‘চরিত্রহীনা২’ পর্ব-৪
.
লেখক : Mahian Khan
.
(৫)
.
সারাদিন অফিসে একগাদা কাজের পর জাভেদের দেহ প্রায় অচল হয়ে গিয়েছে। যে গরম তার মধ্যে বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই জাভেদের বরং একা একা পার্কে বসে কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে থাকে। এই বিকাল বেলা পার্কের সৌন্দর্য ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। লাল, নীল হরেক রঙের পরীতে ভরে যায় পার্ক, তবে কি আশ্চর্য! প্রায় কোনো পরী এখানে একা না, তাদের সকলের সাথেই আছে একজন করে মহাপুরুষ। জাভেদের বিশ্বাস, যেসকল পুরুষেরা নারীর হৃদয় জয়ে সক্ষম তারা সকলেই মহাপুরুষ। জাভেদ কোনো মহাপুরুষ না তবে সাধারন পুরুষ। ঠান্ডা কোল্ড ড্রিঙ্কসে চুমুক দিতে দিতে পার্কে এসব মহাপুরুষ আর পরীদের রোম্যান্স উপভোগ করতে থাকে। অবশ্য মহাপুরুষদের দেখে জাভেদের বেশ ঈর্ষা হয় তাই পরীদের দিকেই তার দৃষ্টি থাকে। কারো লাল লিপস্টিক, কারো লাল নেইল পালিশ, কারো আছে ক্যাটস আই, তো কারো আছে মায়াবী কালো চোখ, কেউ চঞ্চল তো কেউ স্থির, কেউ কালো তো কেউ সাদা কত রঙে তারা আঁকা! তাদের রঙে ক্রমেই বদলাতে থাকে পার্কের রঙ, পার্কের সবুজ, সতেজতার দিকে কারো চোখ নেই। সাধারন পুরুষ হোক অথবা মহাপুরুষ সকলের চোখ শুধু এই পরীদের দিকে। এই সাধারন পুরুষেরা একটু বেশী সুযোগ পায় কেননা তাদের কোনো ভয় নেই কারণ তাদের কোনো পরী নেই। এক পরী অপর পরীর সাথে সর্বদা হিংসা করে যার ফলে তাদের মহাপুরুষেরা অপর কোনো পরীর দিকে ফিরে তাকালে রাগে তারা তাদের মহাপুরুষদেরকে খুন করতে পর্যন্ত দ্বিধা করে না। যার ফলে, অধিকাংশ মহাপুরুষেরা সর্বদা আতঙ্কে থাকে। চুরি করে অথবা নিজের পরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অন্য পরীদের দেখা ব্যতীত তাদের কোনো উপায় থাকে না। এই দিক থেকে সাধারন পুরুষেরা হয়ত বেশী সৌভাগ্যবান। তারা হয়ত এসকল পরীদের সৌন্দর্য স্পর্শ করে অনুভব করতে পারে না তবে দুচোখের গভীর দিয়ে পরীদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। হয়ত এই মহাপুরুষদের দেখে সাধারন পুরুষদের হালকা ঈর্ষা হয় তবে সাধারন পুরুষেরা আনন্দটা বেশী উপভোগ করতে পারে। জাভেদের চোখের মণি দুটো বিভিন্ন এঙ্গেলে শুধু ঘুরতে থাকে। ৫০০ এম এল এর কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলটা যে কখন ফাঁকা হয়ে গিয়েছে সেই হুশ, জাভেদের নেই। খালি বোতলটা চুমুক দিতে গিয়ে সম্পুর্ন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একেবারে সই করে বোতলটা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।
.
– তবুও তিন্নির মত সুন্দরি কাউকে পেলাম না! হরমনের ঠেলায় হয়ত সব মেয়েকে মন থেকে দেখার ইচ্ছে হয় তবে কাউকে তিন্নির মত ভাললাগে না। আচ্ছা, এই মহাপুরুষেরা কি সবাই প্রেমিক? নাও তো হতে পারে, এমনও তো হতে পারে শুধুমাত্র মস্তিষ্কের সকল কল্পনাকে বাস্তবে রুপান্তর করার আকাঙ্খায় তারা নারীদেহ খোঁজে। কে জানে!
.
নিজের সাথে কথোপকথনে ব্যস্ত জাভেদ হঠাৎ বেশ পরিচিত কোনো এক নারীকন্ঠে তার নামটা শুনতে পায়। চোখটা হালকা ঘুরাতেই দেখে, তার প্রাক্তন প্রিয় নারী, ইতি। ইতির সাথে জাভেদ কোনো একসময় ভালোবাসা নামক অভিনয় করত। আজ সেই ইতি বিবাহিত একটা ছোট ছেলে সন্তানও আছে। একদম মায়ের মত ছেলেটা সুন্দর। ছেলেটা যে যথেষ্ট দুষ্টু তা মায়ের কোলে বসে তার চঞ্চলতা দেখলেই বোঝা যায়। দীর্ঘদিন পর ইতিকে দেখে জাভেদ একটা হালকা মুচকি হাসি দেয়। ইতি, জাভেদের দিকে এগিয়ে এসে বেঞ্চে জাভেদের পাশে বসে পড়ে।
.
– কী ব্যাপার কেমন আছো?
তুমি কেমন আছো? তোমার নাম কী বাবু?
.
– বল, তোমার নাম কী?
.
বাচ্চাটা মুহূর্তেই উত্তর দিয়ে ওঠে, “নিয়াম।” জাভেদের বেশ হাসি আসে তবে হাসি চেপে রেখে ইতিকে আবার জিজ্ঞেস করে,
.
– তুমি কেমন আছো, সেটা বলো।
.
– এই তো ভালো আছি, অনেক দিন পর দেখা, একটু খোঁজ,খবর তো নিতে হয় নাকি?
.
– কিভাবে নিব? যে ব্যস্ত জীবনযাপন করতে হয় তাতে, নিজের শ্বাস নেওয়ার সময় কোথায়? তুমি তো বিয়ে করে আরামসে রানী সেজে আছো, আমার মত ফকিরদের কষ্ট তুমি কিভাবে বুঝবা?
.
– হাহাহাহা, রানী? আগে তো এত কমেডি করতা না, সারাদিন মুড নিয়ে থাকতা, এত চেঞ্জ? বিয়ে টিয়ে করেছো নাকি?
.
– সত্যি, অনেক চেঞ্জ হয়ে গিয়েছি? আর বিয়ে? না, করিনি আর শীঘ্রই করব বলেও মনেহয় না। আর করলেও শুধু শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্য, এই যা! প্রেম, ভালোবাসার জন্য না।
.
– হ্যা, চেঞ্জ তো হয়েছো, কিন্তু প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে চিন্তা এখনো একইরকম আছে। বয়স তো প্রায় ৩০ হতে চলল, এখন আর আবেগে চলে কি লাভ? করেই ফেলো বিয়ে।
.
– আবেগ কি অবাস্তব? আমি তো বললাম কোনো একসময় করব কিন্তু সেটা শুধু শরীর আর মস্তিষ্কের জন্য, মনের জন্য না।
.
ইতি কিছু একটা বলতে যাবে, এর মধ্যেই ইতির ফোনটা বেজে উঠল, নিয়াম সু্যোগ পেয়ে জাভেদের সাথে দুষ্টুমিতে লিপ্ত হয়। ইতি বিরক্ত বোধ করে বাধ্য হয়েই নিয়ামকে বলে,
.
– আব্বু, ওটা একটা মামা, এরকম দুষ্টুমি করে না।
.
‘মামা’ শব্দটা শুনে জাভদের দুচোখ কপালে উঠে যায়। ইতি মোবাইলটা একটু কানের কাছ থেকে সরিয়ে জাভেদকে বলে,
.
– একটু কাজ আছে, অন্য একদিন তোমার সাথে কথা বলব।আল্লাহ হাফেজ।
.
– আল্লাহ হাফেজ।
.
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মোবাইলটা কানে দিয়ে, ইতি চলে যায়। বেশ জোরে একটা নি:শ্বাস ছেড়ে হালকা হেসে উঠে জাভেদ মনেমনে বলে,
.
– ‘মামা!’ মেয়েরা এভাবে ছেলেদেরকে ভাই ডেকে কি লাভ পায়? যেই মেয়ে কোনো একসময় ডাকত সোনা আজ আমি তার সন্তানের মামা! হাউ প্যাথেটিক! অবশ্য ইতির সাথে দুই-আড়াই বছর শুধু টাইমপাস করেছি তবুও যেই ছেলের সাথে কোনো মেয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটায়, সে ভাইয়্যা হয় কিভাবে? অবশ্য একদিক দিয়ে ঠিক আছে। ইতি নাহলে, আমাক নাম ধরে ডাকল ওর সন্তান আমাকে কি বলে ডাকবে? মেয়েরা আসলে অনেক ইন্টেলিজেন্ট, আগে থেকেই অনেক কিছু ভেবে রাখে। কিন্তু তিন্নি আমাকে ভাই বানায়নি,, ছোটবেলা ইরাও আমাকে মামা ডাকত না। মায়ের দেখাদেখি আমাকে জাভেদ ডাকত। কিন্তু এখন তো সেই ছোট ইরা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। হয়ত ইরার সাথে আবার কখনো দেখা হলে, তিন্নি মামা বা কাকা ডাকতে বলবে। আসলেই, কতটা ভয়াবহ হবে বিষয়টা!
.
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জাভেদ দেখে প্রায় ৬ টা বেজে এসেছে অর্থাৎ সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। এখন পার্কে বসে আর সময় নষ্ট করা যাবে না, বাসায় যেতে হবে। একগাদা কাজ আছে বাসায় তাই, ব্যাগটা কাধে নিয়ে শতশত পরী আর মহাপুরুষদের মধ্যে থেকে একজন একাকী, সাধারন পুরুষ জাভেদ হেটে চলে যায়।
.
(৬)
.
ইরাকে ঘুম পাড়িয়ে চুপচাপ জানালার কাছে বসে তিন্নি মোবাইল চালাতে থাকে। বেশ মৃদু আর মিষ্টি বাতাস। সন্ধ্যায় আকাশটা আজ অদ্ভুত রকমের নীল।আকাশ নীল হোক, সাদা হোক অথবা কালো, জাভেদ কখনো তার রুটিন ভঙ্গ করে না। রুটিন মাফিক সে প্রতিনিয়ত ৩ বার করে তিন্নিকে ম্যাসেজ পাঠাবেই আজও ২টা পাঠিয়েছে, তৃতীয়টা হয়ত রাতে পাঠাবে। তিন্নি গভীর মনযোগ সহকারে মেসেজগুলো পড়ে। অধিকাংশ সময় তার চোখ থেকে পানি ঝড়ে যায়। ইচ্ছে হয় রিপ্লে দিতে, ইচ্ছে হয় আবার জাভেদের সাথে আড্ডা দিতে। রাত জেগে কত আড্ডা দিয়েছিল তারা ২ জন! অবশ্য আড্ডা শব্দটা যৌক্তিক না, কেননা অধিকাংশ কথা তিন্নি বলত জাভেদ শুধু রোবটের মত শুনত। মাঝে মাঝে ২-১ টা উত্তর দিত আর আজকে তিন্নি সেই জাভেদের হাজার কথার উত্তর দিতে পারছে না। মাঝে মাঝে তিন্নির প্রবল ইচ্ছে হয় জাভেদের সাথে কথা বলতে। জাভেদের প্রতিটি আর্তনাদমূলক কথা তিন্নির দেহে উত্তপ্ত রড দিয়ে আঘাত করে কিন্তু সেই সকল আঘাতকে তিন্নি সহ্য করে। কিন্তু জাভেদকে তিন্নি বিরক্ত করতে চায় না। ৪ বছর জাভেদকে সে যথেষ্ট বিরক্ত করেছে, এখন আর না। জাভেদ তার ইতির কাছে সেটাই তিন্নি ভালো মনেকরে। জাভেদ থেকে নিজেকে দূরে রেখে তিন্নি বিশ্বাস করে, সে জাভেদের উপকার করছে, জাভেদকে আর আঘাত করা তিন্নির পক্ষে সম্ভব না। গভীর মনযোগে, জাভেদের লেখা প্রতিটি শব্দ তিন্নি পড়তে থাকে। হঠাৎ করেই বেলের শব্দ শুনতে পায়। সচারচর সন্ধ্যার দিকে কেউ কখনো বাসায় আসে না তাই, তিন্নি বেশ কৌতূহলী হয়েই দরজাটা খোলে। দরজাটা খুলে তিন্নির সমগ্র দেহে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি প্রবাহিত হতে থাকে। ভয়, অবাক, ঘৃনা,রাগ, সম্পুর্ন একটা মিশ্র অনুভূতি। তবে এই মিশ্র অনুভূতির মাঝে কোনো এক অজানা অনুভূতিও দ্রবীভূত হয়ে আছে। সেই অনুভূতিটা কোনোভাবে তিন্নি প্রকাশে ইচ্ছুক নয়। রনির দুচোখ জুড়ে পানি, একেবারে ছলছল করা চোখে এক দৃষ্টিতে তিন্নির তাকিয়ে আছে। তিন্নি বেশ রাগান্বিত কন্ঠেই বলে ওঠে,
.
– তুমি? এখানে আসছো কিভাবে?
.
– সেটা জানা জরুরি? সেদিন বলেছিলে ১৫ মিনিট কথা বলবে, ১১ মিনিট কথা বলেই চলে গিয়েছিলে। ইরা কেমন আছে, সেটা জানারও সুযোগ দাওনি।
.
– এখানে কিভাবে আসছো সেটা বল।
.
– সেদিন হোটেলে তোমার যে বান্ধবী ছিল তোমার সাথে, তাকে বহুকষ্টে বুঝিয়ে, হাত-পা ধরে তোমার ঠিকানা পেয়েছি। প্লিজ, একটু কথা বলার সুযোগ দাও।
.
– এখন বের হও। এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করতে চাই না। তাড়াতাড়ি বের হও।
.
– প্লিজ তিন্নি, আমার মেয়ের সাথে তো অন্তত আমার কথা বলার অধিকার আছে, নাকি?
.
– কার মেয়ে! তোমার? কান খুলে শোনো, ইরা শুধু আমার মেয়ে আর কারো না। ৩ বছর আগের তামাশা কি ভুলে গিয়েছি? ইরাকে এতদূর আমি এনেছি। ও আমার মেয়ে এই পরিচয়টা ওর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত থাকবে। অন্যকারো পরিচয় আমার ইরার নামের সাথে কখনো যোগ করব না। এখন চুপচাপ চলে যাও।
.
– প্লিজ তিন্নি, শুধু একবার। আমি তো জানি, আমি জীবনে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি কিন্তু তাই বলে তুমি আমার উপর সামান্য দয়া করবে না?
.
– কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমাও হয় না, দয়াও হয় না। তোমাকে শুধু আমি ঘৃনা করি।
.
– প্লিজ তিন্নি, শুধু একবার! আমি কতটা অনুতপ্ত তা তোমার ধারণার বাইরে।
.
– আমি ধারণা পেতে চাই না।
.
রনির চোখের পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। চোখের পানি গুলো প্রচন্ড বাস্তব ও গভীর। দেখে মনেহয় যেন, প্রতি ফোটা চোখের পানির মাঝে লুকিয়ে আছে সাগর। তিন্নি রনির এই চোখের সাগরে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যায়। রনির চোখের পানির মূল্য তিন্নির কাছে হয়ত এখনো কমেনি। রনি, তিন্নির দু গাল হালকা করে চেপে ধরে কান্নাস্বরে তিন্নিকে বলে,
.
– শুধু একবার ইরাকে দেখতে দাও, দয়া কর আমার উপরে।
.
তিন্নি তখনো রনির চোখের সাগরে ডুবে আছে। বাধা দিচ্ছে না রনিকে, সরিয়ে দিচ্ছে তা তার দুহাত! শুধু অদ্ভুতভাবে হারিয়ে আছে রনির দুচোখের মাঝে।
.
(চলবে….)