ভালোবাসার রংধনু পর্ব -০৬

#গল্পঃভালোবাসার_রংধনু
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৬

ঘুরাঘুরি করে সবাই দুপুরের আগেই বাসায় ফিরেছে।দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর রিনি ওর ট্রলি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়া ধরতেই শোভা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,আপু এই সময় ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
রিনি হালকা হেসে বলল,একটু পর বুঝবে।
রিনি চলে যেতেই শোভা ফোন হাতে নিয়ে প্রভার নাম্বারে কল দিলো।নাম্বার বারবার ব্যস্ত শোনাতেই শোভা মায়ের নাম্বারে কল দিয়ে কথা বলতে লাগলো।
রিনিকে আশিক আর শিফাতের ঘরটা ছেড়ে দেওয়া হয়ছে।সবাই মিলে নিহাদকে শোভার সাথেই থাকতে বলল।নিহাদ চরম বিরক্তিকর মুখভঙ্গি দিয়ে বলল,আমি কি একবারো বলেছি আমাকে শোভার সাথে থাকতে দে।
রিনি মৃদু চেঁচিয়ে উঠে বলল,আরে ভাই সবার একটা প্রাইভেসি আছে।তুই বারবার এটা ওটার নাম করে বউকে দেখতে গিয়ে আমার প্রাইভেসি নষ্ট করিস।তাই আমি এই ঘরে একা থাকতে চাই আর তুই যদি এখানে সবার সাথে থাকতে চাস তাহলে থাক।তোর বউয়ের ঘরতো খালিই আছে যখন তখন যেতে পারবি।

রাহুল অসহায় কন্ঠে বলল,ভাই একঘরে চারজন থাকা যাবেনা তুই তোর বউয়ের ঘরেই যা।নিহাদ আর বেশি বাড়াবাড়ি করেনি চলে গেলো শোভার রুমে।সবাই রিনিকে ঘিরে বসে বলল,কি ব্যাপার হুম?
রিনি কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল,ওরা নিউ কাপল,একসাথে ছাড়া উচিত ওদেরকে।তাছাড়া শোভা মেয়েটা নিহাদকে ছাড়া আমাদের কারো সাথেই ভালোভাবে পরিচিত নয়,নিহাদের সাথেই কম্ফোর্ট থাকবে।
আশিক মাথা নেড়ে বলল,হুম সেটাও ঠিক।

নিহাদ ঘরে ঢুকে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে।
শোভা মায়ের সাথে কথা বলছিলো নিহাদকে এই ঘরে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে অনামিকাকে পরে ফোন করবে বলে লাইন কেটে দেয়।সোজা হয়ে বসে বলল,আপনি এখানে শুয়েছেন কেনো?উঠুন নিজেদের ঘরে গিয়ে ঘুমান।
নিহাদ চোখ বন্ধ রেখেই বলল,আমি এই ঘরেই থাকবো।রিনি অন্যঘরে গিয়েছে সেখানে থাকবে।শোভা অবাক হয়ে বলল,মানে?
নিহাদ উঠে বসলো,তারপর শোভার চোখে চোখ রেখে বলল,সকালে রিনি কি বলল শোনোনি?তাই এখন জোর করে আমাকে এইঘরে পাঠিয়েছে।

শোভা ভাব ধরে বলল,আমি এইঘরে থাকবোনা আমি রিনি আপুর ঘরে যাচ্ছি।নিহাদ তীক্ষ্ণ চোখে শোভার দিকে তাকিয়ে বলল,এমন ভাব করছো মনে হচ্ছে আমি পরপুরুষ আর আমার সাথে একঘরে তুমি কখনো থাকোনি।শোভাতো লজ্জা থেকে বাঁচার জন্যই এই ঘর থেকে যেতে চাইলো।সবাই কি ভাববে এটা ভেবেই লজ্জা লাগছে।নয়তো নিহাদের সাথে থাকতে শোভার কোনো সমস্যা নেই।
শোভা মাথা নিচু করে বারান্দার দিকে যেতে নিলেই নিহাদ ওর হাত ধরে আটকে দেয়।শোভা নিহাদের দিকে তাকাতেই নিহাদ চোখ ছোট ছোট করে বলল,তুমি কি চাওনা আমি এই ঘরে থাকি?যদি তোমার সমস্যা হয় তাহলে আমি চলে যাচ্ছি রাহুলের রুমে।শোভা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।নিহাদ হাত ছেড়ে দিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
শোভা ভ্রু কুঁচকে বলল,আপনি না চলে যাবেন বলেছিলেন?
কম্বলের নিচে থেকেই নিহাদ জবাব দিলো,তুমিতো যেতে বলোনি আবার থাকতেও বলোনি তাহলে আমি যাবো কেনো?
নিহাদের কথা শুনে শোভা হেসে ফেললো।শোভার হাসির আওয়াজ শুনে নিহাদ ও কম্বল মুড়ি দিয়ে হেসে উঠলো।

সবাই এখন রেষ্ট নিচ্ছে।এখন আর কোথাও বের হবেনা রাতে পার্টি করবে।শোভার ঘুম আসছেনা দেখে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।জানালার গ্রিলে হাত রেখে চারপাশে চোখ বুললো।একটু দূরে দূরে কয়েকটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে।জানালার গ্রিল থেকে হাত সরাতে গিয়ে শোভার মনে পড়লো কয়েক বছর আগেও জানালার গ্রিল ধরে ঝুলতো সে আর প্রভা।এজন্য প্রভাকে কথা না শোনালেও মিসেস অনামিকা শোভাকে কথা শোনাতেন।এত বড় মেয়ে বাচ্চাদের মতো গ্রিল ধরে ঝুলতো বলে।তারপর আরেকটু ম্যাচিউর হলো এখন আর এসব করে না।তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছে জেগে ওঠে ছোটবেলার মতো দুষ্টুমি করতে।কথাগুলো ভেবে আনমনেই হেসে উঠলো শোভা।
নিহাদ শোভার পেছন পেছন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলো।শোভার পেছনে একেবারে কাছে এসে সামনে গ্রিলে হাত রাখলো নিহাদ।তবে শোভার শরীর স্পর্শ করলোনা।শোভা ঘুরে নিহাদের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো।ভ্রু উঁচিয়ে বলল,আপনি ঘুমান নি?
নিহাদ গ্রিল থেকে হাত সরিয়ে শোভার কিছু চুল আঙ্গুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল,নাহ।
শোভা নিহাদের হাতে থাপ্পড় মেরে বলল,আপনি আমার চুল ধরেন কেনো?শত্রুতা করার জন্যই বিয়ে করে এনেছেন আমাকে।
নিহাদ শান্ত দৃষ্টিতে শোভার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,কেনো তোমার কি মনে হয়?আমি তোমাকে ভালোবাসার জন্য বিয়ে করেছি?তুমি সারাজীবন আমার শত্রু বউ থাকবা নট ভালোবাসার বউ।
তাছাড়া তোমাকে বিয়ে করতে আমার কেনো সমস্যা থাকতোনা।মেয়ে দেখতে এসে দেখলাম যাকে আমি কিডন্যাপ করেছি সেই মেয়েটা তুমি।তুমি আমার প্রপোজ একসেপ্ট না করে জ্ঞান হারালে।এতে আমি ইনসাল্ট ফিল করি তাই তোমাকে রিজেক্ট করে প্রতিশোধ নিতে চাইলাম।আর তুমি কি করলে আমাকে ঝাড়ু দিয়ে পেটাতে গেলে?
শত্রুতামি শুরু করে দিয়েছো তুমি।তাই এখন সারাজীবন তুমি আমার শত্রু বউ হয়ে থাকবা বুঝলা?

শোভা আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে।শত্রু বউ আবার কি?নিহাদ বলল,খোঁপা করে চুল বেধে নাও।তারপর বাইরে চলে গেলো।শোভা চুলগুলো হাতখোঁপা করে ওয়াশরুমে গেলো।বেরিয়ে এসে বাইরে বের হতে গেলেই নিহাদ রুমে আসলো।শোভাকে ঘুরিয়ে দিয়ে ওর খোঁপায় কিছু গুঁজে দিলো।শোভা মাথায় হাত দিয়ে দেখলো নিহাদ ওর খোঁপায় দুইটা পাতা গুঁজে দিলো।শোভা পাতা দুইটা হাতে নিয়ে দেখলো জবা ফুল গাছের পাতা।ও ভাবলো ফুল গুঁজে দিয়েছে।
চোখ গরম করে নিহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,এসব কি?
নিহাদ দাঁত কেলিয়ে বলল,এখান থেকে জবা ফুল গাছ দেখলাম,ভাবলাম নিয়ে এসে তোমার খোঁপায় গুঁজে দেবো কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম গাছ আছে ফুল একটাও নেই।এখন গাছতো আর তোমার চুলে গুঁজতে পারবোনা তাই জবাফুল গাছের পাতা এনে তোমার চুলকে খুশি করলাম।চুলগুলোকে আমি আশা দিয়েছিলাম ফুল এনে দেবো বলে।যেহেতু ফুল পেলামনা তাই পাতা এনে শান্তনা দিলাম।
শোভা পাতা দু’টো নিহাদের দিকে ছুঁড়ে মেরে ওর গলা চেপে ধরে বলল,ইচ্ছা করে এই পাগলা গারদের পাগলকে গলা চেপে মেরে ফেলি।

নিহাদ শোভার হাত ঝাড়া মেরে চোখ বড় বড় করে বলল,তুমি স্বামীর গায়ে হাত তোলো?গুনাহ হবে জানো তুমি?
শোভা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,এত হাদিস জানেন,তো এটা জানেন না বিনা কারণে স্ত্রীকে অত্যাচার করাও গুনাহ।
নিহাদ শুয়ে পড়ে বলল,আমি বউকে অত্যাচার করিনা শাসন করি বুঝলা?এখন মন চাইলে ঘুমাও আর আমাকেও ঘুমাতে দাও।

রাতে সবাই উঠানের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে বসে।শিফাত একা একাই রান্নার দিক সামলাচ্ছে।দাঁড়িয়ে চিকেন সেকছে।এদিকে সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে,বিভিন্ন কথা বলছে।আশিক একটা গান গাওয়া ধরতেই মাঝখানে রাহুল অন্য একটা গান চালিয়ে দিলো।আশিক রেগে গিয়ে ধুপধাপ রাহুলকে কেলানো শুরু করলো।রাহুল উঠে দৌঁড় লাগালো পেছন পেছন আশিক ও গেলো।রিনি নিহাদকে বলল,নিহাদ!তোর সাথে একটু কথা আছে সাইডে আয়তো।
নিহাদ বলল,কি বলবি বল সাইডে যাওয়ার কি দরকার?শোভা এখানে একা আছে।
রিনি মুচকি হেসে বলল,শোভাকে কেউ এখান থেকে তুলে নিয়ে যাবেনা।
নিহাদ উঠে রিনির সাথে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।রিনি একবার শোভার দিকে তাকিয়ে
বলল,মেয়েটার মন অনেক ভালো।অন্যকেউ হলে আমি তোর এক্স গার্লফ্রেন্ড জানার পরই তুলকালাম বাঁধাতো।কিন্তু মেয়েটা আমার সাথে কি সুন্দর কথা বলছে।কখনো কষ্ট দিসনা ওকে।আমার আর তোর মাঝে সেরকম কোনো সম্পর্ক ছিলোনা সেটা তুই ভালো করেই জানিস।তখন যেরকম হেলাফেলা করতি এখন আর সেরকম করিসনা।এবার একটু সিরিয়াস হ’মেয়েটা সারাজীবনের জন্য নিজের প্রিয় মানুষগুলোকে ছেড়ে তোর কাছে এসেছে।এখন তুই সব কিছু।ওকে ভালো রাখা,সুখে রাখার দায়িত্ব তোর।
নিহাদ মুখ বেঁকিয়ে বলল,আমার বউকে আমি সুখেই রাখবো সেটা তোকে বলতে হবেনা।নিজের বিয়ে নিয়ে ভাব তুই।
রিনি হেসে উঠে বলল,এটা নিয়ে কালকেও বাবা অনেক কথা বলেছে।এবার ভাবছি বিয়েটা করেই নেবো।

শোভার কাছে খারাপ লাগছে নিহাদ কেনো রিনির সাথে উঠে গেলো?ওর মনে সন্দেহ হচ্ছে না,কারণ ওদের মাঝে সত্যিই কিছু থাকলে নিহাদ শোভাকে বিয়ে করতোনা।তাছাড়া রিনির ও বয়ফ্রেন্ড আছে।তবুও শোভার কাছে কেনো জানেনা খারাপ লাগছ।শোভা সেখানেই বসে রইলো।নিহাদ এসে শোভার পাশে বসলো।রিনিও এসেছে।শিফাত খাবার নিয়ে এসে বসলো।আশিক আর রাহুলকে ডেকে নিয়ে এসে সবাই খেতে বসে।আড্ডা শেষে যে যার রুমে চলে যায়।শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরই আশিক এসে নিহাদকে ডেকে নিয়ে গেলো।শোভার ঘুম এখনো আসেনি।নিহাদের আসতে দেরি দেখে সে উঠে গিয়ে রাহুলের রুমে উঁকি দিলো।চারজনে দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসেছে তাই সামনে কি করছে বোঝা যাচ্ছে না।শোভা ভ্রু কুচকে আনমনে বলল,করছেটা কি?কিছু দেখতে না পেয়ে রুমে চলে আসে।কিছুক্ষণ পরই নিহাদ ঢুলতে ঢুলতে রুমে ঢুকলো।শোভা শুয়েছিলো।নিহাদ কম্বল টেনে সরিয়ে দিলো।কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে আছে শোভার দিকে।
নিহাদের দিকে তাকিয়ে শোভা ভয়ে ঢোক গিললো।মনে হচ্ছে নেশা করে এসেছে নিহাদ।এতক্ষণ নিশ্চয়ই চার বন্ধু মিলে ড্রিংক করেছে।
নিহাদ এলোমেলো চোখে তাকিয়ে শোভাকে কোলে নিয়ে খাট থেকে নামিয়ে দিলো।ভয়ে শোভার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো।
নিহাদ খাটে শুয়ে পড়ে মাতালের মতো বলল,আজ তুমি নাচবে আমার নাচ দেখতে মন চাচ্ছে।শোভা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।নিহাদ শোয়া থেকে উঠে বলে,নাচো না কেনো?নাচ মেরি লেয়লা লেয়লা।
শোভা কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা।নিহাদ ঠিক করে বসে স্বাভাবিকভাবে বলল,কাঁদতে হবেনা। তুমি দেখতে গিয়েছিলে আমি ড্রিংক করছি কিনা?আমি ড্রিংক করিনা বুঝলা?এসব খেলে নামায হয়না।এখন শুয়ে পড়ো।
#চলবে………

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here