#মেঘের_ওপর_আকাশ_উড়ে
#Part_03
#Writer_NOVA
দু-চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরছে তুলির। সেই জলে বালিশ ভিজে গেছে। তবুও সেদিকে খেয়াল নেই। বুকের ভেতর থেকে আসা চাপা আর্তনাদগুলো গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। যার দরুন ইচ্ছে থাকার সত্ত্বেও চিৎকার করে কাঁদতে পারবে না। কিশোরী মনটা বারবার একজনের নাম জপে যাচ্ছে। সে তো নিশ্চয়ই এতখনে তার নতুন জীবনের পারি দিয়ে ফেলছে। চাপা কন্ঠে বিরবির করে বললো,
— কেন এমন করলেন মৃদুল ভাই,কেন? আমাকে কি একটু ভালোবাসা যেতো না। আমি কি এতই খারাপ? আপনি না বলছিলেন আমি নাকি অনেক ভালো ছেলে পাবো। আমার তো অনেক ভালো ছেলের দরকার নেই। শুধু আপনাকেই লাগবে আমার। আপনি শুনতে পাচ্ছেন মৃদুল ভাই আমার আপনাকেই লাগবে।
হাতে কামড় দিয়ে ভেতর থেকে আসা চিৎকারগুলো আটকে রাখলো। চোখের পানি কর্ণিশ বেয়ে কানের মধ্যে গিয়ে বিরক্ত করছে। ওড়না দিয়ে কানের মধ্যে যাওয়া পানিটা মুছতেই মোবাইলের আলোটা জ্বলে উঠলো। নাক টেনে, চোখ মুছে বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে নিলো। আজও সেই নাম্বার থেকে কল। গত এক সপ্তাহ ধরে একটা নাম্বার থেকে রাতের বেলা কল আসে। কিন্তু রিসিভ করলে ওপর পাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। বেশ কিছু সময় হ্যালো,হ্যালো করে শেষে বিরক্ত হয়ে মোবাইল রেখে দেয় সে। আজও কলটা রিসিভ করে কানে দিয়ে বড় করে সালাম দিলো।
— আসসালামু আলাইকুম।
— (নিশ্চুপ)
— হ্যালো কে বলছেন?
এবারো অপরপাশ থেকে কোন শব্দ এলো না। তুলির রাগ উঠে গেলো। অন্য দিন হলে চুপচাপ রেখে দিতো। কিন্তু আজ রাগ উঠেছে তার। কথা বলার ইচ্ছে নেই। তবুও রাগ কন্ট্রোল না করে বাজখাঁই গলায় বললো,
— সমস্যা কি আপনার? কথা বলতে না চাইলে কল কেন দিয়েছেন? আপনার মোবাইলের অনেক ব্যালেন্স থাকতে পারে কিন্তু আমার এতো সময় নেই যে নিঃশব্দে বসে আপনার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনবো। কোন কথা যখন বলবেন তাহলে দয়া করে কল করে ডিস্টার্ব করবেন না। যত্তসব অসহ্যকর।
একদমে কথাগুলো বলে কলটা কেটে দিলো তুলি। তার সারা শরীর রাগে রি রি করছে। আরেকটু সময় যদি বকতে পারতো তাহলে মনটা শান্ত হতো। কিছু সময় ফোঁস ফোঁস করে নাম্বারটা ব্লাকলিস্টে ফেলে দিলো।
কলটা কেটে যেতেই মুচকি হাসলো মোবাইলের ওপর পাশে থাকা মানুষটা। তুলির গলার স্বর শুনে তার মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে যায়। যতই বকুক তবুও যেন ভালো লাগে। আবার নাম্বার ডায়াল করতেই ওপরপাশ থেকে বলে উঠলো,
— আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন তা এখন ব্যস্ত আছে। আপনি যদি গ্রামীণফোনের নতুন গ্রাহক হোন তাহলে এখুনি ১ চাপুন। নতুন নতুন অফার পেতে……
কলটা কেটে দিলো সে। ওর বুঝতে দেরী হলো না তুলি ওর নাম্বার ব্লাক লিস্টে ফেলে দিয়েছে। আবার নতুন একটা সিম কিনতে হবে। তবুও সে হাল ছাড়বে না। প্রতিরাতে তুলির কন্ঠস্বর না শুনলে যে তার ঘুম ধরা দেয় না। সে একগালে ভিলেন টাইপের হাসি দিয়ে বললো,
— কতদিন পালিয়ে বেড়াবে আমার থেকে রংতুলি। ভালো তোমাকে আমায় বাসতেই হবে। সেটা একদিন আগে হোক কিংবা পরে। আমি জোর করবো না, তবে আদায় করে নিবো।আচ্ছা, রংতুলি তুমি কি কাঁদছিলো? তোমার কন্ঠ শুনে তো তাই মনে হলো। কিন্তু কেন? এই কেন এর উত্তর খুব শীঘ্রই খুঁজে বের করবো। তোমার চোখের পানি যে আমার সহ্য হয় না। মনটাকে বড্ড পোড়ায়।
মোবাইলটা ছুঁড়ে বালিশের পাশে ফেলে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরলো। আজ ঘুমটা তার জব্বর হবে। আগামীকাল কিভাবে কথা বলবে তা আগামীকাল ভাববে। আজ আর জেগে থাকা সম্ভব নয়।তবে তার প্রথম কাজ হলো তুলির কান্নার কারণ খুঁজে বের করা। শত হোক প্রথম ভালোবাসার মানুষ তো।
💞💞💞
বসার রুমে ঠোঁট উল্টে বাচ্চা মেয়ের মতো তাকিয়ে আছে সাবা। এই মুহুর্তে ওর মতো ভালো মেয়ে দুটো পাওয়া একেবারে অসম্ভব। গম্ভীর মুখে সামনে বসে আছে মৃদুলের বাবা জয়নাল বিল্লাহ ও মা সুমি বেগম। মৃদুল দাঁত কেলিয়ে হেসে সাবার দুঃখে দুঃখীত হওয়ার ভান করছে। তা সাবা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিচ্ছে। জামিলা বেগমের চেচামেচিতে সবাই উঠে চলে এসেছে। চোরের কথা শুনে সবাই অবাক।কিন্তু দরজা খুলে সাবাকে দেখতে পেলো। এখন সব একসাথে বসার রুমে জোট হয়েছে। জয়নাল বিল্লাহ ঠান্ডা কন্ঠে মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
— মেয়েটার খিদে পাবে সেদিকে কি কারো খেয়াল ছিলো? যদি রাতে ওদের রুমে খাবার রেখে আসতি তাহলে কি আজ চোরের খেতাব পেতে হতো?
মিথিলা মাথা নিচু করে বললো,
— আসলে আব্বু এতকিছুর মাঝে ভুলেই গিয়েছিলাম। তাই খাবারের বিষয়টা মাথায় আসেনি।
জয়নাল বিল্লাহ মিথিলাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— হয়েছে আর কোন অযুহাত দিতে হবে না।
জয়নাল বিল্লাহের কথার পিঠে সাবা অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে গেলো। কান্নার ভান করে অভিনয়ের গলায় বললো,
— আপনি আমার কষ্টটা বুঝেছেন আঙ্কেল। কিন্তু আপনার ছেলে সব জেনেও আমার সাথে এমন করেছে। ও নিজে খাবার বেড়ে দিয়েছে। তারপর নিজেই চাচীর সাথে চোর চোর বলে চেঁচিয়েছে।
সুমি বেগম কপাল কুঁচকে গম্ভীর সুরে বললো,
— আঙ্কেল কে সাবা?উনি তোমার শ্বশুর মশাই। শ্বশুরকে কি বলে ডাকতে হয় তা কি তুমি জানো?
সাবা মাথা নিচু করে ছোট করে বললো,
— সরি, আন্টি। বাবা বলতে হবে।
মিথিলা ওকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে ফিসফিস করে বললো,
— এই বুদ্ধ মেয়ে কি বলিস এসব? আম্মুকে আন্টি বলছিস কেন?
— মাথা গেছে আমার মিথিলা আপু।
— আম্মু বিষয়টা খেয়াল করলে খবর হয়ে যাবে।
সুমি বেগম সত্যিই খেয়াল করলো না।জামিলা বেগম অপরাধী ভঙ্গিতে মুখ কুচোমুচো করে মৃদুলকে বললো,
— এইটা কি বাজান? তুমি না কইলা চোর? তাইলে সাবা বউমণি আইলো কেমতে?
মৃদুল তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললো,
— সরি চাচী। আমি আসলে ভুল বলেছি। ঐটা চোর নয় চুন্নি হতো।
— এইটা কিন্তু ঠিক না বাজান।
জয়নাল বিল্লাহ কিছু সময় সামনের টি-টেবিলের ওপর থাকা ফুলদানির দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর রাগী লুকে মৃদুলের দিকে তাকালো। মৃদুল তার বাবার চাহনিতে বড়সর এক ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বললো,
— আমি কিছু করিনি আব্বু।
— তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করেছি মৃদুল?
— না আমি এমনি বললাম।
— যাও, বউমাকে নিয়ে রুমে যাও। (জামিলা বেগমের দিকে তাকিয়ে) আর শুনো জামিলা, এই গাধার কথায় কোন কাজ করবে না। আজকে ছেড়ে দিলাম। অন্য দিন হলে কিন্তু ছাড়বো না। মনে রেখো বাসায় মেহমান বলে ছাড় পেলে।
জামিলা বেগম মুখটাকে শুকনো করে ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। মৃদুল তার পাশ থেকে সরে সাবার সামনে এসে লো ভয়েজে বললো,
— রুমে চল।
— আজ বেঁচে গেলি মৃদুল।
— তুই বেঁচে গেলি সাবা।
— তোর কপালে কি আছে তুই নিজেও জানিস না।
— দেখা যাবে ইয়ার।
ওদের দুজনকে ফুসুরফাসুর করতে দেখে সুমি বেগম ধমকে বললেন,
— কি হলো যাচ্ছিস না কেন তোরা?
মৃদুল মাথা চুলকে ভদ্র ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো,
— যাচ্ছি আম্মু।
যে যার যার রুমে চলে গেল। সাবা রুমে গিয়ে রাগে ধপ করে খাটে বসে পরলো। মৃদুল দরজা লাগিয়ে সাবার সামনে বসে বিজয়ী হাসি দিয়ে বললো,
— ডোজটা কেমন হলো মিস সাবরিনা সাবা?
সাবা ফোঁস করে উঠে মৃদুলের চুলগুলো জোরে টানতে টানতে বললো,
— আজ তোর একদিন কি আমার একদিন!
— সাবা ছাড় ব্যাথা পাচ্ছি।
— ব্যাথা পাওয়ার জন্য ধরেছি।
— আমিও কিন্তু তোর চুল ধরবো।
— আমি কি ছেড়ে দিবো নাকি?
মৃদুল ঝাড়া মেরে সাবার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সাবার দুই হাত মুচড়ে পেছন দিকে ধরে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
— এবার তোকে কে বাঁচাবে পঁচা বল সাবান?
— ছাড় মৃদুল। ভালো হবে না কিন্তু।
— ছাড়বো না কি করবি?
— কামড় দিবো।
— দে,ভয় পায় নাকি। কুকুরের কাজইতো কামড় দেওয়া।
সাবা মৃদুলের বাহুডোর থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। সাবা অতিরিক্ত নড়াচড়া করার কারণে আচমকা দুজন খাটের ওপর পরে গেল। প্রথমে সাবা তার ওপরে মৃদুল। দুজন দুজনের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। সাবা চোখ বন্ধ করে মৃদুলের দিকে এগিয়ে এলো।
কি ভাবছেন রোমান্টিক কিছু হবে? জীবনেও না। সাবা সর্বশক্তি লাগিয়ে মৃদুলের নাকের ডোগায় এক কামড় বসিয়ে দিলো। মৃদুল আউচ বলে চিৎকার দিয়ে সাবার ওপর থেকে উঠে গেলো। ওর নাক লাল, নীল সিগন্যাল দিচ্ছে।সাবা উঠে বসে বিছানায় লুটোপুটি খেয়ে হাসতে লাগলো। মৃদুল ভেবেছিলো সাবার গাল দুটো জোরে টেনে দিবে কিংবা চুল ছিঁড়বে। কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর লুটোপুটি খেয়ে হাসি দেখতে লাগলো। মৃদুলকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাবা হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কি দেখছিস?
— কিছু না।
মৃদুল ছোট করে উত্তর দিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেল। সাবা ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,
— আজব ছেলে। ওর মনে কখন কি চলে তা আজও বুঝতে পারলাম না।
মুখ বাঁকিয়ে কাঁথা জড়িয়ে ধুপ করে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলো সাবা। মৃদুলের আসার অপেক্ষাও করলো না। সারাদিন তার ওপর ধকল তো কম যায়নি। কিছু সময়ের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
পরেরদিন সকালে…….
#চলবে