#বেলা_শেষে। [২০]
শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে রান্নার কাজ করছে ভূৃমিকা। ভূমিকার বাবা মা সেই কখন আসছে এখনো কিছু খাওয়া হয়নি। তাই বাবা মায়ের জন্যে নিজ হাতে রান্না করছে ভূমিকা। আরাভ অবশ্য বলেছিলো, অনলাইনে অর্ডার করতে।কিন্তু ভূমিকা শুনে নি। অনলাইনে অর্ডার করা খাবার আর নিজ হাতে রান্না করা খাবার এক হলো নাকি। ভূমিকা প্রথমবার কোন আবদার করেছে আরাভের কাছে। তাই সে চব্বিশ বছরের রেকর্ড ভেঙে আজ গিয়েছিল বাজার করতে। বাজার থেকে টাটকা সবজি মাছ মাংস কিনে এনেছে। আর ভূমিকা সেগুলোই রান্না করছে। ঢের মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে সে।
ড্রয়িংরুমে বসে ভূমিকার বাবা মা-এর সাথে গল্প করছে আরাভ। তার মনোযোগ তাদের সাথে গল্প করার থেকে বেশী তার হাতের দিকে। প্রায় ঘন্টা খানেক আগে এই হাত খুব যত্নকরে স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে তাতে মেডিসিন লাগিয়ে দিয়েছে ভূমিকা। একটু পর পর হাতের দিকে তাকাচ্ছে সে, আর অধরোষ্ঠ চেপে হাসছে।
পিছনে দু-হাত গুজে পুরো রুম পায়চারী করছে মাশহুদ। তার ভাবতেই অবাক লাগছে তার ছেলেটা এতটা অকৃতজ্ঞ। ছেলের প্রতি এতদিন কি বিশ্বাসটা না ছিলো তার। কত ভরসা করতো তাকে। একটা মেয়ের দায়িত্ব দিয়েছিল তাকে। সেটাও অবঞ্জা করলো সে। তবে কি তার ছেলেকে চিনে উঠতে পারে নি সে। ছেলের ভবিষ্যৎ এর কথা ভাবতে গিয়ে নিজেদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। মাশহুদের ভাবতেই অবাক লাগছে, যেখানে পুরো একটা ইউনিয়নের মানুষ তার বিচক্ষণতার তাকে সম্মান করে সেখানে নিজের ছেলের জিবনের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি সে। তাহলে কি নেতা হওয়ার যোগ্যতা নেই তার। যে নিজের ছেলের জিবনের জন্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে সাধারণ জনগনের বিচার করবে কি করে। নাকি তার ছেলেকে চিনে উঠতে পারে নি সে। সে ছোট থেকে দিগন্তকে দূরে রেখেছে। মাশহুদ যদি তার ছেলেকে নিজের কাছে আগলে রাখতেন তাহলে হয়তো তার ছেলেকে বুঝতেন তিনি। ছেলের পছন্দের কথা জানতেন তিনি। দু-জনের মধ্যে এই দূরত্বই হয়তো সব কিছুর জন্যে দায়ী। ভূমিকার জিবনের কি হবে এখন। এটা ভেবেই অস্থির তিনি। তার একটা ভূল সিদ্ধান্ত ভূমিকার জিবনটা উলট পালট হয়ে গেলো। তারপর মনে পরে যায় মিমি নামক রমনীর কথা। মাশহুদ দিয়ে দিগন্তকে জিগ্যেস করে,
-এই মিমি মাইয়াডা কে?? আমার লগে দেখা করবার কইও তো?? দিগন্ত ওনার পাশেই সুফার মাথা নিচু করে বসে ছিলো। মাশহুদের কথা শুনে মাথা উচু করে সামনে তাকায় সে। অতঃপর বলে,
-মিমি আমার স্ত্রী আব্বা।
-হো জানি, এর লাইগ্যাই তো ভূমিমা-কে ডিভোর্স দিলা।
মাশহুদের কথা শুনে চোখমুখে আমাবস্যা রাতের মতো অন্ধকার নেমে আসলো দিগন্তের। কিছু বলল না। দাত দিয়ে অধর চেপে বড় করে শ্বাস ফেলল দিগন্ত। তখন মাশহুদ আবার বলে উঠলো,
-আমরা আ্যজই গ্রামে চইলা যামু।
-আজই??
-হো আ্যজকেই চইলা যামু। দিগন্ত ওর মায়ের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালো। মানে আর কয়েকটা দিন থেকে যাও না। দিগন্তের মা চোখের ইশারায় বলল,সেটা আর সম্ভব না। তোমার সাথে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।
-দিগু, দিগন্তের পাশে সুফায় বসতে বসতে বললেন মাশহুদ। তোমার এই বিয়েতে আমার আপত্তি করিনাই ঠিকি কিন্তু আমরা মাইনাও নেই নাই। তুৃমি তোমার এই বউ নিয়া আমার গ্রামে যাইবা না। হো, বিয়া করছো তুমি, সারাজিবন সংসারও করবা তুমি। এতে আমাগো কারোরই আপত্তি থাকার কথা না। কিন্ত গ্রামে আমারে সবাই অনেক সম্মান করে। সমাজে আমার একটা সম্মানিয় জায়গা আছে। আমি চাইনা তোমার কারনে আমার সেই সম্মনটা নষ্ট হোক। মাশহুদের কথা শুনে ছলছল নয়নে তার পানে তাকালো দিগন্ত। তখন ওর মা বলে উঠলো,
-ওগো, এসব তুমি কি কও। আমার একটা মাত্র ছেলে আর আমার কাছে যাইবো না। তুমি তোমার কথা ফিরিয়া নাও।
-আমার সিদ্ধান্তে আমি অনড় গিন্নি।এই সিদ্ধান্ত আমি বদলাইবার পারুম না। তুমি যাও রেডি হইয়া নাও। বলেই সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন মাশহুদ।
গরম গরম খাবার পরিবেশন করছে ভূমিকা। আর ড্রাইনিং এ বসে আছে ভূমিকার বাবা মা সাথে আরাভ। আরাভ চলে যেতে চেয়েছিলো কিন্ত ভূমিকার বাবা মা তাকে আটকিয়ে রেখেছে। বলছে তারা এক সাথে খাবে। আরাভ ও কোন আপত্তি করে নি। তাছাড়া এটা তো ওরই বাড়ি আর খাবার গুলো ও নিজে কিনে এনেছে তাহলে আরাভের আপত্তি থাকবে কেন? আপনার কিন্ত ভাববেন না ভূমিকার হাতে রান্না করা খাবারের লোভে কোন আপত্তি করে নি। আসলে কিন্তু নয়। প্রথমবার আরাভ কেমন বাজার করলো সেটা দেখার জন্যেই কোন আপত্তি করে নি। খাবার পরিবেশন করা শেষ। ভূমিকা গিয়ে ওর বাবার পাশে বসলো। এখনে যে তাকে তার বাবা খাইয়ে দিবে। যতটা না খুশি লাগছে তার থেকেও বেশী ভয় লাগছে ভূমিকার। মায়ের বকুনি খাওয়ার ভয়। আড় চোখে মায়ের দিকে তাকালো সে। তার মা খাওয়ায় মনোযোগ দিয়েছে এদিকে তাকানের টাইম নাই তার। ভূমিকার চোখ বড় বড় হয়ে আসলো, এটাই প্রথাম বার হচ্ছে, ভূমিকাকে ওর বাবা খাইয়ে দিচ্ছে আর ওর মা চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে।
এক লোকমা ভাত মুখে দিতেই বেশ অবাক হয় আরাভ। খাবারটা মুখের ভিতরে কিছুক্ষণ রেখে তার স্বাধ অনুভব করে নেয় সে। তারপর বিনাশব্দে তৃপ্তির সহিত সব খাবার খেয়ে নেয় আরাভ। খাওয়া শেষে ভূমিকা যখন সব কিছু গুচাচ্ছে তখনি নয়না কল করলো। ভূমিকা কল রিসিভ করে লাউড স্পিকার দিয়ে টেবিলের উপর রাখলো মোবাইল। তখন ওপাশ থেকে নয়না বলে উঠলো,
-ভূমি কোথায় তুই?? আজ অফিসে আসলিনা। জানিস ম্যানেজার কাকা তোকে খুজছিলেন।
স্মিত হাসলো ভূমিকা তারপর বলল,
-আমি না থাকলে ওনার বউয়ের গল্প বলবে কাকে।
-কোথায় তুই?? সন্ধা হয়ে আসছে তো ফিরবি কখন।
-এইতো ফিরবো আপু। আড় চোখে আরাভের দিকে তাকিয়ে বলল।
-তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস, নিতু বাসায় একা আছে। আমি গ্রামে যাচ্ছি।
-এখন??
-হ্যাঁ। বাবা ডেকেছে। শুননা রাখছি। তাড়াতাড়ি ফিরবি কেমন।
-জ্বি আপু।ভূমিকা মোবাইল রেখে সবকিছু গুছিয়ে নেয়।
তারপর থেকেই ভূমিকা জিবনে নেমে আসে দুর্বিষহ। আগে সপ্তাহে অন্তর একবার করে কলেজ যেত এখন সেটাও যাওয়া হয়না কলেজের সকলে জেনে গেছে ভূমিকা তাদের সিনিয়র ভাই দিগন্তের এক্স ওয়াইফ। আর এই কাজটি সম্প্রচারের কাজ করেছে মাহিন নিজে। বিনা বেতন বিনা পারিশ্রমিকে সম্প্রচার করে গেছে সে। ভূমিকার এখন আর কলেজে যাওয়া হয়ে উঠে না। কলেজের কিছু ছেলে আছে যারা তাকে বাজে অফার করে। তোমার মতো একটা সুন্দরীকেও দিগন্ত ভাই ছেরে দিলো। আসলে কি বলতো আমাগো ভাই মিমিকে খুব ভালোবাসে। তাকে ছাড়া অন্যকারো দিকে সে ফিরেও তাকায় না। এমনকি বিয়ে করা বউয়ের দিকেও না। তুমি আমাদের কাছে আসতে পারো। আমরা তোমাকে আদরে সোহাগে ভরে দিবো। কখনো ছেড়ে দিবো না।
ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাধ করতো ভূমিকা। সাদাকে সাদা আর কালো কে কালো বলতে দু-বারও ভাবতো না সে। ছেলেরা যখন ওকে বাজে মন্তব্য করে তখন ইচ্ছে করে তাদের মাটির নিচে পুতে দিতে। অনেকের সাথে লড়াইও করে সে। কিন্তু কয়জনের মুখ বন্ধ রাখবে সে। তাই কলেজে যাওয়াই বন্ধ করে দেয়। সারাদিন অফিসে পরে থাকে আর রাতে নিতুর কাছ থেকে নোট দিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যায়
যান্ত্রিক জীবনে একটা সুন্দর দিন পাওয়া যেন হাফ ছেড়ে বাঁচার মতো। দিনটাকে একটু রঙিন করে নিতে চেষ্টা করেন মাঝে মধ্যেই। তবে ঠিকঠাক হয়ে ওঠাটা অনেকটাই ভাগ্যের ব্যাপার। তবে কাজের দিনটাকে মধুর করে তুলতে চাইলে দরকার একটা মিষ্টি সকালের। চাপমুক্ত, সতেজ একটা সকাল পেতে কে না চায়। আজকের ফুরফুরে সকাল দেখে মনে হচ্ছে দিনটা খুব ভালো কাটবে। কম্বল সরিয়ে উঠে বসলো ভূমিকা। ছুটির দিন তাই আজ বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে। নিতু হয়তো রান্না করছে। নয়না আপু এখনো তার বাড়ি থেকে ফিরে নি। ভূমিকা বালিশের নিচ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকে ডুকলো। তখনি নিতু এসে ওর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নিলো আর রাগী গলায় বলল,
-কখন থেকে ডাকছি তোকে উঠার কোন নাম নাই। যা রেডি হয়ে নি।
-রেডি হবো। কিন্ত কেন??
-আমার বাড়ি যাচ্ছি।
-তোর বাড়ি তো তুই যা_না আমাকে কেন বলছিস। কম্বল সড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো ভূমিকা। নিতু ভূমিকাকে ধাক্কাদিয়ে ওয়াশরুম পাঠিয়ে দিয়ে বলল,
-তুইও যাচ্ছি আমার সাথে। ভূমিকা কিছু বলবে তখনি নিতু দরজা আটকিয়ে দেয়।
চলবে,,,,,,,,,
#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।