#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ০৪
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম হলেও থামার নাম নিচ্ছে না স্পৃহা। স্পন্দন কী করবে, কী বলবে- ভেবে পাচ্ছে না। হাজারো অবহেলা, কষ্টের মাঝেও স্পৃহাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি ও। অথচ তার বোন আজ এভাবে কাঁদছে! স্পৃহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-পিহু, কী হয়েছে তোর? এভাবে কাঁদছিস কেন? কিছু কি হয়েছে?
স্পৃহা স্পন্দনের বুকে মাথা রেখেই অনুনয়ের সুরে বললো,
-তোরা অনেক খারাপ, ভাইয়া। অনেক খারাপ। আমাকে কেউ ভালোবাসে না। একটুও ভালোবাসে না।
স্পন্দন অবাক হয়ে গেল এমন কথা শুনে। মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে ওর। তার বোন কি তাহলে এই বিয়েতে সুখী নয়? ভাবতে ভাবতে বললো,
-কী এমন হয়েছে যে, তোর মনে হচ্ছে তোকে কেউ ভালোবাসে না?
প্রশ্নটা শুনে স্পৃহা চমকে উঠলো। দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। ওভাবে কান্নাকাটি করাটা উচিত হয়নি। স্পন্দনের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দ্রুত চোখের পানি মুছে নিলো ও। জোরপূর্বক হেসে বললো,
-তেমন কিছু হয়নি, ভাইয়া! তোদের দেখে একটু ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কী বলতে কী বলেছি!!
স্পন্দনের কথাটা কোনোভাবেই বিশ্বাস হলো না। সে তার বোনকে ভালো করেই চেনে। ওকে কখনো এতো আবেগী হতে দেখেনি স্পন্দন। সাধারণ মেয়েদের মতো স্পৃহার মধ্যে আবেগ, অনুভূতি কখনোই খুঁজে পায়নি ও। কিছু তো একটা হয়েছে, যা তার অজানা! কিন্তু এখানে এতো মানুষের সামনে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। তাই নিজেকে সামলে একটু স্বাভাবিক হয়ে নিল ও।
আহির দূর থেকে স্পৃহাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে অবাক হয়ে যায়। ওর ভেতরে হাহাকার করে উঠে স্পৃহার অনুযোগ শুনে। কেন এভাবে কাঁদছে মেয়েটা? চশমার আড়ালে টলমলে অক্ষিদ্বয় বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে ওর। আনিলা পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো। আহির অসহায় দৃষ্টিতে আনিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
-স্পৃহা ভালো নেই, আনিলা। ও একটুও ভালো নেই।
আনিলা মলিন হাসলো। বললো,
-তোমাকে আগেই বলেছিলাম, আহির। এভাবে পিহু কখনো সুখী হবে না। একটা মেয়ের মন সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে তোমার? ও তোমাকে চায়। কিন্তু এখন তার পরিবর্তে পেয়েছে অন্য একটা পুরুষকে। এটা মেনে নেওয়া ওর জন্য কতোটা কঠিন, বুঝতে পারছো? জেদের বশে বিয়েটা করেছে। এখন পরিস্থিতিটা ভালোভাবে উপলব্ধি করে কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা।
-কষ্ট পেতে দেবো না আমি ওকে। ওর চোখের পানি সহ্য হয় না আমার!
আনিলা আনমনে বললো,
-আর তুমি? তোমার কী হবে?
আহির চোখের কোণে জলটা মুছে শুকনো হেসে বললো,
-নিজের ভালেবাসাকে সমর্পণ করেছি অন্য এক ব্যক্তির কাছে। নিজে হয়েছি পরপুরুষ। এখন ওর দিকে তাকানো অন্যায়, ওকে নিয়ে ভাবা অন্যায়, ইভেন ওকে ভালোবাসাটাও আমার জন্য অন্যায়। কোনো অধিকারই তো অবশিষ্ট নেই! তবুও ওর সুখের মাঝেই সুখ খুঁজবো আমি। ওর হাসির মাঝেই আনন্দ আর প্রাপ্তির মাঝেই তৃপ্তি। এই তো! জাস্ট এটুকুই চাই!
__________________________
প্রণবের গাড়িটা একটা একতলা বাগান বাড়ির সামনে এসে থামলো। বাড়িতে প্রবেশ করতে করতে প্রান্তিকে ফোন দিলো ও,
-খেয়েছিস?
প্রান্তি গাল ফুলিয়ে বললো,
-আমি খাই বা না খাই! তাতে তোর কী? তোর তো কিছু যায়-আসে না?
প্রণব রাগী স্বরে বললো,
-ঠাটিয়ে দিবো এক! বলেছি না আমার ফিরতে দেরী হবে? না খেয়ে ওয়েট করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন কটা বাজে, আইডিয়া আছে তোর?
প্রান্তি বিরক্তি নিয়ে বললো,
-তোর জন্য ওয়েট করছিলাম না। একটা বিষয় নিয়ে একটু টেন্সড্ আর আপসেট-ও!
প্রণব ভ্রু কুঁচকে বললো,
-কী হয়েছে?
-পিহুর কথা বলেছিলাম না তোকে? ও আজ ফোন দিয়েছিলো। কেন যেন ওর কথাগুলো অস্বাভাবিক লাগছিলো।
-এতো টেনশন হলে ওর বাড়িতেই গিয়ে দেখে আসতে পারিস!
প্রান্তি চোখ বড়বড় করে বললো,
-আরে মাথা খারাপ নাকি? আমি যাব ওর বাসায়? ওর পরিবার সম্পর্কে কী বলেছিলাম ভুলে গেছিস?
প্রণব কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
-উমমম… কী যেন বলেছিলি?
-পিহুর ভাই ছাড়া ওকে কেউ পছন্দ করে না। ওর বাবা, মা আর একটা ফুপি ওদের বাড়িতে থাকে। ফুপুটা তো পুরোই জল্লাদ টাইপ! একবার আমরা যাওয়ার পর পিহুকে কত কথা শুনিয়েছিল। এরপর থেকেই…
প্রণব বিরক্ত হয়ে বললো,
-এসব কী ভাষা ইউজ করিস তুই? ফারদার এসব ল্যাঙ্গুয়েজ শুনলে তোর খবর আছে।
প্রান্তি জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো,
-মানে আসলে, ঐ আর কি…… কোথায় আছো এখন?
-আছি এক জায়গায়। এখন রাখি। খেয়ে নিস তুই।
ফোনটা পকেটে গুঁজে কলিং বেল বাজালো। একজন মধ্যবয়সী মহিলা দরজা খুলে দিলো। প্রণব তার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনার ম্যাডাম কোথায়? জেগে আছেন নিশ্চয়ই?
মহিলাটি হালকা হেসে বললেন,
-অনেক অভিমান করেছে তোমার ওপর। যাও গিয়ে রাগ ভাঙ্গাও!
প্রণব পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে অন্য হাতে গাড়ির চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে ভেতরে ঢুকতে লাগলো। শেষ মাথার একদম কর্ণারের রুমটা ঢুকতেই দেখলো, একজন মহিলা উল্টো ঘুরে বিছানায় বসে আছে। প্রণব এগিয়ে গিয়ে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। মহিলাটা তার হাত ছাড়িয়ে একটু দূরে সরে বসলেন। প্রণব তাকে আবারও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
-আরে… এতো রাগ!! মিসেস মেহরীন তার একমাত্র ছেলের ওপর অভিমান করেছেন বুঝি?
মিসেস মেহরীন মুখ ঘুরিয়ে অভিমানী সুরে বললেন,
-ছেলে তো সেলিব্রিটি! তার কী মনে থাকে তার মায়ের কথা?
-সরিইইইই! অডিশন নিয়ে কতোটা ব্যস্ত আছি, বলে বুঝাতে পারবো না। আদ্রের বিয়েটাও এটেন্ড করতে পারিনি সেজন্য।
মিসেস মেহরীন এবার অবাক চোখে তাকালেন এবার। প্রণব আমতা আমতা করে বললো,
-আমি সারাদিন কিছু খাই-ও নি। অনেক খিদে পেয়েছে কিন্তু। এখনো রেগে থাকবে তুমি?
মিসেস মেহরীন রাগী স্বরে বললেন,
-এখন তো আরো বেশি রাগ হচ্ছে! সারাদিন না খেয়ে ছিলি তুই?
বলেই একজন সার্ভেন্টকে ডেকে খাবার আনালেন। প্রণব বাবু হয়ে বসে আহ্লাদী স্বরে বললো,
-খাইয়ে দাও না!
এহেন কান্ডে মিসেস মেহরীন হেসে দিলেন। প্রণবকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন,
-প্রান্তি কেমন আছে রে? অনেকদিন দেখা করতে আসে না।
-আছে। প্রান্তির জন্যই তো ঐ বাড়িতে থাকতে হয় আমার! নয় তো …
কথাটা আর শেষ করলো না ও। আপনমনেই খেতে লাগলো। মিসেস মেহরীন প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললেন,
-এবার একটা বিয়ে-শাদী কর। এভাবে আর কতো দিন? আদ্রও বিয়ে করে ফেলেছে। দেখেছিস?
প্রণব ভ্রু কুঁচকে বললো,
-এমন ভাবে বলছো যেন আমি বুড়ো হয়ে গেছি। কদিন পর আমার জন্য আর মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
-সেটা বলি নি। বিয়ের বয়স তো হয়ে গেছে তোর! তাই না?
-বয়স হয়েছে, আরো হোক! মন মতো মেয়ে না পেলে বিয়ে করছি না। শান্তশিষ্ট, ভদ্র, ভালো একটা মেয়ে! সাধারণ মেয়ে হলেও যার মধ্যে অসাধারণ কিছু থাকবে। এমন মেয়ে যদি পাই, তবেই ভেবে দেখব, নয়তো নয়!
_________________________
স্পৃহা আর আদ্রকে কিছুক্ষণ আগেই নিজেদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে স্পন্দন। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই আদ্র ঘরে চলে গেল। স্পৃহা খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই ওর অনুরিমা বেগম ব্যাঙ্গ করে বললেন,
-তোর বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হয়েই গেল তাহলে! আমি তো আরও ভাবলাম তোর মতো উড়নচণ্ডী মেয়ে বাইরে কোনো অকাজ করে থাকবি! এতো সহজে তোর ভাগ্যে বিয়ে নেই। তাও…
স্পন্দন ফুঁসে ওঠে এমন কথা শুনে। রাগান্বিত স্বরে বললো,
-ফুপি, তোমায় পিহুকে নিয়ে এতো ভাবতে নিষেধ করেছি না? আমার বোন, আমি বুঝে নেব।
অনুরিমা মুখ বাকিয়ে পাশ ফিরে তাকালেন। স্পৃহা কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেল। স্পৃহার বাবা-মা, স্পন্দন অবাক চোখে তাকায় ওর যাওয়া দিকে। স্পৃহা সবসময়ই অনুরিমার কথার সরাসরি উত্তর দিয়ে দেয়। কিন্তু আজ দিলো না। ওর এতো শান্ত ভাব স্পন্দনের সন্দেহ আরোও জোরালো করে দিলো। সে স্পৃহার পিছু পিছু কিছু টা এগিয়ে গিয়ে ওকে ডেকে বললো,
-তোকে কিছু বলার ছিল, পিহু!
স্পৃহা ঘাড় ঘুরিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
-বলো!
-তুই কি এই বিয়েটাতে সুখী না?
স্পৃহার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। নিজেকে অনেক অসহায় লাগছে ওর। স্পন্দনকে কি সব সত্য বলে দেওয়া উচিত? এছাড়া আর কোনো উপায়ও তো নেই! স্পৃহার জেদের বশে নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তটা, আহিরের ব্যাপারটা, সবটা বলে দিলে কেমন রিয়েক্ট করবে স্পন্দন?
-চলবে…
❌কপি করা নিষেধ❌