তোলপাড় পর্ব ৪৫

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৪৫

প্রায় তিন-চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেল।সময় যেন অতি দ্রুত চলে যাচ্ছে।অরূণীর প্রতি রন্ধ্র রন্ধ্র আনন্দে পুলকিত হচ্ছে।বার বার চোখ জলে ছাপিয়ে ওঠছে। উত্তেজনায় গলা কাঁপছে। রুদ্রর প্রতি রাগ, অভিমান সব ভুলে গেছে।কত প্রতীক্ষিত সময়! এই আনন্দ,এই আবেগের কোনো ব্যাখ্যা হয় না। দুইজনের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ছে। রুদ্র একটার পর একটা কথা বলে যাচ্ছে। আর অরূণী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। রুদ্র বলল, “অরূণী তুমি কিছু বলছো না কেন?মাঝে মাঝে তীব্র ইচ্ছা হতো ফোন দিই তোমার কাছে,কথা বলি। নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত করতাম। আসলে কি জানো অরূণী,কিছু কিছু ভালোবাসা একদম নিখাদ হয়।দূর থেকেও অনুভব করা যায়। আমাদের ভালোবাসা খুব মজবুত অরূণী। ভালোবাসা এমনই হওয়া উচিত।”
রুদ্রর গলা কেমন ভারী হয়ে গেল।দুই বছর পর প্রিয় মানুষটার সাথে দেখা হওয়ার আনন্দে গলা ছলছল করে ওঠছে। এই পর্যায়ে রুদ্র হঠাৎ হেসে ফেলল, “তোমার সাথে পরিচয়ের প্রথম দিন গুলোতে ভেবেছিলাম তোমার মাথায় গণ্ডগোল আছে বোধ হয়।না, এখন মনে হচ্ছে তুমি প্রেমিকা হিসেবে দারুণ,ভীষণ দারুণ।যাকে ভালোবাসা যায়,হাজার হাজার বছর ধরে ভালোবাসা যায়।”
অরূণী খুশিতে আকাশ-বাতাস ভুলে আহ্লাদি গলায় বলল, “এত প্রশংসা করলে সত্যি এখন মাথায় গণ্ডগোল হয়ে যাবে।”
অরূণী একটু থেমে আবার উদাস গলায় বলল, “আপনাকে ছাড়া আমার কষ্ট হয়েছে। কষ্টের পরিমাণ কিংবা তীব্রতার ব্যাখ্যা করতে পারবো না।”
রুদ্র বুঝতে পারলো আবার অরূণী কেঁদে ফেলবে। দ্রুত নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে ফেলল অরূণী। চোখের কোণে জমানো জলটুকু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে দিলো।
– “আমি প্রতিদিনই তোমার খোঁজ নিতাম।”
– “প্রতিদিন খোঁজ নিতেন তা জানতাম না। কিন্তু খোঁজ নিতেন তা জানতাম।”
– “কীভাবে জানতে?”
অরূণী উত্তর না দিয়ে চুপ মেরে রইলো। রুদ্র নিচু গলায় বলল, “অরূণী আমি কি অন্যায় করে ফেলেছি যোগাযোগ না করে?”
– “উঁহু। ভালো করেছেন।”
অরূণী একটু হাসার চেষ্টা করলো।আবার কিছুক্ষণ নীরব ভাবে কাটলো। নীরবতা বিলীন করে অরূণী জিজ্ঞেস করল, “বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিলেন হুট করে!”
রুদ্র খানিক চমকে ওঠলো। এত শত কথার স্রোতে অরূণীদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর ব্যাপারটা যেন ভুলেই গিয়েছিল। রুদ্র হেসে বলল, “আমি তো ভেবেছি এই দুই বছরে তোমার আব্বার রাগ-টাগ কমেছে। আমি চেয়েছি কানাডা থেকে ফিরে তোমার সাথে দেখা না করে,প্রথমে তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিবো। তারপর তোমার ফ্যামিলি রাজি হলে একদম বিয়ের দিন তোমার সাথে দেখা করবো। কিন্তু তোমার ফ্যামিলি তো রাজিই হলো না।”
কিছুটা হতাশা রুদ্রর গলায়। অরূণীর তীব্র আফসোস হচ্ছে। ইস্! যদি অরূণীর ফ্যামিলি রাজি হতো তাহলে বিয়ের দিন দেখা হতো। অরূণী শিউরে ওঠলো এই ভাবনায়। পরক্ষণে বাস্তবে ফিরে আবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। অরূণী ক্ষীণ গলায় বলল, “আব্বা তো রেগে আগুন। ফ্যামিলি থেকে কোনো ভাবেই মানবে না।”
কথাটা বলে রুদ্রর দিকে তাকালো অরূণী। ক্লান্তি চাহনি। রুদ্র জোর গলায় বলল, “এখন আর না মানলে কিছু করার নেই। দুই ফ্যামিলিকেই সুযোগ দিয়েছি। তাঁরা তাঁদের অন্যায় সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দিবে এটা তো হবে না। পালিয়ে যাবো আমরা। দুই-চার বছরই না হয় তাঁরা সবাই আমাদের ওপর রাগ করে থাকবে। কিন্তু যখন নাত-নাতনির মুখ দেখবে তখন আর এসব রাগ-জিদ থাকবে না।”
নাত-নাতনি? অরূণীর মুখ লজ্জায় সিঁদুরে হয়ে ওঠলো। রুদ্র অরূণীর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। রমনীর লজ্জায় সিঁদুরে হয়ে ওঠা মুখটায় যেন বাড়াবাড়ি রকমের সৌন্দর্য থাকে। রুদ্র হাসি থামিয়ে কিছুক্ষণ পর বলল, “ ফ্যামিলিগত সমস্যা একদিন ঠিক হয়ে যাবে। কোনো সমস্যাই দীর্ঘস্থায়ী নয়। ক্ষণিকের এই ঠুনকো সমস্যার জন্য কত মানুষই তাঁদের ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে। ছোট্ট একটা জীবনে এত অপূর্ণতা,এত কষ্ট,এত হাহাকার কেন থাকবে বলো? ফ্যামিলি যদি তাঁদের বিবেকহীন সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়, তখন পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল না অরূণী।”
অরূণী কেমন বিষণ্ণ গলায় বলল, “আমরা তাহলে পালিয়ে যাবো?”
– “সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও যদি ব্যর্থ হই তোমার আর আমার ফ্যামিলিকে বুঝাতে তাহলে পালিয়ে যাবো।”
অরূণী আর কিছু না বলে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। পলকহীন দৃষ্টি। রুদ্রও তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণার্ত চোখ, তৃষ্ণার্ত হৃদয়। অরূণীর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না রুদ্রর বাহুডোরে ও! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে প্রচণ্ড। কতশত দিন পরে মনে প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে!

দরজায় মৃদু আঘাতে শব্দ। রুদ্রর টনক নড়ে। সব ভুলেই বসেছিলো। অরূণীও চমকে যায়।‌ কয়টা বেজেছে? হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে অরূণী। তাইতির ভাবী আর তাইতি ওদের কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে অন্য রুমে বসে ছিলো। অরূণীর মাথায় সূক্ষ্ম একটা চিন্তা জাগলো। বাসায় গিয়ে কী বলবে? রুদ্র অবাক গলায় বলল, “এ্যাই অরূণী, দেখো কয়টা বাজে। বাসায় ফিরতে হবে না তোমার? ফোনে কথা বলবো সারারাত। এখন চলো। দেখা হওয়ার আনন্দে জ্বর আসে না যেন।”
অরূণীর এখন কোথায়ও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সময়টাকে থামিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু অরূণীর সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না। রুদ্র দরজা খোলে। তাইতির ভাবী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। হেসে বলল, “তোমাদের ডিস্টার্ব করতে চাই নি। কিন্তু ডিস্টার্ব না করে উপায় নেই। দেখো কয়টা বাজে। তোমরা তো সময় জ্ঞান ভুলে বসে আছো।”
অরূণী তাইতির ভাবী দিকে এগিয়ে আসে। হাসি মুখে জড়িয়ে ধরে তাইতির ভাবীকে। আবেগ জড়ানো গলায় বলল, “ভাবী কতশত ধন্যবাদ দিবো তোমায় বলো তো?”
– “হয়েছে আর ধন্যবাদ দিতে হবে না। এখন খেয়েদেয়ে বাসায় যাও শীঘ্রই। নয়ত তোমার বাসায় সমস্যা হবে।”
রুদ্র ওদের পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। অরূণী তাইতির ভাবীকে ছেড়ে রুদ্রর উদ্দেশ্যে বলল, “দেরি হয়ে গেল।”
রুদ্র হঠাৎ কৌতুক করে বলল, “অরূণী তুমি ভাবীকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানালে। আমার জানাতে হবে না?”
অরূণী কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়। রুদ্র আবার হাসে। তাইতির ভাবীও বেশ শব্দ করে হেসে ওঠে।

অরূণী বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। বাসায় ফিরে কি হবে, না হবে এসব অরূণীর ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অরূণীর ভাবনার জগতটা দখল করে আছে রুদ্র। অরূণী বাসায় ফেরার পর কেউই কিছু জিজ্ঞেস করলো না। কথাও বলল না। অরূণী বিস্মিত হয়ে রইল কতক্ষণ। অরূণী ভেবেছে আর না হোক সূর্যের হাতে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় নিশ্চিত খেতে হবে। হয়ত এবার এভাবে চুপ থেকে কিংবা কথা না বলে রাগের বহিঃপ্রকাশ করছে।
কিছুক্ষণ পর মিলা অরূণীর রুমে এসে জিজ্ঞেস করলো, “খাবে না তুমি?”
– “না ভাবী খেয়ে আসছি আমি।”
অরূণী একটু থেমে মিলার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, “ভাবী বাসায় কিছু হয়েছে? মানে আমি কোথায় গিয়েছি বা রুদ্রর ব্যাপারে?”
– “তোমার দাদায় বাসায় আসার পর বাবা অনেক চেঁচামেচি করেছে।”
– “দাদা কিছু বলে নি?”
– “না কিছু বলে নি। একটু আগে বাসায় আসলো। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে।”
অরূণী ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রইল। এভাবে চুপ থাকা কী বড় কোনো ঝামেলার পূর্বাভাস? অরূণী মরিয়া হয়ে ওঠে মিলাকে বলল, “ভাবী প্লীজ তুমি ভাইয়াকে একটু বুঝাও না রুদ্রর ব্যাপারটা‌। তুমি পারবে না এই ব্যাপারটা ভাইয়াকে বুঝাতে? আমি পরিবারের কাউকে কষ্ট দিতে চাই না।”
– “তুমি এত অস্থির হয়ো না। আমি বুঝিয়ে বলবো।”

মিলা চলে যাওয়ার পর অরূণীর ফোন আসলো। অরূণী দরজা বন্ধ করলো। মাথা থেকে সব চিন্তা-ভাবনা কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। মনে হিমশীতল প্রশান্তি! তৃষ্ণার্ত মনে বর্ষার আগমন। শরীরে প্রেমের শিহরণ! ঠোঁটের কোণে হাসি। কতশত দিন পর নিজেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে অরূণীর! রাতের নিস্তব্ধতা নীরবতা ভঙ্গ করে চারদিকে ফজরের আজান ধ্বনিত হচ্ছে। কথা বলতে বলতে রাতটা কেটে গেল। রুদ্র নামাজ পড়ে শুয়ে পড়লো। অরূণীও নামাজ পড়ে শুয়ো রইলো। কিন্তু ঘুম আসছে না। রুদ্র না-কি আজ বাসায় আসবে আবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। অরূণী না করেছে বারংবার, কিন্তু রুদ্র তাঁর সিদ্ধান্ত অটুট। একদম বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলে কেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে? ভাবতেই আঁতকে ওঠছে অরূণী। রুদ্রকে কি বাসার সবাই অপমান করবে? অরূণী রুদ্রর অপমান কিছুতেই মানতে পারবে না। অনেকক্ষণ চোখ বুঁজে রইলো। ঘুম আসছে না।

সকাল দশটার দিকে রুদ্র আসে অরূণীদের বাসায়। সূর্য সদ্য ঘুম থেকে ওঠেছে। ভুত দেখার মত চমকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। সেলিনা আহমেদও পরম আশ্চর্যে চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইল। শামীমা দ্রুত পায়ে অরূণীর রুমের দিকে ছুটে গেল। অরূণী ঘুমাচ্ছে। শামীমা ডেকে তুললো অরূণীকে। আতঙ্কিত গলায় বলল, “কি কাণ্ড রে অরূণী! রুদ্র আইছে।”
আচমকা ঘুম ভাঙার ফলে জড়াগ্রস্থ মস্তিষ্ক নিয়ে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল অরূণী। কিছু সময় পর ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই তড়াক করে বিছানা ছাড়ে। অরূণী রুম থেকে বের হয়ে দেখে রুদ্র সোফায় বসে সাহেদ আহমেদের সাথে কথা বলছে। সূর্য,মিলা সবাই সেখানে। অরূণীর আর সেখানে যাওয়ার সাহস হলো না। আড়ালেই দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভিতর ধ্বক ধ্বক করছে অস্বাভাবিক ভাবে। সূর্য বেশ শান্ত গলায় বলল, “তুমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছো, বেশ! আমাদেরও তো ভাবতে হবে। তুমি এখন যাও। আমরা ভেবে জানাবো।”
রুদ্রও চলে গেল। আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা অরূণীর দিকে তাকিয়েছিল বার কয়েক। অরূণীর হাত-পা অবশ হয়ে আসছে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here