চন্দ্রপুকুর পর্ব -২৬+২৭

#চন্দ্রপুকুর
||২৬ ও ২৭ তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“কে চুরি করেছে কাগজপত্র দাদীজান? নাম বলুন আপনার সেই প্রিয় মানুষটির যার জন্য আমার স্ত্রী এই শেরপুরের বেগমের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে।”

বেগম লুৎফুন্নেসা চোখ নামিয়ে ফেললেন। মনে প্রশ্ন জাগে তাঁর। কেউ তো জ্ঞাত নয় যামিনী ফিরিয়ে আনার কারণ সম্পর্কে, তবে মেহমাদ শাহ জানলো কীভাবে?

খাণিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে উত্তর দিলেন,
“কেউ করেনি। আমি দুঃখিত, আমার তদন্ততে ত্রুটি ছিল। পরে বোধ করতে পেরেছি এটা।”

থেমে গেলেন তিনি। হেসে দাদীজানের দিকে তাকালো যুবক। তীব্র তাচ্ছিল্যে ভর্তি এ হাসি। সামনে বসে থাকা নারীটিও জানে তাঁর পৌত্রের বিশ্বাস জাগেনি তার কোনো কথাতেই।

“সারা শেরপুরের জমিদারি সামলাই আমি, আমাকে আপনি যা তা বোঝাতে এসেছেন দাদীজান। জরুরি দলিলপত্র দপ্তর হতে সকলের অগোচরে অদৃশ্য হয়ে গেল, সেই অদৃশ্য বস্তু তথা চুরির বস্তু পাওয়া গেল চন্দ্রমল্লিকার কামরায়।

সবার সামনে সে চোর উপাধি পেল, তাকে তিরস্কার করা হলো, এই মহলেই এই মহলে কর্ত্রীর অপমান হলো। আবার হুট করেই সকলের অগোচরে প্রমাণ হয়ে গেল আমার বেগম নির্দোষ, তাঁকে ফিরিয়ে আনা হলো।

দলিলপত্রাদির যেহেতু স্থান পরিবর্তন হয়েছে, তাহলে যামিনী দোষী নাহলে কেউ না কেউ তো নিজ হস্তে বা অন্যের হস্ত দ্বারা এ কার্য করেছে। জড়বস্তুর তো আর পা গজাতে পারে না, তাই না? আর নিশ্চয়ই আপনি জেনেছেন কোনো না কোনো ভাবে প্রকৃত অপরাধীর নাম, নাহলে হুট করে আমার চন্দ্রমল্লিকার জন্য আপনার মায়া জাগ্রত হবার কথা নয়।”

বেগম লুৎফুন্নেসা নির্বিকার। তিনি জানেন তাঁর নিকট কোনো বাণী নেই এই পরিস্থিতি হতে পরিত্রাণ পাওয়ার। তাঁর নজর ও মাথা দু’টোই নত আজ।

“আচ্ছা, আপনি নিঃশ্চুপ থাকতে ইচ্ছুক। তবে থাকুন, সমস্যা নেই। হয়তো আপনার প্রিয় কেউ অপরাধী। অপরাধী কিন্তু আমার প্রিয় নয়, আমার প্রিয়কে আঘাত করেছে বটে। এই অন্দরমহলের দেয়ালে দেয়ালে যদি আপনার শত কান থাকে, তবে আমার হাজারটা।

আমি বের করে নিয়েছি কে সে। যেহেতু অন্দরমহলের শাসক হয়েও বিচারকার্য আপনি সম্পন্ন করতে পারেননি, তাহলে আমিই হাতে নিচ্ছি সে দায়িত্ব। আপনার পুত্রবধূ ও পৌত্রী উভয়েই শাস্তি পাচ্ছে। ভয়ংকর শাস্তি, কোনো বিবেচনা ব্যতীত। মৃত্যু বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে তা।”

“না, এটা তুমি করতে পারো না মেহমাদ। তোমার নিকট কোনো প্রমাণ নেই। আর নবাব পরিবারের সদস্যের পক্ষে এ আইন অবলম্বন হয় না। এটা আইন বিরোধী।”

“চন্দ্রমল্লিকাকে শাস্তি দেওয়ার পূর্বে মনে ছিল না? যাকগে জমিদার থেকে জমিদারি, জমিদারি থেকে জমিদার হয়, এখানে আইনের জায়গা নেই। আমার কথাই আইন, আর সিদ্ধান্তই ন্যায়বিচার।”

গম্ভীর কণ্ঠে কথা টুকু উচ্চারণ করে মেহমাদ শাহ। আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কামরা ত্যাগ করে সে।

এদিকে তার প্রিয় দাদীজান দুঃশ্চিন্তায় নির্বল হয়ে বোধ করছে। বেগম লুৎফুন্নেসার একমাত্র কন্যা শাহাজাদি জান্নাতুলের স্বামী আমির হাওলাদার খুব সুবিধার লোক নয়, নিশ্চয়ই নিজের রক্তের করা কুকর্মের কালিমাও লেপণ করবেন তাঁর কন্যার ললাটে।

___

যামিনীর চেতনা ফিরেছে ধীরে ধীরে। পিটপিট করে চোখ দু’খানা খুললে দর্শন পায় আভিজাত্যপূর্ণ ঝুলন্ত বাতিদানের।

পাশে তাকায় নিজের প্রিয়তমকে দেখার উদ্দেশ্যে। দিলরুবার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হতাশায় জর্জরিত হয়। তবে কি আসেনি তার বাবু মশাই? সবটাই স্বপ্ন ছিল?

দিলরুবার নড়াচড়াতে জাগ্রত হয় দিলরুবা। মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায় অনতিবিলম্বেই। চোখে-মুখে উপচে পড়ছে আনন্দ ভাব।

“বেগম? বেগম আপনার জ্ঞান ফিরেছে অবশেষে। আল্লাহ আপনাকে নেক হায়াত দান করুক বেগম।”

দীর্ঘশ্বাস নির্গত হয় যামিনীর নাসারন্ধ্র হতে। তার উষ্ণতা বোধ করতে দিলরুবা না পারলে তাদের অগোচরে দ্বারের ফাঁকে চোখ রাখা মানুষটি ঠিকই পারে।

“বাবু মশাই আসেননি, তাই না? তিনি জ্ঞাত নয় আমার বিষয়ে। এতোটা ক্যানো অবজ্ঞা করে আমায়? কৃষ্ণকায়ার অধিকারী বলেই কী?”

নোনাজল গড়িয়ে পড়ে অচিরেই। দিলরুবা কিছু বলবে তার পূর্বে দোয়ার খোলার শব্দে ভঙ্গ হয় বৈদ্যশালার নীরবতা।

“সত্যিই অবহেলা করি?”

মেহমাদ শাহের প্রশ্নে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে কিশোরী। জমিদার বাবুর ইশারা পেতেই স্থান ত্যাগ করে উপস্থিত বৈদ্য ও দিলরুবা।

যুবক এগিয়ে যায়। চিবুক ধরে এই প্রিয় মুখশ্রীটি নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। কতোদিন পর সাক্ষাৎ হচ্ছে তাদের। রমণীর চোখজোড়া বন্ধ। কোনো কিছুর কামনা ধরে রাখতে আগ্রহী নয় কোনো কালেই মেহমাদ শাহ। শুষে নেয় অধরসুধা।

ললাটে ললাট ঠেকিয়ে হিসহিসিয়ে শুধায়,
“কৃষ্ণকায়া তো তোমার সত্যিই, তবে জানি না ক্যানো তোমার এই কৃষ্ণ দেহের উষ্ণতাতেই আমার স্বর্গ সুখ বোধ হয়। তোমার ঘ্রাণ আমার নিকট বেলি ফুলের ঘ্রাণ হতেও প্রিয়। তোমার ঐ অধরসুধা তার কথা আর কী বলবো? গোটা তুমিটাই আমার অতি প্রিয়, আর একান্তই আমার।”

নিজেকে ধরে রাখতে পারে না যামিনী। ঝরঝরিয়ে কেঁদে দেয়।

“তবে কোথায় ছিলেন আপনি যখন কোনো অপরাধের বিনাই আঁধারে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল আমাকে? জানেন, আমায় মৃত্যু ভয়ও অতোটা যন্ত্রণা দেয়নি। যতোটা যন্ত্রণা দিয়েছিল আপনার সুদর্শন এই মুখশ্রী আর না দর্শন করতে পারার ভীতি।”

“আমি দুঃখিত আমার বাচ্চা হরিণী। আমি পারিনি তোমায় সুরক্ষা দিতে। তবে আমার ওয়াদা এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না কখনোই। এমন শাস্তি দিব যাতে রুহু কেঁপে উঠবে সকলের।”

শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও ধরে না মেহমাদ শাহ। তার চন্দ্রমল্লিকা যে ব্যথা পাবে। নিজের বুকে তার মাথা রেখে আলতো স্পর্শে জড়িয়ে ধরে ঘুমোয় বটে।

___

শাহাজাদি মেহনূর ও বেগম নূর বাহার উভয়ই শাস্তির ভীতিতে তটস্থ। বেগম লুৎফুন্নেসা নিজেও বেশ চিন্তিত।

দরজা খুলে প্রবেশ করে বেগম লুৎফুন্নেসার গুপ্তচর তথা দাস হালিম।

“আসসালামু আলাইকুম, বেগম। আল্লাহ আপনাকে সুস্থ রাখুক।”

“আমিন। কোনো খবর আনতে পেরেছো।”

“বেগম, জমিদার বাবু নিজের বিশেষ লোকদের আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বেগম চন্দ্রমল্লিকা যা শাস্তি দিবেন তা-ই মেনে নিতে হবে অপরাধীকে। তবে অপরাধীর নাম তিনি অব্যক্ত করে রেখেছেন এবং শুধু শাস্তি নিয়েই আলোচনা করেছেন।”

“ঠিক আছে। এখন যেতে পারো তুমি।”

আয়েশা খাতুন কিছু অর্থ হালিমের হাতে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে বের করে দেন।

“আম্মিজান, এখন কী হবে? ঐ কালনাগিনী নিশ্চয় নিজের মর্জি মাফিক ভয়ংকরতম শাস্তি দিবে আমাদের।”

“হ্যাঁ, নানীজান। নিশ্চিত আমাদের নামে আরও বানিয়ে বানিয়ে বদনাম করে আমার শাহের কান ভাঙিয়েছে।”

“চুপ করো বেয়াদব, বেহায়া কন্যা! তোমাদের কর্মেই এদিন দেখছো। অন্যকারো দোষে বা বদনাম করায় নয়।”

ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে দেয় শাহাজাদি মেহনূর। খেয়াল করলে যোগ দেন বেগম নূর বাহারও।

“থামো তোমরা। আমি দেখছি চন্দ্রমল্লিকার সাথে কথা বলে কিছু করা যায় কি না…”

___

যামিনী চোখ বন্ধ করে শয্যায় আধশোয়া অবস্থায় স্থির। এতোটা জটিল ক্যানো তার জীবন। কখনোই এ তার কাম্য নয়।

দিলরুবার নিকট সবই জানতে পেরেছে। মেহমাদ শাহ যখন বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষে যায় তখন প্রহরীদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আড়িপাতে সে। প্রায় সকল কিছুই শুনতে পায় তার খাঁস বাঁদী।

রমণী নিজের জীবনের সূচনা হতে এই অবধি ভাবে। তার জন্য আজ অবধি কোনো কিছুই সহজলভ্য ছিল না। তবে হ্যাঁ, সে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে, লড়াই করেছে।

চাইলে তো পারতো দু’ঘর পরে থাকা প্রেমে মন ভাঙা হাসুর মতোন গলায় দরি দিতে দেয়নি। যুদ্ধ করে গিয়েছে বেদনার সাথে, হার মেনে মৃত্যুর স্বাদ নেয়নি।

এই মহলে আসতেই ছোট্ট মস্তিষ্কে কতোখানি চাপ পড়লো, ছোট্ট হৃদয় কতো উত্থান পতন দেখল। প্রথমে ভেবেছে সবার মন যোগাতে হবে, যেমনটা গ্রামীণ বউদের যোগাতে হতো। লাভ হয়নি। কোনোরকম চিঠিদাতার সহায়তায় সংসার বাঁচালো।

পরে ভাবলো তাকে নিজের ক্ষমতার পরিচয় দিতে হবে, জাহির করতে হবে। বুদ্ধি আসলো শাস্তি নামক ধাক্কা খেয়ে বুদ্ধি হলো। পুনরায় ভাবলো উত্তম আচারণ, বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতার পরিচয় দিলেই বোধহয় জটিলতা হতে মুক্তি পাবে। তাও ভুল প্রমাণিত হলো।

প্রথম দিনে শোনা কথাই সত্য মনে হচ্ছে তার নিকট। এই নবাববাড়ি আস্ত একটা অজগর সাপ, যা নিগলে নেয় সকলকে। তবে সে বানের জলে ভেসে যাবে না। সুঁই হয়ে ঢুকে তলোয়ার হয়ে উদর কেটে বের হবে অজগরের প্রয়োজনে।

আপন মনেই রমণী বিড়বিড়ায়,
“জীবন আমাকে যে পথে চালনা করেছে, আমি সেই পথের পথযাত্রী। আল্লাহ যেহেতু আমাকে এই জটিল ও কঠিল পথযাত্রায় এনেছে। তবে তা-ই ঠিক। আমি লড়বো।

আজ সকাল অবধিও আমার চাওয়া শুধু বাবু মশাই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল, নিশ্চিত করতে চাইতাম সে শুধু আমারই থাকবে। এখন আমার ক্ষমতা, নাম, বাবু মশাই সব কিছুই চাই।

আমার সাথে অন্যায়কারীর ধ্বংসও চাই। এর জন্য সব করব, তা ভালো হোক কিংবা মন্দ। তৈরি হোক এই অন্দরমহল প্রকৃত বেগম তথা বেগম চন্দ্রমল্লিকার উদ্দেশ্যে।”

দিলরুবা কিশোরীর অস্থিতিশীল অবস্থা দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়।

“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন? বৈদ্যকে ডাকাবো?”

“না, না, আমি ঠিক আছি। তুমি আমাকে আমার কক্ষে নেওয়ার ব্যবস্থা করো। এখানে আমার অস্বস্তি বোধ, খুঁজেও যেন স্বস্তিরা ধরা দেয় না।”

দিলরুবা সায় জানায়। দু’জন দাসীকে আদেশ করে ব্যবস্থা করার।

এর মাঝে দ্বার খুলে প্রবেশ করে তিনজন নারী। যামিনী সেদিকে চোখ যেতেই অবাক হয়। পরক্ষণেই হাসে। আজ তো গোটা যুদ্ধক্ষেত্রই তার পক্ষে, তার নিকট তো আসবেই।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী অবস্থা তোমার এখন?”

কিছুটা অস্বস্তি দেখা গেল দাদীজানের ভাব-ভঙ্গিমায়। মাথা ঝুঁকে চাপা হাসলো রমণী।

“নিজে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে এই অবস্থায় এনে নিজেই জিজ্ঞেস করছেন কী অবস্থা? ঠাট্টা করারও একটা সীমা থাকে দাদীজান। যাকগে এসব খোশামোদি বাদ রেখে যে জন্য এসেছেন তা-ই সোজাসুজি বলুন।”

নিজের থেকে এত কনিষ্ঠ কন্যার মুখে এমন শীতল কণ্ঠে তিক্ত বাণী শুনে রাগান্বিত হন তিন নারীই। বিশেষ করে শাহাজাদি মেহনূর।

“খবরদার চন্দ্রমল্লিকা! তোমার স্পর্ধা কী করে হয় নানীজানের এভাবে কথা বলার?”

অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিশোরী শাহাজাদির উপর। যেন চাহনির দ্বারাই ধ্বংস করে দিবে।

“আর তোমার স্পর্ধা কী করে হয় এই শেরপুরের বেগমের সাথে এই সুরে কথা বলার? দু’জন বেগম কথোপকথনে বা’হাত দেওয়ার সাহস কী করে হয়? আদব-কায়দা শিখোনি পরিবার হতে?”

“নানীজান দেখুন…”

হাতের ইশারায় থামিয়ে দেন বেগম লুৎফুন্নেসা শাহাজাদি মেহনূরকে। যামিনীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন,

“আমি চাই তুমি আগামীকালের বৈঠকে ক্ষমা করে দাও বেগম নূর বাহার এবং শাহাজাদি মেহনূরকে। এর বিপরীতে আমার ওয়াদা তোমার ঢাল হয়ে তোমায় রক্ষা করব আর মেহমাদ সর্বদা তোমারই থাকবে।”

খিলখিল করে হেসে দেয় কিশোরী। যেন কতো বিদ্রূপের কথা বলেছেন তিনি।

“দুঃখিত দাদীজান। আসলে আপনার কথা প্রকৃত অর্থেই হাসি পেয়ে গেল। মানে বিচার মানেন কিন্তু তালগাছটা আপনার? আরে বাবা প্রয়োজন আপনার আমার, আর শর্ত দিবেন আপনি? না, সেটা বড্ড অমানানসই।

আমি দিচ্ছি শর্ত, যদি সকলের সম্মুখে পায়ে ধরে ক্ষমার আবেদন করে তবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাবে। আর যদি সকলের সম্মুখে আপনি নিজের এবং নিজের এই স্বজনদের অপরাধ স্বীকার করেন এবং তাঁরাও তাতে সায় জানিয়ে চরণ আঁকড়ে ধরে মার্জনার অনুরোধ করার। তবে ক্ষমা পেতে পারে অপরাধীরা।”

“যতোটুকু নেওয়ার ক্ষমতা ততোটুকুই মুখ খুলো চন্দ্রমল্লিকা। তুমি কল্পনাতেও কীভাবে আঁকতে পারো আমি তোমার নিকট ক্ষমা চাব? আদব ভুলে গিয়েছো না কি?”

“সুশিক্ষা তো আপনি ভুলেছেন দাদীজান। যখন আপনার ন্যায়বিচার অন্ধ হতে পারে স্বজনপ্রীতির নিকট তখন আমার আদব ক্যানো নয়? যাকগে আমার শর্ত আমি দিয়ে দিয়েছি, আপনি নিজের সিদ্ধান্ত নিন এখন।

তবে মনে রাখবেন আপনার ত্রুটি এমনিতেই লোকচক্ষুর সম্মুখে আসবে, সুতরাং লজ্জিত আপনি এবং আপনার স্বজন এমনিতেও হবে। আমি তো শুধু বাঁচার সুযোগ দিয়েছি আপনাদের। যেখানে আমার তো ইচ্ছে সোজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার। যাকগে এই মুহূর্তে আমায় নিজের সিদ্ধান্তের জানান দিন।”

তিনজন নারীই ঘাবড়ে গেলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়া সৈনিকের ন্যায় মাথা ঝুঁকিয়ে ফেললেন দাদীজান।

“আমি রাজি।”

তাৎক্ষণাৎ স্থান ত্যাগ করলেন তিনি। পিছন পিছন বেগম নূর বাহার ও শাহাজাদি মেহনূরও।

যামিনী তৃপ্তির হাসি দিল।
“আমি বেগম চন্দ্রমল্লিকা। ক্ষমা নামক কোনো কিছু আমার শব্দভাণ্ডারে নেই। যা হবে, তা শুধুই লেনদেন অথবা যুদ্ধে বিজয়।”

___

বৈঠকে বসেছেন মেহমাদ শাহ তার বিশেষ বিচারকার্য সম্পাদনে সহায়ক মণ্ডলীকে নিয়ে। কাঠের দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে সকলে।

বেগম নূর বাহার, শাহাজাদি মেহনূর ও বেগম লুৎফুন্নেসা প্রবেশ করেন পর্দার অপর পার্শ্বে। তাঁদের আগমনের একটু বাদেই প্রবেশ করে যামিনী। তাঁর পরনে ময়ূরপঙ্খী রঙের জামদানি, দেহ আবৃত রাজকীয় ওড়নায়। দেহের উপরিভাগ হিজাব ও নিকাবে আড়াল করা।

দিলরুবার সহায়তায় হাঁটছে সে। সবাইকে অবাক করে সে পর্দার অপরপাশে না যেয়ে মেহমাদ শাহের পাশে বসে।

যুবক গম্ভীর গলায় আদেশ দেয়,
“বিচারকার্য শুরু করা হোক।”

তার আদেশ অনুযায়ী মিনার এই বিচারকার্য পরিচালনা করে।

“গত শনিবার গভীর রাত্রিতে অন্দরমহলে দপ্তর হতে দলিলপত্র চুরি হয়। যা পরদিন সকালে অনুসন্ধান করলে পাওয়া যায় বেগম চন্দ্রমল্লিকার কামরাতে। বেগম লুৎফুন্নেসা আইন অমান্য করে কোনো বিচারকার্য ব্যতীত এবং সাধারণ আইনে শাস্তি দেয় যেখানে নবাব পরিবারের জন্য শাস্তি পৃথককৃত।

এর চারদিন পর সত্যি সম্মুখে আসে। আসল অপরাধী বেগম নূর বাহার ও শাহাজাদি মেহনূর। তাঁরা বেগমকে ফাঁসাতেই এ কার্য করেন। বিষয়টা জেনেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বেগম লুৎফুন্নেসা। তাই আজ সভায় উঠেছে এই বিচারকার্য। জমিদার বাবু নিজে এর নিশ্চয়তা যাচাই করেছে।”

মিনারের কথা শুনে সারা মাহফিলে হইচই পড়ে যায়। সেসবে ধ্যান না দিয়ে মেহমাদ শাহ নিজের বক্তব্য রাখে।

“গতকাল আমি এবং বিচারক মণ্ডলী আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেহেতু অবিচার চন্দ্রমল্লিকার সাথে হয়েছে এবং অন্দরমহলের কর্তৃপক্ষ তাকে সুষ্ঠু বিচার দিতে ব্যর্থ তাই তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিবেন অপরাধীদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। যামিনী…”

উঠে দাঁড়ায় যামিনী। ইচ্ছেকৃত ভাবে মোলায়েম, অসুস্থ ও দুঃখী কণ্ঠে বলল,

“আমি আসলে কী বলব? শুধু বলব আমি ক্লান্ত। প্রথমে দাদীজানই সবার সম্মুখে এসে নিজের বক্তব্য রাখুক।”

মেহমাদ শাহ ভ্রু কুঁচকায় যামিনীর কথায়। তার শেষবাক্য উচ্চারণ করতেই ছোটো ছোটো পদচারণায় পর্দার বাহিরে আসেন বেগম লুৎফুন্নেসা দুই অপরাধী সমেত। যামিনীর আদেশ মোতাবেকই হাতজোড় করে ক্ষমা চান তিনি।

“আমি দুঃখিত চন্দ্রমল্লিকা। আমি ন্যায়বিচার করতে পারিনি তোমার সাথে। প্রথমে তোমায় পাওনার অধিক শাস্তি দিয়েছি বেআইনী ভাবে, সত্য জানার পরও অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা করিনি নিজের… নিজের আপনজন বলে। আমাকে ক্ষমা কোরো দয়া করে।”

নিকাবের আড়ালে বাঁকা হাসি ফুটে উঠে যামিনীর ঠোঁটজোড়ায়। চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে ক্ষমতা ও বিজয়ের অগ্নিতে। এবার সে শাহাজাদি মেহনূর ও বেগম নূর বাহারের দিকে দৃষ্টি স্থির করে। তাঁরা বুঝতে পেরেই দণ্ডায়মান থাকে, তবে যামিনীর চোখ রাঙানো ও ইশারা পেতেই মৃত্যুর ভীতির নিকট হার মানে তাঁরা।

পা ছুঁয়ে রসকষহীন কণ্ঠে আর্জি করে,
“আমাদের ক্ষমা করো চন্দ্রমল্লিকা। আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছে। তোমাকে ফাঁসাতে আমরা এতো জঘন্য পাপ করেছি।”

যামিনী তৃপ্তির হাসি। দয়াশীলতার ভঙ্গিমায় পা হতে উঠায় উভয়কে।

চোখের জল ছেড়ে দুঃখিত গলায় ঘোষণা করে,
“দুঃখের বিষয় হলেও সত্য অপরাধীরা আমারই পরিবারের সদস্য। তাঁরা যেহেতু অনুতপ্ত, আমি তাঁদের উপর কোনো দাবী রাখতে চাই না। ক্ষমা করে দিয়েছি তাঁদের।

তবে আক্ষেপ একটাই আমি শেরপুরের নবাবের স্ত্রী হয়ে যেখানে এই অন্যায়-অজাচার হতে রক্ষা পাইনি, সেখানে অন্দরমহলে বসবাসকৃত সাধারণ দাসী বা গ্রামের সাধারণ নারী যারা বিচারের জন্য এখানে ন্যায় পেতে আসে তারা কীভাবে সুষ্ঠ বিচার পাবে?

আর কিছু বলার নেই আমার। আমি বিদায় নিতে চাচ্ছি বাবু মশাই। আসসালামু আলাইকুম।”

মেহমাদ শাহ ইশারায় সায় জানালে বিদায় নেয় যামিনী। বৈঠক ও মানব চক্ষু ত্যাগ করতেই রমণীর অশ্রু সিক্ত মুখ খানা হুট করেই রঙ বদল করে। আনন্দ গ্রাস করে তার মুখশ্রীকে।

___

গভীর রাত। তন্দ্রায় ডুবে গোটা রহমতপুরের বাসিন্দা।

রহমতপুরের ডাকঘরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টারও মেঝেতে শীতলপাটি বিছিয়ে একটু একটু নিদ্রায় তলিয়েছেন। এই মুহূর্তে বিশাল কালো চাদরে আবৃত এক মানব করাঘাত করে দরজায়।

কাঁচা ঘুম ভঙ্গ হয় মাস্টার মশাইয়ের। বিড়বিড় করে গালি-গালাজ করতে করতে দরজা খুলেন।

“কে ভ্রাতা তুমি? এখন কোনো সময় হলো আগমনের।”

অজানা সেই মানুষটি মুখশ্রী হতে চাদর খাণিকটা সরায়। সাথে সাথে দৃষ্টি নত হয়ে যায় পোস্টমাস্টারের।

পোস্টমাস্টারকে বের করে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে টেলিফোনে কল করেন কাউকে। কিছুটা সময় কাটার পর কল রিসিভ হয়।

“আসসালামু আলাইকুম, জনাব।”

অপর পাশ হতে গমগমে কণ্ঠে উত্তর আসে,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তা ঐদিকের খবর কী?”

“খবর ভালো না। চন্দ্রমল্লিকাকে ফাঁসিয়ে হত্যা করার সকল ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। একটু জন্য কন্যা মৃত্যুর মুখ হতে ফিরে এসেছে।”

“মানে?”

ব্যক্তিটি অল্প শব্দে প্রকাশ করে গোটা ঘটনা। তা শ্রবণপথে প্রবেশ করলে চিন্তার রেখা দেখা যায় টেলিফোনের অপরপাশের মানুষটির ললাটে।

“এভাবে হবে না। চন্দ্রমল্লিকার সুরক্ষা আরও নিশ্চিত করো। তাকে জুড়েই সব পরিকল্পনা। সে মরলে সব ভেস্তে যাবে।”

“হুম, আমিও তাই ভাবছি। তবে আরও অর্থের প্রয়োজন আমার।”

“সমস্যা নেই। আমি পাঠানো ব্যবস্থা করছি।”

কথোপকথন সমাপ্ত হতেই রাতের ঘোর আঁধারে যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই সবার আড়ালে বের হয়ে যান আগুন্তক। যাওয়ার পূর্বে মূল্য স্বরূপ অর্থ ধরিয়ে দিতে ভুল করেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here