জনৈক প্রেমিক পর্ব -০২

#জনৈক_প্রেমিক
পর্ব- ০২

বিয়ের রাতেই আমার স্বামী আমাকে তার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে যদি একঘরে দেখে তবে তার ফলাফল কতটা ভয়ানক এবং অসম্মানজনক হবে তা ভাবতেই শিউরে উঠলাম। আসল ঘটনাটা কী ছিল সেটা হয়তো কেউই বুঝতে চাইবে না! সম্মানহানি তো হবেই। ওয়াহাব নিশ্চয়ই আমাকে ডিভোর্সই দিয়ে দেবে! কিন্তু সেটা আমি এই মুহূর্তে অবশ্যই চাইছি না।

ডাকটা আরেকবার কানে এলো। ‘মা! দরজা খুলছো না কেন?’

আমি কী করব কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। প্রত্নও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও নিজেও হয়তো বুঝে উঠতে পারেনি এমন কিছু হবে! আমি ওকে জোরেসোরে ধাক্কা দিয়ে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর দরজা ভিজিয়ে রেখে বললাম, ‘আমি না বলা পর্যন্ত বের হবে না। বাই চান্স, তুমি যদি বের হয়েছো তোমার বড় ভাইয়ের সামনেই তোমায় খুন করবো আমি!’

ও কোনো প্রতুত্তর করলো না।

আমি দরজা খুলে দিলাম। ওয়াহাবের মুখভঙ্গি দেখে কিছু বোঝা গেল না। উনি কি আমাকে দেখে অবাক হলেন না কি বিরক্ত?
মা হাতে একটা প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে ফেরত এলেন। ওয়াহাবকে দরজার সামনে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার তুই এখানে? কিছু লাগবে?’

ওয়াহাব খানিক আমতাআমতা করলেন। ‘না, আসলে, তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল!’

‘হ্যা, বল!’

‘ওহ হো কী যেন বলতে এসেছিলাম! মনে পড়ছে না!’ বলেই ওয়াহাব দ্রুত পায়ে চলে গেলেন এখান থেকে।

মা ওনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রহস্যজনক মুচকি হাসলেন। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ কি! এখনো শাড়িটা বদলাসনি কেন মা?’

আমি বললাম, ‘এখনি বদলে নিচ্ছি!’

‘খাবারটা ঠান্ডা হয়ে যাবে। জলদি হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নে!’

আমি মাথা ঝাঁকালাম। মা সামান্য হেসে চলে গেলেন। যাবার সময় বললেন দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে নিতে।

মা চলে যাওয়া মাত্রই প্রত্ন ওয়াশরুম থেকে বের হলো। এসেই আমার হাত চেপে ধরল, ‘আমাকে এভাবে ঠকালি কেন হৃদি?’

আমি ব্যঙ্গাত্মক হেসে বললাম, ‘ আমি তোকে ঠকিয়েছি না কি তুই আমাকে ঠকিয়েছিস? ‘

প্রত্ন জবাব না দিয়ে অদ্ভূত চোখে চেয়ে রইল।

আমি আবার বললাম, ‘আমি কী জানতাম দেখতে এসেই ওনারা বিয়ে ঠিক করে যাবেন? আমি তো এটাও জানতাম না, ওনারা যে আমাকে দেখতে আসবে! তারা চলে যাবার পরপরই এক মুহুর্ত দেরি না করেই আমি তোকে ফোন করেছি। তখনই তোকে সব খুলে বলেছি। অথচ তুই কী করলি? আমার সঙ্গে এমন বিহেভ করলি যেন সব দোষ আমার! যেন আমিই এসব কিছুর জন্য দায়ী!
সেদিনের পর আমি তোকে কতবার ফোন করেছি তোর কোনো ধারণা আছে? প্রত্যেকবারই সুইচড অফ ছিল। গত সাত দিনে তুই আমাকে একটা বারও ফোন করিসনি। একটাবার যোগাযোগ করারও চেষ্টা করিসনি আমার সঙ্গে। আমার ওপর দিয়ে কী পরিমাণ ঝড় গেছে এ’কদিন তোর কোনো ধারণা আছে? একদিকে বিয়ের টেনশন, একদিকে পরিবারের টেনশন, আরেকদিকে তোর টেনশন! আমি একা একা কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এদিকে তুই আমার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিস। বাবাকে যে তোর কথা বলবো সে সুযোগটাও তো তুই আমাকে দিসনি। তো আমার আর কী করার ছিল? কী করতাম আমি? উত্তর দে!’

প্রত্ন আরো শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরল। ‘তাই বলে তুই বিয়েই করে নিবি? ‘

‘নয়তো কী করতাম আমি? তুই কেন একটাবারও আমার খোঁজ নিলি না?’

প্রত্ন হুট করে রেগে গেল। ‘তুই আমাকে বলিসনি কেন এক সপ্তাহ পরই বিয়ের ডেট? কেন এক মাস বলেছিলি?”

‘ওনারা প্রথমে এক মাস পর বলেছিল তাই। বাসায় ফেরার পর তারা জানায় সামনের শুক্রবারই তারা বিয়ে পড়িয়ে ফেলতে চায়।’

প্রত্ন নিজের মাথার চুল টেনে ধরল। ‘আমার সঙ্গেই কেন এমন হলো হৃদি?’

‘কারন তুই নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারিস না।’

প্রত্ন ব্যঙ্গ করে বলল, ‘আর আপনি?’

আমি জবাব দিলাম, ‘আমিও তোর মতোই!’

‘এখন আমরা কী করবো হৃদি?’

আমি বললাম, ‘কেন এতক্ষণ যেটা করছিলি সেটাই! এতক্ষণ যেভাবে “ভাবি”, ” ভাবি’ করছিলি, ফাজলামো করছিলি তেমনটাই করবি। তবে সারাজীবন! ‘

প্রত্ন চেঁচিয়ে উঠল, ‘হৃদি!’

আমি বললাম, ‘আমার ওপর চেঁচিয়ে কোনো লাভ নেই। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য তুই নিজেই দায়ী।’

প্রত্ন চুপ করে তাকিয়ে আছে। আমি আবার বললাম, ‘তোর জন্য আমি সবার সামনে অপমানিত হয়েছি। শুধুমাত্র তোর কারনে তোর ভাই আমাকে বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে চড় মেরেছে।’

প্রত্ন আমার গালের বাম পাশে হাত বুলাতে লাগল, ‘স্যরি! আমার জন্যই…!’

আমি ওর হাত আমার গালের ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘হ্যা। তোর জন্যই। এখন দয়া করে এ রুম থেকে বের হ।’

প্রত্ন রাগ দেখিয়ে রুম থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল। আমার হাসি পেল। আমি নিজেই রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আবার আমার জীবনে যারা আসে তারা আমার চাইতে আরো এক ডিগ্রি এগিয়ে থাকে এ ব্যাপারে।

হাত-মুখ ধোয়ার পরিবর্তে একবারে গোসলই করে নিলাম। গাড়িতে জার্নি করে গোসল না করলে আমার ভালো লাগে না। শান্তি লাগছে এখন।
ভেজা চুল টাওয়েল দিয়ে পেঁচিয়ে খেতে বসলাম। খাওয়ার মাঝেই কেউ একজন দরজায় নক করল। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখলাম বাইরে শ্রেয়া দাঁড়িয়ে। শ্রেয়া আমার ননদ। রিহার বয়সী। দুজনেই ইন্টারে পড়ছে।
আমাকে বাম হাত দিয়ে দরজা খুলতে দেখে শ্রেয়া বলল, ‘স্যরি ভাবি, খাওয়ার সময় ডিস্টার্ব করলাম!’

আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘মোটেও না! ভেতরে এসো।’

শ্রেয়া ভেতরে ঢুকে বলল, ‘ভাবি, ভাইয়া এসেছিল?’

‘হ্যা, কিছুক্ষণ আগেই। কেন বলো তো!’

শ্রেয়া বলল, ‘তোমাকে ভাইয়া খুঁজছিল কেন যেন! আমাকে জিজ্ঞেস করল তুমি কোথায়।’

আমাকে খুঁজছিল! আমি বললাম, ‘কখন শ্রেয়া?’

‘এই তো আধ ঘন্টা হবে।’

ও এর মানে তখন তিনি আমার শ্বাশুড়ি মা’কে নয় আমাকে খুঁজতেই এ ঘরে এসেছিলেন! তবে মা’কে খোঁজার অভিনয়টা কেন করলেন!
কেনই-বা খুঁজছিলেন উনি আমাকে? পুনরায় মারার জন্য? আবার কী ভুল করলাম কে জানে!

আমাকে কিছু একটা ভাবতে দেখেই হয়তো শ্রেয়া বলল, ‘ভাবি, তুমি আসলে ভাইয়াকে যেমন ভাবছো সে তেমন নয়।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কীভাবে বুঝলে আমি তোমার ভাইয়াকে কেমন ভাবছি!’

ও বলল, ‘আসলে তোমার এখন ভাইয়াকে খারাপ মনে হবারই কথা। তখন তোমাকে যেভাবে চড়..!’

শ্রেয়া হঠাৎ থেমে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘ভাইয়া আসলে ওমন নয়। তখন যে কেন এমন করল! আমার মনে হয় ভাইয়া তোমার ওপর কোনো কারনে রেগে ছিল। সে আবার নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না। তাই হয়তো! ‘

আমাকে চুপ থাকতে দেখে শ্রেয়া আবার বলল, ‘কষ্ট পেয়ো না ভাবি! তোমাকে মন খারাপ করে থাকতে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। তুমি আমার খুব পছন্দের! ভাইয়ারও!’

আমি জোরে হেসে দিলাম, ‘ তোমার ভাইয়ার পছন্দের কি না জানিনা। কিন্তু তোমার বেশ পছন্দের সেটা বুঝতে পারছি। মন খারাপ করেছিলাম। কিন্তু এখন আর নেই। তোমার সঙ্গে কথা বলে মন ভালো হয়ে গেছে।’

শ্রেয়া হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আরো নানান কথা বার্তা হলো আমাদের মাঝে। এই কয়েক মুহূর্তেই ও খুব ফ্রি হয়ে গেল আমার সঙ্গে। ও ওর স্বমন্ধে অনেক কথাই বলল। আমিও মনোযোগ দিয়ে শুনলাম।

.
রাত এগারোটার দিকে আমাকে ওয়াহাবের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ঘরটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বিছানাটাকেও। বিছানার মাঝখানে লাভ আকৃতিতে গোলাপের পাপড়ি সাজানো। ফুলের গন্ধে ঘরটা মঁ মঁ করছে।
আমি বিছানার এক কোনে গিয়ে বসে রইলাম। ওয়াহাব ঘরে এলো ঠিক দশ মিনিট পর। ঘরে ঢুকেই ঠাস করে দরজা লাগিয়ে বারান্দায় চলে গেল। আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখি সিগারেট খাচ্ছে। যতসব বদঅভ্যাস! সিগারেট আমি দু’চোখে সহ্য করতে পারি না। অথচ আমার কপালে একজন সিগারেটখোর এসে জুটেছে।
এখানটায় সিগারেটের গন্ধ এসে পৌঁছাচ্ছে না। তবুও খুব ধোঁয়া আসছে এমন ভান ধরে কাশতে লাগলাম। উনি পেছন ফিরে একবার আমার দিকে তাকালেন। এরপর পিষে সিগারেটটা নিভিয়ে ফেললেন।

বারান্দায় দাঁড়িয়েই ওয়াহাব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমার অস্বস্তি লাগতে লাগল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, ‘আপনি না কি আমাকে খুঁজছিলেন? ‘

আমার কথা বোধহয় ওনার কান অব্দি পৌঁছালো না। উনি ঘোরগ্রস্তের মতো বললেন, ‘তোমাকে এতো সুন্দর লাগছে কেন?’

আমি খানিক মেজাজ খারাপ করে বললাম, ‘এখন তো আমাকে সুন্দর লাগবেই। সব পুরুষদেরই…!’

আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই উনি লাইট নিভিয়ে দিলেন। তারপর আমার পাশে শুয়ে পড়ে বললেন, ‘ঘুমিয়ে পরো। অনেক রাত হয়েছে।’

আমি বাধ্য মেয়ের মতো একদম কিনার ঘেষে শুয়ে পরলাম। উনি মৃদু স্বরে বললেন, ‘স্যরি, হৃদি!’

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here