বেলাশেষে -২ পর্ব -১০

#বেলা_শেষে- ২
[১০]

তীব্র রোদের মধ্যে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর ভাইয়া। মার্চের দুপুরের এমন তীব্র রোদে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি দুজনে।দুজনের মধ্যে চলছে পিনপতন নিরবতা। কড়া রোদ এসে পরছে আমার মুখে। যার কারনে পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে। ঘমাক্ত শরীর বেয়ে পড়ছে ঘাম। প্রায় অনেক্ষন রোদে থাকার কারনে তৃষ্ণাও পেয়েছে ভিষন। বারবার শুকনো ডুক গিলছি। এতক্ষণ ভাইয়ার আমার দিকে ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও এবার সে আমাকে তার ছায়া দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায় যাতে আমার মুখে রোদ এসে না পরে। এখন রোদের সমস্ত তেজ এসে পড়ছে ভাইয়ার পিঠে।

– সকাল সকাল এক কাফ কফি দিয়ে এভাবে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখার কোন মানেই হয় না। আগে যদি জানতাম এক কাফ কফির বিনিময়ে এমন কড়া রোদে দাঁড় করিয়ে রাখবি তাহলে তোর হাতের কফি আমি জিবনেও খেতাম না। তুই মুখ খুলবি নাকি আমি চলে যাব।

ভাইয়ার হুমকি সরুপ কথা শুনে আমি মাথা তুলে তার দিকে তাকালাম। অস্ফুটভাবে বলে উঠলাম,

– জিয়ানকে তোমরা কি করে চিনো। তোমাদের সাথে ওদের পরিবারের সম্পর্ক কি?

আমার কথা শুনে ভাইয়া মনে হয় চমকে উঠলো। তার মুখের এমন রিয়্যাকশন।

– এতক্ষণ ধরে তীব্র রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস এমন ফলতু প্রশ্ন করার জন্যে। বলেই ভাইয়া চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায়। তখন আমি ভাইয়ার হাত ধরে ফেলি। আর বলি,

– প্লিজ ভাইয়া বলো আমাকে। কেন মামনির কথা জিয়ান মেনে নিলো। ভাইয়া চুপ করে থেকো না। তুমি যতক্ষণ না বলবে আমি এখান থেকে কোথাও যাব না।

– এ্যস ইউর ওয়িশ। আমার থেকে নিজের হাত ছাড়ি চলে যেতে নিল ভাইয়া। আমি সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম ভাইয়ার চলে যাওয়ার পানে। ভাইয়া কয়েক কদম এগোতেই তার এসমনে এসে দাঁড়ায় দাদি। খন্দকার জুবাইদা। দাদি ভাইয়ার হাত ধরে টেনে আমার সামনে নিয়ে এসে দাঁড় করায়। তারপর ভাইয়ার উদ্দেশ্য বলে,

-মেয়েটা এত করে বলছে তবুও কেন কিছু বলছিস না। আজ আমি বলবো। তোর মত মিষ্টির ও সবটা জানার অধীকার আছে। না জেনে মিষ্টি একটা ভুল করে বসেছে। আমি চাইনা মিষ্টি দ্বিতীয়বার কোন ভুল করুক। কিন্ত এখানে নয়। অনেক রোদ। ওহ একটুতেই আমার শরীর কেমন তাপ হয়ে গেছে। ওদিকে চল তোরা। আজ আমি তোদের সব খুলে বলবো।

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা তিনজনে। ভাইয়া নিশ্চুপ। মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। দাদি তাকিয়ে আছে ভাইয়ার দিকে। আর আমার দৃষ্টি স্থির দাদির মুখপানে। দাদি কখন মুখ খুলবে কখন আমি জানতে পারবো সবটা। অতঃপর আমাকে অবাক করে দিয়ে দাদি বলতে লাগলেন,

– মাহিনের নাম শুনেছিস কখনো মিষ্টি। পুরো নাম মোহাম্মাদ মাহিন হায়দার। যার ফাঁসির রায় লেখেছিল ভূমি নিজহাতে। তার চাচা ছিলো জিয়াউর হায়দার। যে ভূমিকে এই ক্ষমতা দিয়েছিলো। অবশ্য তখন আমরা কেওই জানতাম না যে জিয়াউর হায়দার মাহিনের চাচা হয়। সবাই জানতো মাহিনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ হবে। এর মধ্যে ভূমির জেদ ধরে মাহিনের মৃত্যুর রায় সে নিজ হাতে লেখবে। ভূমির এই জেদ পুরুন করে জিয়াউর হায়দার। তবে এসবে তার একটা শর্ত থাকে ভূমি কখনো তার ক্যারিয়ারে ফিরতে পারবে। সে দিন কোটে বিচারপতি হওয়াই ছিলো ভূমির ক্যারিয়ারের শেষ দিন। আবেগের বসে ভূমি জিয়াউর হায়দারের শর্ত মেনে নেয়। তিন দিনের জন্যে হাই কোটের বিচারপতি সাথে আইনজীবি হয়ে মাহিনকে দোষী সাব্যস্ত করে ওর ফাঁসির রায় ঘোষনা করে ভূমি। পরে যখন আরাভ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে তখন অনেক চেষ্টা করেও জিয়াউর হায়দারের থেকে ভূমির স্নপ্ন ভূমির ক্যারিয়ার কিছুই ফেরাতে পারে নি। মাহিন ছিলো জিয়াউর হায়দারের ছোট ভাইয়ের ছেলে। তার এমন মৃত্যু সে মেনে নিতে পারে নি। তাই ভূমিকে এমন একটা শর্ত দিয়েছিলো সে। যেন নিজের সব স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে কষ্ট পায় ভূমি। আর জিয়াউর হায়দারের একমাত্র নাতি হলো জিয়ান হায়দার। জিয়ান তোকে খুব ভালোবাসে এটা সত্যি। একটা কথা বল মিষ্টি যে পরিবারের দুই পুরুষ পরপর আমাদের ক্ষতি করে গিয়েছে সেই পরিবারে তোকে পাঠাই কি করে। তুই আধো সেই পরিবারে গিয়ে সেইভ থাকবি তো। না থাকবি না। জিয়ান আজ ভালো আছে কাল নাও থাকতে পারে। ওদের রক্তের একটা দোষ আছে। আগে জিয়ানও এসবের কিছুই জানতো না। এখন সে সব জানে। তার চাচার কুকর্মের কথা আর দাদার স্বার্থপরতার কথা জেনে গেছে সে সেদিন জিয়ান এসেছিল কারন জিয়াউর হায়দারের থেকে সে সবটা জানতে পেরেছিল। জিয়াউর হায়দারের কথা কতটুকু সঠিক সেটাই জানতে এসেছিল সে। তারপর ভূমি তাকে সবটা বলে। সব শুনার পরে জিয়ান নিজ থেকে তোকে প্রত্যাখ্যান করে। কারন ওর বাড়ির কেও তোকে মেনে নিবে না। জিয়ানের সাথে তোর বিয়ে হলে তোরা আধো সুখী হতে পারবি না।যেহেতু জিয়ান তোকে এখন ভালোবাসে তাই সে তোকে কষ্ট দিতে চায়না। তাই জিয়ান নিজ থেকে চলে গেছে। এখন তুই বল মিষ্টি ভূমি কি কোন ভুল করেছে জিয়ানকে ফিরিয়ে দিয়ে

একনাগাড়ে কথাগুলো বলল দাদি। দাদির কথাশুনে আমার নিজেরই এখন খুব খারাপ লাগছে। না মামনি কোন ভুল করেনি। আমার মামনি ভুল করতেই পারে না। ভুল তো করছে জিয়াউর হায়দার। তার জন্যে মামনির ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। মামনি এভাবে তার সব স্বপ্ন বিসর্জন দিলো। কিন্ত মাহিন কে? সে কি করেছিল যার ফাঁসির রায় লেখারা জন্যে মামনি এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলো। কেন জানি আমার এখনি সবটা জানতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা আংকেল তখন কোথায় ছিলো? আরাভ আংকেলের মতো এরকম একজন স্মাট সাহসী ও পাওয়াফুল ম্যান থাকতেও মামনিকে এরকমন একটা সিদ্ধান্ত কেন নিতে হলো। আংকেল কোথায় ছিলো তখন? আমি দাদিকে কিছু জিগ্যেস করবো তখন দাদি বলে উঠে,

– তোদের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি ভুলেই গিয়েছি কেন ছাদে এসেছি। তোরা কথা বল আমি আসছি। বলেই দাদি হনহন করে চলে যায়। আমাকে কিছু বলার সুযোগও দেয়না। দাদির চলে যাওয়ার পর নিরবে তাকিয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। দাদি চোখের আড়াল হতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানবের দিকে তাকালাম। অতঃপর জিগ্যেস করলাম,

– তুমি এসব আগে থেকেই জানতে? আমার প্রশ্নের উত্তরে ছোট্টকরে জবাব দিলো ভাইয়া।

-হ্যাঁ।

– এই মাহিনটা কে? বেশ উৎসাহ নিয়ে জিগ্যেস করলাম আমি।

– একজন ধর্ষক। গম্ভীর গলায় বলল ভাইয়া।

– ধর্ষক মানে কাকে ধর্ষন করেছে সে।

– তোর যা জানার ছিলো সেটা তো জেনে গেছিস তাহলে এত প্রশ্ন করছিস কেন?? শক্তগলায় বলল ভাইয়া। আমি সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকে নিরক্ষণ করতে লাগলাম। এই মানুষটা কখন রেগে যায় আবার কখন তার রাগ পরে যায় বুঝা মুশকিল। ভাইয়ার কথায় ঘোর কাটলো আমার।

-একটা গল্প শুনবি?

– কিসের গল্প??

– আমার গল্প।

– হুম বলো।

– আজ থেকে ঊনিশ বছর আগে আমার বয়স তখন মাত্র তিন। আধো আধো করে বাবা মা ডাকতে শিখেছি। আব্বু আম্মুকে সারাদিনে খুব একটা কাছে পেতাম না। আব্বুর বিজনেস আর আম্মুর পড়াশুনা নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো। দিনের বেলা দাদির কাছেই কাটিয়ে দিলাম। দাদুভাই কলেজ আর তার বই নিয়ে থাকতো সর্বক্ষণ। পুরো বাড়িতে আমি বড় আব্বু আর দাদি থাকতাম। কিন্ত রাতে যখন সবাই একসাথে থাকতাম তখন মনে হতো আমার ফ্যামিলি পরিপূর্ণ। আনন্দ হাসি উল্লাস, আর এসব কিছু শুধু মাত্র আমাকে ঘিরে। এতসুন্দর পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ ফুলের মতো একটা পরিবারের একটাই কাটা ছিলো মাহিন। যেন এই কটাটা উপরে ফেলতেই পারলে আমরা বেঁচে যেতাম। কিন্তু কে জানতো এই কাটা উপরাতে গিয়ে এত কাঠখড় পুড়াতে হবে।

সেদিন ছিলো আম্মুর কলের বসন্ত উৎসব। প্রতিদিনের মতো সেদিনও আম্মু আমাকে দাদির কাছে রেখেই কলেজে চলে যায়। আব্বুও অফিসে যায়। সেদিন তার একটা মিটিং ছিলো। মিটিং এর সব কিছু রাকিব আংকেল আর ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিয়ে আব্বুও কলেজে চলে যাবে। বসন্ত উৎসবে কলেজের প্রধান অথিতি হিসাবে সেখানে উপস্থিত হয় খন্দকার আজহার মওদুদ মানে আমার বড় আব্বু। আর দাদুভাই তো সেই কলেজের একজন প্রফেসর মাত্র। বাড়িতে শুধুমাত্র আমি আর দাদি একা। দুজনে অপেক্ষা করতে থাকি রাতের জন্যে কখন তারা ফিরে আসবে এই নীড়ে। সেদিনের সেই ছোট্টশিশুর স্বপ্ন তখন তার পুরো পরিবার এক হবে। একসাথে এক ছাদের নিচে থাকবে। জানিস মিষ্টি আমার সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেছিল তারও দুই বছর পর। কারন সে দিন রাতে বড় আব্বু আর দাদুভাই ফিরে আসলেই ফিরে আসেনি আমার আব্বু আর আম্মু। আম্মুর ফিরতে সময় লেগেছিল দেড় মাস। তারপর যে আম্মু চলে যায় একেবারে দুই বছর পর বাড়ি ফিরে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

[বিঃদ্রঃ- মনে আছে তো বেলা_শেষের কথা। রিচেক করা হয়নি ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আসসালামু আলাইকুম ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here