#চন্দ্রপুকুর
||২৫তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
মেহমাদ শাহের হৃদয়টা ছটফট করছে তার বাচ্চা হরিণীটির উদ্দেশ্যে। তবে এর চেয়েও অধিক হৃদয় পুড়ছে অজানা যন্ত্রণায়।
ছোটোবেলায় তার আম্মাজান বলতেন, ‘ভালোবাসার গভীরত্ব মাপকাঠি ছাড়ালে না কি প্রেয়সীর ভালো থাকা, খারাপ থাকা বোধ করা যায়’। তবে কি ভালো নেই তার চন্দ্রমল্লিকা।
সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এতদিন যামিনীর কোনো খোঁজ-খবর না পাওয়া। কাজের চাপে, বিভিন্ন ঝামেলায় সে নিজেও আর বিষয়গুলো ঘেঁটে খোঁজ নিতে পারেনি। আজ কাজটা শেষ করে সোজা বাড়ির পথে রওনা হয়েছে সে। আর মিনিট পাঁচেক লাগবে।
“মিনার তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাও। নাহলে নির্ঘাত দুঃশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় এই পথযাত্রাতেই মৃত্যু হবে আমার।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ্, জমিদার বাবু। মরুক আপনার শত্রুরা। এখনই পৌঁছে যাব আমরা। আপনি চিন্তা করবেন না। কে সাহস করবেন আপনার তথা জমিদারের বেগমকে আঘাত করার?”
মেহমাদ শাহ আলতো হাসে প্রিয় ভৃত্যের বক্তব্যে। তবুও হৃদয়ের যন্ত্রণা যেন কোনো কিছুতেই উপশম হওয়ার নয়।
অবশেষে নবাববাড়িতে প্রবেশ করে যুবক। সবাই বেশ অবাক, খবর না দিয়ে এসেছে বলে কথা। কোনো দিকে না তাকিয়েই সে অগ্রসর হয় যামিনীর কক্ষের দিকে।
দ্বারের সামনে দাঁড়াতে ভ্রু কুঁচকে যায় একজন প্রহরীও উপস্থিত। মৃদু ধাক্কাতে দ্বার খুলে যায়। শূন্য ঘর। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বেশ কিছুদিন হয়েছে এই ঘরে কারো অস্তিত্ব নেই।
ভীতি আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে যুবকের মন ও মস্তিষ্ককে। তার প্রেমিক হৃদয় বদ্ধ উন্মাদের ন্যায় কামরা হতে বের হয়।
দাসীদের সামনে যেয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে,
“চন্দ্র কই? আমার চন্দ্রমল্লিকা কোথায়?”
প্রতিটি মেয়ে কেঁপে উঠে তার কণ্ঠের তীক্ষ্মতায়। তবে তাদের জানা নেই এই মুহূর্ত সত্য উন্মেচন করা কতো টুকু সঠিক।
এর মাঝেই পুনরায় ধমক দেয় মেহমাদ শাহ। একজন দাসী ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়,
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা বৈদ্যশালায়। তার অবস্থা খুব খারাপ।”
কর্ণগোচর হতেই এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সাহসী জমিদারও। পরমুহূর্তেই ছুটে যায় বৈদ্যশালার দিকে।
সে কি জানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য অপেক্ষা করছে তার উদ্দেশ্যে। যা হয়তো কাঁপিয়ে দিবে তার লোম লোম।
___
বেগম লুৎফুন্নেসা ভোরের দিকে নিজের কক্ষে এসেছেন। পোশাক পরিবর্তন করে বিছানায় গা ঠেকালে সারারাত্রি অনিদ্রায় কাটানোর কারণে অবিলম্বেই তন্দ্রায় ডুব দেন।
“বেগম! বেগম! দ্রুত ঘুম থেকে উঠেন। সর্বনাশ হয়ে গেল।”
আয়েশা খাতুন চেঁচাতে চেঁচাতে মনিবের ঢুকেন। বৃদ্ধা নারীটি উঠে বসে শঙ্কিত হৃদয়ে।
“কী হয়েছে আয়েশা? এমন আচারণ করছো ক্যানো? চন্দ্রমল্লিকার কি আরও অবনতি হয়েছে?”
“বেগম, আমাদের শাহ আজ সকালে কাউকে না জানিয়েই এসে পড়েছেন। তিনি এখন বৈদ্যশালার দিকে ছুটেছেন। সব সামনে এসে যাবে শাহের বেগম।”
আতঙ্কে শয্যা হতে উঠে দাঁড়ান বেগম লুৎফুন্নেসা। তাঁর জানা নেই তিনি কী করবেন, তবে এখন প্রিয় মেহমাদ শাহের মুখোমুখি তো হতেই হবে তাঁকে।
“আমার বস্ত্র বের করো আয়েশা খাতুন দ্রুতো। রাতের উত্তরীয় ছাড়তে হবে। পরিণাম যা-ই হোক পরিস্থিতির মোকাবেলা তো করতেই হবে।”
আয়েশা খাতুন বস্ত্র বের করতে শুরু করেন। মালিহা খাতুনও তাঁকে সহায়তা করছেন।
মালিহা খাতুন কাজ করতে করতে নত গলায় বলে উঠেন,
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। তবে বেগম চন্দ্রমল্লিকার সাথে যা হয়েছে তা খুবই জঘন্য হয়েছে। কোনো রূপ ভুল না করেও এমন পাহাড় সমান শাস্তি তার ভাগ্য লেপিত হলো। আর আসল অপরাধীরা মুক্ত আকাশে স্বাধীন তারার ন্যায় আছে।”
মনে মনে ক্ষুব্ধ হতে যেয়েও হতে পারলেন না এই অন্দরমহলের কর্ত্রী। নারীটি ত্রুটিপূর্ণ কোনো কিছু তো বলেননি। তাঁর কর্মেরই ফল বটে যা তাঁকে দগ্ধিত করছে।
___
বৈদ্যশালার দ্বার খুলতে সামনে বিদ্যমান শয্যা খেয়াল করতেই স্তব্ধ হয়ে যায় মেহমাদ শাহ। এতোটাই বিস্মিত, হতাশ ও বেদনা জর্জরিত সে যে পড়ে যেতে নেয় দাঁড়ানো হতে। মিনার তাকে আগলে ধরে।
এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে যায় মেহমাদ শাহ। সে কোনো প্রশ্ন করে না কাউকে, হয়তো তা নিয়ে ভাববার চেতনাতেই নেই। পাশে বসে শীর্ণ, চেতনাহীন হাত খানা আগলে ধরে দু’হাতের মাঝে।
“বাচ্চা বাঘিনী, কী হয়েছে তোমার? এভাবে চোখ বন্ধ করে থেকো না গো, তোমায় এভাবে মানায় না। তুমি বাচ্চা হরিণের ন্যায় দুষ্টুমি করবে, অভিমান ভরা চোখে তাকাবে, বাচ্চা বাঘিনীর মতোন রাগ দেখাবে।
কত দিন বাদে এসেছি আমি অভিমান ভরা কণ্ঠে আমায় অভিযোগ জানাবে না? আমার চন্দ্রমল্লিকা, উঠো না! উঠো! তোমার বাবু মশাই তোমায় ডাকছে।”
যুবকের শব্দ উপেক্ষিত হয় রমণীর নিকট। সে মাথায় ঠেকায় হাতটা।
আকুতি করে উঠে,
“এতো অভিমান কোরো না চন্দ্রমল্লিকা। তুমি তো জানো তোমার দেহের ঘ্রাণ আমার প্রাণবায়ু। তোমার কণ্ঠ আমায় প্রেরণা দেয় বাঁচার। তোমার স্পর্শ আমার জন্য মহৌষধি। গোটা তুমিটাই আমার আঁধার রাতের সূর্য। তুমি ব্যতীত আমি কীভাবে থাকবো বলো? আমাকে আর পুড়িয়ো না। একবার ডাকো না ‘বাবু মশাই’ বলে।”
বারবার উপেক্ষিত হয়েও বারংবার আর্জি জানাতে দ্বিধা করে না মেহমাদ শাহ। দ্বারে মাথা নত করে দাঁড়ানো মিনারও ভাবে,
– সারা শেরপুরে সবচেয়ে ক্ষমতাধর, মর্যাদাসম্পন্ন, সম্ভ্রান্ত জমিদারও এতোটা অসহায় বোধ করেন? যার সাহস, এমন কী দুঃসাহসের কথা মানুষের মুখে মুখে তাঁকেও বুঝি ভালোবাসা দুর্বল করে? ভালোবাসার অপর নাম তবে দুর্বলতাও। অদম্য দুর্বলতা, যা কখনও কখনও শক্তি এবং হাতিয়ারও হয়ে দাঁড়ায়।
মেহমাদ শাহের এতো ব্যাকুলতা সত্ত্বেও যামিনী জবাব দেয় না। অযাচিত ক্ষোভেই শক্ত এক খানা চুমু খায় প্রেয়সীর অধরজোড়াতে। আঁখি হতে অলক্ষ্যেই এক ফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে অচেতন মুখশ্রীতে।
শুধু গল্প-উপন্যাসেই চমৎকার হয় কে বলেছে? তার জীবনেও তো হলো পরমুহূর্তে। সেই জলকণা পাওয়ার পরপরই পিটপিট করে চোখ খুলে যামিনী।
“বাবু মশাই।”
অস্ফুটবাক শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে যুবক। আদরের সহিত মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শুধায়,
“হ্যাঁ, আমার বেগম। আমার রাজকন্যা চন্দ্রমল্লিকা। আমি এসে পড়েছি এখন, কেউ তোমায় কষ্ট দিতে পারবে না।”
“তারা অনেক কষ্ট দিয়েছে আমায় বাবু মশাই। আমার হাত-পা সব ব্যথাতুর, গা জ্বলছে। খুব কষ্ট হচ্ছে বাবু মশাই। আমি সইতে পারছি না।”
মেহমাদ শাহ কী বলে সান্ত্বনা দিবে বোধ করতে পারছে না। জীবনের কোনো অধ্যায়ের কোনো পাতায় তার এতোটা অসহায় বোধ হয়নি। আজ মনে হচ্ছে এতো অর্থ ও ক্ষমতা থেকে কী লাভ যদি প্রেয়সীর কষ্টই না মোচন করা যায়?
শুধু ললাটে আদর সিক্ত চুমু খায় সে। বিড়বিড়ায়,
“সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ভালোবাসার চন্দ্রমল্লিকা যে বা যারা পায়ে পিষার চেষ্টা করেছে তারা সকলে নিজ কর্মফল ভোগ করবে।”
“আমার বেগমের সুস্থ হতে আর কতো দিন সময় লাগবে?”
“যেহেতু গুরুতর অসুস্থ তাই এক মাস তো লাগবেই। তবে আল্লাহ সহায় হলে এর পূর্বেই সুস্থ হয়ে যেতে পারেন।”
“আমি চন্দ্রমল্লিকার চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি চাই না। যত দ্রুত সম্ভব ভালো ফলাফল চাই।”
“ইনশা আল্লাহ, হুজুর।”
বৈদ্যের সাথে কথা বলে দিলরুবার সাথেও স্পষ্ট জিজ্ঞেসাবাদ করলো মেহমাদ শাহ। তার ললাটে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ভাঁজ উপস্থিত হলো। চোখে-মুখে গম্ভীরতা।
___
মেহমাদ শাহের সম্মুখে বসে আছেন বেগম লুৎফুন্নেসা। সরু ঘামের সঞ্চার হচ্ছে তাঁর ললাট হতে। অপেক্ষা করছেন প্রিয় পৌত্রের প্রশ্নবাণের।
তবে তাঁর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে যুবক মুখ খুলে যা বলল, তাতে আরও ভীতিগ্রস্ত হলেন তিনি।