#ভালোবাসি_বলেই_তোমাকে_প্রয়োজন
লেখক – এ রহমান
পর্ব ৫
দরজায় বেশ জোরে কয়েকবার দুমদুম আওয়াজ হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো সারিয়া। তার মনে হলো মাত্রই শুয়েছিলো আর তখনই কেউ দরজায় এসে ডাকছে। সারিয়া ঘুম জড়ানো চোখ জোড়া ভালো করে মেলে বিছানা থেকে নিচে নামলো। দরজা খুলতেই একটা তার মত বয়সী মেয়েকে হাস্যজ্বল চেহারায় দাড়িয়ে থাকতে দেখলো সে। মেয়েটি এক রাশ হেসে বলল
— আপনাকে খেতে ডাকে।
সারিয়া পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিলো। ক্লান্ত গলায় বলল
— আমি খাবো না। ঘুমাবো।
বলেই দরজা লাগাতে গেলেই মেয়েটি আবার বলল
— আপনার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। স্যার খাওয়া বন্ধ করে বসে আছে। আপনাকে সাথে নিয়ে যেতে বলেছে।
সারিয়া বিরক্ত হলো। চোখ ভেংগে ঘুম আসছে তার। সারাটা রাস্তা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এসেছে তবুও যেনো মনে হচ্ছে কতকাল ঘুমায় নি। মাথাটাও কেমন ভারী হয়ে আছে। একটু ভেবে বলল
— ভেতরে বসুন। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।
মেয়েটি ভেতরে ঢুকে বসলো। সারিয়া ওয়াশ রুমে গেলো ফ্রেশ হতে। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে এসে মেয়েটিকে বলল
— আপনার নাম কি?
— তৃষা।
তৃষা উত্তর দিতেই সারিয়া মৃদু হেসে বলল
— আমি সারিয়া।
মেয়েটিও মৃদু হেসে বলল
— আমি জানি। চলুন।
সারিয়া পা বাড়ালো বাইরে যাওয়ার জন্য। তাকে শুধু সুতি জামা পরতে দেখে তৃষা বলল
— শীতের কাপড় পরে নেন নাহলে ঠান্ডা লাগবে।
সারিয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
— আমি যে কোন শীতের কাপড় নিয়ে আসিনি।
তৃষা ভ্রু কুচকে তাকাল। অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
— আপনি কি প্রথমবার এসেছেন?
সারিয়া মাথা নাড়ল। যার অর্থ সে প্রথমবার সিলেটে এসেছে। কিছু বলার আগেই দরজায় আবার আওয়াজ হলো। সারিয়া দরজা খুলতেই অরণ্যকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলো। এতো রাতে অরণ্য কি করছে তার ঘরে। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল
— আপনি?
অরণ্য হাতে ধরে থাকা ব্যাগটা সারিয়ার দিকে এগিয়ে দিল। সারিয়া কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
— কি এটা?
— গরম কাপড়। এখানে রাত হলে অনেক ঠান্ডা পড়ে। তাই…।
বলেই পেছনে চোখ পড়তেই থেমে গেলো সে। স্থির দৃষ্টিতে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর আওয়াজে বলল
— তুমি এখানে কি করছ?
তৃষা হাত গুঁজে বলল
— ওনাকে খেতে নিয়ে যেতে এসেছি।
— ও রুমেই খাবে। তুমি যাও। খেয়ে শুয়ে পড়ো। কাল ভোর থেকে শুটিং শুরু হবে।
অরণ্যর কথা শেষ হতেই তৃষা বলল
— সীমান্ত স্যার খাওয়া বন্ধ করে ওনার জন্য বসে আছেন। আমাকে সাথে নিয়ে যেতে বলেছে।
অরণ্যর রাগটা মাথায় উঠে গেল। হাত মুঠো করে নিয়ে দাতে দাঁত চেপে বলল
— ও কোথাও যাবে না।
তৃষা বলল
— তোমার সমস্যা কোথায় অরণ্য? স্যার তার গেস্টদের ছাড়া খাবার খায় না সেটা তুমি ভালো করেই জানো।
— ও তোমার স্যারের কোন গেস্ট নয়। বিষয়টা মাথায় রেখো। আর কখনো এই কথা আমার সামনে উচ্চারণ করবে না।
বেশ উচ্চশব্দে কথাটা বলল অরণ্য। সারিয়া একটু ভয় পেয়ে গেল। তৃষা তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল
— আমার বলা না বলাতে কিছুই যায় আসে না অরণ্য। সময় হলেই স্যার নিজেই বলবেন। এখন আমার উপরে ওনাকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়েছে। আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতেই হবে।
অরণ্য আর কোন কথা বলল না। হাতের ব্যাগটা সারিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। সারিয়া ব্যাগ খুলে গরম কাপড় দেখে বলল
— আমি এসব নিতে পারবো না।
অরণ্য এমনিতেই রেগে ছিলো। তার উপর সারিয়ার কথা শুনে আরো রেগে গেলো। রাগান্বিত স্বরে তৃষাকে উদ্দেশ্য করে বলল
— তুমি যাও। আমি নিয়ে আসছি।
তৃষা চলে গেলো। অরণ্য ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। সারিয়া দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল
— কি করছেন? দরজা কেনো বন্ধ করলেন?
অরণ্য খুব সাভাবিক ভাবেই বলল
— শুধু কি চেঁচাতে পারো? আর কিছু পারো না? মানে হাত পা চালাতে। এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে নিজেকে বাঁচাবে কীভাবে?
সারিয়া হতভম্ভ হয়ে গেলো। অরণ্যর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না সে। তাকে আরো অবাক করে দিয়ে অরণ্য তার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। সারিয়া আরো পিছিয়ে একদম দেয়ালের সাথে আটকে গেলো। অরণ্য একটু ঝুঁকে এক হাতে তার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে নিলেই সারিয়া এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলো। অরণ্য কোন রিয়্যাক্ট করলো না। শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো। সারিয়ার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সে দ্রুত নিশ্বাস ফেলছে। অরণ্য আবারও হাত বাড়িয়ে সারিয়ার গালে হাত দিয়ে গেলে এবার সে অরণ্যর হাতে তার ধারালো তীক্ষ্ণ নখ গেঁথে দিলো। তার চাহুনি আর আচরণে ভীষন হিংস্রতা। ব্যাথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠলো অরণ্য। হাত ঝেড়ে খুব শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল সারিয়ার দিকে। সারিয়া এগিয়ে গিয়ে ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো বলল
— কোনভাবেই আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। নাহলে পরিণাম এর থেকেও ভয়ংকর হবে। আপনি আমাকে যেমন ভাবছেন আমি কিন্তু তেমন নয়।
অরণ্য প্রশস্ত হাসলো। বলল
— আই লাইক ইট। খেতে যাও। সোজা গিয়ে ডানে ঘুরলেই দেখতে পাবে সবাইকে।
সারিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। অরণ্যর কাজকর্ম কথা কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। এমন কেনো লোকটা। এলোমেলো আচরণ তার। নামটাও যেমন বন জঙ্গলের মত আচরণটাও ঠিক তেমন। অরণ্য ধমক দিয়ে বলল
— কি হলো যাও। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
সারিয়া চলে গেলো বাইরে। অরণ্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
— নিজেকে বাঁচাতে শিখতে হবে তোমার। আমি সব সময় তোমাকে হেল্প করতে পারবো না। তোমার জন্য প্রতিটা পদক্ষেপে অপেক্ষা করছে বিপদ।
—————
অরণ্যর কথা মতো জায়গায় গিয়ে সারিয়া দেখতে পেলো টেবিলে একা সীমান্ত খাবার নিয়ে বসে আছে। তার সাথে একজন মোটামুটি বয়সের ভদ্রলোক কথা বলছে। সারিয়াকে দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সৌজন্য হেসে বললেন
— আসুন ম্যাডাম। আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন স্যার।
সীমান্ত অমায়িক হাসলো। সারিয়া এগিয়ে গিয়ে সীমান্ত থেকে অনেক টা দূরত্ব বজায় রেখে বসে পড়লো। সীমান্ত বিষয়টা খেয়াল করলেও কিছু বলল না। কারণ সে এই মুহূর্তে কিছুই বলতে চায় না। ধীরে ধীরে সারিয়ার কাছে আসবে সে। মুচকি হেসে বলল
— অনেক সময় অপেক্ষা করেছি। এতো দেরি হলো যে?
সারিয়া মৃদু স্বরে বলল
— একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
সীমান্ত আর কথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করতে বলল। নিঃশব্দে দুজন খাওয়া শেষ করে ফেললো। খাওয়া শেষে সারিয়া উঠতে গেলেই সীমান্ত চাপা আবদারের সুরে বলল
— আপনি তো মনে হয় প্রথম এসেছেন তাইনা? চলুন আপনাকে আশপাশ টা একটু ঘুরে দেখাই।
সারিয়ার বিষয়টা ভালো না লাগলেও ভদ্রতার খাতিরে কিছুই বলতে পারলো না। মাথা নামিয়ে ভদ্রভাবে সম্মতি জানালো। সীমান্ত বেরিয়ে গেলো সারিয়া কে নিয়ে। রিসোর্ট থেকে বেরিয়েই সামনে গভীর জঙ্গল। ঝি ঝি পোকারা পাল্লা দিয়ে ডেকে উঠছে। বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। নীরবে কেটে গেলো কয়েক মুহূর্ত। কিছুদূর সামনে এগুতেই নিরবতা ভেংগে সীমান্ত বলল
— আপনি কি ভয় পাচ্ছেন সারিয়া?
সারিয়া শান্ত চোখে তাকাল। বলল
— না তো।
সীমান্ত বেশ আশ্বস্ত করে বলল
— ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আছি তো। আপনাকে সব বিপদ থেকে উদ্ধার করবো।
সীমান্তের কথা আর ইঙ্গিত কোনটাই সারিয়ার ভালো লাগলো না। বেশ বিরক্ত হলো। বলল
— আমি নিজেকে সব বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারি। আমার হেল্প লাগবে না।
সীমান্ত বাঁকা দৃষ্টি ফেললো। রহস্যময় হাসলো। চোখে মুখে এক পৈশাচিক আনন্দ তার। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে হুট করেই পা বাড়িয়ে দিলো। সারিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই সীমান্ত ধরে ফেললো। প্রথমে আলতো করে ধরলেও স্পর্শ ক্রমেই অসস্তিকর হয়ে উঠলো। সারিয়া হাত সরিয়ে নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করলে আরো গভীর ভাবে আকড়ে ধরলো হাত দুটো।
চলবে….