গল্প:#অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা
লেখক:#কাব্য মেহেরাব
পর্ব:০৪
অপেক্ষা করেছি নদীর মোহনায়,
অপেক্ষা করেছি রাত জাগা জোছনায়,
গ্রীস্মের প্রখরে , বরর্ষার অঝোরে ,
বসন্তের অনেক ছোয়ায়,
কতো প্রহর কেটে গেছে।
ঢেকে গেছে এই সূর্যটা,
কতো অভিমান শুকিয়ে
বয়ে গেছে ঝড়ো হাওয়া,
আসোনি ফিরে তুমি
এই মনে।
হাত বাড়িয়ে কাব্য আমাকে ডাকছে। আস্তে আস্তে কাব্যর অবয়টি মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি চারি দিকে চোখ মেলে খুঁজে বেড়াচ্ছি তাকে। কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। চিৎকার করে ডাকছি,
কাব্যওওওওওওও….
হুড়মুড় করে উঠে বসলাম। কি দেখলাম এটা আমি…..?কাব্য আমার জন্য অপেক্ষা করছে….? আর আমি…..?
না এখনি আমাকে যেতে হবে নদীর পাড়ে, কাব্য আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
বলে যখনই উঠতে যাব, মোমেনা বুবু আমাকে ধরে বললেন
মোমিনা:কি হয়েছে…. ডালিয়া….? তুমি ঠিক আছো তো..? (তিনি আমাকে ডালিয়া বলে ডাকেন)
মেঘা:…..….. কাব্য! কাব্য আমাকে ডাকছে। আমাকে যেতে হবে……
মোমিনা:আবারো কাব্য কে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছ তাই না….? এতগুলো দিন পার হয়ে গেল তুমি এখনো সেই কাব্য- কাব্য করে যাচ্ছ…? বলছি কি ….একটু বাইরে বের হও, বাইরের পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নাও ।দেখবে সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর কতদিন এইভাবে তুমি নিজেকে কষ্ট দিবে…? মানুষটা বেঁচে থাকলে তুমি ঠিক তাকে খুঁজে পাবে।
মেঘা: আমার কাব্যর কিছু হতে পারে না। ও বেঁচে আছে। আমার এই হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করেছে সারা জীবন আমার পাশে থাকবে। (হাত দেখিয়ে বলল মোমিনা কে)
মোমিনা: দেখো ডালিয়া…. আমি বলছি না,তোমার কাব্য বেঁচে নেই। তবে তার জন্য তুমি এই ভাবে নিজেকে কষ্ট দিলে কাব্য যখন তোমার সামনে আসবে তার কি ভালো লাগবে বল?
মেঘা: আপু কাব্য কোথায় ?বলতে পারো…?(মোমিনা কে জড়িয়ে ধরে বলল)
মোমিনা: দোয়া করি,সে যেখানেই আছে যেন সুস্থ থাকে ।আর আল্লাহ যেন তোমার কাছে তাকে ফিরিয়ে দেয়।
আমিনা আজ 10- 12 দিন গেছে তার গ্রামের বাড়িতে । মোমিনা রাতে তার কাজে যায় আর দিনে এসে আমার সাথে দিন কাটায় আমার একাকিত্বের সাথী হয়ে। সেদিনের পর থেকে আমি এখানেই থাকি। আমিনা আপা এবং মমিনা আপা দুজনেই তাদের কাজে ব্যস্ত থাকে। তবে আমাকে তাদের ওই অন্ধকার জীবনে নিয়ে যেতে চায়না। আমাকে খুব ভালোবাসে তারা। আমিও তাদের কে আপন করে নিয়েছি । এভাবেই আমার দিন কাটে।
কেটে গেছে তিন তিনটা মাস আমার জীবনে। আমি প্রতিদিন যায় সেই নদীর পাড়ে কাব্য কে খুঁজতে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায় সূর্যমামা অস্ত্র যায়। নদীতে জোয়ার ভাটা আসে। কিন্তু আমার মনে ভাটায় পড়ে আছে জোয়ার আর এলো না। বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনি। এই হয়তো কাব্য এসে পিছন থেকে আমায় জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু এটা যেন শুধু আমার কল্পনায়। বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্বই নেই। তবে প্রতি রাতে কাব্য হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকে। কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে পারিনা আমি। যখনই তার কাছে যেতে চাই সে বিলীন হয়ে যায়।
আমিনা আপা গ্রামে গেছে কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি। তার গ্রামের মোড়ল মাতব্বররা তাকে গ্রামে দেখামাত্রই লাঠি দিয়ে আঘাত করে ,আর বলে তোর মত নষ্টা মেয়ে এই গ্রামে ঢুকার সাহস হলো কি করে। কতগুলো যুবক মিলে হেনস্থা করে। বেধক মার মারে তাকে। আসলে কথায় আছে না, জোর যার মুল্লুক তার। গ্রামে আমিনা আপার কিছু জমি ছিল সেটা বিক্রি করে আনতে গিয়েছিল সেদিন। বাবা মা মারা যাবার পর গ্রামের কিছু যুবক রাতে অন্ধকারে তাকে ব্যবহার করেছিল ।আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল তার ছোট ভাইকে। নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে ঠাঁই নেয় মমিনা আপাদের বাড়ি। কিন্তু মোমিনার বাবা-মা তাকে ফিরিয়ে দেয়। তখন মোমিনা তার হাত ধরে বেরিয়ে আসে গ্রাম থেকে। এতে করে মমিনা বাবা-মা তার প্রতি তীব্র ক্ষোভ জন্মায় এবং মেয়েকে তারা তেজ্য করে দেয়। তবে এখন কিছু টাকার প্রয়োজন অবশ্য সেটা আমারই জন্য। আমাকে হোস্টেলে রেখে পড়াতে চাই। ভালো কলেজে আমাকে ভর্তি করতে চাই। তার জন্য প্রয়োজন অনেক টাকার। সেজন্যই গিয়েছিল গ্রামে।কিন্তু ঐযে ক্ষমতাবান মোড়ল রা তা হাতিয়ে নিতে চেয়েছিল বিনা পয়সায় ।সেই সুবাদে আপাকে মেরে রক্তাক্ত করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। মোড়লকে সহযোগিতা করেছিল অনেক যুবক। অবশ্য তারা ও অনেক টাকা ভাগ পেয়েছে।
আমিনা আপা র কোন খোঁজ খবর না পেয়ে মমিনা আপা গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তাকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। কান্নায় সেদিন ভেঙে পড়েছিল। আমার জন্য আজ তার এই অবস্থা। কোনভাবেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না। আমি কি এতই খারাপ…? বিধাতা আমার কপালে কি লিখেছে..? আমার প্রতিটা আপন মানুষকে কেন কেড়ে নেয় বিধাতা..? আমার অপরাধ টা কি? কেন এভাবে তিনি আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন? আমি যদি তার এতই অপছন্দের তাহলে কেন তিনি এই পৃথিবীতে আমাকে পাঠিয়েছেন?
সেইদিন আমি কান্না করতে পারিনি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। মনকে তো পাথর করে নিলাম। কিন্তু আমার চোখ সে তো আমার বশে নেই। ঝর্ণাধারা সে তো বইয়েই চলছে।
যেই বোনের জন্য নিজেদের পরিবার ছেড়ে এসেছিল আজ সেই বোন নেই। জীবনে বাঁচার তাগিতে অন্ধকার জীবন বেছে নিয়েছিল। দুইজন একসাথে। সেখানে তাঁর বোন নেই ,বড় একা হয়ে গেল সে। কান্নাকাটি করতে করতে কিছুদিন পর , মোমিনা আপা অসুস্থ হয়ে পড়ে। যেখানে কাজ করতো সেখান থেকে হাজার বিশেক টাকা ধার স্বরূপ নিয়ে এসেছিল। সেটা দিয়েই ডাক্তার দেখিয়েছে। তার এইচআইভি পজিটিভ হয়েছে রিপোর্টে। দিন দিন অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর আমি তার সেবা করতে থাকি।
একদিন মমিনা আপা যেখানে কাজ করতো সেখান থেকে কিছু মাঝবয়সি পুরুষ (দালাল)মানুষ কে পাঠিয়েছিল, মমিনা আপাদের বস্তিতে। টাকাটা ফেরত নেওয়ার জন্য। এবং সে কবে থেকে কাজে আসবে সেটা জানার জন্য। সেই দিনটায় আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো।
তারা এসে আমাকে দেখে ছিল। মমিনা আপার কাছ থেকে টাকা ফেরত চেয়ে ছিল ।আপা বলল সে এখনো অসুস্থ ধান্দায় যেতে পারবেনা। টাকা কি করে দিবে। তারা টাকার বদলে আমাকে চেয়েছিল। মমিনা আপা এবং তাদের মাঝে একসময় তর্কাতর্কি হাতাহাতি হয়ে যায়। আমি রান্নাঘর থেকে সব শুনছিলাম। মমিনা আপা জোরে চিৎকার করে বলেছিল ।ডালিয়া তুই পালিয়ে যা তুই পালিয়ে যা বোন।না হলে এই শয়তানগুলোকে নরকে নিয়ে যাবে।তোকে। আমি পালাতে পারেনি সেদিন। কি করে পালাবো আপন মানুষ বলতে তো এখনই মমিনা আপায় আছে আমার। তাকে এই কঠিন মুহূর্তে আমি কি করে ফেলে নিজের পথ ধরবো?? সাহস করে তাদের সামনে গিয়েছিলাম। আর সেই সাহসটা আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো। মমিনা আপাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় । ভাঙ্গা চুরা সরু ধারালো লোহার জানালার সাথে ধাক্কা লাগে। তাল সামলাতে না পেরে সেই সরু লোহার শিক ঢুকে যায় মমিনা আপার চোখে। সে চিৎকার করে কান্না করে। আবারো আমি পাথর হয়ে যায়। আমার সাথেই কেন বারবার এমনটা হয়? আমার #অপ্রত্যাশিত_ভালোবাসা গুলো আর পাওয়া হলো না।
টেনে-হিঁচড়ে সেদিন আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেই অন্ধকার জগতে। দু তলার সিঁড়ি বেয়ে আমাকে উপরে উঠানো হলো ছেচরাতে ছেচরাতে । ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো কোন একটা রুমের ভিতর। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম আমি ফ্লোরে। আমি কান্না করছি না, কিন্তু চোখের পানি সে আমার কথা শুনছে না। দুই হাতে ভর করে উঠে বসলাম। আমার গায়ের ওরনাটা এখন আমার সাথে নেই রাস্তায় পড়ে গেছে। বুকে হাত ক্রস করে সামনে তাকালাম। একজন মহিলা বসে আছে শাড়ি পড়ে। ভারী অলংকার তার শরীরে। বাটা ভরা পান সাজিয়ে গালে পুড়ছে। আমার দিকে কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কয়েকটি চিবনী দিয়ে মুখ থেকে পানির ছিপ ফেলল একটা বাটিতে। তিনি দালালদের উদ্দেশ্যে বলল….
-কই থেকে পাইসোস এই মা* রে…
লোক গুলো ওই মহিলা সামনে চেয়ারে বসলো। বলল আর বইলো না রহিমা খালা ।ও আমিনা মমিনা আছে… না…?ওদের ঘরে যেয়েই পায়ছি এই মালডারে। সারাদিন ওই মা** শুয়ে থাকে অসুস্থ হয়ে পরছে নাকি। আমার তো মনে হয় শুয়ে শুয়ে এই মালডারে দিয়ে ইনকাম করে। টাকা চাইছি কয় টাকা দিবার পারবেনা।
– তা হঠাৎ ঐ বস্তি গিলি কিল্লাই। কতদিন ধইরা করতাছি আমার টাকাটা আইনা দে।
-আরে খালা..? তোমার টাকাই তো আনবার গেছিলাম। তুমি টাকার কথা কইছিলা না? এত দিন সময়ই পাই ছিলাম না। আজ সময় করে যাইয়া দেখি এই মালডারে ঐ ম*** পুসতাছে। এই লাইনে যখন আইতে হইবো ।তাহলে আর দেরি কিসের ….?তাই লইয়া আইলাম তোমার কাছে।
-ভালোই করছস মালডা একেবারে ডাসা । টস টসা শরীল। দেখেতো মনে হইতেছে যৌবনে পা রাখলো কেবল।
-হ খালা। আমাগো এইখানকার সব মাইয়াগুলো পাইনসা হয়ে গেছে। প্রতিদিন পান্তাভাত কি ভালো লাগে ….? কাস্টমার গুলো আহে আর যায় । যাইবার সময় ফহিন্নির মত কইডা টাহা দিয়া যাই। এতে কি আর আমাগো পেট ভরে।। তাই ভাবলাম এই কাচ্চিবিরিয়ানি রে লইয়া আসি ভালো মাল পাওয়া যাবে।
এইনে ১০০০০ টাকা আমার পক্ষ থাইকা তোগো ছোট্ট পুরস্কার। ইনজয় কর। মালডারে এইহান কার নিয়ম শিখাইতে হইবো। একবার শিখে গেলে টাকাই টাকা । তখন আরো দিমু নি।
লোক গুলো হাসতে হাসতে চলে গেল। আমি দৌড়ে যেয়ে ওই মহিলার পা জড়িয়ে ধরলাম। বললাম আমাকে যেতে দিন আপনি। আপনি আমার মায়ের সমান। মোমিনা আপার অবস্থা মেলা খারাপ। তার এখন আমাকে প্রয়োজন। এই শয়তান লোক গুলো তাকে মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।
-আইতেই না আইতে তোর জন্য 10000 টাকা থুথু দিয়া গুইনা দিছি কি তোরে যাওন এর লাইগা…?
-আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনবো । তবু আমাকে যেতে দিন। তাছাড়া আমি বিবাহিত। আমি এখানে থাকতে পারবো না। দয়া করে আমাকে যেতে দিন।
-(মহিলাটি আমার চুলগুলো হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে বলল )এইখানে কাজ কর তোর মোমিনা রে আমি ডাক্তার দেখাবো তার বদলে তুই এখানে কাজ করবি। তাছাড়া এই চার দেয়ালের মাঝে থাইকা তুইবার হইতে পারবি না।
#চলবে …..