শরতের শুভ্র মেঘের ভেলায় পর্ব- ০২

#শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায়
#থ্রিলার_রোম্যান্টিক
#পর্ব_২
#Sadia_afrin_nishi

জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা ভাঙাগোলপাতার ঘরে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না।চৌকি থেকে নেমে হাঁটা ধরলাম বাহিরে। বাহিরে কিছু লোকজন কীছু একটা নিয়ে কথা বলছিল।আমাকে দেখা মাত্রই একজন বলে উঠল,, ওই তো মাইয়াডার হুঁশ ফিরছে তাইলে আর ডরানোর কোনো কারণ নাই।আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একজন আমার কাছে এসে বলল,,

_মা তুমার শরীর ভালা লাগতাছে তো

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।হঠাৎ করে বাবা-মায়ের কথা মনে পরতেই আমি হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম।আমার সামনে থাকা লোকটি তখন উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,,

_কী হইছে মা কাঁনদো কেন

আমি তখন ভাঙা গলায় বললাম,,
_আমি আব্বা, মার কাছে যাব

লোকটির মুখটা তখন মলিন হয়ে গেল। সে আমার মাথায় হাত রেখে বলল,,

_আজই থেইক্কা আমিই তর বাপ,মা।এই দুনিয়ায় আমারও কেউ নাই তরও কেউ নাই।তাই আমরা দুইজন অহন বাপ,মাইয়া বুঝলি রে মা।

সেদিন থেকে শুরু হলো আমার জীবন সংগ্রাম।চিরতরে সুখ বিদায় নিয়ে দুঃখ,কষ্ট নেমে এলো।আব্বা, মা, দাদু সবার কথা খুব মনে পরত।আমার পালিত বাবা তখন আমাকে নানারকম কথার ছলে অতীত ভুলানোর চেষ্টা করতেন।দাদু কেমন আছে তাও জানি না।আমি ছোট হওয়ায় বাড়ির ঠিকানা কিছুই জানতাম না।আমার পালিত বাবা অনেক চেষ্টা করেছে আমাকে দাদুর কাছে নিয়ে যাওয়ার কিন্তু ঠিকানা না জানায় প্রতিবার ব্যর্থ হয়েছে।ধীরে ধীরে অতীত ভুলে পালিত বাবার সাথে নিজের জীবন শুরু করলাম।কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে দিন অতিবাহিত হতো আমাদের।খুব কষ্টকর সেই দিনগুলি।

সময়ের নিয়মে বয়স বারতে লাগল আমার।এখন আমার বয়স ষোল বছর। পালিত বাবা নামটা কেটে সেখানে বসেছে আমার বাবা নামটি।অতীতের স্মৃতি সবকিছু আমার কাছে এখন ঝাপসা। বাবা,মায়ের চেহারাও তেমন একটা মনে নেই বললেই চলে।বাবার মুখে শুনেছি ছোট বেলায় লঞ্চডুবির সময় আমি ট্রলারে বসে অজ্ঞান হওয়ার পরে বাবা আমাকে তার গ্রামে নিয়ে আসেন।নানা লোকে নানা কথা বলেছে কিন্তু আমার বাবা আমাকে কখনো একা ছেড়ে দেননি।সবসময় আমাকে আগলে রেখেছেন। আমার বাবা আমাকে লেখাপড়াও শেখাচ্ছেন।আমি এখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। খুব শীঘ্রই এসএসসি পরীক্ষা দিবো।লেখাপড়া করার ফলে আমার কথাবার্তা, চালচলনে এসেছে পরিবর্তন। এমন অভাবের সংসারে পড়াশোনা করাটা নিতান্তই বিলাসিতা বলে অনেকে মনে করলেও আমার বাবা মনে করেন তার মেয়ে বড় হয়ে তার মুখ উজ্জ্বল করবে। এজন্য পাড়া-পড়শীর নানারকম কটুক্তি শোনা স্বত্বেও আমার বাবা আমার পড়াশোনা বন্ধ করেননি বরং আরও উৎসাহ দিয়েছেন। আমার জীবনে চলার পথে একমাত্র অনুপ্রেরণা আমার বাবা।বাবা,মেয়েতে হেসে-খেলে বেশ ভালোই দিন চলছে আমাদের।

আমাদের গ্রামের মোড়লের ছেলে নিজাম।ছেলেটা একদম ভালো না।ইদানিং স্কুলে যাওয়ার পথে প্রায়শই আমার পথ রোধ করতে চেষ্টা করে। আমি প্রতিবারই ছলচাতুরী করে পলায়ন করি।আজও ঠিক আমার পথ আটকাতে দাড়িয়ে আছে।এই ছেলেটাকে দেখলেই আমার অন্তত কেঁপে ওঠে।আমি নত মস্তকে হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে পদার্পণ করছি।ঠিক সে সময়ই নিজাম আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

_ওই ছেড়ি অতো ভাব লইস কেন?সামনে যে এত্তো সুন্দার একখান পোলা খাড়াইয়া আছে সেইদিকে কী তর চোখ যায় না

আমি কিছু না বলে তাড়াতাড়ি পাঁ চালাতে লাগলাম।নিজাম হয়তো আমার কাজে প্রচন্ড ক্ষেপে গেছে।
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজাম আমার হাত শক্ত করে ধরে ক্ষিপ্র গতিতে বলল,,

_তর অনেক সাহস হইছে তাই না। খাড়া তর ডানা ছাটার ব্যবস্থা করতাসি

এতটুকু বলে নিজাম হনহন করতে করতে চলে গেল। এদিকে আমার হাত রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।আমি হাতের দিকে তাকিয়ে দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে শ্রেণি কক্ষে চলে গেলাম।

স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে গিয়ে দেখি আমাদের ছোট্ট টিনের ঘরটা ভেঙে চুড়ে তছনছ অবস্থা। বাবা চোখে পানি উঠানে বসে আছে। আমি হতবাক হয়ে বললাম,,

_এগুলো কী করে হলো বাবা।

বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বললেন,,

_মা রে মোড়লের পোলা আইছিল তর লাইগা বিয়ার প্রস্তাব লইয়া। আমি না করছি দেইখা ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা ফালাইছে।আমার গাঁয়েও হাত তুলছে। সামনের শুক্কুরবার(শুক্রবার)কাজী লইয়া আইবো।তহন বিয়া না দিলে কইছে জানে মাইরা হালাইবো

বাবা কথা শেষ করে আবার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন।আমার চোখেও পানি।ঘরবাড়ি ভেঙেছে ঠিক আছে কিন্তু আমার জন্য বাবা মার খেলো এটা কিছুতেই মানতে পারছি না।

আমার ভাবনার সুতো ছিঁড়ল বাবার কথা,,

_চল রে মা আমরা এইহান থেইক্কা পলাই যাই।তরে আমি শহরে নিয়া গিয়া ইস্কুলে পড়ামু।তুই চল মা আমার সাথে চল(মিনতি করে)

বাবার কথায় আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,,

_এসব তুমি কী বলছো বাবা।এখান থেকে চলে গেলে কোথায় থাকবো আমরা।আর শহরে যেতে তো অনেক খরচ হবে।এতো টাকা তুমি কোথায় পাবে

বাবা নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে বলল,,

_এই জমিডা বেইচ্চা দিমু।তা থেইক্কা যে টাকা পামু ওইডা লইয়া শহরে যামু। তারপর এখখান কামের (কাজের)ব্যবস্থা করমু তাই দিয়া দুই জনের চইল্লা যাইবো।তুই আর না করিস না মা। এইহানে থাকলে তর জীবনডা শেষ রে মা

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। চুপটি করে শুয়ে পরলাম বাবার বুকের ওপর মাথা রেখে।

বাবার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।কেউ জমি কিনতে রাজি হচ্ছে না। সবাই জমি অনুযায়ী কম দাম বলছে।শেষমেষ বাবা নিরুপায় হয়ে অল্প দামেই জমিটা বিক্রি করে দিলেন।শেষ সম্বল এই জমিটুকুও গেল এখন মানুষের দারে দারে ঘুরতে হবে আমাদের। এরপর কী আছে নিয়তিতে তা একমাত্র ওপর ওয়ালাই ভালো জানেন।

_ _ _ _ _

প্রাণপণে দৌড়চ্ছি ইটের রাস্তা ধরে।পাঁ থেকে রক্তের ফিনকি ছুটছে।বাবারও একই অবস্থা। নিজের থেকেও বাবার এই অবস্থা দেখে আমার বেশি কষ্ট হচ্ছে। তবুও কিছুই করার নেই। ছুটতে যে আমাদের হবেই।

মোড়লের ছেলের কানে কীভাবে যেন আমাদের পালিয়ে যাওয়ার খবরটা চলে গেছে। হয়তো নজরদারি করছিল আমাদের ওপর।আমি আর বাবা বাড়ি থেকে বেরতেই আমাদের পিছু তাড়া করতে শুরু করল নিজামের দলের লোকজন। আমরা দুজনে ছুটতে ছুটতে প্রায় স্টেশন পর্যন্ত চলে এসেছি।ওরা এখনো আমাদের ধাওয়া করছে। এমন একটা দিনও যে আমার জীবনে আসবে এটা কখনোই ভাবতে পারিনি।

কপাল ভালো যে আমরা স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম ট্রেন এখানো আছে। আমি তাড়াতাড়ি একটা কামড়ায় উঠে পরলাম। তারপর বাবার হাত ধরে টেনে তুললাম।আর একটুর জন্য ওদের হাত থেকে বেঁচে গেলাম আমরা। ট্রেনে বসে দুজনে হাঁপাচ্ছি।বাবার বয়স হচ্ছে এমনিতেই শরীরটা ভালো নয় তারওপর আবার এইসব।ট্রেনের মধ্যে সবাই আমাদের দিকে বারবার তাকাচ্ছে আর কীসব যেন কানাঘুষো করছে।

ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছি।ছোট বেলায় একবার নিজের বাড়ি হারিয়েছি আজ দ্বিতীয় বার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল।তবে কারণ টা ভিন্ন।

ঢাকা পৌছলাম পরদিন বিকেলে।নতুন শহর কী করব, কোথায় যাব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।বাবাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।এই শহরের মানুষগুলো বড্ড অদ্ভুত।কারো মনে কোনো দয়া-মায়া নেই।যার কাছেই সাহায্যের জন্য আবেদন করছি সেই দুরদুর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে।এই অচেনা শহরে নিজেদের ভীষণ অসহায় লাগছে।মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি একটু আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু বিনিময়ে পাচ্ছি শুধুই অবহেলা,লাঞ্চনা।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here