এক মুঠো প্রেম পর্ব -০৫

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ০৫

স্পৃহা বারবার দ্বিধাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। সবটা খুলে বলে দিতে চাইছে স্পন্দনকে। কিন্তু কথাগুলো গলায় আঁটকে যাচ্ছে শুধু। স্পন্দনও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছেন ওকে। স্পৃহার মতো স্ট্রেইটফরওয়ার্ড মেয়ে কিছু বলার জন্য এমন দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে, ব্যাপারটা কিছুতেই হজম হচ্ছে না ওর।

-ভাইয়া, তোকে কিছু বলার ছিল!

স্পন্দন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই বললো,

-এই নিয়ে তিনবার বলে ফেলেছিস এক কথা। এখন কী বলার আছে, সেটা বল!

স্পৃহা এবার ভীত দৃষ্টিতে তাকালো। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ধীর কন্ঠে বলা শুরু করবে, এমনসময় আদ্র সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। স্পৃহাকে দেখামাত্রই আশেপাশের পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই হুট করে বলে ফেলে,

-স্পৃহা, এতো দেরি করছো কেন? কখন থেকে ঘরে বসে তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম! তুমি আসছো-ই না!! অপেক্ষা করাতে করাতে মেরে ফেলতে চাও নাকি আমায়?

এহেন কথা শুনে স্পৃহা চোখ বড়বড় করে একবার আদ্র, তো একবার স্পন্দনের দিকে তাকাচ্ছে। স্পন্দন এমন পরিস্থিতিতে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। সেটা বুঝতে পেরে স্পৃহার কান গরম হয়ে আসছে। আদ্র স্পৃহার দৃষ্টি অনুসরণ করে পাশে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ক্যাবলামার্কা একটা হাসি দিয়ে বললো,

-ভ্ ভাইয়া, আপনি এখানে? স্পৃহার সাথে কথা বলছেন বুঝি? তাহলে…

স্পন্দন ঠোটের কোণে হাসির রেখা টেনেই বললো,

-আরে, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলছি না। তোমরা যাও। গুড নাইট।

স্পন্দন দ্রুত পা চালিয়ে চলে যেতেই স্পৃহা রক্তচক্ষু নিয়ে আদ্রের দিকে তাকালো। ওর চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থেকে বিরক্তি নিয়ে নিজের দু’হাত ঝাড়া মারলো ও। পরমুহূর্তেই গটগট করে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।

আদ্র নিজের বোকামির কথা ভেবে মাথা চুলকাতে চুলকাতে স্পৃহা পেছন পেছন ঘরে গেল। আমতা আমতা করে,

-আসলে আমি বুঝতে প্…

স্পৃহার কটমট করতে থাকা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বাকি কথাটুকু এক ঢোকেই গিলে ফেলে আদ্র। আর সেটা বের করার সাহস হলো না তার। স্পৃহা কয়েকপা এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-কী বুঝতে পারেননি আপনি? আপনি জানেন আপনি কী করেছেন? উনি আমার বড় ভাই হন। তার সামনে আপনি ওসব বলেছেন! মানে সিরিয়াসলি!!!

আদ্রের মুখটা ছোট হয়ে গেল। অপরাধীর সুরে বললো,

-তুমি যেভাবে বলছো, ওভাবে তো আমি বলিনি! অতো কিছু মিন-ও করিনি। আমি তো…

-ভাইয়া তো ওটাই বুঝেছে, যেটা আমি মিন করছি, তাই না? আর আপনার-ই বা ওসব লাগামহীন কথা মুখ থেকে বের হচ্ছিল কেন?

-আসলে মাথাটা অনেক ধরেছে। ব্যথা সহ্য হচ্ছিল না, তাই কী বলতে কী বলেছি!

স্পৃহা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আদ্রের দিকে। সেই ক্লান্ত মুখশ্রী ও ব্যথিত চোখজোড়া দেখে স্পৃহার মনে প্রচন্ড মায়ার সৃষ্টি হলো। কয়েক মুহুর্ত শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে স্পৃহা নরম স্বরে বললো,

-শুয়ে পড়ুন। আমি কপালে মলম লাগিয়ে দিচ্ছি। ভালো লাগবে।

আদ্র চোখ তুলে তাকালো স্পৃহার দিকে। স্পৃহার প্রস্তাবটা ভারী পছন্দ হলো তার। সে তো শুধু পেইনকিলার চাইতে চেয়েছিল। কিন্তু আশার থেকে প্রাপ্তিটা একটু বেশিই হয়ে গেল হয়তো। খুশি মনে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই স্পৃহা তার পাশে বসলো। কপালে হাত ছোঁয়াতেই আনমনে আদ্রের মুখ থেকে এক অদ্ভুত আবদার বেরিয়ে এলো,

-তোমার কোলে মাথা রাখার অধিকার দেবে আমায়?

বিস্মিত, হতবাক, হতভম্ব হয়ে গেল স্পৃহা। আদ্রের কপালের ওপর চলতে থাকা আঙুল গুলো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই থেমে গেল। অবাক চোখে তাকালো আদ্রের ঘনপল্লব বেষ্টিত চোখজোড়ায়। আদ্র চোখ বন্ধ রেখেই পুনরায় বললো,

-ভয় হয় আমার। জানো? প্রচুর ভয় হয়। তোমাকে স্পর্শ করতে। যদি আমার ছোঁয়া তোমার অস্বস্তির কারণ হয়! তোমার ওপর আমার অধিকার। তুমি একান্তই আমার। অথচ তোমার মনে আমার জন্য এক বিন্দু পরিমাণ জায়গা নেই। ‘তুমি একান্তই আমার’- শব্দ তিনটা নিছকই বিলাসিতা! তাই না?

স্পৃহার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠলো। আজ ওর জন্য বিনা অপরাধে একটা মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। কী দরকার ছিল আদ্রকে নিজের জীবনের সাথে জড়ানোর? নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে এখন। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে বেলকনিতে চলে গেল স্পৃহা। চোখের কোল ছাপিয়ে যে অশ্রু কণা ঝরছে, সেটা দেখানোর কোনো ইচ্ছে এখন নেই।

চোখ মেলে স্পৃহাকে না দেখে কষ্ট লাগলো আদ্রের। ভীষণ কষ্ট লাগলো। মেয়েটাকে ও ভালোবাসে, এমনটা না। তবে ভালো বাসতে তো চায়! তার ভালোবাসাও পেতে চায়। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব? স্পৃহা কি কোনোদিন তার হবে?
________________________

কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। এ কয়দিনে সংসারের কাজকর্ম অনেকটাই আয়ত্ত করে ফেলেছে স্পৃহা। নিজের বাড়িতে একরাতের বেশি থাকা হয়নি তার। পরেরদিনই শাশুড়ী মায়ের জরুরি তলবে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। বিষয়টা নিয়ে মনে তেমন কষ্টও নেই। বেরিয়ে যাওয়ার আগে স্পন্দন শুধু স্পৃহার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলেছিল,

-কী হয়েছে তোর আমি জানি না! তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে একটা কথাই মাথায় রাখবি। পৃথিবীতে যদি তোর পাশে কেউ না থাকে, তবুও ছায়ার মতো আমি থাকবো তোর পাশে। আমার বিশ্বাস আছে তোর ওপর। তুই ভুল কিছু করতে পারিস না।

স্পৃহার বুক ভার হয়ে আসছিল এমন কথা শুনে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়েছিল সে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পাশে আদ্রকে না দেখে ভ্রু জোড়া আপনাআপনি-ই কুঁচকে গেল স্পৃহার। এতো সকালে কোথায় চলে গেছে? প্রশ্নটা বারবার মাথায় আসছে। ভাবতে ভাবতেই ফ্রেশ হয়ে রুমে ফিরে এলো স্পৃহা। আদ্রকে দেখে অবাক চোখে তাকালো সে। ব্ল্যাক জিন্স পরনে শুভ্র রঙের একটা শার্টের হাতা ফোল্ড করায় ব্যস্ত আদ্র। স্পৃহা তা দেখে বললো,

-এতো সকালে কোথায় যাচ্ছেন? আপনি তো এসময় বের হন না!

আদ্র আয়নায় তাকিয়ে চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে ব্রাশ করতে করতে বললো,

-যাচ্ছি আজ। শুধু আমি না। তুমিও যাচ্ছো।

বিস্ময়টা আরো একধাপ বৃদ্ধি পেল স্পহার। এগিয়ে এসে বললো,

-আমি যাচ্ছি মানে? কোথায় যাচ্ছি আমরা?

-আমি চাই তুমি পড়াশোনা কন্টিনিউ করো। মাকে বলে এলাম। প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হয়েছে। তাই এখন তুমি ভার্সিটিতে যাচ্ছো।

স্পৃহা ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। ব্যাপারটাতে সে তেমন খুশি নয়, যেমনটা আদ্র আশা করেছিল। তবুও আদ্রের মনঃক্ষুণ্নের কারণ আর হতে ইচ্ছে করে না তার। সেজন্যই জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে সম্মতি জানালো।
________________________

প্রায় দেড়মাস পর ভার্সিটিতে স্পৃহাকে দেখে প্রান্তি, নীড় আর আহানের চক্ষু চড়কগাছ। চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে স্পৃহার দিকে। এতোদিন পর স্পৃহা এসেছে, সেটা অবাক করার বিষয় ঠিকই। কিন্তু স্পৃহার হলুদ চুড়িদারের পাশাপাশি মাথায় ঘোমটা টেনে আসাটা ওদের শক লাগানোর জন্য যথেষ্ট। ওকে আদ্রের গাড়ি থেকে নামতেও দেখেছে সবাই। আহান হতভম্ব দৃষ্টি বজায় রেখেই প্রান্তির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

-আমি স্বপ্ন দেখতাছি নাকি পিহু সত্যি সত্যিই ভার্সিটিতে আইসে? ঐ আমারে কেউ চিমটি কাট!

প্রান্তি ওর হাতে জোরে একটা চিমটি দিলো। আহান ব্যথায় লাফিয়ে ওঠে। হাতটা বার কয়েক ঝাড়া মেরে প্রান্তির দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-তোরে এতো জোরে খামচি দিতে কই নাই, হারামি! চিমটি আর খামচির পার্থক্য বুঝোস না?

নীড় ওদের কথায় পাত্তা না দিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বললো,

-পিহু এদিকেই আসছে, দোস্ত। আমরা সত্যিই দেখছি। এক সাথে কেউ একই স্বপ্ন দেখে নাকি!

প্রান্তি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

-আসল কথাটা সেটা না। আসল কথা হলো, ও এতোদিন ছিলটা কোথায়? আর ওকে যে পৌঁছে দিলো, সেই ছেলেটা কে?

স্পৃহা ওদের তিনজনকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

-হোয়াট হ্যাপেন্ড? ওমন করে তাকিয়ে আছিস কেন সবাই? আমি তোদের পিহু! কোনো এলিয়েন নই।

আহান স্পৃহার হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসালো। সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,

-তোর গেটআপ দেইখা অবাক হই নাই। এতোদিন গায়েব হইয়া যাওয়ায়-ও অবাক হই নাই। আহির ভাইয়ে ছ্যাঁকা দেওয়ায় তুই দেবদাসের ফিমেল ভার্সন হয়ে গেছোস, সেটা আমরা বুঝছি। কিন্তু কথাটা হইলো, তোর পিছনের ঐ জিনিসটা কে ছিলো রে?

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকালো। নীড় মাথা ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,

-আরে, এখন না। একটু আগে যে ছেলেটা তোকে ড্রপ করে দিয়ে গেল, তার কথাই জিজ্ঞেস করছি আমরা।

স্পৃহা গাল ফুলিয়ে একটা শ্বাস ফেললো। শান্তভাবে বসে রইলো সেখানে। ওর মৌনতা দেখে প্রান্তির মনের সন্দেহটা জোরালো হলো। ও বললো,

-সেদিন তুই রান্নার রেসিপি চাইলি। বাই এনি চান্স ……

-আহির ভাইয়ের উপ্রে জেদ কইরা বিয়া কইরা ফালাস নাই তো তুই?

আহানের বড়বড় চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসলো।
__________________________

ভার্সিটির গেইটের সামনে অনেকক্ষণ যাবৎ ওয়েট করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেছে প্রণব। প্রান্তিকে আজ রিসিভ করতে এসেছিল ও। কিন্তু প্রান্তির আসার নামই নেই।

বিরক্তি নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো সে। পা বাড়িয়ে সামনে এগোতে যাবে এমনসময় মাটিতে চোখ আঁটকে গেল ওর। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দিলো দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া বস্তুটার দিকে। জিনিসটা হলো রুপালি বর্ণের একটা পায়েল। হাতে নিতেই রোদের তীব্র আলোয় ঝলমল করে উঠলো পায়েলটা। কিন্তু এই জিনিসটার মালিক কে?

হঠাৎ গেটের দিকে চোখ যেতেই প্রান্তিকে এগিয়ে আসতে দেখে তাড়াহুড়ো করে পায়েলটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো প্রণব। এখন এটা দেখলে প্রান্তি ওকে জ্বালিয়ে মারবে। উদ্ভট সন্দেহ তো করবেই!

-এতো দেরী কেন করলি? এসে নিয়ে যেতে বললি বলে এলাম। এখন তোর আসার নামই নেই।

প্রান্তি মন খারাপ করে বললো,

-আরে ভাইয়া আজ পিহু এসেছিল। ওর বিয়ে হয়ে গেছে।

-তো কী হয়েছে? বিয়ের বয়স হয়েছে, বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।

প্রান্তি বিরক্তি নিয়ে বললো,

-আরে ধুর! তুমি বুঝবে না। অনেক কাহিনী আছে। বাদ দাও।

প্রণব আর কথা বাড়ালো না। কথা বাড়ানোর ইচ্ছেও তার নেই। মাথায় শুধু ঐ পায়েলটার কথা ঘুরছে। একবার ভাবলো,

-কী দরকার এই ঠুনকো পায়েলটা নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার? এটা নিয়ে অযথা ভাবনা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। সস্তা বস্তুটাকে ফেলে-ই দেই!

পরমুহূর্তেই আবার ভাবলো,

-আসলেই কি ঠুনকো? আসলেই কি সস্তা?

নিজের ভাবনা নিয়েই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে সে।

-চলবে……

❌কপি করা নিষেধ❌

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here