#সুখের_পাখি
২৯
ইহান কেমন যেন তনুকে এড়িয়ে চলছে। তনু বেশ বুঝতে পারছে ইহানের কিছু তো হয়েছে। সামনে দেখলেও না দেখার মতো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। মেসেঞ্জারেও কথা বলছে না। তনু নিজে থেকেই মেসেজ দেয়। কিন্তু ইহান রিপ্লাই দেয় না। তনুর কান্না পায়। ইহান ভাই এমন অদ্ভুত কেন? কেন এমন করে ওর সাথে? তনু কী করেছে? ওর কোন দোষে ইহান ভাই তাকে এরকম শাস্তি দিচ্ছে। তনুর মন খারাপ থাকলেও সে ঘরে বসে থাকতে পারে না। সাদাফ পুরোটা দিন তাকে মাতিয়ে রাখে। এই বাইরে থেকে একগাদা খাবার নিয়ে ফিরে। ফুচকা, চটপটি, আইসক্রিম। কতকিছু। বিকেল হলেই বসার ঘরে ক্যারাম খেলার আড্ডা বসে। সেই আড্ডায় কখনও সখনও ইহান আসে। বেশির ভাগ সময়ই আসে না। নিজের ঘরে একা থাকে। বাড়ির সবাই কত মজা করে। সাদাফ জোর করেও ইহানকে আনতে পারে না। আজ ফুলির অনুরোধ রাখতে ওরা লুডু খেলছে। ফুলি ক্যারাম খেলতে পারে না। তনুর দান এলে সাদাফ হেসে বলল,
–‘এবার তোমার পালা তনু। একটা চার উঠলেই আমরা জিতে যাব। দেখা যাক তোমার ভাগ্য কতটা ভালো।’
ফুলি ভয়ে ভয়ে বলল,
–‘তনুর যা কপাল! আমার তো ভয়ই লাগতাছে। কেন যে বাজি ধরতে গেলাম। আমার দলে ভাইজান থাকলে ভালো হইতো। ভাইজান কোনোদিন হারে না। তনুর মতই ভাইজানেরও চান কপাল।’
তনুর চার উঠল না। উঠল তিন। সাদাফের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে গেল,
–‘ইশ! আর একটুর জন্য।’
তনুর খেলার দিকে মন নেই। সে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। ইহান ভাই কি আজ একটা বারের জন্যও নিচে আসবে না? তনু মনে মনে ভীষণ সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।
–‘ইহান ভাই না আসুক। আজ আমিই উনার কাছে যাব। উনাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করব, কী সমস্যা উনার? কেন এরকম করেন?’
সাদাফের ডাকে তনু ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। ভালো লাগছে না কিছু। সাদাফ ভাই বড় ভালো মানুষ। ডাকলে আসতেই হয়। উনার কথা ফেলা যায় না। নইলে তনু আজ ঘরেই শুয়ে থাকতো। মন ভালো না থাকলে কোনো কিছুই ভালো লাগে না। কিসের লুডু খেলা! আর কিসের ফুচকা খাওয়া!
রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে তনু ইহানের ঘরে যাবে। সবাই না ঘুমানো পর্যন্ত কিছু করা যাবে না। খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেলে সাবিনা তনুকে নিজের ঘরে ডাকল। তনু বাধ্য মেয়ের মত ঘরে গিয়ে সাবিনার পানের বাটা নিয়ে বসল।
–‘তোমাকে তো পান খেতে দেখি না। তবুও ঘরে পান রাখো কেন?’
–‘মাঝে মাঝে খাই।’
–‘আজ আমি একটু খাই?’
–‘খাবি? আচ্ছা খা একটা। জর্দা দিয়ে খাস না। মাথা ঘুরাবে।’
–‘হু।’
তনু বড় একটা পান নিল। কয়েকটা সুপারি, সামান্য একটু জর্দাও নিল। আরও কয়েক কোটায় পানের সাথে খাওয়ার নানারকম মসলা আছে। তনু ওসব কিছুই নিল না। আঙুলের ডগায় চুন নিয়ে পান পাতার মাঝখানে একটু চুন ঘষে পানটা সুন্দর করে ভাঁজ করে মুখে পুরে নিল। সাবিনা এক ধ্যানে তনুকে দেখতে লাগল। তনুকে দেখে তার মুগ্ধতা শেষ হয়না। সেদিন বাবার সাথে ছোট্ট মেয়েটা ওর বাড়িতে এসেছিল। দেখতে দেখতে মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। আজ ওরই বিয়ের কথা উঠছে। সাবিনা কোনোদিনও কল্পনাও করেনি রাশেদা আপা সাদাফের জন্য তনুকে চেয়ে বসবে। তনুটার বয়স এবার কত হলো? সতেরো? হ্যাঁ, সতেরোই তো হলো। এই মেয়ে টেন এ প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষায় ফেল করে বাড়ি এসে সে কী কান্না! সাবিনা ওকে সান্ত্বনা দিয়েছিল। ইহানের কাছে পড়তে পাঠিয়েছিল। এই তনুই এসএসসিতে অত ভালো একটা রেজাল্ট নিয়ে পাস করে বেরিয়েছে। কয়েক মাস ধরে কলেজে যাচ্ছে। এখনই ওর বিয়ের কথা তোলা কি ঠিক হবে? তনু আবার এটা ভাববে না তো, ওকে মাথার বোঝা ভেবে তাড়াতাড়ি বিদায় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কেউ না জানুক, সাবিনা তো জানে তনু ওর আপন ভাইয়ের মেয়ে না হলেও আপনের থেকে কমও না।
সাদাফ ভালো ছেলে। ছোট থেকে ওকে চোখের সামনে দেখে আসছে। তনুকে অনেক ভালো রাখবে ও। ছেলেটা ওর জন্য পাগল। সাদাফের সাথে তনুর বিয়ে দিয়ে দিলে তনু এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। এটা ভাবতেই সাবিনার চোখে পানি চলে আসছে। নরম গলায় তিনি বললেন,
–‘তনু!’
তনু মুখ ভরা পানের পিক নিয়ে তোতলিয়ে তোতলিয়ে বলল,
–‘পিক কোথায় ফেলব? নাকি খেয়ে ফেলব?’
–‘বেসিনে ফেলে আয়।’
–‘হু।’
তনু ছুটে গেল। সাবিনা ওর পাছে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পাগলী মেয়ে। আবার ফিরে এলো তনু। ওর পান চিবোনোর ভঙ্গিটা সুন্দর লাগছে। সাবিনা বলল,
–‘তুই এত সুন্দর করে পান খাওয়া কোত্থেকে শিখলি রে তনু?’
–‘সুন্দর হচ্ছে নাকি? আমি তো আজই জীবনের প্রথম পান খাচ্ছি। আগে কখনও তো খাইনি।’
–‘ওহ।’
সাবিনা ভেবে পাচ্ছে না সাদাফের কথা তনুকে কীভাবে বলবে। কীভাবে বললে তনু ওকে ভুল বুঝবে না। সাবিনা রাশেদা আপাকে কোন প্রকার কথা দেয়নি। আপার প্রস্তাবে সে বলেছে,
–‘তনুর মতামত না নিয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না আপা। ও আমার আশ্রয়ে থাকছে ঠিক আছে। তাই বলে আমি ওর উপর কোনোকিছু চাপিয়ে দিতে পারব না। বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার তো না-ই। আগে তনুকে জিজ্ঞেস করি। দেখি ও কী বলে। তারপর আমি আপনাকে জানাব। তনু রাজি না হলে কিন্তু আপা আমি ওকে জোর করতে পারব না। ওর জীবনের সিদ্ধান্ত আমি ওর হাতেই ছেড়ে দিতে চাই।’
উত্তরে রাশেদাও একই কথা বলেছে,
–‘হ্যাঁ তনুর মতামতই সবচে বেশি গুরুত্ব রাখে। ওর জীবনের সিদ্ধান্ত ওর হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমরা কেউ ওকে জোর করব না। সাদাফও এই কথাই বলছিল।’
–‘তনু!’
–‘হুম। বলো।’
–‘তোর জীবনের পরিকল্পনা কী? মানে পড়াশোনা শেষ করে কী করতে চাস তুই। কী হতে চাস? জব নাকি বিয়েশাদি কোনটা?’
–‘পরিকল্পনা? আমি না ঠিক বুঝতে পারি না কী হতে চাই আমি। একেক সময় একেক পেশা টানে। তবে আমার সবথেকে বেশি যেটা ভালো লাগে, আমি ডাক্তার হবো। বাবারও এটাই স্বপ্ন ছিল। বাবার স্বপ্ন কতটুকু পূরণ করতে পারব জানি না। তবে আমি চেষ্টা করব।’
–‘মাশাআল্লাহ। ডাক্তার হতে চাস এটা তো ভালো কথা। ধর তুই ডাক্তার হয়ে গেলি। তারপর কী করার চিন্তাভাবনা আছে।’
–‘ডাক্তার হওয়ার পর? আল্লাহ যদি আমাকে তৌফিক দেন তাহলে ডাক্তার হওয়ার পর, গরীব মানুষদের সেবা করব। পারলে নিজে একটা হাসপাতাল করব। ওখানে বিনা পয়সায় গরীব-দুঃখী মানুষদের চিকিৎসা করা হবে।’
তনুর স্বপ্নের কথা শুনে সাবিনার নিজের জীবন নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করছে। সংসার সংসার করে সে কী পেল? তার থেকে ভালো হতো অন্যের পাশে দাঁড়াতে পারলে।
–‘হুম। তারপর?’
–‘তারপর। তারপর আর কি?’
–‘বিয়েশাদি। স্বামী সংসার। ছেলেমেয়ে। ওসব নিয়ে কিছু ভাবিসনি? জীবনে বিয়ে ছাড়াই থাকবি নাকি?’
তনু একটু লজ্জা পেল। মনে মনে বলল,
–‘তোমাকেই তো শাশুড়ি বানাতে চাই। তোমার ছেলেটাই তো কিছু বুঝে না। ও এরকম করলে কীভাবে দাদী বানাব তোমাকে বলো? ছেলেটাকে একটু বুঝাও না শাশুড়ি মা।’
সাবিনা আগ্রহ নিয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে তনু বলল,
–‘বিয়ে তো করতেই হবে।’
–‘হুম। আচ্ছা কেমন ছেলে তোর পছন্দ? কোন ধরণের ছেলেকে স্বামী হিসেবে আশা করিস?’
–‘পাগলাটে ধরণের। পুরোপুরি পাগল না। হালকা পাগল। মানে ৫০% পাগলাটে ৫০% সুস্থ।’
মুখ ফসকে চট করে বলে ফেলল তনু। সাবিনা ওর কথা শুনে শব্দ করে হাসতে লাগল। তনু মনে মনে নিজেকে গালি দিল। ভাগ্য ভালো ফুপু আম্মা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। নইলে তার ছোট ছেলেই যে এমন এটা বুঝে ফেললে তনুর সব ফাঁস হয়ে যেত।
–‘পাগল মেয়ে। তুই নিজে পাগল বলে বরও পাগল খুঁজবি? দুই পাগলে সংসার চলবে কীভাবে? একজনকে তো ভালো হতে হবে।’
সাবিনার হাসি থামলে তনু বলল,
–‘তাহলে তুমিই আমার জন্য একটা ভালো বর খুঁজে দিও।’
–‘তা তো দিবই। কিন্তু আমার খুঁজে আনা বর কি তোর পছন্দ হবে?’
–‘হবে না কেন? খুব হবে।’
–‘আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে আমাকে বল তো কেমন বর পেলে তুই খুশি হবি? এখন থেকেই তেমন ছেলে খুঁজতে শুরু করে দিব।’
–‘আমার বর! লম্বা, ফর্সা, হ্যান্ডসাম না হলেও চলবে। আবার আমার থেকেও খাটো, কুচকুচে কালো, মোটা হলেও চলবে না। মানে, সে কেমন হবে তুমি বুঝে নাও৷ আমি বুঝাতে পারব না।’
সাবিনা হাসছে।
–‘সাদাফের মতো হলে চলে তো?’
তনু এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল। মনে মনে অনেক কিছুই বুঝে নিলেও চেহারায় প্রকাশ করল না। ফুপুকে বুঝতে না দিয়ে হেসেই বলল,
–‘সাদাফ ভাই তো ভালোই। তবে উনার একটা সমস্যা আছে।’
সাবিনা অবাক হলো। এই মেয়ে সারাদিন সাদাফ ভাই, সাদাফ ভাই করে মরে। এখন বলছে তারও নাকি সমস্যা আছে।
–‘কী সমস্যা শুনি।’
–‘সাদাফ ভাই অতিরিক্ত ভালো মানুষ। এত ভদ্র মানুষ আমার পছন্দ না। কোন রাগ নেই। ছেলেমানুষ একটু রাগী, কড়াকড়ি না হলে কেমন লাগে। মেয়েদের মত সারাক্ষণ হাসে। মুখ থেকে হাসি সরেই না। উনাকে আমি কড়া করে একটা কথা বলতে দেখিনি।’
সাবিনা আবার হো হো করে হাসতে লাগল। এই মেয়ের সত্যি সত্যিই মাথায় সমস্যা আছে।
–‘তোর ইহানের মতো রাগী কাউকে লাগবে নাকি? ইহান কিন্তু ভীষণ রাগী। হাসির খুব বড় কারণ না হলে হাসে না। হুটহাট রেগে যায়। আমার তো মনে হয় রাগ ওর নাকের আগায় থাকে। তোর সাথেও তো কয়েকদিন কড়া কথা বলেছে। এমন ছেলে খুঁজব? অত কড়াকড়ি সামাল দিতে পারবি?’
তনু বিড়বিড় করে বলল,
–‘পারব। তুমি আমাকে তোমার ছেলেটাকে দিয়ে দাও। আমি ওর রাগ, কড়াকড়ি, বকাবকি সব সহ্য করতে পারব। একটুও অভিযোগ করব না৷ কোনোদিনও না।’
#সুখের_পাখি
৩০
ঘড়ির কাটা ঠিক একটার ঘরে। নিশুতি রাত। বাড়ির সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ারই কথা। এত রাতে কেউ জেগে থাকবে না। শুধু তনু জেগে আছে। তার চোখে ঘুম নেই। মাথায় অনেক চিন্তার ভীড়। মনে একঝাঁক প্রশ্ন। আজ সব উত্তর নিয়ে ফিরবে সে। আজ হয়তো তার মনের অনুভূতির দাফন হবে। নইলে ইহান ভাইকে নিয়ে নতুন স্বপ্নে ভাসবে। ইহান ভাইকে বলতেই হবে, কী চায় সে। তনু বাইরে বেরিয়ে নিঃশব্দে দরজা ভেজিয়ে দিল। পা টিপেটিপে বারান্দা দিয়ে হাঁটতে লাগল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে কোন গাছে বসে অচেনা এক পানি করুণ কন্ঠে ডেকে যাচ্ছে। তনুর আজ একটুও ভয় হচ্ছে না। ফুপু আম্মা সরাসরি তাকে বলতে না পারলেও ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে সাদাফ ভাইয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে চায়। ফুপু আম্মা যদি এমনটা চায় তাহলে তনু না করতে পারবে না। ফুপু আম্মা তাকে আগুনে ফেলে দিতে চাইলেও তনু প্রতিবাদ করবে না। বরং ফুপু আম্মার কথা রাখতে হাসি মুখে আগুনে ঝাপ দিবে।
তনুর জানা দরকার ইহান ভাইয়ের মনে তার জন্য কিছু আছে কি-না। না থাকলে তনু নিজেকে স্রোতে ভাসিয়ে দিবে। জীবন যেদিকে মোড় নিতে পারে। আর যদি ইহান ভাইও তাকে ভালোবাসে তাহলে তনু মরে গেলেও সাদাফ ভাইকে বিয়ে করবে না। দরকার পড়লে ফুপু আম্মার পায়ে ধরে কেঁদেকেটে বিয়ে ভাঙতে বলবে। ছাদের দরজায় এসে তনু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। বুক ভরে দম টানল ও ছাড়ল। ইহান ভাই কি এখনও জেগে আছে? নাকি ঘুমিয়ে গেছে? অত রাতে কি জেগে থাকার কথা? ঘুমিয়ে পড়াই তো স্বাভাবিক। তনু শব্দহীন পায়ে হেঁটে ইহানের ঘরের সামনে চলে এলো। ইহান ভাই ঘুমিয়ে থাকলেও দরজা খোলাই থাকবে। দিন হোক বা রাত, কোন কারণে ইহান ভাই দরজা আটকায় না তা তনু জানে না। তনু খোলা দরজা পেয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ঘর অন্ধকার। মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু নাকে একটা গন্ধ লাগছে। সিগারেটের গন্ধ! হ্যাঁ। তনু লক্ষ করল পেছনের দিকের ছোট্ট ব্যালকনিতে ছোট্ট একটা আগুনের ফুলকি একবার উপরে উঠছে পরক্ষণে আবার নামছে। ইহান জেগে আছে। এত রাতেও সিগারেট খাচ্ছে সে। তনু অন্ধকারে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে নিজেও জানে না। ইহান যেন বুঝতে পারল। মনের সন্দেহ দূর করার জন্যই হয়তো ডাকল,
–‘কে, তনু? তনু এসেছ?’
ইহান ভাইয়ের কন্ঠে নিজের নাম শুনে তনু হকচকিয়ে গেল। সে কোন আওয়াজ করেনি। অন্ধকারে তাকে দেখতে পাবারও কথা না। মানুষটা তার অস্তিত্ব কীভাবে টের পেল! কীভাবে বুঝল সে ঘরে এসেছে? মনের টান! উঁহু। তাহলে?
–‘কে?’
তনু ভীতিগ্রস্ত গলায় বলল,
–‘আমি।’
ইহান হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল। এগোতে গিয়ে টেবিলের কোনায় পা বেজে হুঁচট খেল। ব্যথা পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেদিকে ধ্যান দিল না সে। অন্ধকার হাতড়ে লাইট জ্বালিয়ে দিল। পায়ের আঙুলের নখ উলটে গেছে। কলকলিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। তা নিয়ে ইহান মাথা ঘামাল না। রক্তচক্ষু নিয়ে তনুর দিকে তাকাল। তনুর মুখের চেহারা নির্বিকার হলেও তার ভেতরে ভেতরে কোন ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা শুধু সে-ই জানে। কর্কশ গলায় ইহান জানতে চাইল,
–‘এত রাতে আমার ঘরে কী করো তুমি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?’
তনুর হাত পা কাঁপছে। কথা বলতে গিয়ে অনুভব করল গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারছে না। কপালের ঘাম গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
–‘কথা কানে যায় না! নিজের ঘরে যাও তনু, প্লিজ। তুমি নিজের সম্মানের কথা ভাবো না! কেমন মেয়ে তুমি?’
–‘আপনার সাথে আমার কথা আছে।’
–‘তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না আমি। ঘরে যাও তুমি।’
–‘আমি বলেই যাব। নইলে যাব না।’
–‘যাবে না! ডর ভয় নেই তোমার! আশ্চর্য!’
–‘ভয় পাব কেন আমি? আমি কি কোনো অন্যায় করছি?’
–‘মাথা খারাপ মেয়ে, অন্যায় করছো না কী করছো বুঝো না তুমি? মাথায় ঘিলু নেই?’
–‘আপনি আমার কথা শুনবেন না তো?’
–‘তোমার তো সাহস কম না। রাত কয়টা বাজে জানো তুমি?’
–‘জানি। ঘড়ি দেখেই ঘর থেকে এসেছি।’
তনুর একরোখা উত্তরে ইহান হতভম্ব। এই মেয়ে আজ কেলেঙ্কারি না ঘটিয়ে যাবে না। রাগ দেখিয়েও কোন লাভ হবে না ইহান বুঝে গেছে। এর কথা শুনতেই হবে।
–‘আচ্ছা, কী বলার জন্য এসেছ তাড়াতাড়ি বলে আমার ঘর থেকে দূর হও।’
তনু স্থির দৃষ্টিতে ইহানের চোখের দিকে তাকাল। ইহানও চোখ সরিয়ে নিতে পারল না। তনুর চাহনিতে কষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বেদনা লুকিয়ে আছে।
–‘আপনি জানেন সাদাফ ভাই এবাড়িতে কেন এসেছে?’
–‘কেন আসবে আবার? মামার বাড়ি। বেড়াতে এসেছে।’
তনু কী বলতে চায় তা ইহানের অজানা নয়। তবুও সে বুঝেও না বোঝার ভান করে যাচ্ছে।
–‘না। সাদাফ ভাই পাত্রী দেখতে, মানে আমাকে দেখতে এসেছে। আপনি হয়তো এটাও জানেন না ফুপু আম্মা আমাকে সাদাফ ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে চায়।’
ইহান অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না। তনুর চোখের দিকে তাকিয়েই রইল। তনুর চোখে পানি টলমল করছে। ইহানের যেন এই খবরে কিছুই এসে যায় না। গলার স্বরে আগ্রহ ফুটিয়ে বলল,
–‘সত্যি! ভালোই তো তাহলে। সাদাফ ভাই ছেলে হিসেবে খারাপ না। তুমি তো তাহলে আমার ভাবি হয়ে যাবে।’
টুপ করে তনুর চোখ থেকে একফোঁটা পানি পড়ে গেল। ইহান দেখেও চোখ সরিয়ে নিল।
–‘এসব শুনেও আপনার কিছু বলার নেই?’
–‘আছে। তোমার তো এখনও আঠারো বছর হয়নি। সাদাফ ভাই বিয়েটা কি এবছরই করে ফেলতে চায়? এখন বিয়ে হলে তোমার পড়াশোনার উপরে চাপ পড়বে না? সবকিছু ম্যানেজ করতে পারবে তুমি তনু?’
ইহানের এসব রঙঢঙের কথা শুনে তনু রাগে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।
–‘আপনি কি এখনও বুঝতে পারছেন না এত রাতে এই কথাগুলো কেন আমি আপনাকে বলতে এসেছি। নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছেন? আপনি এতদিনেও আমার মনের কথা একটুও বুঝতে পারেননি! এতই অবুঝ আপনি? আমি পাগল হয়ে আপনার কাছে ছুটে এসেছি। আর আপনি ফালতু কথা বলে যাচ্ছেন। পড়াশোনা, পড়াশোনা, পড়াশোনা! চুলোয় যাক পড়াশোনা। আমার পড়াশোনা নিয়ে আপনাকে অত ভাবতে হবে না।’
গলা ধরে আসায় থামল তনু। ইহান নির্লিপ্ত চোখে তনুকেই দেখে যাচ্ছে।
–‘আমি আপনাকে ভালোবাসি ইহান ভাই। শুধু আজ থেকে না। সেই প্রথম দিন থেকে। যেদিন প্রথম আপনাদের বাড়িতে এসেছিলাম। আপনি দরজা খুলে দিয়েছিলেন। মনে আছে আপনার? এতগুলো দিন ধরে আমি মনে মনে আপনাকে ভালোবেসে যাচ্ছি। কত ভাবে, কত কায়দায় আপনাকে বুঝাতে চাইছি। আপনি বুঝতেই চান না। কেন? কেন ইহান ভাই? আমি দেখতে ভালো না? আমাকে পছন্দ করা যায় না? আমি খাটো বলে আপনার অসুবিধা? নাকি পড়াশোনায় আপনার মত ভালো না বলে? আমাকে কেন ভালোবাসা যায় না বলুন। আপনার জন্য আমি ডরভয়, লাজলজ্জার মাথা খেয়েছি। আর আপনিই এমন নির্বিকার। আমাকে কষ্ট দিতে আপনার ভালো লাগে? এইযে আমি কাঁদতেছি, আমার চোখের পানি দেখে আপনার আনন্দ লাগছে? এমন পাষাণ মানুষ কেন আপনি?’
দু’জনই চুপ। মাঝে মাঝে শুধু তনুর ফোঁপানোর শব্দ আসছে। তনু মেঝেতে বসে কাঁদছে। ইহানের দৃষ্টি ওর উপরই নিবদ্ধ।
–‘ঘরে যাও তনু।’
তনু চুপ করে থাকল। ইহান আবার বলল,
–‘যা বলতে এসেছিলে তুমি বলেছ। আমিও শুনেছি। এবার যাও। কেউ দেখে ফেললে ব্যাপারটা ভালো হবে না।’
তনুর চোখ ধক করে জ্বলে উঠল। ক্রোধিত গলায় বলল,
–‘আপনি পুরুষমানুষ! পুরুষ মানুষ হয়েও এত ভীতু কেন আপনি?’
–‘আমি ভীতু না। আবার তোমার মত দুঃসাহসীও না।’
–‘আপনি একটা ভীতুর ডিম।’
–‘হুম। ঘরে যাও এবার।’
–‘আপনার ঘরে থাকতে আসিনি আমি।’
–‘তাহলে যাচ্ছ না কেন?’
–‘আমি উত্তর চাই।’
–‘আবার কী উত্তর?’
–‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন না?’
–‘তুমি আমার তুলনায় নিজেকে দেখেছ? এই বয়সে আমার সামনে এসে ভালোবাসার কথা বলতে লজ্জা লাগছে না তোমার? তোমার বিয়ের বয়স হতে হতে আমি এক মেয়ের বাপ হয়ে যাব।’
–‘আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন আপনি?’
–‘হুম।’
–‘কেন?’
–‘কেন আবার কী?’
–‘সত্যিই ভালোবাসেন না আমাকে?’
–‘উঁহু।’
–‘আমি সাদাফ ভাইকে বিয়ে করে নিলে আপনার কষ্ট হবে না?’
–‘না।’
–‘সত্যিই তো এই বিয়েতে আপনার কোন আপত্তি নেই?’
–‘থাকার তো কথা না।’
–‘আমি সাদাফ ভাইকে বিয়ে করতে রাজি হলে আপনি খুশি হবেন?’
–‘হুম। তবে বিয়ের পর এরকম ভাই ভাই বলো না। শুনতে খারাপ লাগবে।’
–‘আপনি এসব কথা মন থেকে বলছেন? মজা করছেন না তো?’
–‘এবার কিন্তু তুমি আমাকে বিরক্ত করছো তনু। আমি কখনও তোমার সাথে মজা করেছি যে, আজ করব?’
তনু শেষ একটা আশা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু যাবার সময় সব অনুভূতি মাটি চাপা দিয়ে যাচ্ছে। ইহান ভাই আজকের পর থেকে তার কেউ না। যে মানুষটা তার সাথে এতটা কঠিন আচরণ করতে পারে সে মানুষ কখনও ওকে ভালোবাসতে পারে না। সে-ই পাগল ছিল। এই মানুষটাকে সে মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসেছিল! এই মনহীন নিষ্ঠুর পাথরকে! তনু চলে যাবার পর ইহান পায়ের নখের দিকে দেখল। এখনও রক্ত পড়ছে। এরকম রক্তক্ষরণ কি তার মনে হচ্ছে না? ভেতরটা কি ভেঙেচুরে চুরমার হচ্ছে না? কথাগুলো বলার সময় একবারও কি তার গলা ধরে আসেনি? ইহান সিগারেট ধরাল। ধোঁয়ায় নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগল।
সকালে তনুর ঘুম ভাঙতে অনেক বেলা হয়ে গেল। হবে না-ই বা কেন? রাতে কি ঘুমোতে পেরেছে সে? আর ঘুমালেও কখন ঘুমিয়েছে। সেই ভোরের দিকে। ইহানের ঘর থেকে ফিরে এসে বাকিটা রাতই তো কেঁদে ভাসিয়েছে তনু। একটু কাঁদলেই এত মাথা ব্যথা হয়! এখন উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। সাদাফ তনুকে দেখার অপেক্ষাতেই বসে ছিল। ধীর পায়ে তনু হেঁটে আসে। ফুলি ওকে দেখেই বলে উঠে,
–‘ও তনু! কী হইছে তোমার? চোখ মুখ এমন ফোলে আছে কেন? কাঁনছো নাকি তুমি?’
তনু জোর করে হেসে বলল,
–‘তুমি যে কী বলো না ফুলি আপা! কাঁদব কেন আমি? আমাকে কি তোমার ছিঁচকাঁদুনে মনে হয়?’
সাদাফ তনুকে দেখল। উঁহু, ফুলি ঠিকই ধরেছে। তনু কোন কারণে কেঁদেছে। ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এখন তনুর মিথ্যা বলার কারণ সাদাফ বুঝতে পারল না। কিন্তু তাকে আর প্রশ্নও করল না। উল্টো ফুলিকে চুপ করিয়ে দিল,
–‘ফুলি তোমার চোখের সমস্যা হয়েছে বুঝলে। কোথায় কেঁদেছে তনু? ওকে তো প্রতিদিনকার মতই লাগছে।’
সাদাফ তনুর দিকে ফিরে বলল,
–‘গুড মর্নিং তনু। চা খাবে?’
–‘চা আমার তেমন ভালো লাগে না।’
–‘কী বলো এসব! তুমিই মনে হয় একমাত্র মেয়ে যার চা পছন্দ না।’
তনু হাসল। সাদাফ ভাই কত কায়দা করে তার সাথে কথা বলে। তাকে ইমপ্রেস করতে কত কৌশল খাটাচ্ছে বেচারা। তবুও তনুর ওকে পছন্দ না। তার পছন্দ সেই কাঠখোট্টা বদমেজাজি থ্রী কোয়ার্টারকে। পছন্দ হলেও এখন তনু আর ওকে নিয়ে ভাববে না। কাল রাতে ইহান ভাই সব শেষ করে দিয়েছে।
চলবে🍁
#জেরিন_আক্তার_নিপা