বিনিময় পর্ব ৮

#বিনিময়
পর্ব-৮
চোখ মেলে তাকাতেই লিসাকে নিজের সামনে দেখে রুহান। বিয়ের সাজে সেজে আছে সে এখন। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রুহান।
“দেখ তো…তোমাকে বিয়ের গিফট দেওয়াই হয়নি,” মিষ্টি হেসে বলল লিসা।
রুহান উঠে বসার চেষ্টা করলো…কিন্তু লিসা তাকে চেপে ধরে রেখেছে।
ধীরে ধীরে লিসা তার হাত রুহানের গলার কাছে নিয়ে আসে…এরপর তার গলা চেপে ধরে, “এই নাও তোমার গিফট.”
দম বন্ধ হয়ে আসে রুহানের।
চিৎকার করতে যেয়েও করতে পারেনা রুহান।
গলার মধ্যেকার চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে।
.
এমন অবস্থায় ধড়মড়িয়ে চোখ মেলে তাকায় সে। চারপাশের পরিবেশ কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছে।
ধীরে ধীরে তার স্মৃতি ফিরে আসতে থাকে।
লিসাকে কিডন্যাপ করানো…সে প্ল্যান ব্যাকফায়ার করা…নিজের বন্ধুরা কেমন করে তার শত্রুতে পরিণত হয় সে স্মৃতি।
রাগে অনুশোচনায় রুহানের মন তিক্ত হয়ে গেল। কি দরকার ছিল তার লিসাকে টার্গেট করার?
.
হাত, পা সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা করছে রুহানের।
পিপাসা লেগেছে…কাউকে ডাকতে চাইলো সে…কিন্তু মুখ থেকে আওয়াজ বের হলনা তার। গলায়ও প্রচন্ড ব্যাথা।
.
“ঘুম ভাঙলো?” হঠাৎ কার গলার আওয়াজে চমকে গেল রুহান। তাকিয়ে দেখে সোফায় লিসা বসে আছে। মিটিমিটি হাসছে সে…।
কাছে রাখা পানির গ্লাসের দিকে তাকালো রুহান।
লিসা তার ইশারা বুঝতে পারলো…টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এসে রুহানের পাশে বসলো সে…কিন্তু রুহানকে দিলনা পানি…নিজেই খেয়ে নিলো পানিটা।
.
রুহান উঠে বসার চেষ্টা করেও পারলোনা। রাগে দুই চোখ জ্বলে উঠলো তার।
লিসা হেসে বলল, “ঘুমিয়েই তো ছিলা আরাম করে…এত রাগ করার কি আছে? কষ্ট তো আমাদের হয়েছিল এই কয়দিন।
পানি আমাদের বেশি প্রয়োজন।
বিরক্তিকর ভঙ্গিতে হেসে উঠলো লিসা।
রুহান কিছু বলতে পারলনা।

এরপর লিসা বলল, “যাই হোক। তোমাদের বাসা থেকে বের হয়ে আমার বাসায় যাওয়ার আগে আমরা দুইজন রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। দিয়ে একটু ঘোরাফেরা করে সন্ধ্যায় তুমি আমাকে বাসায় রেখে কি এক কাজে গিয়েছিলা…এই স্টোরি আমি বলেছি সবাইকে। আমাকে বাসায় রেখে তুমি কি করেছ না করেছ তা তুমি বলে দিও বানিয়ে বানিয়ে।”
এরপর রুহানের দিকে আরেকবার তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “যদিও কিছু বলার মত অবস্থা আছে বলে মনে হচ্ছেনা।”
এত ক্রুয়েল এই লিসা! এত ক্রুয়েলটি মনে হয় রুহানের মধ্যেও নাই।
.
লিসা বাইরে যেয়ে বাবা মা কে ডেকে নিয়ে আসলো. সেই সাথে ইন্সপেক্টর ও ঢুকলেন স্টেটমেন্ট নেওয়ার জন্য।
ইন্সপেক্টর কে দেখে রুহানের মুখ তেতো হয়ে গেল। দুনিয়ায় এত পুলিশ আছে তার মধ্যে দুনিয়ার সবচেয়ে সৎ পুলিশকেই তার কেসের ইনভেস্টিগেশন এ থাকা লাগলো?
এই লোকের সাথে রুহানের সম্পর্কও ভাল না। রুহানের কয়েকটা কুকাম সম্পর্কে সে খানিকটা অবগত আছে। খালি প্রমাণ পায়না তাই কিছু করতে পারেনা।
.
যদিও তাকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য লিসাই দায়ী। তবে লিসার অপরাধের থেকে তার অপরাধ অনেক বেশি গুরুতর।
.
লিসার মুখও কেমন যেন শক্ত হয়ে গেল।
বোঝাই যাচ্ছে তাকেও খুব বিরক্ত করেছে ওই লোক। ভাগ্য ভাল রুহানের এখন কথা বলার মত অবস্থা নাই। তাই তাকে কথা বলা লাগলো না।
.
রুহানকে শয্যাগত করে মনের আনন্দে বাসায় আসলো লিসা। কিন্তু বাসায় এসে তার এমন বিপদ হবে কে জানতো?
বাসায় আসামাত্র দাদী লিসাকে বললেন, “মা, জানি তোমাদের সম্পর্ক সেরকম ভাল না। কিন্তু এমন সময়ে তাকে ঘরের বাইরে এভাবে রেখনা। এমন অবস্থায় সে গেস্টরুমে থাকবে?”
.
রুহান দাদীর কথা শুনে হেসে উঠলো। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে লিসা।
এমনিতে সে অসুস্থ মানুষের দেখাশোনা করতে পারেনা তা না। তার ভাই এর দেখাশোনা অনেকবারই করেছে সে। কিন্তু তাই বলে রুহানের মত ছেলের সেবা করতে যাবে সে? ধুর!
কিন্তু সবার সামনে কিছু বলতে পারলনা সে।
কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল, “অবশ্যই। সেটা তো আমার দায়িত্বে মধ্যেই পড়ে। তাছাড়া সে তো এখন শয্যাগত। এ অবস্থায় তো সে মনে হয় আমার গায়ে হাত তুলতে পারবেনা”.
.
লিসা ইয়ার্কি করেই কথাটা বলেছিল। কিন্তু সবাই কেমন যেন মুখ কাল করে দিলো লিসার কথা শুনে।
.
রুহানকে ঘরের মধ্যে আনাটা সমস্যা না। কিন্ত সমস্যা হল তার হাত পা ভাঙা। সব কাজই করে দেওয়া লাগবে তার। আগে যদি লিসা জানাতো যে বাসার লোকজন তার ঘাড়ের উপরে ফেলবে রুহানকে তাহলে অন্ততপক্ষে হাত দুইটা ভাঙতে মানা করতো লিসা।
বুঝাই যাচ্ছে যে এই সুযোগে বাসার লোকজন রুহানের সাথে তার সম্পর্ক শুধরাতে চাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে ছেলেকে শুধরালে তো আর এত সমস্যা হতনা।
.
যাই হোক…রুহান যখন তার আন্ডারে তখন তাকে ইচ্ছামত শাস্তি দেওয়া যাবে। মনে মনে হাসলো লিসা
.
.
বিছানায় বন্দী থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে রুহান।
মোবাইলটা নিলো সে। এ কয়দিন অফিসে কি কি ঘটেছে এ ব্যাপারে কোনো খোঁজই নেওয়া হয়নি।
হঠাৎ করে মোবাইলটা কেড়ে নিলো লিসা।
রুহানকে বলল, “মোবাইল নিয়ে কি করবা? আবার দুই চারটা বখাটেকে ফোন দিবা আমাকে সরানোর জন্য? আজকের পর থেকে ফোন ধরা নিষেধ তোমার জন্য।”
.
রাগে গা জ্বলে উঠলো রুহানের। ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “তুমি কে আমার ফোন নেওয়ার? ”
লিসা আহ্লাদ করে বলল, “তোমার কেয়ারং ওয়াইফ! তোমার দাদী না তোমার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে? দেখ কত সুন্দর কেয়ার করি তোমার!”
.
এরপর ঘরের বাইরে যেয়ে ইচ্ছা করে রুহানকে শুনিয়ে রুহানের মা কে বলল, “আন্টি… রুহান ঘুমিয়ে গিয়েছে। আজকে রাতে বলে সে খাবেনা!”
রুহানের মা শুনে বললেন, “কিন্তু ডাক্তার যে বলল রেগুলার ভাল খাওয়ার দিতে?”
লিসা বলল, “আমি তো আছিই মা রাতে তার ঘুম ভাঙলে আমি কিছু রান্না করে দিবো।”
.
নিজের মিথ্যা বলা দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল লিসা। আগে মিথ্যা বললে তাও।অনুশোচনা হত। এখন মিথ্যা বলতেই বেশি সহজ লাগছে তার। মিথ্যা বলা মনে হয় নেশার মত।
রুহান ডাকতে গেল মাকে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলনা তার।
লিসা মুচকি হাসলো সেদিকে তাকিয়ে।
.
রুহান ছটফট করে বলল, “লিসা, এ যে ইন্সপেক্টর আছে তার কিন্তু সমস্যা আছে। তার মনে যদি কোনো সন্দেহ ঢুকে তাহলে কিন্তু সে সব সত্যি বের করেই ছাড়বে। ”
.
লিসার চোখ জ্বলে উঠলো। সে কোনোমতে বলল, “পাপকাজ করার সময় সে কথা মনে হয়নি?”
রুহান এতক্ষণ ধরে ঠান্ডা মেজাজের লিসাকে দেখছিল। লিসার এক্সপ্রেশন দেখে এখন সে বুঝলো কি পরিমাণ রাগ আর ঘৃণা লুকিয়ে আছে সেখানে।
মনের ভিতরটা কেমন করে উঠলো রুহানের।
.
শীঘ্রই লিসা নিজেকে সামলে নিলো…
তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, “আমার বিরূদ্ধে সাক্ষী দিবে এমন কেউ নাই এই দুনিয়াতে। তুমি তোমার চিন্তা কর।”
রুহান বলল,”জামিল ধরা পড়লে আমি ফাঁসবো তুমিও ফাঁসবে”.
.
লিসা এবার মন খুলে হাসলো। এরপর বলল, “তোমার বন্ধুদের কথা ভুলে যেতে পারো তুমি।”
রুহান বলল, “কেন? কি হয়েছে তাদের?”
.
লিসা বলল, “তোমার গর্দভ ফ্রেন্ড রাহাতের রিলেশন ছিল জেমির সাথে জানো?”
রুহান বলল, “অসম্ভব… আমাদের অলিখিত নিয়ম ছিল যে নিজের বন্ধুদের আত্মীয়দের থেকে দূরে রাখবো।”
.
লিসা না শোনার ভান করে বলল, “সে কি ভেবেছিল যে জামিল কিছু জানতে পারবেনা?
জামিল যেয়ে রাহাতের এমন অবস্থা করেছে যে পাষাণেরও বুক কেঁপে উঠবে। তোমার জন্য আমি ছবিও রেখেছি একটা”
লিসা রুহানকে ছবি দেয়। ছবি দেখে রুহানের বুক কেঁপে উঠে। গলা ভাল থাকলে তার চিৎকার চারিদিকে শোনা যেত।
.
লিসা খুব এঞ্জয় করলো রুহানের এক্সপ্রেশন।
এরপর বলতে থাকলো, “জানো পুলিশ ক্লুলেস ছিল রাহাতের মৃত্যু কেন হল কী হল এসব ব্যাপারে। এর মাঝে কোন শত্রু যেন রাহাত আর জেমির কয়েকটা ছবি রাহাতের বাবাকে দেয়। উনি চালাক মানুষ উনার জন্য ইশারাই যথেষ্ট।
মাঝে কি হয়েছে আমি বলতে পারবনা…কিন্তু পরেরদিনই জামিল আর তোমার আরও দুই বন্ধুর লাশ একই পুকুরে একইভাবে ভেসে উঠে. কে মেরেছে তাদের এ ব্যাপারে কারোরই সন্দেহ নাই। কিন্তু পুলিশ তো আর রাহাতের বাবাকে কিছু করার সাহস পাবেনা! “.
.
লিসা আরও তিনটা ছবি দেয় রুহানকে। রুহান আর তাকানোর সাহস করেনা।
.
লিসা এবার রুহানের হাতের উপর হাত রেখে বলে, “কি অদ্ভুত ব্যাপার না? আগে রাহাতের বাবার প্রটেকশনের জন্যই জামিল এর সাহস বেড়ে গিয়েছিল। ইচ্ছামত একে খুন করতো, ওকে গুম করত। রাহাতের বাবা মনে হয় কল্পনাও করেননি যে জামিলের ভিক্টিমের খাতায় রাহাতেরও নাম আসবে.নাকি জামিল কখনো কল্পনা করেছিল যে তার গার্ডিয়ান এঞ্জেলই তাকে কুকুরের মত মেরে ফেলবে? তাকে গোসল করাতেও রাজি হয়নি কেউ।
আইরনি অফ ফেট!”
.
রুহানের মুখ থেকে ধীরে ধীরে রক্ত সরে যাচ্ছে।
.
লিসা রুহানের হাতে চাপ দিয়ে বলল, “তোমার কোনো ধারণা আছে যে রাহাত আর জেমির রিলেশনের ব্যাপারে কে জামিলকে জানালো? আর রাহাতের বাবাকে ছবিগুলোই বা দিলো কে? তোমার ফ্রেন্ডরা কি না বুঝেই কারো সাথে শত্রুতা করেছিল যার সাথে লাগা তাদের উচিত হয়নি? এই লিস্টে কি তোমারও নাম আছে?”
.
রুহানের মাথা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। মনের অজান্তেই ভয়ে কেঁপে উঠলো সে।
.
লিসা মুখে খুশি খুশি ভাব এনে বলল, “ভয় পাও কেন? তোমার খুশি হওয়া উচিত। তোমার বহু পাপের সাক্ষী ছিল জামিল।”
এ মুহুর্তে লিসাকে রীতিমত সাইকোপ্যাথ মনে হচ্ছে রুহানের।
.
লিসার চোখ কেমন যেন চকচক করছে। ক্রাইমসিন এর বর্ণনা করার সময় জামিলের মুখও এমন উজ্জ্বল হয়ে উঠত.
বহুদিন পরে মুখে আল্লাহর নাম নিয়ে রুহান বলল, “হে আল্লাহ রক্ষা কর”.
.
রুহানকে আতঙ্কিত অবস্থায় রেখে এসে লিসা ফোন দিলো সিয়ামকে,
“হ্যালো, রুহানের ফোন আমার হাতে এখন। এবার আমার প্ল্যানের শেষ ধাপে পা দেওয়ার পালা”
..
চলবে…

.
(শহরের বাইরে থাকায় এ পর্ব দিতে দেরি হল। সেজন্য দুঃখিত)
.
#ফারিহা_আহমেদ
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here