#বেলা_শেষে- ২
[অন্তিম পর্ব]
সেদিনও আমি কোন রকমে নিজেকে বাঁচিয়ে ছিলাম। কেও কিছু টের পাওয়ার আগেই আমি কলেজে পৌঁছাত ছেয়েছিলাম। তখন বাবা আমাকে কল করে বলল আমি যেখানেই থাকি না কেন তাড়াতাড়ি যেন হসপিটালে পৌঁছে যাই। আমি কেন হসপিটালে যাবো জিগ্যেস করলাম বাবাকে। তখন বাবা জবাব দেয় সেটা আমি হসপিটালে গিয়েই দেখতে পারবো। আমার মন বলছিল খুব খারাপ কিছু হয়েছে, নাহলে বাবা আমাকে এইভাবে ডেকে পাঠাতো না। নিজেকে কোনরকমে ঘুচিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেই আমি। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি আরাভের এমন অবস্থা দেখব সেটা কল্পনাও করতে পারিনি।
– কি হয়েছিল আঙ্কেলের? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম আমি।
– অ্যাকসিডেন্ট অ্যাকসিডেন্ট।যেটা আমাদের জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছি। জবাব দিলো মামনি।
আমি জিঞ্জেসু দৃষ্টিতে মামণির দিকে তাকালাম কি হয়েছিল আঙ্কেলের? কেন মামণির ক্যারিয়ার নষ্ট হল! আর দুই বছর কোথায় ছিল তারা ! নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছি আমার মাথায়। তখন পাশ থেকে আরাভ আঙ্কেল বলে উঠলো,
– রাকিবকে অফিসের সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিলাম আমি। মনে মনে খুব খুশি ছিলাম আমি সেই দিন। গুন গুন করে গান গাইছিলাম আর ট্রাই করছিলাম আমি। কিছুদূর আসতেই খেয়াল করলাম আমার গাড়ি ব্রেক কাজ করছে না। গাড়ির ব্রেক নষ্ট হয়ে গেছে আমি যতই চেষ্টা করছি ব্রেক কন্ট্রোল করতে পারছি না। আমি হাল ছাড়িনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ব্রেক কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি। তখন গাড়ির ব্ল্যাক মিররে করে দেখলাম একটা বড় লরি আসছে আমার পিছু পিছু গাড়িটা আমাকে ফলো করছে। গাড়িটা দ্রুত আমার পিছু আসছে। একদিকে আমার গাড়ির ব্রেক নষ্ট হয় অন্যদিকে পিছনে লরি দুটানায় পড়ে গেছি আমি। কিছুক্ষণ পর লরিটা পিছন থেকে আমার গাড়ি ধাক্কা দিল। তাতে আমি হালকা সামনে এগিয়ে গেলাম। গাড়িটা পিছন দিক থেকে একের পর এক আমাকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে আর আমি গাড়ির কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছি। একটা ব্রিজের কাছে আসতেই লরিটা পিছন থেকে আমাকে এত জোড়ে ধাক্কা দেয় যে আমি ব্রিজ ভেঙে নিচে পরে যাই। তখন ব্রিজের নিচে থাকা জেলেরা আমাকে বাঁচিয়ে নেয়।
– হসপিটালে আরাভের অবস্থা থেকে আমি ঞ্জান শূন্য হয়ে পড়েছিলাম। সেদিন খুব ভেঙে পড়েছিলাম আমি।দুইদিন পর ডক্টর এসে যখন বলল আর আমায় চলে গেছে তখন মনে হয়েছিল আমার পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছে। ফারাবী এই অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না আমি। তখন আমার পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাবা আর দাদু। তাদের সাহায্যে নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। নিজেকে হসপিটালে হারাবে পাশেই শিফ্ট করে নিয়েছিলাম। সেখান থেকে আরবের দেখাশোনা করছি আর নিজেরা পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ততদিনে মাহিন গা ঢাকা দিয়েছিল শহরের বাইরে। ছয় মাসের মধ্যে আমার এলএলবি কমপ্লিট হয় তারপরও তোমায় আমি মহিনের নামে একটা ডাইরি করি। পনেরো দিনের মধ্যে পুলিশ মাহিনকে খুঁজে বের করে। তার ঠিক চার দিনের মধ্যে আমি মাহিনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু প্রমান জোগাড় করি আর আদালতে মাহিনকে দোষী প্রমানিত করি। তারপর বিচারপতি জিয়াউর হায়দারের সাহায্য নিয়ে নিজেই মাহিনের ফাঁসির রায় লেখি। মাহিনকে মৃত্যু দন্ডে দণ্ডিত করি আমি। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে আরাভ আংকেলের দিকে তাকালো। আংকেল ও তখন তাকালো মমনির দিকে। দুজনে তাকিয়ে আছে দুজনের চোখের দিকে। তখন মামনি অস্ফুটভাবে বলে উঠলো,
– আমার এলএলবি পড়া স্বার্থক হয়েছে। আমার কোন আফসোস হয় না। তবে জিয়াউর হায়দার আমার সাথে এমনটা ন। করলেও পারতো
মামনির কথা আরাভ আংকেলের কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই আংকেল মামনির হাত চেপে ধরলো। আর মামনি নিরবে আংকেলের কাদে মাথা রাখলো। আংকেল একহাতে মামনিকে তার সাথে জড়িয়ে নিলো তার বাহুডোরে। আরাভের মন যেন বলে উঠছে,
সিদ্ধান্ত যখন ভালোবাসা,
তখন, আগলে রাখার দায়িত্ব আমারই।
তাদের এমন অটুট ভালোবাসা দেখে হাসি ফুটে উঠলো আমার অধরে। অধর প্রসারিত করে তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে।
টেবিলে থাকা ল্যাম্প এর দিকে তাকিয়ে আছি একমনে। একবার ল্যান্প অফ করছি তো আরেকবার অন করছি। মামনি আর আংকেলের বলা কথাগুলো এখনও কানের কাছে বেজে চলেছে। মাহিন মানুষটা কেমন ছিল তাকে দেখার ইচ্ছে হচ্ছে। তাকে যদি সামনে পেতাম প্রথমে তার চোখ দুটি উপরে দিতাম আমি। যে চোখ দিয়ে নারীদের প্রতি কুদৃষ্টির দেয় সেই চোখে উপড়ে নিতাম আমি একটা মানুষের মন কতটা নোংরা হলে এরকম জঘন্য কাজ করতে পারে। ওই মাহিনের জন্য ভাইয়ের শিশু বয়সে বাবা মায়ের আদর পায়নি। মামনি তার ক্যারিয়ার হাড়িয়েছে। আংকেল তার জিবন থেকে মূল্যবান দুটি বছর হাড়িয়েছে।
চোখথেকে দু -ফোটা জল গড়িয়ে পরলো বালিশের উপর। ভালো লাগছে না। একদমই কিছু ভালো লাগছে না। আমার মামনির জিবনটা এমন জটিল না হলেও পারতো। #বেলা_শেষে প মামনির তার পরিবার নিয়ে খুশি এটাই অনেক। আংকেল ও তো মামনিকে অনেক ভালোবাসে। আর ভাইয়া, ওহ নো ভাইয়া তো আমাকে ছাদে যেতে বলছিলো। আমি ভুলেই গিয়েছি। উঠে বসলাম আমি। দেয়ালে সাটানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি এগারোটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। বারোটা বাজতে আর মাত্র পনেরো মিনিট। ভাইয়াতো আমাকে দশটায় যেতে বলছিলো। কি করি এখন। যাবো ছাদে। ভাইয়া সেখানে আছে নাকি চলে আসছে। ওহ মিষ্টি কেন যে তুই সব ভুলে যাস। ভাইয়া তো এবার খুব রেগে যাবে। যাই দেখি ভাইয়া চলে গেছে কি না এখনো রয়ে গেছে।
ছোটছোট পা ফেলে ছাদে চলে আসলাম। এতরাতে একা ছাদে আসাতে বেশ ভয়ই লাগছে আমার। বুকের উপর হাত ছোটছোট পা ফেলে চলে আসলাম। ছাদের দক্ষিণ পাশটায় যেখানে আমি নয়নতারা ফুলের গাছ লাগিয়েছি সেখানে উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে ভাইয়া। ভাইয়াকে দেখে এবার মনে একটু সাহসের সঞ্চার হলো। ধীর পায়ে তার পাশে দাঁড়ালাম গিয়ে। আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে ভাইয়া সমানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– দুই ঘন্টা ধরে এখানে অপেক্ষা করছি আর তোর এখন আসার সময় হলো।
– ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা তুমি এত সময় অপেক্ষা করছো কেন? রুমে চলে যেতে।
– আমার মন বলছিল তুই আসবি!
– ভবিষ্যৎ বলতে পারো নাকি!
– না। তবে তোর মন পড়তে পারি। কোথায় ছিলি এতক্ষণ।
– তুমিই বলো না। তুমি তো আমার মন পড়তে পারো।
আমার কথার কোন জবাব দিলো না ভাইয়া। আমার হাত ধরে ফ্লোরে বসিয়ে দিলো। তারপর সে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আমার এক হাত তার হাতের মুঠি নিয়ে তাতে চুমু খেলো। তারপর বলল,
– ভালোবাসি, তোকে খুব বেশী ভালোবাসি।
আমি কোন জবাব দিলাম না। মৃদু হাসলাম। অতঃপর ভাইয়া আবার বলে উঠলো,
-কিছু বলছিস না যে,
– তোমার নেক্সট ব্লগে আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। আমার পড়াশুনা ভালো লাগে না। রাখবে আমাকে তোমার পার্টনার হিসাবে।
আমার কথাশুনে উঠে বসলো ভাইয়া। আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
– দিবো এটা চড়। পড়াশুনা ভালো লাগে না। তো কি করবি তুই, লোকের বাড়িতে কাজ করবি! অবশ্য তোর জন্যে এটাই মানায়।
– এইতো খন্দকার জুবায়ের আহসান অভি নিজের আসল রুপে চলে আসছে। বিরবির করে বললাম আমি।
– কি ভাবছিস??
– তোমার সাথে কাজ করবো আমি।
ভাইয়া আমার হাত তার মুঠিতে নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– না মিষ্টি, আমি তোকে ভার্চুয়াল লাইফে আসতে দিবো না। কখনো না। কোন মেয়ে যখন সোসাইল মিডিয়ার ছবি আপলোড করে তখন ছেলেরা তাতে কমেন্ট করে, নাইচ, লাভলি,হট ব্লা ব্লা। আমি চাইনা তোকে কেও সুন্দর বলুক। তোকে নিয়ে কেও কথা বলুক। তুই শুধু আমার। হ্যা মিষ্টি তুই শুধু আমার। তোকে শুধু আমি দেখবো। আমি বলবো সুন্দরী। আমার বউ সুন্দরী। আর কেও তোকে সুন্দর বলবে না।
ভাইয়ার কথা শুনে আমি কি বলবো বুঝতে পারছি। ভাইয়া যা বলছে সেটা তো ঠিকই বলছে। এই অভিকে আমি যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। লজ্জামাখা হাসি দিয়ে ভাইয়ার বুকে মাথা রাখলাম আমি। ভাইয়ার আমার কপালে অধর ঠেকিয়ে দুহাতে আমাকে তার বুকে জাড়িয়ে নিলো। ভাইয়ার প্রতিটা হৃদস্পন্দন যেন বলছে ভালোবাসি মিষ্টি। ভালোবাসি তোকে খুব বেশী।
নির্মম এই শহরে আমি এমন একজোড়া বিশ্বস্ত হাত চেয়েছিলাম,
চেয়েছিলাম সারাজীবন আগলে রাখা মানুষ টাকে।
যেখানে অভিমান থাকলেও ভালোবাসার কমতি হবে না কখনো। আমি পেয়েগেছি তাকে। হ্যাঁ, অভিই আমার সেই বিশ্বস্ত মানুষ। যে আমাকে সারাজিবন তার ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবে। শত রাগ ঝগড়া অভিমান উপেক্ষা করে ভালোবাসে সে আমাকে।
সমাপ্তি,
[