এক মুঠো প্রেম পর্ব -২২

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২২

” আজকের ধাক্কাটা স্পৃহা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ও একজন মানসিক রোগীতে পরিণত হবে।”

জানালা দিয়ে শো শো করে বয়ে আসা হিম শীতল হাওয়া পুরো ঘর জুড়ে বিচরণ করছে। ঘড়ির কাটা দু’টোর ঘর পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। স্পৃহা বিছানায় অবচেতনের মতো ঘুমোচ্ছে। গায়ে কম্বল, মাথার ওপর কিছুটা দূরে স্যালাইন ঝুলছে। প্রণব জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একবার স্পৃহার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ঠোঁট গোল করে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে আবার বাইরে তাকিয়ে বললো,

” মানসিক রোগী মানে? মা, আমি জানি ওর শরীরের অবস্থা ভালো নয়। তার মানে এই নয় যে, ও ……”

প্রণবের কথা শেষ না হতেই মিসেস মেহরীন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন,

” ডাক্তার তুই নাকি আমি? মেয়েটার শরীরের অবস্থা একটু ইম্প্রুভড্ হয়েছে। এর আগেও ওর হাসবেন্ড-এর কাছ থেকে একটা ধাক্কা খেয়েছে ও। আর আজ আরেকটা কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে ওকে। ও একটা মানুষ, কোনো রোবট না। মন বলতে কিছু একটা আছে ওর। এই বয়সে এতো ট্রাজেডি সহ্য করাটা এতোও সহজ নয়। আর আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছি। আজকে ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ওর মানসিক অবস্থা অস্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

” যদি কাটিয়ে উঠতে পারে, তো?”

মিসেস মেহরীন চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ” আমার মনে হয় না এটা এতো সহজ হবে। আদৌ সম্ভব হবে তো?”

প্রণব আঙুল দিয়ে নাক ঘষে ভরাট কন্ঠে বললো,

” অসম্ভব কেন হবে? ও ঠিক নিজেকে সামলে নেবে। এটা আমার নিজের বিশ্বাস। আর……”

” প্রণব মেহরাজ- এর বিশ্বাস কখনো হারে না, তাই তো?”

প্রণব ঠোঁট প্রসারিত করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বললো,

” একজেক্টলি! আর স্পৃহার মেডিকেল রিপোর্ট গুলো নিজের কাছে রেখেছো নাকি হসপিটালেই?”

” হসপিটালেই আছে। কাল স্পৃহা আসবে নিতে। তখন ওকে কী বলবো?”

প্রণব রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,

” একটা কাজ করতে হবে তোমায়, মাই সুইট মাদার। কাজটা একটু রিস্কি। কিন্তু তোমায় সবটা হ্যান্ডেল করে নিতে হবে। ”

মিসেস মেহরীন অবাক হয়ে বললেন, “আবার কী কাজ?”

প্রণব একে একে সবটা বেশ নিখুঁতভাবে বুঝিয়ে দিলো। সব শুনে মিসেস মেহরীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

” সবই বুঝলাম। কিন্তু এটা করা কী ঠিক হবে?”

” তুমিই তো বলো তোমার ছেলে ভুল কিছু করতেই পারে না! আমি অনেক ভেবেচিন্তে কাজটা করছি। এটা ছাড়া আপাতত আর কোনো ওয়ে নেই। ”

মিসেস মেহরীন প্রসন্ন চিত্তে হেসে বললেন, “এখন কোথায় আছিস?”

প্রণব খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল এমন প্রশ্ন শুনে। আমতা আমতা করে বললো,

” বাসায়ই আছি। ”

” সেটা তো আমি জানিই! নিজের ঘরে আছিস নাকি ছাদে?”

প্রণব থতমত খেয়ে বললো, “আসলে…ঐ আর কি আছি এ…”

মিসেস মেহরীন ঠোঁট টিপে হেসে বললেন,

” মিথ্যে বলা তোর দ্বারা হবে না। কোথায় আছেন আপনি তা বেশ বুঝতে পারছি আমি। এখন রাখি। অনেক রাত হয়েছে। নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

” মা, তুমি যেমন ভাবছো, তেমন কিছু …”

প্রণবের কথা শেষ হওয়ার আগেই কলটা কেটে গেল। সেটা দেখে ও খানিকটা বিব্রতবোধ করলো। কী ভাবলো তার মা? নিজের ওপরই রাগ লাগছে ওর। কেন যে মিথ্যে বলতে পারে না? অসহ্য!!

নিজেকে কয়েকটা গালি দিয়ে চোখ ঘুরিয়ে স্পৃহার দিকে একবার তাকালো প্রণব। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার দিকে পা বাড়ালো। দরজা খোলার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই পেছন থেকে তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এলো।

” আহিরররর!!!”

চিৎকারটা কর্ণপথে তরঙ্গিত হতে প্রণব চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালো। স্পৃহা চিৎকার দিয়ে শোয়া থেকে এক লাফে উঠে বসেছে। এরকম কিছুর ভয় পাচ্ছিল বলেই প্রণব এতো রাতে স্পৃহার ঘরে এসেছিল চেক করতে। কিন্তু ধারণা যে এভাবে সত্য পরিনত হবে, সেটা ভাবনাতীত ছিল।

প্রণব ছুটে এগিয়ে এসে স্পৃহার পাশে বসে ওর কপালে হাত দিয়ে চেক করে বললো,

” কী হয়েছে? খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন? শরীর খারাপ লাগছে? ওয়েট, আমি লাইট জ্বালাচ্ছি।”

বলেই বসা থেকে ওঠার জন্য প্রস্তুতি নিতেই স্পৃহা প্রণবের হাত দুই হাতে আঁকড়ে ধরে। প্রণবের ভ্রু আপনাআপনি কুঞ্চিত হলো। চোখ ঘুরিয়ে তাকালো স্পৃহার দিকে। ঘরের ভেতর জ্বলে থাকা নীলচে আলোয় স্পৃহার চোখের সামনে ফুটে উঠে এক পুরুষালি অবয়ব। প্রণবকে অবাক হওয়ার সুযোগ না দিয়েই স্পৃহা এক অদ্ভুত কাজ করে বসলো। মুহুর্তেই ঝাপিয়ে পড়লো প্রণবের বুকে। প্রণবের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। পরমুহূর্তেই স্পৃহার কান্নামিশ্রিত বাক্যস্রোত শুনে সব অবাকতা এক নিমিষেই উবে গেল,

” তুমি অনেক খারাপ, আহির। অনেক খারাপ। কেন মিথ্যে বলেছিলে আমায়? কেন আমায় দূরে ঠেলে দিলে? আমাকে কষ্ট দিয়ে কী আনন্দ পাও তোমরা? কিন্তু তবুও তোমায় কেন ভুলতে পারি না আমি? কেন তোমায় এতো দিনেও ঘৃণা করতে পারলাম না? তোমার মতো বাজে মানুষকে আমি একটুও ভালোবাসতে চাই না। একটুও না!!!”

স্পৃহার অভিযোগ শেষ হতেই কান্নাগুলো আরও বেশি জোর দেখিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো। প্রণব নিজেকে সামলে স্বাভাবিক করলো। মুহুর্তেই মন খারাপেরা এসে ভীড় জমালো তার অন্তর্দেশে। নিজের অজান্তেই এক হাত স্পৃহার মাথায় রাখলো সে। স্পৃহার কান্নার গতি যেন আরো বেড়ে গেল,

” আর কখনো যাবে না তো আমায় ছেড়ে? আমি একা একা কীভাবে বাঁচবো? আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমায় আর একা ফেলে যেও না, আহির!!”

শেষোক্ত কথাগুলো অনেকটা নিস্তেজ কন্ঠে বললো স্পৃহা। প্রণব মন্থর কন্ঠে বললো,

” কোথাও যাবো না।”

কথাটা স্পৃহা শুনলো কি না কে জানে? কয়েক সেকেন্ডে ঢলে পড়লো সে। প্রণব বুঝতে পারলো স্পৃহা আবারও অবচেতন হয়ে গেছে। ওকে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কম্বল মুড়িয়ে দিলো। ওষুধের কড়া ডোজের কারণেই এমনটা হয়েছে, সেটাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মনের ভেতর ভয় দানা বাঁধছে প্রণবের। সত্যিই স্পৃহা মানসিক রোগী হয়ে যাবে না তো! পরমুহূর্তেই চোখ বন্ধ করে ভরাট কন্ঠে বললো,

“নো! প্রণব মেহরাজের বিশ্বাস এতো সহজে হেরে যেতে পারে না।”

বলেই স্পৃহার দিকে এক পলক তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিলো।
________________________

মিসেস মেহরীনের চেম্বারে বসে আছে স্পৃহা আর প্রান্তি। স্পৃহা একদমই জড় বস্তুর মতো বসে আছে। ওর চুপ হয়ে যাওয়াটা সবাইকে ভাবাচ্ছে। তবে এখন কথার প্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে সায় দিচ্ছে স্পৃহা। যেটা দেখে প্রান্তি একটু স্বস্তি পেল।

মিসেস মেহরীন আজ কথা বলার চেয়ে স্পৃহাকে পর্যবেক্ষণ করছে বেশি। তার দৃষ্টিতে সন্তুষ্টি ও প্রসন্নতার মিশ্র এক অভিব্যক্তি। স্পৃহার ওপর থেকে সেই দৃষ্টি যেন সরছেই না। স্পৃহার সেদিকে কোনো খেয়াল না থাকলেও প্রান্তির চোখে বিষয়টা বেশ ভালো করেই ধরা খেয়েছে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

-মা, রিপোর্ট গুলো দেখেছো? কী বুঝলে সব দেখে?

মিসেস মেহরীন একটু নড়েচড়ে বসলেন। চশমাটা ভালো করে নাকে বসিয়ে হতাশ কন্ঠে বললেন,

-রিপোর্ট চেক করে তো আমি রিসিপশনে জমা দিয়ে এসেছি। স্পৃহাকে সিগনেচার করে সেটা কালেক্ট করতে হবে। আর রিপোর্টে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

প্রান্তি অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

-মানে কী? স্পৃহা আর কখনো ……

কথাটা আর শেষ করতে পারলো না প্রান্তি। আহত দৃষ্টিতে তাকালো স্পৃহার দিকে। স্পৃহা মাথা নিচু করে বসে থাকলেও এই মুহূর্তে তার ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। সে তো আগে থেকেই জানতো, এমনটাই হবে। সুখ নামক বস্তুটার থেকে বঞ্চিত হতেই সে পৃথিবীতে এসেছে। যেখানে কোনো সুখ-ই কপালে জুটলো না, সেখানে মাতৃত্বের সুখ আশা করা নিতান্তই যুক্তিহীন।

হসপিটাল থেকে রিপোর্ট কালেক্ট করে স্পৃহার হাত ধরে টেনে সেটা আবার মিসেস মেহরীন এর কাছে নিয়ে গেল প্রান্তি। ওর যেন বিশ্বাস-ই হচ্ছে না! মিসেস মেহরীন তপ্ত শ্বাস নিয়ে বললেন,

-আমি সবটাই চেক করেছি। রিপোর্টটা সঠিকই এসেছে।

তিনি স্পৃহার দিকে একবার তাকিয়ে আবার প্রান্তির দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন,

-শোন, তোকে একবার আমার সাথে আমার বাড়িতে যেতে হবে। কাজ আছে একটু।

প্রান্তি বিরক্তি নিয়ে বললো,

-তাহলে পিহু? ওকেও নিয়ে যাবো?

-না, ওর শরীর তেমন একটা ভালো নেই। আমি প্রণবকে ফোন করে দিয়েছি। ও এসে নিয়ে যাবে।

প্রান্তি অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

-ড্রাইভারকে বলে দিলেই পারতে। ভাইয়া…

মিসেস মেহরীন রাগী গলায় বললেন,

-প্রণব এদিক দিয়েই বাড়ি ফিরবে, তাই ওকেই বলেছি। এখন আর কথা বাড়াস না। চল।

বলেই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো তারা। পার্কিং লটে যেতেই প্রণবকে গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। সে ওদের তিনজনকে দেখেই হৃষ্টচিত্তে হেসে এগিয়ে এলো। স্পৃহার কোনো বিশেষ ভাবাবেগ নেই। ও শুধু শান্ত ভঙ্গিতে সবটা দেখে চলেছে।

প্রণব মিসেস মেহরীন এর দিকে তাকিয়ে বললো,

-সবটা ঠিকঠাকভাবেই হয়েছে তো?

মিসেস মেহরীন চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করতেই প্রণবের চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। ও নিজের মাকে ঝাপটে ধরে উৎফুল্লচিত্তে বললো,

-থ্যাঙ্কিউ! থ্যাঙ্কিউ!! থ্যাঙ্কিউ সোওও মাচ, মা!!! ইউ আর দ্য বেস্ট মম অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। আই লাভ ইউ, মা!!

প্রণবকে এতো খুশি হতে দেখে প্রান্তি বেশ অবাক হলো। কী এমন হলো যে ওর ভাই এতো খুশি? সবটাই মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে এখন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে প্রান্তি। আর স্পৃহা শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। এমুহূর্তে তার মনে কোনো প্রশ্ন জাগছে না আর না জাগছে কিছু জানার কৌতূহল! কোনো বিষয়ে কোনো আগ্রহ-ই আর অবশিষ্ট নেই।

# চলছে.………

✘কপি করা নিষেধ ✘

[রিচেক হয়নি। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here