বিনিময় পর্ব ১

“আগে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেই তো এত সময় নষ্ট হতনা। তোমার ভাই এর শরীরের অবস্থাও এত খারাপ হতনা,”
পৈশাচিক হাসি হেসে বলল রুহান”.
.
কাঁদো কাঁদো চোখে লিসা বলে, “জীবন্মৃত হওয়ার প্রস্তাবে কেউ সহজে রাজি হয়না”.
.
রুহান বলল, “ভালোবাসা এক দূর্বলতা যা মানুষকে দিয়ে সবই করাতে পারে। অনেক সময় নষ্ট করেছ তুমি। যাই হোক, বেটার লেট দেন নেভার। আজকে রাতে দেখা হবে।
.

*(ঘরের মধ্যে রুহান আর লিসার কথোপকথন শুনে মুচকি হাসলো ব্যক্তিটি।
একটা নাম্বারে কল করে বলল, “কাজ হয়ে গেছে”.
অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর আসলো, “ভাল। পরের পার্সেলে নেক্সট টাস্ক পাবা।”
ব্যক্তিটি ফোন কেটে ফোনটা পানিতে ফেলে দিলো। একটা ফোন একবারই ব্যবহারের নিয়ম তাদের।)
.
******
.
লিসা নিজের মায়ের উপরে খুব বিরক্ত হচ্ছে। সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে তার ছোটভাই লিটনকে কে নিয়ে। ছোটবেলা থেকে সে অসুস্থ তাই আব্বা আম্মারা সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখে তাকে। লিসাও তার অনেক কেয়ার করে। কিন্তু স্কুল থেকে আসতে একটু দেরি হচ্ছে তাই বলে এত টেনশন করবে কেন?
.
“আম্মু তুমি বেশি টেনশন কর। আসবে একটু পর। হয়তো বন্ধুর সাথে এদিক ওদিক গিয়েছে,” লিসা বলল।
“কেন যাবে এদিক ওদিক? ও কি সবার মত সুস্থ? আমার মন কেমন যেন করছে তুই প্লিজ স্কুলে ফোন দে” আম্মা ব্যাকুল স্বরে বললেন।
.
এমন সময় ফোন আসলো। লিসার বাবা তাদের বললেন তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে। লিটন এর স্কুল থেকে ফোন এসেছিল সে বলে হঠাৎ অসুস্থ হতে গিয়েছিল স্কুলে।
.
.
হাসপাতালে যে কি টেনশনের মধ্যে গেল লিসা আর তার মা তা আর কাউকে বলে বুঝানো যাবেনা . মায়ের সাথে তখন একটু রাগারাগি করেছিল বলে এখন খারাপই লাগছে লিসার। এখন দেখি মায়ের চিন্তাই ঠিক।
.
আসলে ছোটবেলা থেকেই সারাক্ষণ মায়ের মুখে লিটনেরই নাম। ছেলেদের প্রতি মায়ের একটু ভালোবাসা বেশিই থাকে হয়তো. তাই বলে সারাক্ষণ এমন করা দেখে মাঝেমাঝে লিসার হিংসা হয় একটু।
.
এর মানে এই না যে নিজের চাই এর প্রতি লিসার ভালোবাসার কমতি আছে। নিজের ভাইকে লিসা প্রচন্ড ভালোবাসে। তাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। তবে টিনএজার হওয়ার জন্যে মাঝেমাঝে খিটখিটে হয়ে যায় লিসা। ছোটবেলা থেকেই তাদের দুইজনের মধ্যে অনেক মিল ছিল। লিসার ভাই তার থেকে ৪ বছরের ছোট।.
ছেলেরা বোনের সাথে অত বেশী ক্লোজ হয়না। বড় হলেই বন্ধুদের নিয়ে আলাদা জগত তৈরি হয়ে যায়।
.
কিন্তু বাবা মা লিসার ভাইকে অত বাইরে যেতে দিতনা। কারণ ছোটবেলা থেকেই তার অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট ছিল। এটা কি জিনিস ঠিকমত বুঝতনা লিসা। তবে লিটন বাইরে যেয়ে তাই খেলাধুলা করতে পারতনা। বলাই বাহুল্য বাবা মা দিতেননা।
সেই কারণে তার দুনিয়া ছিল কেবল স্কুলকলেজ আর বাড়ি।
বন্ধু বলতে ছিল কেবল তার বোন। লিসাও বাইরে সময় কম কাটাতো ভাই এর সাথে সময় কাটাবে বলে।
তাদের মধ্যকার ভালোবাসা দেখে প্রতিবেশীরা বলতো, “লিসা বিয়ের পরে ভাইকে শ্বশুড়বাড়ি নিয়ে যাবে দেখিও”.

.
বড় হওয়ার সাথে সাথে সমস্যাগুলোও বাড়তে থাকে লিটনের। আজকে আল্লাহই জানে কি হয়েছে।
.
হাসপাতালে যেয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করে লিসা, “আব্বু ওর কি হয়েছে?”
তিনি শুকনো মুখে জবাব দিলেন, “জানিনা রে। স্কুলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকেই আমাকে ফোন দেয় আর হাসপাতালে আসতে বলে।”
এমনসময় ডাক্তার আসলেন। এসে তিনি বললেন, “লিটনের পায়ের ভেইনে ক্লট ডিসলজ হয়ে এমবোলাই তৈরি হয়েছিল। তার সেপ্টাল ডিফেক্ট থাকার কারণে তা আর্টারিতে এসেছে। এজন্য সে স্ট্রোক করেছে। ডিটেইলস রিপোর্টে আছে। এখন ট্রিটমেন্ট দিচ্ছি কিন্তু অপারেশন করিয়ে নেন হার্টের। নাহলে পরে প্রবলেম আরো বাড়তে পারে।”
.
লিসা এসব কথার কিছুই বুঝলনা। শুধু “স্ট্রোক” আর “অপারেশন” কথাটা কানে বাজতে থাকলো। এত টাকা তাদের থাকলে তো কব্বেই অপারেশন করে ফেলত তারা।
.
লিসা তার ভাইকে যতই ভালোবাসুক, ভালোবাসা দুনিয়ার কারেন্সি না। তাইতো হাসপাতালে ভাই এর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনোই উপায় নাই তার।

.
বাবামা অনেক চেষ্টা করছেন, তবে যাদের টাকা নাই তাদের কেউ সাহায্যও করতে চায়না। সকলেরই স্বভাব তেলা মাথায় তেল দেওয়া। তাই প্রায় সকলের কাছে থেকেই খালি হাতে ফিরে আসতে হচ্ছে তাদের।
খুব কান্না পাচ্ছে লিসার। তাদের অবস্থা আগে এমন ছিলনা। খুব বড়লোক না হলেও কারো সামনে হাত পাততে হয়নি তাদের। কিন্তু বাসায় এক অসুস্থ মানুষ থাকলে সবকিছু বদলে যায়। আর্থিক অবস্থা দুর্বল হতে থাকে সেই সাথে সম্পর্কও।
.
.
এ দুনিয়া কোনোকালেই দূর্বলদের জন্য ছিলনা, এখনও নাই। দুর্বলকে দেখে মানুষের মনে মায়া জাগেনা, বরং সুযোগ নেওয়ার ইচ্ছা জাগে। মানুষ, প্রাণী উভয়ের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।.

লিসার এভাবে চুপ করে থাকতে ভাল লাগছেনা। কিছু একটা করতে চায় সে। কিন্তু কি করবে? তাদের অসহায় অবস্থা দেখে এক নার্স বলেন, “দেখুন, এ হাসপাতালে প্রতি মাসে একটা রোগীর চিকিৎসা ফ্রি তে করা হয়। আপনি হাসপাতলের মালিকের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এ প্রজেক্ট তারই”.
.
লিসা ভাবলো, “যদি কোনোমতে আমরা এ অপারেশন করতে পারি তাহলে আমাদের সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে!
.
বাবা আরেকজন এর কাছে গিয়েছেন টাকা ধার করতে। দেরি করলে যদি টাকা হাতছাড়া হয়ে যায়? তাই লিসা তাড়াতাড়ি মাকে নিয়ে মালিকের অফিসে যায় তার সাথে দেখা করতে।
.

অফিসে যেয়ে লিসার দেখা হয় রুহানের সাথে। সে মালিকের ছেলে।
লিসা আর তার মাকে অফিসে নিয়ে যেয়ে সুন্দর করে কথা বলল সে। মন্ত্রমুগ্ধের মত তার কথা শুনতে লাগলো লিসা। বড়লোক মানুষেরও ব্যবহার এত ভাল হয়? লিসার মা কাঁদতে কাঁদতে সব খুলে বলল তাকে।
রুহান বলে, “আপনি চিন্তা করবেননা। ব্যাপারটা আমি পার্সোনালি দেখব। আপনারা কয়েকদিন পর যোগাযোগ করেন।”
.
লিসাকে কয়েকদিন পর অফিসে ডাকে সে।
লিসা খুব খুশি! এত সহজে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি সে!

বাবাকে গিয়ে সব খুলে বলে লিসা। তিনিও খুব খুশি হন।
.
রাতের বেলা বাবাকে হাসপাতালে রেখে এসে লিসা আর মা বাসায় ফিরে আসলো। ঘুমাতে যাওয়ার সময় লিসা দেখে তার ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। এমনিতে সে এত রাতে ফোন রিসিভ করেনা কিন্তু এই সময়ে যদি প্রয়োজনীয় হয় তাই রিসিভ করলো। ফোনে রুহানের কন্ঠস্বর চিনতে সমস্যা হলনা লিসার।
.
“কেমন আছেন?”, জিজ্ঞাসা করলো রুহান।
লিসা খুব বিরক্ত হল। এই সময়ে এসব ফাউল গল্প করার মত সম্পর্ক তাদের?

“ভাই এর অপারেশন হয়ে গেলে ভাল থাকবো,” জবাব দিলো লিসা।

“সারাক্ষণ ভাই এর চিন্তা করলেই হবে?
নিজের কথাও তো চিন্তা করা উচিত”, রুহান হেসে বলল।
লিসার ভাই এর ব্যাপারটা না থাকলে ফোন কেটে দিতো লিসা।
“আমি জেগে থেকে ভাই এর চিন্তা করি আর ঘুমিয়ে নিজের চিন্তা করি। এখন নিজের চিন্তা করার প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম।”
লিসার উত্তর শুনে হাসলো রুহান, “বিরক্ত হচ্ছো তো? আচ্ছা ঠিক আছে। এখন থেকে তো কথা হতেই থাকবে”
.
আর কথা বাড়ালো না লিসা। কথা হতেই থাকবে মানে? অপারেশন হয়ে গেলেই আর কথা বলার প্রশ্নই উঠেনা। তবে এখন তো আর এভাবে বলা যাবেনা। সে শুধু অপেক্ষা করতে লাগলো নির্ধারিত দিনের।

.
**
নির্ধারিত দিন আসলে লিসা তার বাবাকে মনে করিয়ে দেয়, “বাবা, আজকে কিন্তু তোমার উনার অফিসে যাওয়ার কথা ফর্মালিটি পূরণ করার জন্য।”
বাবা বললেন, “আজকেই যাওয়া লাগবে মা? একটা ক্লায়েন্ট এর সাথে মিটিং আছে যে!”
লিসা বলল, “এমন সময়ও অফিসে যাওয়া লাগবে তোমার!!”
একটু অভিমানই হচ্ছে তার।
বাবা বললেন, “ডিল ফাইনাল হলে ভাল টাকা পাওয়া যাবে। অপারেশন ছাড়াও আরো আনুসাঙ্গিক খরচও তো আছে। তুই আর তোর মা দেখ ম্যানেজ করতে পারিস কি না।”
.
উনার কথাও ঠিক। অপারেশন নাহয় ফ্রিতে করলো কিন্তু আরও আনুসাঙ্গিক খরচ আছে এর জন্যও তো টাকা দরকার।
লিসা যেয়ে মাকে জানালো কথাটা।
মা বললেন, “আমি ওসব বুঝিনা রে! আর লিটনও একা থাকবে ঘরে। তুই যেয়ে দেখ। এমনিতেও এসব ফর্ম ফিলাপ তুইই ভাল বুঝিস।”
লিসার এমনিতে একা যেতে ভয় লাগতো।
এভাবে সে ছেলেদের সাথে কথা বলে অভ্যস্ত নয়।
কিন্তু রুহানের ব্যবহার দেখে তাকে ভালই মনে হয়েছিল তার।
একরাশ আশা নিয়ে রুহানের অফিসের দিকে গেল লিসা।
.
অফিসে সেক্রেটারি লিসাকে বসতে বলল। প্রথমে ভাবছিল সে যে ১০-১৫ মিনিট বসা লাগবে। কিন্তু দেখতে দেখতে দুইঘন্টা পার হয়ে গেল তাও তাকে ডাকছেনা।
সেক্রেটারি কে সে জিজ্ঞাসা করলো, “উনি অফিসে আছেন তো আজকে?”
সেক্রেটারি বলল, “হ্যা উনি মিটিং এ আছেন।”
কতক্ষণ লাগে মিটিং শেষ হতে।
দেখতে দেখতে অফিসের টাইম শেষ হয়ে যাচ্ছে। সবাই ফিরে যাচ্ছে। লিসার কেমন ভয়ভয় লাগছে।
নাহ! ফিরে যাওয়াই ভাল।
.
“আজকে যাই কাল আসবো আমি,” বলেই উঠে চলে যেতে লাগলো লিসা। রুহানকে আচ্ছামত কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার। সেইই ডাক দিয়েছে এই সময়ে। সে খুব ব্যস্ত ঠিক আছে কিন্তু লিসাও এখানে বসে পিকনিক করছেনা। ভাই এর কাছে থাকা উচিত তার এখন। অথচ সে এখানে বসে আছে এমনিতে। অর্থসাহায্য চাইছে তাই বলে তাদের এভাবে ঘুরানো লাগবে?
.
এমন সময় ডাক দিলো তাকে সেক্রেটারি,
“স্যার ফ্রি হয়েছেন তার সাথে দেখা করতে পারেন এখন।”
নিতান্তই বাধ্য না হলে মুখ ঝামটা মেরে চলে আসতো লিসা। কিন্তু এখন তার সেই পরিস্থিতি নেই। চুপচাপ অফিসে গেল লিসা। রুহান তার চোখ দেখেই বুঝতে পারলো যে সে রেগে আছে।
.
রুহানের সাথে প্রথমদিন কথা বলে তাকে অনেক ভদ্র আর ভাল মনে হয়েছিল লিসার। তা নাহলে এভাবে সে একা আসতনা।
কিন্তু আজকে অফিসে যেয়ে যে ছেলেটি নিজেকে রুহান বলে পরিচয় দিলো তাকে লিসা চিনতেই পারলোনা।
.
চলবে…
.
#বিনিময়
পর্ব-১
#ফারিহা_আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here