#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২৩+২৪
গোধূলির রক্তিম আভা মুছে গিয়ে নীলাম্বরের গায়ে নিকষ কালো বর্ণে নিজেদের কর্তৃত্ব বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহের হিম শীতল হাওয়ায় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। আঁধার পুরোপুরি ঘনীভূত হয়ে আসতেই প্রণব গাড়ির ইনার লাইটটা অন করে দিলো। শো শো করে ঠান্ডা বাতাস গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করায় নিজের পাশের গ্লাসটা উঠিয়ে দিলো। আড় চোখে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে দেখলো, সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। দৃষ্টি জানালা ভেদ করে বাইরে নিবদ্ধ তার। স্পৃহার এমন অনুভূতি শূন্য আচরণটা পছন্দ হচ্ছে না প্রণবের। সে গলা ঝেড়ে ভরাট কন্ঠে বললো,
-ঠান্ডা হাওয়া আসছে। আপনার পাশের গ্লাসটা অফ করে দিন।
স্পৃহা বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে ভেতরে সামনের দিকে তাকালো। জানালা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলো। প্রণব সেটা পর্যবেক্ষণ করে বললো,
-আপনি এভাবে সাইলেন্ট মুডে থাকেন কীভাবে, মিস… অব্ সরি… মিসেস নিস্তব্ধতা?
কথাটা কর্ণগোচর হতেই স্পৃহা ভ্রু ঈষৎ কুঞ্চিত করে প্রণবের দিকে তাকায়। নিস্পৃহ ভাবেই বললো,
-নিস্তব্ধতা মানে?
প্রণব ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। ড্রাইভিং এ মনযোগ দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
-নামটা মানিয়েছে আপনার সাথে। এতো চুপচাপ থাকেন যে, আপনাকে নিস্তব্ধতা বলেই ডাকা উচিত। আমাদের সাথে আছেন একমাসের বেশী সময় হয়ে গেছে। অথচ আপনার মুখে আমি সেদিন ছাদেই লাস্ট কথা শুনেছিলাম। এরপর এখন শুনলাম, তাও দুটো শব্দ! “নিস্তব্ধতা মানে?” এটাও শুনতাম না যদি আমি সাধারণ কোনো প্রশ্ন করতাম। হাহ!!
স্পৃহা প্রণবের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। স্বগতোক্তি কন্ঠে বললো,
-আপনার সাথে আমি কী কথা বলবো? আপনি প্রান্তির ভাই হন। আমারও ভাইয়ের মতো। বয়সেও……
স্পৃহার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রণব অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকা হেসে বললো,
-ইউ আর রাইট! ভাইয়ের মতো আমি তোমার। বাট দ্য ট্রুথ ইজ, আ’ম নট ইয়র ব্রাদার।
স্পৃহা কথাটা ঠিকভাবে ধরতে না পেরে বললো,
-মানে?
-অনেক রকম মানে হতে পারে, মিসেস নিস্তব্ধতা। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি বলুন তো?
প্রণবের কথার সুরে হেয়ালি স্পষ্ট। স্পৃহা ওর এমন গা ছাড়া ভাব দেখে কথাটাকে তেমন গুরুত্ব দিলো না। এই মুহূর্তে কোনো বিষয়ে গুরুত্ব প্রদানের আগ্রহও নেই ওর। তবে একটা কথা মাথায় আসতেই কন্ঠে তিক্ততা মিশিয়ে বললো,
-আপনি বারবার মিসেস নিস্তব্ধতা বলছেন কেন বলুন তো? আমার নামের পাশ থেকে মিসেস শব্দটা অনেক আগেই মুছে গেছে।
প্রণব গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখেই স্পৃহার দিকে একপলক তাকালো। মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
-প্রণব মেহরাজ লজিক ছাড়া কোনো কথা বলে না, মিসেস নিস্তব্ধতা। লজিক্যাল কোনো রিজন আছে বলেই মিসেস বলছি।
কথাগুলো বেশ ভারী শোনালো স্পৃহার কানে। সেলিব্রিটি মানুষের মধ্যে একটা আলাদা মুড থাকে- সেটা স্পৃহা জানে। কিন্তু প্রণবের প্রতিটা কথা-ই হাসির ভাঁজে প্রকট হওয়া তার প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে। স্পৃহা খানিকটা অবাক হয়ে বললো,
-লজিক? কোন যুক্তিতে আপনি আমায় মিসেস বলছেন? কারো মিসেস ……
-একটা ছোট্ট কথাকে নিয়ে এতো ঘাটাঘাটি করাটা কি ভালো দেখাচ্ছে, মিসেস নিস্তব্ধতা? আপনার নিস্তব্ধ পার্সোনালিটির সাথে বিষয়টা বেমানান।
স্পৃহা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো প্রণবের রহস্যময় হাসিটার দিকে। মুহূর্তেই সেই দৃষ্টি বিরক্তে ভরাট হলো। মুখ কুঁচকে বললো,
-আমার জানার কোনো আগ্রহও নেই। বিকজ আই নৌ হু আই এ্যাম। তবে আপনার মুখের ঐ অদ্ভুত হাসি দেখে সবার মনেই প্রশ্ন জাগবে।
প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে হাসির রেখা আরো প্রসারিত করে হাসলো,
-ওহহ রিয়েলি! আমার হাসি তোমার কাছে অদ্ভুত লাগছে?
-বরাবরই অদ্ভুত। এমন হাসি দেখলে মানুষ কনফিউজড হয়ে যাবে। আমিও হয়ে গিয়েছিলাম।
প্রণবের চোখে মুখে তৃপ্তি ও আনন্দের আভা খেলা করে উঠলো। সে স্বাভাবিক ভাবে হেসে বিরবির করে বললো,
-আমার হাসিটা স্বার্থক তাহলে!!
কথাটা স্পৃহার তেমন কর্ণগোচর হলো না। সে আশেপাশে একবার চোখ বুলালো। গাড়িটা জনমানবের কোলাহল ছাড়িয়ে এখন একটা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে চলছে। মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ির আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। রাস্তার দুই ধারে বিস্তৃত মাঠ ও শস্য ক্ষেত। মূলত মিসেস মেহরীন শহর থেকে দূরে একটা গ্রামীন লোকালয়ের হাসপাতালে বসেন। তার আবাসও সেই গ্রামীন পরিবেশে পিতৃপ্রদত্ত একটা বাগান বাড়িতে। স্পৃহা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
-আর কতক্ষণ লাগবে আমাদের পৌঁছাতে?
-সবেমাত্র এক ঘন্টা হলো। যদিও রাস্তা ফাঁকা থাকায় অনেকটা পথ চলে এসেছি। ল আরো দুই থেকে আড়াই ঘন্টার পথ বাকি।
কথাটা শেষ হতেই আকস্মিক ভাবে গাড়িটা একটু শব্দ করেই থেমে গেল। হুট করে থেমে যাওয়ায় ওরা দুজনেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো। প্রণব নিজেকে সামলানোর আগেই স্পৃহার সামনে নিজের বলিষ্ঠ হাতটা প্রসারিত করে দিলো। স্পৃহা প্রায় ঝুঁকে গিয়ে মাথায় আঘাত পেতে যাচ্ছিলো। প্রণব হাত দিয়ে বাঁধা প্রয়োগ করায় একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সে। প্রণব রাগী স্বরে বললো,
-সিটবেল্ট কেন লাগান নি আপনি? আমি খেয়াল না করলে কী হতো ভেবে দেখেছেন?
স্পৃহা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ছিল। প্রণবের রুক্ষ বক্তব্য কানে পৌঁছুতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো। প্রথমেই প্রণবের লম্বা বাহুটা দৃষ্টিতে ঠেকলো তার। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই প্রণবের রক্তিম চোখজোড়া দেখে বিশেষ ভাবাবেগ দেখালো না সে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
-গাড়ির কী হয়েছে? এভাবে থেমে গেল যে?
প্রণব সোজা হয়ে বসলো। সিটবেল্ট খুলে বাইরে বের হতে হতে আদেশসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-আমি দেখছি। ভুলেও গাড়ির বাইরে পা রাখবেন না বলে দিলাম।
স্পৃহা কথার পৃষ্ঠে নীরব রইলো। প্রণব কিছুক্ষণ পর স্পৃহার পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে বললো,
-গাড়ি থেকে বেরোন। এই গাড়ি নিয়ে আর যাওয়া যাবেনা।
স্পৃহা গাড়ি থেকে বেরিয়ে অবাক কন্ঠে বললো,
-কেন?
প্রণব চোখ দিয়ে ইশারা করে স্পৃহার পায়ের পাশের চাকার দিকে তাকাতে বললো। স্পৃহা চোখ নামিয়ে পাম্পচার হওয়া চাকাটার দিকে তাকাতেই প্রণব বললো,
-চাকা চেঞ্জ করতে হবে। কিন্তু ডেকিতে এক্সট্রা টায়ার নেই।
-তাহলে কাউকে ফোন করুন যেন গাড়ি পাঠায়।
প্রণব নিজের ফোনটা দেখিয়ে বললো,
-চার্জ শেষ ফোনের। আপনার ফোন এনেছেন?
স্পৃহা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়িয়ে না বললো। হতাশ ভঙ্গিতে বললো,
-এখন কী হবে?
প্রণব ব্যাক সিট থেকে নিজের গিটারটা নিয়ে পিঠে ঝুলালো। আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বললো,
-চলুন সামনের দিকে কোনো দোকান থাকলে কাউকে কল দেয়া যাবে।
______________________
দশ-পনের মিনিট হাঁটার পর প্রণব আর স্পৃহা সামনে একটা ছোট দোকান দেখতে পেল। স্পৃহা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো,
-ঐ তো, দেখুন। ঐ দোকানটায় বেশ কয়েকজন মানুষ দেখা যাচ্ছে।
প্রণব সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-ওকে, চলুন। কিন্তু আগে আপনার মুখটা ঢেকে নিন। আর যতটা সম্ভব আমার আড়ালে থাকার চেষ্টা করবেন।
স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-কেন? আমি আ…
প্রণব আদেশের সুরে বললো,
-যা বলছি, তাই করুন। আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না।
স্পৃহা বাধ্য হয়েই শালটা ভালো করে গায়ে মুড়িয়ে নিলো। ওড়নার কিনারা দিয়ে কোনো রকমে নাক-মুখ ঢেকে নিলো।
প্রণব দোকানের দিকে এগিয়ে যেতেই স্পৃহাও পেছন পেছন গেল। দোকানে হাতে গোনা চার-পাঁচজন মানুষ। তারা সবাই খাওয়ায় ব্যস্ত। প্রণব দোকানের মালিককে জিজ্ঞেস করল,,
-আপনাদের এখানে কারো কাছে ফোন আছে। একটা জরুরি কল করার ছিল।
দোকানদার পাংশুটে চেহারা বানিয়ে বললো,
-এইডা একটা অজপাড়াগাঁ, সাহেব। এইখানে এহনো বিদ্যুৎ আসে নাই। সোলার দিয়া আলো জ্বালাইতে হয়। এইখানে আপনে ফোন দিয়া কথা কইতে পারতেন না। কারো কাছে ফোন থাকলেও কথা কওন যায় না।
প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
-নেটওয়ার্ক প্রব্লেম।
-হ! হ!! ঐডা-ই।
প্রণব স্পৃহার দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো। স্পৃহা চাপা সুরে বললো,
-এবার কী করবেন?
-চলুুন, ভেতরে বসে কিছু খেয়ে নেই। এরপর ভেবে দেখি কী করা যায়। রাত হয়েছে অনেক।
প্রণব ভেতরে ঢুকে একটা টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে স্পৃহাকে বসালো। নিজে ওর বিপরীত পাশে বসে খাবারের অর্ডার দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার দিয়ে যেতেই স্পৃহা দেখলো, সাদা ভাত, ভর্তা, শাকপাতা টাইপ ভাজি আর ডাল। প্রণব খাবার দেখে স্পৃহাকে জিজ্ঞেস করল,
-আপনি এসব খেতে পারবেন তো? একটু কষ্ট করে ম্যানেজ করে নিন।
স্পৃহার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ও বিস্মিত চোখে তাকিয়ে প্রণবকে বললো,
-আপনি এসব খাবেন? এসব খেয়েছেন কোনোদিন আপনি?
প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। বললো,
-হ্যাঁ, খাবো। কেন? আমি সেলিব্রিটি বলে কি এসব খেতে পারবো না নাকি? আপনার সমস্যা হলে বলুন। কিছু ব্যবস্থা করি।
-না, আমি খেতে পারবো।
স্পৃহা অবাকতা নিয়েই খাবার খাওয়া শুরু করলো। প্রণব নিজের হাতে বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই খাচ্ছে। স্পৃহা নিজে খাচ্ছে কম, প্রণবকে দেখছে বেশি। প্রণবকে এভাবে খেতে দেখে অবাকের ওপর অবাক হচ্ছে সে। প্রণবও স্পৃহার কার্যকলাপ খেয়াল করছে আর মনে মনে হাসছে।
খাওয়ার পর বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করল, কোনো ভাবে যোগাযোগ করা যাবে কি না। সবাই-ই একই কথা বললো। স্পৃহা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো,
-কোনো উপায়ই তো নেই দেখছি! চলুন মেইন রাস্তায় যাই। কোনো গাড়ি পেলে হেল্প চাইবো।
-হ্যাঁ, সেই। পরে কোনো বাজে লোকের খপ্পরে পড়ি। তারপর আপনাকে কিডন্যাপ করে আমায় ফেলে রেখে চলে যাক। তাই তো?আমি একা হলে সমস্যা ছিল না। সুন্দরী মেয়ে মানুষ সাথে থাকায় বিপাকে পড়েছি।
স্পৃহা হাঁটা থামিয়ে প্রণবের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-কিডন্যাপ করলে আপনি আমায় বাঁচাবেন না?
-বাঁচানোর চেষ্টা করবো। কিন্তু সিনেমার হিরোদের মতো তো আর ফাইটিং করতে পারবো না। আর করলেও আপনি আমার ওপর ইম্প্রেসড্ হবেন না।
স্পৃহা নির্বাক হয়ে তাকালো। এটা আবার কেমন যুক্তি? স্পৃহাকে ওভাবে তাকাতে দেখে প্রণব ওর দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো,
-কী? ওভাবে কী দেখছেন? ইম্প্রেস হবেন? হলে সত্যি সত্যিই বলুন। আমি রিস্ক নিতে রাজি আছি। ফাইটিং করতেও রাজী আছি।
স্পৃহা বিরক্ত হয়ে একটু পিছিয়ে গেল। প্রণব সেটা দেখে বাঁকা হেসে বললো,
-রাতে কোনো স্টেপ নেওয়াটা ঠিক হবে না। অহেতুক কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
বলেই প্রণব সামনের মাঠটার দিকে এগিয়ে গেল। মাঠের এক প্রান্তে একটা ছোট ছাউনি আছে। ছাউনির নিচে আবার বসার জন্য মোটা কাপড়ও বিছানো। হয় তো যারা এখানে চাষাবাদ করেন, তারা বিশ্রামের জন্য এখানে বসেন। প্রণব সেটা দেখে খুশি মনে বললো,
-এখানে আপনি বসতে পারেন। যদিও কাপড়গুলো কুয়াশায় একটু ভিজে গেছে।
স্পৃহা এতোকিছু না ভেবে বসেই পড়লো। দাঁড়িয়ে থাকায় পা দুটো ব্যাথা করছে ওর। শরীরটাও দূর্বল লাগছে খানিকটা। প্রণব কিছু কাঠ-পাতা একসাথে নিয়ে পকেট থেকে কেরোসিন এর ছোট বোতল আর লাইটার বের করে আগুন জ্বালালো। স্পৃহা সেটা দেখে সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,
-এসব কোত্থেকে পেলেন আপনি? কেরোসিন, লাইটার- এগুলো?
প্রণব খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। থতমত খেয়ে বললো,
-অব্.… ঐ রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়েছি। আগুন না ধরালে আলো পাবো কোথায়? আর শীতও পড়েছে অনেক।
স্পৃহা হাতে হাত ঘষতে ঘষতে বললো,
-অহহ! আমি আরো ভাবলাম এগুলো আপনি পকেটে নিয়েই ঘোরেন।
প্রণব কিছু বললো না। আগুনের কুন্ডলী মাঝে রেখে স্পৃহার বিপরীত পাশে বসলো। কাঁধ থেকে গিটার নামিয়ে সেটা নিজের কোলের ওপর রেখে বললো,
-পরিবেশটা কেমন লাগছে আপনার, মিসেস নিস্তব্ধতা?
-তেমন বিশেষ মনে হচ্ছে না।
-ভয় লাগছে না?
স্পৃহা আগুনের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-ভয় কেন লাগবে?
প্রণব ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বললো,
-এই যে, আপনি এখানে একা। আমি তো আপনার পরিচিত কেউ নই। ততোটা বিশ্বাসযোগ্যও না। সবচেয়ে বড় কথা, একটা পুরুষ মানুষ। আপনার মনে নেগেটিভ কোনো চিন্তা আসছে না?
স্পৃহা আগুন থেকে চোখ সরিয়ে প্রণবের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কথাটার মর্মার্থ বুঝতে পেরে ওর ঠোঁটের কোণে শ্লেষাত্মক হাসি ফুটে উঠলো,
-আমার মনে এখন কোনো ভয়-ই কাজ করে না। যদি আপনি আমার কোনো ক্ষতি করেন, তাহলে আমায় বাঁচিয়ে রাখবেন না নিশ্চয়ই। আমায় মেরে ফেললে আমি আপনার নিকট চির কৃতজ্ঞ থাকতাম।
প্রণব থমকালো। হতবাক দৃষ্টিতে তাকালো স্পৃহার মুখের দিকে। স্পৃহা যে এভাবে নিজের মৃত্যুর জন্য উন্মুখ হয়ে আছে, সেটা ওর কথা না শুনলে বুঝতেই পারতো না। প্রণব খানিকটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
-নিজের জীবনের প্রতি এতো বিতৃষ্ণা থাকতে নেই, মিসেস নিস্তব্ধতা। সুখ, দুঃখ, প্রাপ্তি, ত্যাগ – এসব নিয়েই জীবন।
স্পৃহা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-প্রাপ্তির পরিমাণ যখন শূন্যের কোঠায় থাকে, তখন বিতৃষ্ণা আসাটাই স্বাভাবিক। আমার জায়গায় আপনি থাকলে হয়তো বেঁচে থাকতে পারতেন না। এতো ঝড়ের মুখে নিজেকে সামলে রাখার শক্তি কারো থাকে না।
প্রণব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো,
-আমায় নিজের সমীকরণে দাড় করাবেন না, মিসেস নিস্তব্ধতা। আমি আপনার মতো এতো ধৈর্যশীল নই, আপনার প্রাক্তন প্রেমিকের মতো ত্যাগী নই, আপনার প্রাক্তন স্বামীর মতো ব্যক্তিত্বহীনও নই। আমার সত্তাটা একদম ভিন্ন যেটা বাইরে থেকে অবলোকন করা সম্ভব নয়। যেটা আমার চাই, সেটা আমার যেকোনো মূল্যে চাই। আমার নিজস্ব জিনিস একান্তই আমার। তাতে কারো হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই। মানুষ হিসেবে আমি অতোটাও জেন্টেলম্যান নই, মিসেস নিস্তব্ধতা।
কথাগুলো বলেই স্পৃহার দিকে তাকিয়ে দেখলো, সে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। প্রণব গিটারের কাভার খুলে বললো,
-আপনি নাকি অনেক ভালো গান গাইতে পারেন।
-অতো ভালোও গাই না।
-একটা গান শুনাতে পারেন, যদি আপনার ইচ্ছে থাকে।
স্পৃহা শ্লেষের হাসি দিয়ে বললো,
-ফেমাস রকস্টার প্রণব মেহরাজ আমার গান শুনতে চাইছেন! আপনিই গান। আমার এখন গান গাওয়ার মুড নেই।
প্রণব হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-আমার গান তো অনেক শুনেছেন! আপনার গান তো আর আমি শুনিনি। শুধু প্রান্তির মুখে আপনার প্রশংসাই শুনেছি।
-কিছু ইচ্ছে অপূরণীয় থাকা উচিত।
প্রণব আর কথা বাড়ালো না। স্পৃহা এখন কোনোমতেই গান গাইবে না- সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তাই নিজেই গিটারে সুর তুললো।
“আমার অজানায় হলো কী?
তোমাকে তা কখনো বুঝতে দেবো না…
দৃষ্টির পানে আকাশে চেয়ে
তোমাকে আর খুঁজবো না…
আকাশের পানে চেয়ে চেয়ে
ভালোবাসি তা বলবো না……
তুমিও কি আমার মতো করে
একটু ভালোবাসবে না?
তুমিও কি আমার মতো করে
একটু কাছে ডাকবে না?
তুমিও কি আমার মতো করে
একটু ভালোবাসবে না?
তুমিও কি আমার মতো করে
একটু কাছে ডাকবে না?
আগেও তো ভালোবাসতে তুমি!
আগেও তো কাছে ডাকতে তুমি!
তবে আজ কেন দুরত্বটা সবচেয়ে কাছের?
ভালোবেসে কী ভুল করেছি আমি? ”
গানের মাঝে স্পৃহার দিকে চোখ পড়তেই প্রণবের গিটারে সুর তোলা থেমে গেল। ভ্রু যুগল আপনাআপনি কুঁচকে গেল। স্পৃহা গান শুনতে শুনতেই তার পাশে থাকা পিলারে হেলান ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রণব আনমনেই হাসলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে স্পৃহার পাশে গিয়ে পুনরায় বসলো। ওর মাথাটা নিজের কাঁধে রাখতেই স্পৃহা ঘুমের ঘোরে প্রণবের হাত জড়িয়ে ধরলো। প্রণব নিশ্চিত হলো স্পৃহা ঘুমিয়ে গেছে। বেশ সাবধানে পকেট থেকে ফোন বের করে সেটা অন করতেই দেখলো, প্রান্তির অনেক গুলো মেসেজ। সাথে সাথেই ফোনটা ভাইব্রেট হওয়া শুরু করলো। প্রান্তি ফোন দিয়েছে আবার। প্রণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রিসিভ করলো,
-কী, ভাইয়া? জল গড়িয়ে এতদূর? অথচ আমি জানতেই পারলাম না। মাকে দিয়ে সবটা করালি। ভালোই! এখন কোথায় আছিস? গাড়িটা নষ্ট হয়েছিল তো? নাকি তোর প্ল্যান কোনো কাজে আসেনি? কাজ হয়ে গেলে তো পুরোই সিনেম্যাটিক ব্যাপার হয়ে গেছে।
প্রণব চাপা সুরে বললো,
-এতো প্রশ্নের উত্তর তোকে দিতে পারবো না। জাস্ট এটা জেনে রাখ, সব ঠিকঠাক আছে। এখন রাখছি।
বলেই ফোনটা কেটে আবার অফ করে দিলো। স্পৃহার দিকে একপলক তাঁকিয়ে আপনমনে বিরবির করে বললো,
-আমি জানতাম, আপনি এতো সহজে ভেঙে পড়বেন না। তবে ঝড় তো এখনো অনেক বাকি! সবকিছু সহ্য করে আপনি স্ট্রং থাকতে পারবেন তো, মিসেস নিস্তব্ধতা?
# চলবে…
✘কপি করা নিষেধ ✘
[রিচেক হয়নি। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়। ]