‘চরিত্রহীনা’ পর্ব-৫
.
লেখক : Mahian Khan
.
আগের ৪ পর্বের লিঙ্ক কমেন্টে দেওয়া হবে 🙂
.
তিন্নির নরম চুলের স্পর্শে জাভেদ সম্পুর্ন অন্য জগতে চলে যায়। আহ! কি অদ্ভুত গন্ধ তিন্নির চুলের। জাভেদের এরকম অদ্ভুত আচরণ দেখে তিন্নি নিজের চুলগুলোকে সরিয়ে আনে।
.
কিন্তু চুল সরিয়ে আনার পরও জাভেদের অদ্ভুত আচরণ বন্ধ হয় না। এক অদ্ভুত ভঙ্গিমায় জাভেদ বেহুশ হয়ে আছে। হয়ত তিন্নির চুলের গন্ধ জাভেদের মাথায় যে প্রভাব ফেলেছে সেই ঘোর এখনো কাটাতে পারেনি। জাভেদের এরকম অদ্ভুত আচরণে তিন্নি বেশ বিরক্তবোধ করে।
.
– এই যে আপনার আবার কি হল?
.
তিন্নির চুলের মায়ায় বিভোর জাভেদের মাথায় হঠাৎ যেন বজ্রপাত হল।
.
– কিছুই হয়নি, কেন?
.
– এরকম মুখ হা করে কি ভাবছেন?
.
– কিছুই না।
.
– আপনি আসলেই অদ্ভুত !
.
তিন্নির সাথে অযথা আর তর্ক করে না। কেননা তিন্নির সাথে কোনোরকম আলোচনায় গেলেই তার মাথায় আগুন লেগে যায় আর তর্কের শেষ হয় তিন্নির জোরালো একটা ধমকে । তাই মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে,
.
– আর কোনো কথাই বলব না।
.
পুরো রিক্সার পথে জাভেদ মুখ দিয়ে একটা, ‘টু’ শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। পার্কে গিয়েও একেবারে বোবার মত হয়ে হাটছে। কিন্তু এরকম চুপচাপ পরিবেশ হয়ত তিন্নির খুব একটা ভাললাগে না।
.
– আপনি এরকম চুপ হয়ে আছেন কেন?
.
– এমনি।
.
– এমনি মানে? আপনি তাহলে এরকম চুপচাপ এই দুপুরে পার্কে শুধু হাটতে থাকবেন?
.
– তাহলে কি নিয়ে কথা বলব?
.
– আশ্চর্য এটা কেমন প্রশ্ন?
.
– আচ্ছা আগে এক জায়গা বসেন, আমি কিছু খাওয়ার জন্য নিয়ে আসি। কি খাবেন?
.
– আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করে না।
.
– কেন?
.
– এটার কোনো কারণ লাগে? এমনি ইচ্ছা করে না।
.
– আচ্ছা কোল্ড ড্রিংকস খাবেন?
.
– কানে কি ডিস্টার্ব?
.
– আচ্ছা সরি।
.
– এতে সরি বলার কি আছে?
.
– একটা কাজ করুন।
.
– কি?
.
– আকাশের রোদ অনেক কমে এসেছে। আবহাওয়াটা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, আপনি চোখ বন্ধ করে জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে নিজের রাগ গুলো ছুড়ে ফেলে দিন।
.
– ঠিক আছে সরি, আসলে আমি খুব একটা রাগী মানুষ না। কিন্তু ইদানিং জীবনে এত সমস্যা আর ভবিষ্যৎ এতটা অনিশ্চিত যে, আর কিছুই ভাললাগে না। ক্ষমা করুন প্লিজ।
.
– নাহ! ক্ষমা করার কিছু নেই। আসলে আমার জীবনও নানা ঝামেলার জর্জরিত কিন্তু কি আর করার!? এগুলো নিয়েই বেচে থাকতে হবে আজীবন। আর এই ঝামেলা গুলো নিয়েই যদি সারাক্ষণ চিন্তা করি তাহলে বাচব কিভাবে?
.
– আমার ঝামেলাগুলোর কোনো প্রতিকার নেই।
.
– ওরকম সবার মনেহয়, আপনার বয়সি একটা মেয়ের আর কি ঝামেলা থাকতে পারে? ওই তো টিনেজ লাভ নিয়ে নাকি? বাবা মায়ের কাছে যান তাদের কাছে ক্ষমা চান অবশ্যই মাফ করে দিবে। আর যদি আমার মত বাবা মা’র সাথে অভিমান করে থাকতে চান তাহলে নিজেকে শক্ত করুন, প্রতিকূলতার সাথে লড়াইয়ের চেষ্টা করুন। কিন্তু আপনার বয়স যথেষ্ট কম, জীবন আরো অনেক পড়ে আছে আপনি বরং বাবা মায়ের কাছে যান।
.
– যদি সত্যি এত সহজে সব সমাধান করা যেত তাহলে হয়ত বহুআগেই সব কিছু ঠিক হয়ে যেত। আমার জীবনকে আপনি যত সহজে ব্যাখা দিলেন অত সহজ না।
.
– হ্যা আমি আন্দাজের উপর বলেছি, আপনার ব্যক্তিগত ঝামেলা জানতে চেয়ে বিরক্ত করব না। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করি উত্তর দিবেন?
.
– জ্বী করুন।
.
– আপনার প্রেমিক কি ফেরত এসেছে, রাগ করবেন না এমনি জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর না দিলেও অসুবিধা নেই।
.
– না ফিরে আসেনি হয়ত আর কখনো আসবে না।
.
– ওহ! আচ্ছা।
.
তিন্নির মুখে হঠাৎ কষ্ট আর শোকের ছায়া দেখা যায়। হয়ত প্রশ্নটা তিন্নিকে বেশ আঘাত করে।
.
– আচ্ছা, আকাশ মেঘলা হয়ে যাচ্ছে মনেহয় বৃষ্টি হবে। কোনো রেস্টুরেন্টে যাবেন?
.
– না ইচ্ছা করে না।
.
– সরি আমার হয়ত আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত হয়নি।
.
– না ঠিক আছে এতে সরি বলার কিছু নেই। আমার এমনিতে খেতে ইচ্ছা করে না।
.
হঠাৎ আকাশ থেকে ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়া শুরু করল। বৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পুর্বপ্রস্ততি হিশেবে আগেই গাছের নিচে আশ্রয় নেয় জাভেদ।
.
একেবারে কয়েক মুহুর্তে ফোটা ফোটা বৃষ্টি, তুমুল বৃষ্টিতে পরিণত হয়। জাভেদ তিন্নিকে হাত দিয়ে ইশারা দিতে থাকে গাছের নিচে আসার জন্য। হাতে বন্ধ হয়ে থাকা ছাতা নিয়ে একেবারে পুতুলের মত বসে আছে। তিন্নি যেন বৃষ্টিকে কোনো পাত্তা দেয় না। চুপচাপ বৃষ্টিকে শুষে নেয় নিজের দেহে। কিন্তু এই অদ্ভুত দৃশ্য জাভেদের পচ্ছন্দ হয়না। বৃষ্টিতে ভেজাও জাভেদের খুব একটা পছন্দ না কিন্তু তিন্নিকে এই অবস্থায় দেখে তার মোটেও ভাললাগে না।
.
দৌড়ে গিয়ে তিন্নিকে হালকা ধাক্কা দেয়।
.
– কি ব্যাপার, এই তুমুল বৃষ্টিতে হাতে ছাতা নিয়ে বসে আছেন কেন?
.
– এমনিতেই, বৃষ্টিতে ভিজতেছি। চোখ নেই সাথে।
.
– ঠান্ডা লেগে যাবে না?
.
– যাক।
.
– পাগল নাকি? ছাতাটা দিন।
.
তিন্নির হাত থেকে ছাতাটা টেনে নিয়ে ছাতাটা খুলে তিন্নির মাথার উপর ধরে। যথেষ্ট ছোট ছাতা দুজন কোনোভাবে এই ছাতার নিচে ধরবে না। যদিও বৃষ্টিতে ভেজা জাভেদের খুব একটা পছন্দ না তবুও শুধুমাত্র তিন্নিকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। যদিও এরকম অদ্ভুত কাজ জাভেদ কি কারণে করে তা সে নিজেই জানে না।
.
তিন্নি জাভেদের অদ্ভুত কর্মকান্ড দেখে অবাক হয়ে যায়, বাধ্য হয়েই উঠে দাড়ায়।
.
– আপনি কি পাগল আমার ঠান্ডা লাগবে তাতে আপনার কি? আপনি নিজেই একগাদা উপদেশ শুনিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতেছেন।
.
একেবারে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে জাভেদ। হয়ত নিজেও জানে না কেন সে এরকম উদ্ভট কাজ করেছে।
.
– ছাতা আমার হাতে দেন, ঐ গাছের নিচে চলেন।
.
জাভেদের হাত থেকে ছাতাটা টেনে গাছের নিচে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে তিন্নি। তিন্নির পিছনে পিছনে জাভেদও চুপচাপ গাছের নিচে আশ্রয় নেয়।
.
জাভেদের চোখ যায় বারবার তিন্নির দিকে, বৃষ্টিতে ভিজে তিন্নি যেন রঙিন হয়ে উঠেছে। তিন্নির লম্বাচুলগুলো বৃষ্টিতে ভিজে অদ্ভুত রুপ ধারণ করেছে। নাক মুখ ভিজে যেন একেবারে সতেজ হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে থাকা তিন্নি যেন সাধারন তিন্নি থেকে বহুগুণ আলাদা।
.
বৃষ্টি বেশী সময় স্থায়ী হয় না। ১০-১২ মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যদিও আকাশ এখনো একেবারে অন্ধকার। ফোটা ফোটা বৃষ্টি এখনো অব্যাহত আছে,কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি ফিরে আসার প্রবল সম্ভাবনা। তাই বেশ তারাহুড়ো করেই জাভেদ আর তিন্নি পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। এই বৃষ্টির মধ্যে রিক্সা পাওয়া বেশ কঠিন তাও ভাগ্যের জোরে একটা খালি রিক্সা জুটে যায়। তারাহুড়ো করে দুজন রিক্সায় উঠে পড়ে।
.
(১৩)
.
বৃষ্টি আবার কিছুক্ষণের ভিতর শুরু হয়েছে এবার প্রচন্ড জোরালো বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এবার বৃষ্টি থামার কোনো নাম গন্ধ নাই।
.
বাসায় গিয়ে জাভেদ গোসল করে ফেলে। বৃষ্টিতে ভেজা তার এমনিতে অসহ্য লাগে কিন্তু আজকে কি কারণে এরকম বৃষ্টিতে ভিজল? হয়ত তিন্নির কারণে। মাথায় তিন্নির অসাহয়ত্বের কথা বারবার ভেসে আসে।
.
– মেয়েটা বাবা-মায়ের কাছে যায় না, যে প্রেমিকের উপর বিশ্বাস করেছে সেই প্রেমিক পর্যন্ত কাছে নেই। মেয়েটার জীবন আসলে চলবে কিভাবে? ওর কাছে আদৌ এই মাস চলার মত টাকা আছে? কে জানে! আমি একা ব্যক্তি এতগুলো টিউশনির টাকা প্রতি মাসে ফাও কাজে ইউজ করি তার চেয়ে কিছু টাকা দিয়ে একটা অসাহয় মানুষকে সাহায্য করা কি ভাল হবে না? কিন্তু মেয়েটা যদি নেগেটিভলি নেয়?
.
কিন্তু তবুও সাহস সঞ্চয় করে তিন্নির বাসায় গিয়ে বেল বাজায়।
.
কিছুক্ষণের মধ্যে তিন্নি দরজাটা খোলে।
.
– প্লিজ এবার রাগ করবেননা, বিষয়টাকে নেগেটিভলিও নিবেন না। আমি আপনাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক আর কিছু না। আমি আপনার ব্যক্তিগত ঝামেলা সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানি না কিন্তু আপনার অসাহয়ত্বেকে ভালোভাবে বুঝি অন্যকোনভাবে বিষয়টাকে নিবেন না কিন্তু আমি আপনাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক। আমি আপনার প্রতি মাসের যাবতীয় খরচ নিতে প্রস্তত আছি। অন্যকোন ভাবে বিষয়টা নিবেন না প্লিজ।
.
– ধন্যবাদ কিন্তু প্রয়োজন নেই।
.
– কিন্তু কেন? আপনি থাকবেন কিভাবে? আপনার পুরো জীবন এখনো পড়ে আছে।
.
– কোনো না কোনোভাবে রাস্তা হয়ে যাবে হয়ত।
.
– জ্বী রাস্তা হওয়া পর্যন্ত কি আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি না?
.
– না, দরকার নেই। অন্যকারো বোঝা হয়ে থেকে কি লাভ? আর তাছাড়া আপনি আমার ঝামেলা সম্পর্কে আর কতটুকু জানেন?
.
– বললাম তো জানি না, আমি কি বলেছি আপনাকে বোঝা হিসেবে বহন করতে চাই?
এমনি শুধুমাত্র সাহায্য করতে ইচ্ছুক আর কিছু না।
.
– আপনি আমাকে আদৌ ঠিকমত চেনেন? মাত্র ২-৩ দিন ধরে আমাদের পরিচয়।
.
– তাতে কি হয়েছে? আমি তো অন্যকিছু বলিনি শুধু আপনাকে সাহায্য করতে চেয়েছি। প্লিজ আপাতত এই টাকাটা রাখুন। দয়া করে সঙ্কোচ করবেন না। টাকাটা রাখুন।
.
– প্লিজ আপনি আমাকে নিয়ে এত ফাও চিন্তা করা বন্ধ করুন, আমি বারবার বলতেছি। আপনি কি কানে শুনতে পান না।
.
বেশ রেগেই তিন্নি কথাটা বলে। জাভেদ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। নিজেকে প্রচুর অপমানিত মনেহতে থাকে জাভেদের।
.
হঠাৎ বেশ জোরে একটা বজ্রপাত হল। বোধহয় আশেপাশে কোনো স্থানে বজ্রপাত হয়েছে। একটা ভয়ানক বিকট শব্দ! শব্দটা শুনে তিন্নি বেশ ভয় পেয়ে যায়। বেশ জোরে জাভেদকে জড়িয়ে ধরে।
.
(চলবে….)