রুব মনের জোর পাচ্ছে না তাই তো আয়ানার সাথে এরূপ ব্যাবহার করে চলে গেছে দূরে। আল্লাহ না করুক (আল্লাহ আমার মাথায় কুবুদ্ধি না দিক) ধ্রুবের কিছু হয়ে গেলে আয়ানা কি করবে আমি ভাবতে পারছি না। আমি ডিসিশন নিয়েছি শুভ্রর মতো আয়ানাকেও ধ্রুবের রিপোর্টটা মেইল করবো।
আরোহী নিজেকে সামলিয়ে বলে,
–হ্যাঁ, তাই করো। ওদের দুজনের এখন দুজনকে দরকার। খুব দরকার। কেউ কাউকে ছাড়া ভালো নেই।
________
আয়ানা নিজের মেইলে আসা রিপোর্টটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার দৃষ্টি ঝাপসা হচ্ছে ক্রমশ। টুপ করে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো মোবাইলোর স্ক্রিনে। বাকশূন্য হয়ে বসে আছে সে নিজের রুমের বিছানায়।
তখনি সাদিয়া ও সাবিলা আয়ানার রুমে আসে। ওরা দুজন আয়ানার দুইপাশে বসে। সাদিয়া আয়ানার এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে মুখটা নিজের দিকে ঘুরায়। সাবিলাও আয়ানার মাথায় হাত রাখে। দরজার বাহিরে দুই ভাই দাঁড়িয়ে আছে। তারাই বলেছে আয়ানার কাছে যেতে। প্রতিদিন তো বাসায় ফিরার পর যে দরজা খুলে তাকে দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফোঁটায় কিন্তু আজ মূর্তির মতো পাংশুটে মুখ করে নিজের রুমে এসে পড়েছে।
সাবিলা আজকে যেহেতু সদর দরজা খুলেছে তখন এরকম প্রতিক্রিয়া দেখে সাদিয়াকে বলে তারপর নীড় ও মেঘকে।
সাদিয়া আয়ানার চোখের পানি মুছিয়ে বলে,
–আয়ু সোনা, তুই এভাবে কাঁদছিস কেনো? দেখ তোর ভাতিজারা কিন্তু তাদের ফুপির সাথে রাগ করবে। একটু হাসি দে না সোনা।
সাবিলাও বলে,
–আয়ুপি, হাসো না। ওদের এক ফুপির খোঁজ তো পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আরেক ফুপিও কান্না করছে। ওদের কি ভালো লাগে বলো!
হ্যাঁ, সাদিয়া ও সাবিলা দুজনেই প্রেগনেন্ট। ওইদিনের সারপ্রাইজটা এটাই ছিলো। সাদিয়া ও সাবিলা দুজনের ইচ্ছে ছিলো একই সময় প্রেগনেন্ট হবে। জমজ বাচ্চা তো নাও হতে পারে তাই নীড় ও মেঘের মতো একইদিনে যদি তাদের বাবুরা হয় তো কতো সুন্দর হবে।
আয়ানা সাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে ফেলে। সাদিয়া ও সাবিলা কেউ প্রস্তুত ছিলো না। সাবিলা সাদিয়ার পিঠে হাত রাখে শান্তনা স্বরূপ আর সাদিয়া আয়ানার মাথায় হাত বুলায়।
দরজার আড়াল থেকে দুই ভাই বিচলিত হয়ে আছে। অনেকক্ষণ কান্নার কারনে হিঁচকি উঠে গেছে। এরপর কিছুটা শান্ত হয়ে ওদেরকে মোবাইল থেকে ধ্রুবের রিপোর্টটা দেখায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,