সুখের পাখি পর্ব -০৩+৪

#সুখের_পাখি


গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুর। রোদের তীব্রতায় মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ফ্যানের বাতাস থেকেও আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরুচ্ছে। ঘরের ভেতর শুয়ে থেকেও শান্তি নেই। তনু বিছানায় শুয়ে আশপাশ করছে। বাবা রে বাবা! শহরে এত গরম! গ্রামে তো এত গরম ছিল না। জানালা খুলে দিলেই ঠান্ডা বাতাস এসে ঘর শীতল করে দিত। বাড়িতে প্রত্যেক দিন দুপুরেই ঘুমিয়েছে তনু। কই তখন যদি এমন গরম লাগত তাহলে কি ঘুমাতে পারত? আজ শরীর জ্বলছে। শুয়ে শুয়ে তনু ভাবছে, জীবন কত বিচিত্র! একদিনে কতকিছু হয়ে গেল! সাত মাস ধরে সহ্য করছিল। কখনও প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না এমন না। সাহস ছিল ঠিকই। কিন্তু গ্রামের মানুষগুলো যে ভীষণ সেকেলে। মূর্খই বলা চলে। সামান্য বিষয়কে গল্পগুজবের মাধ্যমে বটগাছের রূপ দিত। ছেলে গায়ে হাত না দিলে ওই মেয়ে চেঁচাত কেন? নিশ্চয় গায়ে হাত দিয়েছে। এই মেয়েকে কে বিয়ে করবে? না, এই ছেলের সাথেই এই মেয়ের বিয়ে হতে হবে।
ভাবতেই তনুর গা জ্বলে গেল।

–‘জন্মের শিক্ষা দিয়ে এসেছি শালাকে। এবার যাস কোনো মেয়ের কাছে। হিজড়ার বাচ্চা। তোর মা’র শাড়ি চুড়ি পরে গ্রামে ঘুরে বেড়াস।’

তনু নিজের ওই কাজে মনে মনে তৃপ্তি পাচ্ছে। গ্রাম ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে বলে এখন ওর মোটেও খারাপ লাগছে না। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেল তনু। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। জানালা দিয়ে দেখল অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো। সন্ধ্যার পরে ফুপু আম্মা তনুর কাছে এলো। অনেকক্ষণ বসে ওর সাথে অনেক গল্প করল। তনুর ফুপু আম্মার একটা জিনিস ভালো লাগছে। হঠাৎ ওরা না বলে কেন এসেছে সে বিষয়ে একবারও জানতে চাইছে না।

–‘তুই চা খাস তনু?’

–‘হ্যাঁ।’

–‘আমি চা বসাতে যাচ্ছি। আয় তুই। ইহান আবার ফুলির হাতের চা খায় না। ফুলি সব পারলেও চা-টা একদমই ভালো বানাতে পারে না। বাজে হয়। ও চা করেছে শুনলেই ইহান চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। তাই আগুনের কাছে গেলে কষ্ট হলেও চা-টা আমাকেই করতে হয়।’

ফুপু আম্মা চলে গেলে তনু ক্ষীণ শ্বাস ফেলে ভাবল। ফুপু আম্মা বাচাল টাইপ মহিলা। তবে মনটা ভালো। যে মানুষগুলো বেশি কথা বলে ওদের মনে অত প্যাঁচ থাকে না।
বাবা, তনু, ফুপু আম্মা আর ফুলি মেয়েটা একসাথে বসে টিভি দেখতে দেখতে চা খেল। তনু জানতে পারল ফুপু আম্মার স্বামী দেশে থাকেন না। উনি গত ছয় মাস ধরে ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে আছেন। উনার যাওয়া আসা লেগেই থাকে। দুই মাস এখানে থাকলে তিন মাস ওখানে।
রাতের খাবার টেবিলেও ইহান এলো না। সাবিনা বিরক্তি গলায় ফুলিকে বলল,

–‘তোর ভাইজানকে ডেকে নিয়ে আয়।’

ফুলি খেতে খেতে জবাব দিল,

–‘ভাইজান আইব না আম্মাজান।’

সাবিনার বিরক্তি আরও বাড়ল। কপাল কুঁচকে বলল,

–‘সব কথায় জান, জান লাগাবি না তো ফুলি। আম্মাজান, আব্বাজান, ভাইজান। বিয়ের পর বরকে বরজান ডাকবি নাকি?’

ফুলির গাল লাল হলো। লজ্জা পাওয়া গলায় বলল,

–‘লজ্জার কথা কইবেন না তো আম্মাজান। আমার লজ্জা করে।’

তনুর মজাই লাগছিল। ফুলি মেয়েটার সাথে এখন পর্যন্ত তার কথা না হলেও তনু বুঝতে পারছে, ফুপু আম্মা এই ফুলির জন্যই এখনও মনের দিক থেকে সুস্থ আছেন। নইলে স্বামী খুব কম সময়ই দেশে থাকেন। এক ছেলের দেখা পাওয়ার দুষ্কর। বাড়িতে মানুষই বাঁচে ফুলি আর ফুপু আম্মা। এই বাচাল মেয়েই বাড়িটাকে ভূত বাড়ি হতে দেয়নি।

–‘ইহানটা আবার কী নতুন ঢঙ শুরু করেছে হ্যাঁ! প্রতি বেলা তাকে ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতে হবে! কেন টেবিলে এসে খেয়ে গেলে লজ্জা লাগে নাকি তার।’

–‘আপনে চিল্লাচিল্লি কইরেন না তো আম্মাজান। আমার খাওয়া শেষ হইলে আমি ভাইজানের খাওয়োন ঘরে দিয়া আসমু।’

–‘তোর এই অতি ভালোবাসার কারণেই আমার ছেলেটা বিগড়ে যাচ্ছে। ওর কথার আগে সব কাজ করে দিবি না একদম।’

–‘ভাইজান রাইতে খাইতে চাইছিল না। আমি অনেক জোর করায় রাজি হইল। আপনে আর গানাবাজানা কইরা ভাইজানের মুড বিগড়াইয়া দিয়েন না।’

–‘বাবাহ! আমি তোর ভাইজানের মুড বিগড়ে দেই?’

–‘তা নয়তো কী? অত চিল্লায় কেউ?’

–‘ছেলেটা আমার পেট থেকে হয়েছে নাকি তোর? আজব কথাবার্তা! মা’র থেকে ফুলির দরদ বেশি দেখছি।’

ফুলি মুখ মুচড়ে উত্তর না দিয়ে খেতে লাগল। তনু খানিকটা অবাকই হলো। বাড়ির কাজের লোকের সাথে যে বাড়ির মালিকের এরকম সম্পর্ক হতে পারে তা তনুর ভাবনার বাইরে ছিল। এবাড়িতে ফুলির ভালোই রাজত্ব চলে দেখা যাচ্ছে।

–‘বাবা, আমরা কি এখানেই থাকব?’

তনুর প্রশ্নে জামাল সাহেব মৃদু হেসে তনুর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলেন,

–‘কয়টা দিন তো থাকতেই হবে রে মা। কেন তোর কি এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে?’

তনু অতিদ্রুত মাথা নাড়ে। বাবার বাঁ হাত নিজের হাতে নেয়।

–‘আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না বাবা। ফুপু আম্মা ভীষণ ভালো মানুষ।’

–‘হ্যাঁ। সেই ভরসাতেই ওর কাছে এসেছি। ও না থাকলে কার কাছে যেতাম বল তো।’

–‘আমার জন্য এতসব সমস্যা দেখা দিল, তাই না বাবা?’

–‘দূর পাগল মেয়ে। তুই তো আমার সাহসী মেয়ে। তুই যা করেছিস একদম ঠিক কাজ করেছিস। অন্যায়ের প্রতিবাদ সবার করা উচিত।’

–‘কয়টা দিন নাহয় এখানে থাকব। তারপর আমরা কোথায় যাব বাবা?’

–‘দেখি। ব্যবস্থা একটা তো করতেই হবে।’

নতুন জায়গা বলেই হয়তো রাতে তনুর ঘুম হলো না। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকল। আজ আবার দিনে ঘুমিয়েছিল। সন্ধ্যায় চা খেয়েছে। এখন সারারাতই জাগতে হবে তাকে। নিজের ঘর ছাড়া তনুর সহজে ঘুম আসে না। রাত মনে হয় একটা কি দুইটা। তনু তখনও জেগে। তার চোখে আজ ঘুম ধরা দিচ্ছে না। হঠাৎ তনু কারো মিষ্টি একটা গলা শুনতে পেল। এই রাতের বেলায় গান গাইছে কে? সাথে গিটারের মুগ্ধ করা সুর। তনু উঠে বসে কান পেতে শুনতে থাকল। মাথার উপর থেকে আওয়াজ আসছে মনে হচ্ছে। কে গান গাইছে? কার গলা এতটা সুন্দর! একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে চোখ বুজে তনু অচেনা মানুষটার গলায় গান শুনছে। শুনতে ভালোই লাগছে তার। গান শুনতে শুনতেই মনে হয় একসময় সে ঘুমিয়ে গেল। তনুর জানা হলো না মানুষটা কে ছিল। কে অত রাতে বাকি সবার ঘুম নষ্ট করছিল। না, নষ্ট করছিল বললে ঠিক হবে না। তার ঘুম এসেছে মানুষটার গান শুনে।

তনু ঘর থেকে বেরিয়েই কালকের সেই থ্রী কোয়ার্টার ছেলেটার সামনে পড়ে গেল। এই ছেলে এখনও খালি গায়েই আছে। তনু চলতি পথে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাথে সাথে চোখও বন্ধ করে নিল। মনে মনে বিরক্তিতে ফেটে পড়ছে তনু। ছেলেটার জামাকাপড় নেই নাকি? সারা দিন রাত এরকম খালি গায়েই থাকে নাকি? মানুষকে বডি দেখায়! গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়! লজ্জাহীন ছেলে, বাড়িতে নতুন দু’জন মানুষ এসেছে। অচেনা মানুষদের সামনে এভাবে আসতে লজ্জা করে না! বাবা নাহয় ছেলে। সে তো একজন মেয়ে। তাকে তো অন্তত ছেলেটার লজ্জা পাওয়া উচিত। বেশ অনেকক্ষণ ধরে তনু চোখ বন্ধ করে আছে। ছেলেটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে? নাকি চলে গেছে। পিটপিট করে একচোখ খুলে তনু৷ না এক চোখে ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না। আরেক চোখও খুলে তনু। দু’টো চোখেই থ্রি কোয়ার্টারকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তার মানে চলে গেছে।

–‘ফুপু আম্মা, আপনাদের বাড়িতে রাতে গান করছিল কে?’

–‘রাতে গান! অহ, বুঝেছি। কে আবার মা? আমার পাগল ছেলে, ইহান। সারাদিন ওই টুংটাং যন্ত্রটা নিয়ে পড়ে থাকে। রাতের পর রাত জেগে গান লিখে। নিজে গায়।’

–‘ওহ।’

–‘আর বলিস না মা। এই ছেলে পুরো পাগল। মাঝ পথে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে ছেলে বলে তার দ্বারা নাকি ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সম্ভব না। সে গায়ক হবে। সেই থেকে শুরু হয়েছে ওর জ্বালা। গলা মাশাআল্লাহ ভালোই। তাই বলে পড়াশোনা ছেড়ে আদাজল খেয়ে গানের পেছনে পড়তে হবে? এই নিয়ে ওর বাবাও অনেক রাগারাগি করেছে। শেষ পর্যন্ত কোনোভাবেই ছেলেকে বুঝাতে না পেরে রাগ করে ছেলের সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। দেশে কয়জন গান খেয়ে নামডাক কামাতে পারে? গায়কদের ভাত আছে দেশে? তার থেকে পড়াশোনাটাও অন্তত চালিয়ে যেত।’

তনু ভারী অবাক হলো। সত্যিই এই ছেলে পাগল। নইলে ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে গায়ক হতে চায়!

–‘ইহান পড়াশোনায় ভালোই ছিল। এখনো আবার ধরলে পাস করে যাবে। গান ধরল তো মোটে পাঁচ মাসও হবে না। কত বুঝাচ্ছি ওকে। ওর এক কথা। সবাই যদি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে মা তাহলে বাকি পেশা গুলোয় মানুষের অভাব পড়বে না!’

তনু মাত্র দশম ক্লাসে পড়লেও সে একটা কথা খুব ভালো করে জানে যে, পড়াশোনা ছাড়া ভবিষ্যত অন্ধকার। জীবনে কিছু করতে হলে পড়াশোনা করতেই হবে। তনুকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। বাবার জন্য, নিজের জন্য কিছু করতে হবে তাকে। তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ভীষণ জরুরি।

এবাড়িতে আসার পর থেকে তিনটা দিন কেটে গেল। অথচ ইহানের সাথে এখনও তনুর সামনাসামনি কথা হয়নি। হ্যাঁ দেখা হয়েছে ঠিকই। প্রতিবারই অপ্রস্তুত ভাবে। ছেলেটার মনে হয় জামাকাপড়ের ভীষণ অভাব। তাই সারাক্ষণ খালি গায়ে থাকে। অমন খালি গায়ের ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা যায়!
ইহান নিচে আসে। মা’কে, ফুলিকে খুঁজে। কাউকেই পায় না। বাড়িতে নেই নাকি? কোথায় গেল সব একসাথে?
তনু ইহানকে দেখে পেছন থেকেই কেটে পড়ছিল। ইহান তার নাম ধরে ডেকে উঠলে অবাক হয়ে থমকে দাঁড়াল। থ্রী কোয়ার্টার ওর নাম জানে!

–‘তনু, মা কোথায়?’

সাথে সাথে কোন কথা বলতে পারল না তনু। থ্রী কোয়ার্টার এতটা স্বাভাবিক ভাবে ওকে ডেকেছে যেন রোজ আলাপ হয়। ইহান ভাবল তনু হয়তো তার কথা শুনেনি। সে আবার বলল,

–‘মা কোথায় তনু, জানো?’

–‘ফুপু আম্মা ফুলি আপার সাথে বাজারে গেছে।’

–‘অহ।’

ইহান আর কথা বাড়ায় না। চিন্তিত মুখে ব্যস্ত পায়ে তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। তনু ফোঁস করে দম ফেলে।

–‘থ্রী কোয়ার্টার ভাই আমার নাম জানে। আমাকে চেনেও। তবুও এতদিন কথা বলেনি। অহংকার! কী অহংকারী ছেলে রে বাবা! এর সাথে কোনোদিন যদি আমার কথাবার্তার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়, তাহলে একে জিজ্ঞেস করব, কী রে ভাই পরার কাপড় নেই তোর? এই মাশাআল্লাহ বডি দেখিয়ে বেড়ানোর মানে কী হ্যাঁ?’

তনু একা একাই হাসে। তার যত পাগলামি। তনু ভাবে, তার থেকেও পাগল তাহলে পৃথিবীতে আরও একজন আছে। ফুপু আম্মার ছেলে। ওই থ্রী কোয়ার্টার তো তার থেকেও পাগল। রাত একটার পরই তার পাগলামি শুরু হয়। গান গাওয়ার পাগলামি। তনুর অবশ্য ভালোই লাগে। পাগলের গান শুনতে শুনতে ঘুম এসে যায়।
#সুখের_পাখি


সাবিনা এখানকার একটা স্কুলে তনুকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই তনু স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। স্কুলে নতুন বন্ধুবান্ধবও বানিয়ে ফেলেছে। তনুর সবথেকে ভালো বন্ধু হয়েছে মিলি নামের একটা মেয়ে। মিলির নামের মতই মিলি সবার সাথে নির্দ্বিধায় মিশতে পারে। তনু ওর গ্রামের কথা প্রায় ভুলেই গেছে। অল্প সময়েই শহরের জীবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। ফুপু আম্মার বাড়িটাও তার পছন্দ হয়েছে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে সারাক্ষণই ফুলি আপা নানান কথা বলে হাসিয়ে মারে। ফুলি বয়সে তার থেকে দুই তিন বছরের বড় হলেও ওকে সমবয়সীই মনে করে। ফুলিকে সে, ফুলি আপা ডাকে। প্রথম কয়দিন ফুলি আপত্তি করেছিল। ওর মুখে আপা ডাক শুনে কপাল কুঁচকে নাক উঁচিয়ে বলেছিল,

–‘আপা, আপা করো কেন অত?”

তনু অবাক গলায় বলেছিল,

–‘ওমা! তুমি আমার বড় তো। তোমাকে আমি নাম ধরে ডাকব নাকি?”

–‘তাই বইলা কথায় কথায় আপা ডাকবা?”

–‘তোমাকে আপা ডাকতে আমার ভালো লাগে। আমার নিজের তো বড়/ছোট কোন ভাই বোনই নেই। তাই তোমাকে আপা ডেকে শখ মেটাব। বুঝলে ফুলি আপা।”

ফুলি হার মেনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল,

–‘আচ্ছা ডাইকো। ভাল্লাগলে আর কী কওন যাইব!”

তনু এটাকে নিজের বাড়ি ভেবে থাকছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, লেখাপড়া করে যাচ্ছে। কেউ তাকে কিছু বলে না। কেউ কোন কাজে বাধা দেয় না। সে নিজের স্বাধীন। ফুপু আম্মার মতো ভালো মানুষ এই দুনিয়ায় আর দুইটা হয় না। নিজের মেয়ের মতো আদর করে ওকে। কত ভালোবাসে। মায়ের মতন তার খেয়াল রাখে।
ইহান তার চিলেকোঠা ছেড়ে নিচে আসেই না বলতে গেলে। ওকে নিয়েও তনুর কোন মাথা ব্যথা নেই। প্রথমদিকে ইহানের সাথে ভাব জমাতে চেয়েছিল সে। কিন্তু ফুপু আম্মার এই ছেলে আস্ত বজ্জাত। প্রথম দিন যখন তনু ছাদে ইহানের ঘরে যায় সেদিনই ইহান তার সাথে বাজে ব্যবাহর করে। তনু শুধু কথা বলতেই গিয়েছিল। কথায় কথায় যদি বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাহলে তো আরও ভালো। বন্ধুত্ব না হলেও অবশ্য সমস্যা নেই। তনু তিড়িংতিড়িং করে ছাদে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা খোলাই পেয়েছিল। উঁকি ঝুঁকি পেরে ভেতরে দেখেছে। কেউ নেই। তাই অনুমতি না নিয়েই ভেতরল ঢুকে গেল। ঘরটা আহামরি কিছু না। মোটামুটি মানুষ থাকার উপযোগী। কিন্তু একে অগোছালোই বলা যায়। বিছানার চাদর কুঁকড়ানো। সোফায় চায়ের কাপ। আলনায় জামা-কাপড়ের স্তুপ। ফ্লোরেও জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তনু নাক কুঁচকে বলে,

–‘ছি! এত নোংরা! এই ঘরে মানুষ থাকে? ফুলি আপা তো বলেছিল ফুপু আম্মার ছেলে নাকি এই ঘরেই থাকে বেশিরভাগ সময়।”

ইহানের গিটারের দিকে নজর গেলে তনু ওটাকে হাতে নেয়। বাজাতে জানে না। তবুও চেষ্টা করে টুংটাং আওয়াজ তুলে। সেই আওয়াজ শুনেই হয়তো হঠাৎ দেয়াল ফুঁড়ে ইহান বেরিয়ে আসে যেন। দেয়াল না পর্দা টানানো ছিল। তনু লক্ষ করেনি। ইহান ঘরে এসে তনুর হাতে ওর গিটার রেখে রেগে যায়। ছোঁ মেরে ওর থেকে গিটার নিয়ে নেয়। ইহান এখনও খালি গায়ে। এই ছেলের সত্যিই কোন কাপড় নেই। নয়তো মনে হয় কাপড় গায়ে দিলে গা জ্বালা করে। নইলে চব্বিশ ঘণ্টা খালি গায়ে টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়। লজ্জাহীন বেলাইজ্জা পুরুষ মানুষ। তনু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তবুও হাসার চেষ্টা করে বলে,

–‘আমি ভেবেছিলাম আপনি ঘরে নেই। বাইরে থেকে দেখতে পাইনি তো।”

গিটার হাতে নিয়ে শান্ত মুখে ইহান বলে,

–‘কারো রুমে যাওয়ার আগে নক করে যাওয়া সাধারণ ভদ্রতা। আর কারো জিনিসে হাত দেওয়ার আগে তার পারমিশন নেওয়াও ভদ্রতার মধ্যে পড়ে। নক না করে আসা, পারমিশন না নিয়ে কারো জিনিস ধরা অভদ্রতার মধ্যে পড়ে। এটুকু জ্ঞান তোমার থাকা উচিত।”

এই অপমান তনু সহ্য করতে পারল না। সেই দিনের পর থেকেই ছাদে যাওয়া বন্ধ করল। ইহানের সাথে কথা বলাও সেদিনের পর থেকেই বন্ধ হয়েছে। আগেও অবশ্য কথা কোথায় বলত। সামনে পড়লে হাই হ্যালো এটুকুই তো। ওইদিনের পর তা-ও বন্ধ হলো। তনু ইহানকে দেখলেও না দেখার মতো চলে। ওকে পাত্তা না দিয়ে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে। বাজে লোক। সেদিন ওরকম অপমান করতে পারল! তনুর চোখে পানি চলে এসেছিল। ফুপু আম্মার কাছে বিচারও দিতে চেয়েছিল। কী মনে করে দেয়নি সে-ই জানে।

এবাড়িতে শুধু ইহান বাদে সবাই তনু বলতে পাগল। সকালে স্কুলে যাবার সময় ফুপু আম্মা টিফিন ব্যাগে ভরে দেয়। তনু স্কুল থেকে ফিরলেই প্রতিদিন ফুলি আপা জিজ্ঞেস করবে,

–‘আজ স্কুলে কী কী করলা তনু? কয়টা পোলা চোখ টিপ দিল? এই তোমারে কেউ প্রেমপত্র দেয় না? তুমি দেখতে তো মাশাআল্লাহ সুন্দর। তোমার পিছে তো পোলাগো লাইন লাইগা যাওনের কথা।”

তনু ফুলির কথা শুনে খিলখিল করে হাসে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে ওর হাসির শব্দে বাড়িটা গমগম করে। দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি করে সবাইকে মাতিয়ে রাখে। ফুলির কথায় তনু গম্ভীর মুখে উত্তর দেয়।

–‘না গো ফুলি আপা আমি মনে হয় ততটাও সুন্দরী না। দেখো না, আজ পর্যন্ত একটা ছেলেও আমাকে দেখে চোখ টিপ দিল না। না কারো থেকে কোন প্রেমপত্র পেলাম। অন্তত একটা পেলেও নাহয় নিজেকে সুন্দরী হিসেবে দাবি করতে পারতাম।”

দু’জন একসাথে শব্দ করে হেসে উঠে। ফুলি দুপুরের রান্নার জন্য ফুলকপি কাটছিল। তনু স্কুল থেকে ফিরে ঘরে যায়নি। কাপড়ও ছাড়েনি। স্কুল ড্রেস পরেই ব্যাগটা ছুড়ে রেখে হলে সোফায় শুয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে রিমোট নিয়ে টিভি ছেড়ে দিয়ে ফুলির দিকে ফিরে গল্প করতে লাগল। টিভিতে গান চলছে তনু উপুড় হয়ে শুয়ে দু’পা নাচাতে নাচাতে স্কুলের গল্প করে যাচ্ছে।

–‘আচ্ছা ফুলি আপা তুমি পড়াশোনা করলে না কেন? স্কুলে কত মজা হয় তুমি জানো? আর পড়াশোনা ছাড়া তো জীবনে কিছু করাও যায় না।”

ফুলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার জীবনের কষ্টের কথা তনুকে বলে,

–‘আমার কী আর লেখাপড়ার কপাল আছে গো? ওই কপাল নিয়া আমি জন্ম নেই নাই। ছয় ভাই বইনের অভাবের সংসারে জন্ম নিছি। বাপ মা সহ মোট সদস্য আট জন। সবার ভরণপোষণ, খাওয়োন নিয়াই টানাটানি। তুমি আবার লেখাপড়ার কথা কও! খালি পেটে লেখাপড়া ভাল্লাগবো? নাকি খালি গায়ে? আমি পরিবারের তিন নাম্বার সন্তান। আমার বড় দু’জনও মানুষের বাড়িতে কাম করে। আমরা বড় তিনজন কাম করে ছোট তিনজনের লেখাপড়ার খরচ চালাই। আব্বাও কম খাটে না। এইসব দুঃখের কথা তোমরা বুঝবা না বইন। এমনিতে কী লোকের বাড়িতে কাম করতে আইছি? আমাদের কী লেখাপড়া করার শখ ছিল না? পেটের কষ্টের কাছে সব স্বপ্ন মাটি দিছি বইন। দুইটা ভালো খাইতে পারি, দুইটা ভালো পরতে পারি। মাস শেষে বাড়িতে বাপ মা’র কাছেও কিছু পাঠাইতে পারি। এতেই আমার সুখ।”

ফুলি আপার কথা শুনে তনুর চোখ দিয়ে পানি চলে আসছে। অথচ ফুলি আপা কত অবলীলায় বলে যাচ্ছে। একটুও কষ্ট হচ্ছে না যেন। আল্লাহ সবাইকে বড়লোক দিলো না কেন? নয়তো সবাইকে গরীবই দিত। একজনকে বড়লোক, একজনকে গরীব দিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছেন তিনি। কেউ বেশি পেয়ে সেটার মর্ম বুঝে না। আর কেউ না পেয়ে কষ্ট পায়। তনু কথা ঘুরিয়ে নিল। বলল,

–‘তুমিও তো কম সুন্দরী না ফুলি আপা। তুমি কয়টা প্রেমপত্র পেয়েছ? কত সুন্দর করে সেজে বাজারে যাও তুমি। নিশ্চয় অনেকে চোখ টিপ দেয়। কেউ একজনের কথা বলো না ফুলি আপা। আমি কিন্তু আমার সব কথা তোমাকে বলি।”

ফুলি যেন লজ্জা পেল। গাল লাল করে বলল,

–‘কত জনেই তো ভালোবাসার কথা কইতে আহে। আমিই পাত্তা দেই না। এসব করা ভালা না গো।”

তনু আগ্রহী হয়। ফুলি আপাকে খেপায়।

–‘ওমা! কে বলল ভালো না। প্রেম ভালোবাসাকে তুমি খারাপ বলছো? আমি তো প্রথম সুযোগেই প্রেমে পড়ে যাব। কিন্তু আফসোস কোন ছেলেই তো আজ পর্যন্ত আমার সামনে প্রেমের কথা বলতে আসলো না।”

–‘ফুলি কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোকে। কানে কথা যায় না। অবশ্য যাবে কীভাবে? ফালতু আলাপে ব্যস্ত আছিস।”

ইহানের গলা শুনে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে তনু। পাজামা উপরে উঠে গিয়েছিল। ঝুঁকে টেনে নামানোর চেষ্টা করে তনু। ফুলি ভাইজানকে দেখে উঠে দাঁড়ায়।

–‘সরি ভাইজান। সত্যই আপনার ডাক শুনি নাই।’

ইহান কখন এসেছে কে জানে। কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে? তনুর বলা সব কথা শুনে নিয়েছে নাকি? হায় কী লজ্জা! তনু কখনও মুখ দেখাতে পারবে ওই বজ্জাতের সামনে? এমনিতেই তনুকে ও অভদ্র ভাবে। এবার কী ভাববে কে জানে? ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেল আজ।
ইহান তনুকে কটাক্ষ করে ফুলিকে বলল,

–‘তোকে আজেবাজে সব মানুষদের সাথে মিশতে না করেছিলাম ফুলি। দেখা যাচ্ছে আমার কথার কোন দামই দিসনি তুই। খিদে পেয়েছে আমার। খাবার টাবার কিছু থাকলে ঘরে নিয়ে আয়।”

ইহান চলে গেলে তনু মুখ বাঁকাল। রাক্ষস একটা। সারাদিন খালি খাই খাই। তনুর কিছুটা মন খারাপ হলো। ইহান ভাই তার সাথে এরকম আচরণ করে কেন? ইহানের বাজে আচরণের মানে খুঁজে পায় না সে। কোন কারণ ছাড়া শুধু শুধু তাকে দেখতে পারে না!

–‘ফুলি আপা ইহান ভাই আমাকে দেখতে পারে না কেন? আমাকে না দেখতে পারার পেছনে কারণটা কী? উনাদের বাড়িতে আছি বলে এরকম ব্যবহার করে?”

ফুলি সাথে সাথে মাথা নেড়ে আপত্তি জানায়। সে তো জানে ভাইজান কেমন মানুষ। শুধু যে কেন তনুর সাথেই এমন করে, কে জানে?

–‘না, না তনু। ভাইজান ভীষণ ভালো মানুষ। আমি যে এই বাড়ির কাজের লোক তবুও ভাইজান আমারে কোনদিন ধমক দিয়া একটা কথা কয় নাই। খালি যে তোমার লগে কেন এমুন করে আল্লাহ মাবুদ জানেন।”

তনুও রাগ করে বলল,

–‘তোমার ভাইজান ভালো মানুষ না ছাই। আস্ত বদ লোক। হাড় বজ্জাত। পেটে পেটে শয়তানি। শিরা-উপশিরায় শয়তান নাচানাচি করে। মিচকা শয়তান একটা। ওদের বাড়িতে আছি বলেই এত দাম দেখায়। ওর দাম দেখতে আমার বয়েই গেছে। ফুপু আম্মা এত ভালো মানুষ। উনার পেট থেকে একটা মিচকা শয়তানের পয়দা হলো। খবিশ!”

চলবে🍂

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা
5/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here