সে এক মনগড়া প্রেমকাব্য পর্ব -১১

#সে_এক_মনগড়া_প্রেমকাব্য
১১তম_পর্ব
~মিহি

আমি বাড়ি ফেরার পর আর অভির দিকে ফিরে তাকাইনি আর না তার প্রশ্নের জবাবগুলো দিয়েছি। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ আমার। শ্রাবণকে ভালোবাসতাম আমি, এত সহজে তাকে ভুলে অন্য কাউকে মনে কী করে স্থান দিতে পারি? প্রকৃতি হয়তো শূণ্যস্থান পছন্দ করে না কিন্তু মানবমনের রকমফের কি বোঝে না প্রকৃতি?

অভির প্রতি আমার দুর্বলতা আছে তবে তা নিতান্তই শ্রাবণের বিরহে সৃষ্টি হওয়া আবেগ। এত সহজে আবার ভালোবাসা হয় নাকি? নিজেকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করায় মনের যন্ত্রণা যে কমছিল তা না, উল্টো প্রতিমুহূর্তে বাড়ছিল সে যন্ত্রণা। আমার জীবনের প্রশ্নগুলোর উত্তর কিনা আমার কাছেই নেই! শ্রাবণকে আমি ভালোবাসতাম কিনা কিংবা অভিকে ভালোবেসে ফেলেছি কিনা আমি বুঝে উঠতে পারছি না। এতটা সিদ্ধান্তহীনতায় তো আগে কখনো ভুগতে হয়নি আমায়। তবে আজ কেন এত প্রশ্নের মুখে মুষড়ে পড়ছি আমি?

ঘড়ির দিকে তাকালাম। চারটা পয়তাল্লিশ, একটুপর আযান দিবে। নামায পড়ে একটু ঘুমোনো দরকার। না ঘুমালে কিছুতেই আর নিজেকে শান্ত রাখা রাবে না। ঘুম জিনিসটা হলো বড় বড় সমস্যার ছোট এবং কার্যকরী সমাধান। ছোট থেকেই তো বাবা-মাকে ছাড়া বড় হওয়া, তাই স্বভাবতই রাগ নিয়ন্ত্রণ করা কেউ শেখায়নি। বড় হয়ে অবশ্য আয়ত্তে এসেছে। ছোট থাকতে রাগ হলে টানা ১২ ঘণ্টা ঘুম দিতাম। ঘুম থেকে উঠে আর রাগের ‘র’ও মনে থাকতো না। ঘুম আমার জন্য সে সময়ের কার্যকরী ওষুধ ছিল কিন্তু এখন চেষ্টা করলেও আর ঘুম আসে না। শ্রাবণের থেকে দূরে সরে আসা, দাদামশাইয়ের সাথে কথা না বলে থাকা, এই অপরিচিত রকমের বাড়িটাতে একরকম দমবন্ধ জীবনযাপন, হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। আমার আর কিছুতেই ভালো লাগছেনা কোনোকিছু। অদ্ভুত সব খেয়াল ঘোরে মাথায়। ইচ্ছে করে খুব দূরে কোথাও চলে যায় কিন্তু সামর্থ্যহীনতার শিকলে জর্জরিত আমি। চাইলেও দূরে কোথাও চলে যাওয়া সম্ভব নয়।

মৃদু গতিতে গান বাজছে। সম্ভবত মেসেজ এসেছে। এ ফোনে অভি ছাড়া কেউ মেসেজ দেয় না আমি জানি কিন্তু এখন অভির মেসেজ দেখার মতো ইচ্ছে আমার নেই। চারপাশের সবকিছুকেই বিষাক্ত লাগছে আমার। নিজের নজরে নিজেকে খারাপ দেখালে যতটা অস্বস্তি লাগে, ঠিক তেমন একটা অবস্থা আমার।

______________________________

– “তোর মাথা ঠিক আছে? মদ-টদ খাইছিস নাকি? চোখও তো লাল!”

– “দেখ তনয়, আমি ফাজলামি করছি না। তুই ব্যবস্থা করতে পারলে বল নাহলে আমি নিজেই ব্যবস্থা করছি।”

– “থাপ্পড় চিনিস? খুব বড় হয়ে গেছিস না? আঙ্কেল-আন্টির কথাটাও ভাববি না একবার? তাদের কথা না ভাবলি, তোর নিজের স্বপ্ন? তোর ভবিষ্যৎ? একটা মেয়ে যে তোকে কখনো ভালোই বাসেনি তার জন্য তোর সর্বস্ব বিসর্জন অথচ সে কিনা তোর প্রতি কোনকিছু অনুভবই করে না। দুদিনে সে অন্য ছেলের প্রেমে পড়ে গেল অথচ সেই ছোট থেকে তুই ওকে ভালোবেসে আসছিস, তোর ভালোবাসার কোনো মূল্যই নেই।

– “তনয়! তুই চুপ কর! এখনি আমার সামনে থেকে চলে যা তুই। তোর আর একটা কথাও এই মুহূর্তে আমি শুনতে চাইনা।”

তনয় চুপচাপ মাথা নিচু করে ঘরত্যাগ করল। সে জানে রূপম এখন কারো কথাই শুনবে না কিন্তু তনয় এটা ভেবে পায় না একজন মানুষের থেকে বারংবার কষ্ট পাওয়ার পরও তার প্রতি এত ভালোবাসা কোত্থেকে আসে! যে মেয়েটা নিজে রূপমকে আঘাত করেছে অথচ রূপম মেয়েটাকে শাস্তি না দিয়ে তাকে আর তার পরিবারকে নিরাপদ রাখার জন্য নিজের চিকিৎসায় টালবাহানা শুরু করেছে। তার কাছে নিজের প্রাণের কোনো মূল্যই নেই। মানুষগুলো প্রেমে পড়লে এত বোকা হয়ে যায় কেন! এই যে রূপম মীরার জন্য নিজেকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত কিন্তু রূপমের কিছু হলে মীরা কি ফিরেও তাকাবে? তাকাবে না তো! কারণ রূপমের প্রতি মীরার কোনো টানই নেই। উল্টো রূপমের পরিবারের মানুষগুলো কষ্ট পাবে যেটা রূপম বুঝছে না। কথায় আছে না, “আমরা সেই মানুষটাকেই বেশি গুরুত্ব দিই যে আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।” রূপমের অবস্থাটা ঠিক সেরকম। ধ্রুবর কল আসার পর থেকে পাগলের মতো হয়ে আছে রূপম। শান্তিতে কোথাও বসতে অবধি পারছে না যেখানে কিনা এখন তার পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। মাথার আঘাতটার জন্য ডাক্তারকেও দেখাতে হবে কিন্তু রূপমকে সে কথা বলারই সাহস পাচ্ছে না তনয়। রূপম আরো কবে যে বুঝবে নিজের জীবনের মূল্যটা! ভবিষ্যতে এই মীরা মীরা করতে করতে নিজের জীবনের সবকিছু না হারিয়ে ফেলে! অবশ্য হারানোর বাকিও তো কিছু নেই। সবদিক থেকে সবকিছু ক্রমশ হারাচ্ছেই তো রূপম কিন্তু এসব করেও কি আর সে মীরাকে ফিরে পাবে?

___________________________________

বাসায় আসার পর থেকে অভির সমানে টেক্সট। উত্তর দিব কি? একবার মায়ের সাথে কথা বলে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে মা কেন অভিকেই আমার জন্য যোগ্য ভাবলেন। আর অভির সাথে কথাবার্তাই বা হলো কবে! সবকিছু আমার কাছে একরকম ধোঁয়াশা মনে হলেও এটা নিশ্চিত যে আমি অভির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি। অভির কথা কিংবা আচরণ কিংবা আমার প্রতি তার কেয়ার- কোন না কোন কারণে আমি একটু হলেও ঝুঁকে পড়ছি তার আগে। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি নতুন করে কাউকে ভালোবাসতে।

যারা একবার প্রতারণার শিকার হয়, তারা সহজে নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। আমার অবস্থাটা ঠিক সেরকম। শ্রাবণ নিশ্চয়ই খুব ভালো আছে, মাঝখান দিয়ে আমার জীবনটা বিষিয়ে দিয়ে গেল।

_______________________

ফজর নামাযের পরপরই শ্রাবণের লাশ দাফন করা হয়েছে। আত্মহত্যা বলে যদিও কেউ জানাযা পড়তে রাজি হচ্ছিল না, তার উপর প্রণয়ঘটিত ব্যাপারে ধরা খাওয়া! শ্রাবণের মায়ের কাকুতির জের ধরে জানাযা পড়া হলো। শ্রাবণের স্ত্রী একবারো দেখতে আসেনি। সে তখন অনুশোচনার অনলে পুড়ছে। শ্রাবণকে সে পাগলের মতো ভালোবাসত যার কারণে শ্রাবণকে একান্ত করে পাওয়ার জন্য বাচ্চার ষড়যন্ত্র করলো অথচ সে শ্রাবণকে তো পেলোই না। উল্টো শ্রাবণের পরিবারও শ্রাবণকে হারালো। প্রচণ্ড আফসোস হচ্ছে তার কিন্তু মানুষ মারা যাওয়ার পর আফসোস করে কী-ই বা যায় আসে! সময় থাকতে কেউই সঠিক বস্তুর মূল্য বোঝে না!

_________________

রূপমের মাথা কাজ করছে না। তনয়কে বলেছে প্লেনের টিকিট আনতে। যেভাবে সম্ভব দেশ ছাড়তে চায় সে। পাসপোর্ট বাড়িতে, সেটা কিভাবে আনানো যায় সেটাই ভাবছে সে। আর তাছাড়া সামনেই ইলেকশন, রূপম না থাকলে ঝামেলাগুলো সামলাবে কে? এত মানুষের ভরসা রূপমের উপর কিন্তু রূপম এইমুহূর্তে নিজেকে চরম স্বার্থপর বানিয়ে ফেলেছে যে শুধুমাত্র একটা মেয়ের জন্য সবকিছু ছেড়ে পাড়ি জমাতে চায় এক অজানা রাজ্যে।

হুটহাট সিদ্ধান্তগলো সর্বদাই ভুল হয় কিন্তু রূপমের মনে হচ্ছে মীরাকে অন্য কারো সাথে দেখলে এইমুহূর্তে সে দম বন্ধ হয়ে মরেই যাবে। এতটা যন্ত্রণা হচ্ছে তার বুকের বা-পাশটায়! সে যন্ত্রণা না কাউকে দেখানো হচ্ছে আর না ব্যক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। আর মানবের অন্য কোন মানবের মন বোঝার ক্ষমতা নেই। একজন আপনার সম্পর্কে ঠিক সেটাই আর ততটুকুই বুঝবে যতটুকু আপনি তাকে দেখাবেন বা বোঝাবেন। আমি অনেক ভালো কিন্তু কারো সামনে নিজেকে খারাপ উপস্থাপন করলেন, অবশ্যই বিপরীত মানুষটি আপনাকে খারাপ বলেই জানবে। সবটাই নির্ভর করে আমরা নিজেকে কতটা আড়াল করি কিংবা প্রকাশ করি তার উপর।

তনয় সারা ঘরে পায়চারি করছে। ধ্রুবকে কি কল করে বলবে রূপমকে আটকাতে? নাকি রূপমের বাড়িতে কল দিতে বলবে? রূপমের বাবা যদি ভুলেও জানে মীরার জন্য এসব হচ্ছে তাহলে মীরা কিংবা ওর পরিবার কাউকেই বিন্দুমাত্র ছেড়ে দেখবে না। রূপমের কথারও হয়তো তোয়াক্কা করবেন না। উভয় সঙ্কট এখন তনয়ের। রূপমকে এভাবে দেখতেও পারছে না আবার যেতেও দিতে পারছে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here