তোমার নেশায় পর্ব -২৩

# তোমার_নেশায় !
.
.
(২৩)
,
,
কঠিন হৃদয়ের মেয়ে তৃষ্ণা!
.
.
.
.
ও.টির বেডে শোয়া ঝন্ত্রনা কাতর মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হলো ডাক্তার রঞ্জিতের। যদি মেয়েটার জন্য কিছু করা যেত। আর আদ ঘন্টার মধ্যে ব্লাডের ঝোগাড় না হলে তো মেয়েটি কে বাঁচানো যাবেনা। তখনই তার মনে পড়লো রুপাঞ্জনের কথা! রুপাঞ্জনের ব্লাড গ্রুপ তো O-। একবার ব্লাড ডোনেট ক্যেম্পে টেস্ট করিয়েছিল ওরা বন্ধুরা সবাই! রুপাঞ্জন কে বললে হয়ত ও রাজি হতে পারে।
ফোন টা নিয়ে রুপাঞ্জন কে কল দেয় রঞ্জিত। রুপাঞ্জন হাইওয়ে ব্রিজের উপর উদাসীন হয়ে বসে আছে। তার চেহেরায় বেদনার চাপ স্পষ্ট! গভীর ভাবে ভাবছে রুপশা কে নিয়ে। আজ যে রুপশার কথা খুব মনে পড়ছে। তখনই দেখি রঞ্জিতের ফোন,
,
:– হ্যলো দোস্ত তুই কি বিজি??
,
:– না এইত একটু ঘুরছিলাম। কেন কোনো দরকার??
,
:– হ্যা আসলে একটা মেটারনিটি পেশেন্টের জন্য ইমেডিয়েটলি O- রক্তের প্রয়োজন। আদ ঘন্টার মধ্যে রক্ত না পাওয়া গেলে মা শিশু কাউকে বাঁচানো যাবেনা। প্লিস তুই যদি….
,
:– আচ্ছা আর বলতে হবেনা। আমি এক্ষুনি আসছি। তুই হস্পিটাল এর এড্রেস ম্যেসেজ কর।
,
:– ওকে।
,
,
ফোন রাখার পর রুপাঞ্জন ভাবতে থাকে। জিবনে অনেক পাপ করেছি। সেই পাপের শাস্তি রুপেই আজ হয়ত আমার রুপশা এতো দুরে। যদি আমার শরিরে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে দুইটা প্রান বাঁচে তাহলে আল্লাহ পাক হয়ত আমার পাপ গুলা ক্ষমা করবেন। আজ আমি যেভাবেই হোক ব্লাড ডোনেট করবো।
রঞ্জিতের ম্যেসেজ পেয়েই রুপাঞ্জন হস্পিটাল পৌছে যায়। দেখলাম রঞ্জিত হস্পিটালের গেইটে দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতেই,
,
:- দোস্ত আর মাত্র বিশ মিনিট। তাড়াতাড়ি চল।
,
:– হুম চল।
,
রঞ্জিত আমার ব্লাড গ্রুপ জানে তাই আর নতুন করে টেস্ট করেনি। আমি ব্লাড দিতে বেডে শুয়ে পড়লাম। সিরিঞ্জ টা হাতে ডুকানোর সময় ভাবতে লাগলাম,
:– আজ কেন জানিনা মনে হচ্ছে আমার আপনজন দের রক্ত দিচ্ছি। খুব ভালো অনুভুতি হচ্ছে আবার আগের সেই অস্থিরতা ও বাড়ছে।
মোট দুই ব্যেগ রক্ত নিয়ে রঞ্জিত আমাকে বসিয়ে এক প্রকার দৌড়ে চলে গেল। আমার অনেক ক্ষিদে পেয়েছে কিন্তু রঞ্জিত তো ও.টি তে চলে গেছে। ওকে জিজ্ঞাস করা ছাড়া কি করে যাই, যদি আবার কোনো প্রয়োজন পড়ে। বাধ্য হয়ে বসে রইলাম বেডে। অন্যদিকে ও.টি তে রুপশা প্রানপন যুদ্ধ করছে মৃত্যুর সাথে। এই লড়াই তার অনাগত প্রান কে বাঁচানোর জন্য! রুপশা তো আর জানেনা তার শরিলে প্রবেশ করছে তার ই প্রিয়তমের রক্ত। কিছুক্ষন একটা নবজাতকের কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। ডাক্তার রঞ্জিত বাচ্ছা টা কে হাতে নিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। খুবই রিস্কি একটা অপারেশান। রুপশা সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। অবশেষে রুপশার এতোদিনের অপেক্ষার ফসল, তার চাঁদমুখ ছেলে পৃথীবির আলো দেখেছে। রঞ্জিত বাচ্ছাকে ফ্রেশ করাতে নার্স কে দিল। নার্স বাচ্ছা টা কে নিয়ে আসার পর, রঞ্জিত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শিশুটির দিকে, এমন ফুটফুটে সুন্দর বাচ্ছা উনি খুব কমই দেখেছেন। আজ আমার বন্ধু রুপাঞ্জনের কারনেই এই বাচ্ছা বেচে আছে। তাই আগে ওকে কোলে নেওয়ার অধিকার রুপাঞ্জনের। এইভেবে রঞ্জিত বাচ্ছা কে নিয়ে রুপাঞ্জন যে রুমে আছে সেই রুমে নিয়ে যায়। রঞ্জিত কে দেখে রুপাঞ্জন উঠে বসে।
,
:- দেখ তো রুপাঞ্জন বাবু টা কি সুন্দর হয়েছে। আজ ও তোর কারনে আলোর মুখ দেখেছে তাই আগে তুই ওকে কোলে নিবি। দেখ আমি জানি তোর বাচ্ছা কাচ্ছা ভালো লাগেনা। তবে সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্ছাদের কোলে নেওয়ার অনুভুতি আলাদা। নিয়ে দেখ।
,
রুপাঞ্জন তখন থেকে বাচ্ছাটির দিকে একমনে তাকিয়ে ছিল। রঞ্জিতের কথায় ওকে কোলে নিতেই রুপাঞ্জনের সারা শরিলে শিহরন বয়ে গেল। সমস্ত শরিল ভালো লাগায় ভরে গেল। রুপাঞ্জন বাচ্চাটাকে বুকের সাথে খুব আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে রইল। কেন আমার এই বাবু টা কে এতো মায়া লাগছে। কেন ইচ্ছা করছে ওকে নিজে থেকে আলাদা না করি। বাবু নিতে এতো ভালো লাগে সেটা তো জানতাম না। বাবুটাও যেন নিজের বাবাই কে চিন্তে পেরে ওর কোলে গুটিশুটি মেরে পড়ে রইল। রুপাঞ্জন যেন একটা ঘোরের মাঝে হারিয়ে গেল। রঞ্জিতের দাক্কানিতে বাস্তবে ফিরল।
,
:– কিরে…….??
,
:– রঞ্জিত দোস্ত! আমার বাচ্ছা টা এতো আপন মনে হচ্ছে কেন?? কেন মনে হচ্ছে ও আমার খুব কাছের??
,
:– হাহাহা আসলে তুই প্রথম বার কোনো বাচ্চা কোলে নিয়েছিস তো তাই। তবে একটা জিনিস বুঝতেছি না।
,
:– কি??
,
;– বেবি টার সাথে তোর ফেইস অদ্ভুত ভাবে মিলে।
,
;– মানে??
,
:– আরে ইয়ার, জাস্ট জোকিং!! আচ্ছা এবার বাবু কে দে। এখন ও ওর মা ই ওকে দেখেনি।
,
:– বাবুর মা কেমন আঁছে রে??
,
:– বুঝতেই তো পারছিস খুব উইক হয়ে আছে। এখন ও সেন্স ফিরেনি। তবে কিছুক্ষনের মধ্যে ফিরে আসবে আশা করি! আচ্ছা বাবু কে দে!
,
যখনই রুঞ্জিত বাবু কে নিতে গেল, বাবু রুপাঞ্জনের গলার চেইন টেনে ধরল। যেন সে বলছে, “বাবাই প্লিস আমাদের ছেড়ে যেওনা!!”
রুপাঞ্জন ও অবাক। কোনো মতে বাবুর হাত থেকে চেইন টা ছাড়িয়ে ওর কপালে চুমু খেল। তারপর বলল,
,
:– দোস্ত আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে এবার যাই তাহলে।
,
:– আরেকটু পরে যাস বাবু টার মা কে ও দেখে নে।
,
:– না রে। উনি রেস্ট করুক। উনি আমার জন্য বেচে গেছেন এটাই আমার কাছে অনেক।
,
রুপাঞ্জন বাবু কে দেখে বেরিয়ে যেতে নিল। তখনই আহসান সাহেব মসজিদ থেকে নামাজ শেষ করে আসলেন কিন্তু তিনি খুব টাড়াহুড়ায় থাকায় রুপাঞ্জন কে খেয়াল করেননি। আহসান সাহেব ডাক্তার রঞ্জিত দেখেই জিজ্ঞাস করলেন,
,
:– ডাক্তার আমার মেয়ে…..
,
:– আরে স্যার মিষ্টি আনুন। আপনি নাতির নানা হয়েছেন। আপনার দোয়া আল্লাহ শুনেছেন।
,
:– কিন্তু O- রক্ত কোথায় পেলেন।
,
রঞ্জিত পিছনে ঘুরে রুপাঞ্জন এর চলে যাওয়ার দিকে আঙগুল তুলে দেখালেন,
,
:– ওই যে দেখুন চলে যাচ্ছে, সেই আপনার মেয়েকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে।
,
আহসান সাহেব দুর থেকে রুপাঞ্জনের ব্যেকসাইড দেখে চিন্তে পারেননি। তবুও মনে মনে বললেন,
,
:– আল্লাহ ওই ছেলেটার সব ইচ্ছা তুমি পুর্ন করো। ওকে সব সময় ভালো রাখো।
,
তখনই নার্স এসে খবর দিল রুপশার সেন্স ফিরেছে। আহসান সাহেব মেয়ের কেবিনে এগিয়ে গেলেন। মেয়েকে দেখতেই কান্না শুরু করে দিলেন,
,
:– কি হলো বাবা কাদছো..কেন? আমি.ঠিক আছি তো!
,
:– জানিস মা ডাক্তার যখন বলল রক্ত না পেলে তোকে বাঁচানো যাবেনা তখন এক মুহুরতের জন্য মনে হয়েছিল তুই ও তোর মায়ের মতো আমাকে রেখে চলে যাবি।
,
:- আমি কোথাও যাইনি বাবা! আমার বাবু কে একটু কোলে দাও তো!
,
আহসান সাহেব উঠে নাতি কে কোলে নিয়ে রুপশা কে দিলেন। রুপশা বাবু কোলে নিয়ে বলল,
,
:– বাবাই সোনা দেখ, এটা তোর নানা ভাই! আর তুই ওনার দুষ্ট নাতি। তুই এবার ওনার পিঠে চড়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলবি কেমন। খুব জালাবি ওনাকে।
এই বলে বাবুকে বুকে নিতেই চমকে উঠল রুপশা। এই গন্ধ….এই গন্ধ যে তার খুব চেনা। বাবুর শরিলে ওই লোকটার গন্ধ আসবে কি করে?? তবে কি এখানে এসেছিলেন?? না তা কি করে হয়, উনি তো ঢাকায়। রুপশা আবার বাবুর শরিলে নাক ডুবালো। না এই গন্ধ টা চিন্তে তার এতোটা ভুল হতে পারেনা।
,
:– বাবা আমার আগে বাবুকে কেউ কোলে নিয়েছিল??
,
:– না তো! ওকে তো গোসল করিয়ে এই দোলনায় রাখা হয়েছে। সবাইর আগে তুই নিয়েছিস।
,
:– না বাবা, ওর শরিলে রুপাঞ্জন খানের শরিলের স্মেল পাচ্চি আমি।
,
:– তোর হয়ত কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। রুপাঞ্জন এখানে কি করে আসবে??
,
:– বাবা তুমি ভুলে যেওনা ছয়মাস সংসার করেছি লোকটার সাথে। ওর সব কিছু সমপর্কে আমি জানি। আর এই স্মেল……
,
:– দেখ মা এই স্মেল হয়ত বাবুর শরিলে জন্ম থেকেই ছিল শত হোক ওরই তো সন্তান।
,
:- না বাবা ও শুধু আমার সন্তান!! আমার রুপক চৌঃ। ও এই পরিচয় বড় হবে।
,
:– বাহ নাম ও ঠিক করে নিলি! জানিস আজ তুই আর তোর বাবু একটা লোকের জন্য বেচে আছিস। সে যদি সময় মতো রক্ত দিতে না পারতো তাহলে কাউকেই বাঁচানো যেত না।
,
:– তাই নাকি বাবা। ওই লোকটা কোথায়?? একবার ধন্যবাদ তো দেওয়া যায়, উনি আমাদের এতো বড় উপকার করলেন।
,
:– আমি ও চেয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তার বলল লোকটার খুব তাড়া তাই দেখা না করেই চলে গেলেন।
,
:– যাই বলো ওনার কৃতজ্ঞতার কথা আমি কোনোদিন ভুলবনা।
,
,
রুপশা ওর বাবু কে নিয়ে খেলায় মগ্ন হয়ে গেল। অন্যদিকে রুপাঞ্জন রেস্টুরেন্টে খেতে বসে হাস্পাতালের বাবুটির কথা ভাবছে। কেন যে বাবু টা এতো মিস করছে নিজেও জানেনা। ফুফি বলেছিল রুপশা ও প্র্যেগনেন্ট আজ রুপশা থাকলে তার ও হয়ত এমনই একটা বাবু থাকতো। রুপশা কোথায় তুমি??একবার ফিরে এসো, কথা দিচ্ছি তোমাকে আর আমাদের সন্তান কে আর কোনো অভিযোগের সুযোগ দিবনা। আমি যে পারছিনা তোমাদের ছাড়া থাকতে। প্লিস কাম ব্যেক!!
নিয়তির লিখন কে খন্ডাতে পারে নিজের সন্তান কে এতো কাছে পেয়ে ও চিন্তে পারলোনা রুপাঞ্জন। কিন্ত অজান্তেই তাদের রক্ত দান করে বাঁচালো! অজান্তেই সবার আগে নিজের বাবু কে কোলে নিল। ওদের এতো কাছে পেয়ে আবার হারিয়ে ফেলল। রুপাঞ্জন কি কোনো দিন ফিরে পাবেনা তার প্রিয়তমা স্ত্রী আর সন্তান কে!
আর রুপশা কি মেনে নিবে তাকে আবার?
,
,
,

,
,
# ধন্যবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here