জনৈক প্রেমিক পর্ব -০৩

#জনৈক_প্রেমিক
পর্ব- ০৩

স্যরি! স্যরি কেন বলছেন উনি? বিয়ের দিনই সবার সামনে আমাকে চড় মেরে অপমানিত করার জন্য? আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই আবার বললেন, ‘তোমার প্ল্যান সফল হতে দিলাম না, তাই স্যরি!’

আমি অবাক হলাম। আবোলতাবোল এসব কী বলছেন উনি! জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্ল্যান? কীসের প্ল্যান?’

উনি জবাব না দিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে রইলেন। ওদিক ফিরেই আবার বললেন, ‘আমাদের পরিবারের একটা সম্মান আছে। আর এখন তুমি এ পরিবারের একটা অংশ। তাই এমন কিছু করো না যাতে এ বাড়ির সম্মান নষ্ট হয়। তাহলে কিন্তু আমি তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবো না!’

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। দুপুরে অতো বড়ো অপমানের পর একটাবার ক্ষমাও চাইলেন না উনি। আবার এখন এমন সব কথা বলছেন যেন আমি বিশাল কোনো অপরাধ করে ফেলেছি। আর আমার কারনে ভবিষ্যতে তাদের পরিবারের সম্মান নষ্ট হবে।

আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দাঁড়ালাম। তারপর চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘বিয়ে হতে না হতেই সবার সামনে শুধু শুধু আমাকে চড় মারলেন আবার এখন বলছেন আমার জন্য ভবিষ্যতে আপনাদের পরিবারের সম্মান নষ্ট হবে! কেন কী করেছি আমি? কী এমন ক্ষতি করেছি আমি আপনাদের যে আমার কারনে আপনাদের পরিবারের সম্মান নষ্ট হবে?’

উনি উঠে বসে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘আস্তে কথা বলো! সবাই শুনবে!’

আমি পরোয়াই করি না এমন ভাব করে বললাম, ‘শুনুক! তাতে আমার কী যায় আসে? তখন সবাই আপনার আসল রূপটা তো দেখলোই। এখন আবার দেখুক!’

ওয়াহাব ক্রুদ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমি তাতে একটুও টললাম না। এমনিতে আমি শান্ত মানুষ। তবে রেগে গেলে কোনো কিছুরই পরোয়া করি না। আমি আবার বললাম, ‘আসলে তখন আমি ভুল বলেছিলাম। প্রত্ন না! আসল জানোয়ার তো আপনি!’

ওয়াহাব যেন বিস্ময়ের সপ্তম চূড়ায় পৌঁছে গেল। ‘আমি জানোয়ার?’

‘ হ্যা, আপনি-ই! নয়তো কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ তার সদ্য বিয়ে করা বউকে মারে?’

উনি রেগে ওনার পাশের টেবিলের ওপর থেকে ফুলদানিটা মেঝেতে ছুড়ে মারলেন। তাতে যেন আমার মেজাজের আগুনে ঘি ঢালা হল। আমার কী হলো জানি না। পাশের ওয়ারড্রবের ওপর একটা ছোটো টেবিল ক্লক রাখা ছিল সেটা তুলে একদম ওনার বরাবর ছুড়ে মারলাম। ভাগ্যিস ওনার গায়ে লাগেনি! লাগলে একটা কুরুক্ষেত্র বেধে যেত নিশ্চিত।

ওয়াহাব হয়তো ভাবতেও পারেনি আমি এমনটা করতে পারি! বিস্ময়ে ওনার চোখ কোঠর থেকে বেরিয়ে পড়ার মতো অবস্থা। উনি মিনমিন করে বললেন, ‘আমি ভাবতাম আমিই পৃথিবীর সবচাইতে বেশি রাগী মানুষ! ‘

বেশি রাগ হলে আমি ধরে রাখতে পারি না। কেঁদে ফেলি। এখনো বোকার মতো তাই-ই করলাম। উনি হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। আমি নিশ্চিত উনি আমাকে মারধোর করতেই আসছেন। আমি দৌঁড়ে গিয়ে ভাঙ্গা ফুলদানিটা তুলে উঁচিয়ে ধরলাম। ‘খবরদার! আমার কাছে এসেছেন তো! ‘

ওয়াহাব স্থির হয়ে গেলেন। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ওখানেই। আমি আবার বললাম, ‘আপনি এ ঘর থেকে বের হন! জলদি!’

উনি এক পাও নড়লেন না। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি বুঝতেই পারছেন না আমি কী করছি! আমার হাসি পেল। একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়েছি প্রতিশোধ নেবার। এটাকে তো হাতছাড়া করা যায় না!
‘আপনি না বের হলে আমি কিন্তু সত্যি সত্যি আপনার মাথা ফাটিয়ে ফেলব! ‘

ওয়াহাব ঘোরগ্রস্তের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলাম। এরপর ফুলদানিটা ফেলে এগিয়ে গেলাম দরজা লাগাতে। তখনই ওয়াহাব দরজার বাইরে থেকে উঁকি মারলেন।
‘আমি তোমাকে মারতে আসছিলাম না হৃদি!’

‘তাহলে কেন আসছিলেন? ‘

উনি আচমকা ভেজা বেড়াল বনে গেল। ‘তোমাকে জড়িয়ে ধরতে! তুমি কাঁদছিলে তাই..!’

আমি বললাম, ‘আপনার লজ্জা করে না? মেরে, অপমান করে আবার দরদ দেখাতে আসেন!’

‘দুপুরের ওই ঘটনার জন্য তোমারও কিন্তু দোষ ছিল হৃদি!’

ওনার বকবকানি আমার আর সহ্য হলো না। আমি ঠাস করে ওনার মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিলাম।
উনি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কেউ দেখে ফেললে তাকে আমি কী বলব হৃদি?’

আমি বললাম, ‘বলবেন বিয়ের দিনই আমি বউয়ের গায়ে হাত তুলেছি তাই সে আমাকে বাসর ঘর থেকে বের করে দিয়েছে!’

বাইরে থেকে আর কোন কথা ফেরত এলো না। উনি বোধহয় চলে গেছেন! এবার আমি শান্তিতে ঘুমোবো। হঠাৎই ফ্লোরটা নজরে এলো। ফুলদানি, ঘড়ি দুটোই ভেঙে চৌচির। এমন ভাঙাচোরার শব্দে বাড়ির কেউ এলো না কেন খবর নিতে! বাড়ি ভর্তি মেহমান। সবাই এখনো ঘুমোয়নি। তাদের মধ্যে বাচ্চাকাচ্চাও অনেকগুলো। ওদের চেঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে এ ঘর থেকেও। তারা হয়তো ভাবছেন বাচ্চারাই জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করছে!

যাই হোক, আমি ভাবছি কেউ আবার ওয়াহাবকে বাইরে দেখে ফেললো না তো! তখন যদি ওয়াহাব সম্পূর্ণ আমার দোষ দিয়ে দেয়! দিলে দেবে তাতে আমার কীইবা হবে। আমি কালই চলে যাবো এ বাড়ি ছেড়ে। এখানে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব আর একদিন থাকলেও।
নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হতে লাগল আমার। কেন যে মায়ের ওপর রাগ করে ওনার সঙ্গে চলে এলাম! অপমানিত তো হলামই সেই সঙ্গে বদনাম ফ্রি!

ফ্লোরের আবর্জনা পরিষ্কার করে ঘরের কোনে রাখা ঝুড়িতে ফেলে এলাম। নয়তো কাল সকালে যদি আমার শ্বাশুড়ি মা দেখে জিজ্ঞেস করেন, ঘরের এ অবস্থা কেন? তখন আমি আবার কী উত্তর দেবো!


সকালে ঘুম ভাঙ্গলো আমার ননদের ডাকাডাকিতে। উঠে দরজা খুলে দিলাম। শ্রেয়া আমাকে দেখে বলল, ‘গুড মর্নিং, ভাবি!’

‘গুড মর্নিং! ঘরে এসো।’

শ্রেয়া বলল, ‘না না ভাবি, আমি বাইরেই ঠিক আছি!’

আমি ওর হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে এলাম, ‘কে বলেছে তুমি বাইরেই ঠিক আছো!’

শ্রেয়া ভেতরে ঢুকেই বলল, ‘ভাইয়া কোথায় ভাবি?’

আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওয়াহাবের কথা! কাল রাতের পর তো আর উনি এ ঘরে আসেননি। উনি এখন কোথায় কে জানে!
শ্রেয়াকে বললাম, ‘এইতো কিছুক্ষণ আগে কোথায় যেন বেরোলো।’

‘ও আচ্ছা। ভাবি চলো, মা তোমাকে খেতে ডাকছে।’

আমি হাত-মুখ ধুয়ে শ্রেয়ার সঙ্গে খেতে গেলাম। গিয়ে দেখি ওয়াহাব টেবিলে বসা। আমার চোখে চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে নিল। ওয়াহাবকে দেখে শ্রেয়া বলল, ‘এত সকালে কোথায় গেছিলে ভাইয়া? ভাবি বলল তুমি নাকি কোথায় বেরিয়েছো!’

ওয়াহাব আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে শ্রেয়াকে বললেন, ‘হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। ওই যে “মর্নিং ওয়াক”!

‘ওহ।’

খাবার টেবিলে আর তেমন কথা বার্তা হলো না। খাওয়া শেষ হলে টেবিল গোছাতে আমার শ্বাশুড়ি মা’কে সাহায্য করতে গেলে তিনি আমাকে নিষেধ করলেন। ‘নতুন বউ! কোনো কাজ করার দরকার নেই। তুই এখন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নে।’
আমি জোর করে কাজ করতে গেলে আমাকে ধমক দিলেন। ধমক খেয়ে আমি ঘরে চলে এলাম। ঘরে ঢুকতেই কোত্থেকে প্রত্ন দৌড়ে এসে একটা কাগজ ছুড়ে মারল। কাগজটা ওঠানোর সময় দেখলাম ওয়াহাব বড় বড় কদম ফেলে এ ঘরেই আসছে। আমি দ্রুত কাগজটা উঠিয়ে আমার শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে ফেললাম। ওয়াহাব ঘরে ঢুকে ওয়ারড্রবের ড্রয়ারে কী যেন খুঁজতে লাগলেন। তারপর না পেয়ে চলে যেতে লাগলেন। যেতে যেতে অকস্মাৎই পেছন ফিরে তাকিয়ে আমার ওপর অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমার বুঝতে বাকি রইল না কেন! আমি ওনার ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

উনি চলে যাওয়ার পর দরজা আটকিয়ে কাগজটা খুললাম। সেখানে লেখা,

”হৃদি, শ্রাবণ ভাই আমাদের ব্যাপারে সব জেনে গেছে। গতকালকে এজন্যেই তোকে চড় মেরেছিল। আমাকে জানোয়ার বলেছিস বলে নয়। শ্রাবণ ভাইয়ের এংগার ইস্যু আছে। আর তাই তার সদ্য বিয়ে করা বউ তারই চাচাতো ভাইয়ের প্রেমিকা সেটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। আমাদের দুজনের ওপরই অনেক রেগে ছিল। আর সেই রাগটা তোর ওপর ঝেড়েছে। তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস শ্রাবণ ভাই কেমন প্রকৃতির? এমন লোকের সঙ্গে তুই কখনোই ভালো থাকতে পারবি না।
আমাকে ক্ষমা করে দে হৃদি! আমি জানি তুই আমাকে ভুলতে পারিস নি! তুই আমাকে এখনো ভালোবাসিস! তুই চাইলে আমি তোর পায়ে ধরেও ক্ষমা চাইতে রাজি! তবুও প্লিজ চল আমরা দুজন অনেক দূরে কোথাও চলে যাই! আমরা অনেক ভালো থাকবো দেখিস! আর কেউ কখনো আমাদের আলাদা করতে পারবে না।
আমি তোর অপেক্ষায় থাকবো!”

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here