এক মুঠো প্রেম পর্ব -২৮

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২৮

প্রণব নিজের ঘরে ঢুকতেই আদ্রকে বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। এখানে আসার পর থেকে-ই আদ্রের পাংশুটে মুখটা প্রণবের দৃষ্টিতে বেশ ভালো করেই ধরা খেয়েছে। তাই ওর সামনে বসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-এতো আপসেট দেখাচ্ছে কেন তোকে বল তো? মনে তো হচ্ছে সিরিয়াস কিছু ঘটেছে! তুই এতো তাড়া দিয়ে আজ দেখা করতে চাইলি!!!

আদ্র চোখ তুলে তাকালো। হাতের মুঠোয় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বিমর্ষ ভঙ্গিতে বললো,

-বলার মতো অনেক কিছু-ই তো ঘটেছে! কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা বলবো, বুঝতে পারছি না। ভেবেছিলাম তোর সাথে সবটা শেয়ার করলে একটু মানসিক শান্তি পাবো। কিন্তু এখানে এসে যা ফেস করলাম, তাতে শান্তি নামক বস্তুটা কপাল থেকে মুছেই গেছে বোধ হয়।

প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। বললো,

-কী হয়েছে? সেটা তো বলবি!!

-বলবো অন্য একদিন। তবে আমাকে আগে এটা বল যে, স্পৃহা এ বাড়িতে কেন?

প্রণব ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-তুই ওকে চিনিস?

আদ্র একটু হকচকিয়ে গেল। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললো,

-আগে বল ও এখানে কীভাবে এলো?

প্রণব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাত দিয়ে কপাল ঘসে বললো,

-সে অনেক কথা। ওর ব্যাপারে কেউ কৌতূহল দেখাক, সেটা আমি মেনে নিবো না। শুধু এতোটুকু জেনে রাখ, ও একটা হারিয়ে যাওয়া অমূল্য সম্পদ যা বহু সাধনার মাধ্যমে ফিরে পেয়েছে কেউ।

আদ্র কথার কোনো অর্থ খুঁজে পেল না। ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে বললো,

-হারিয়ে যাওয়া সম্পদ মানে? কার সম্পদ? কে খুঁজে পেয়েছে?

প্রণব অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,

-বললাম না!! ওর ব্যাপারে এতো কৌতূহল দেখাস না।

আদ্র বেশ অবাক হলো। ওর চিন্তাজগত জুড়ে এখন শুধু আহির ঘুরছে। আহির কি স্পৃহার জীবনে আবার ফিরে আসবে? নাকি স্পৃহার সম্পর্কে ওর এখনো অনেক কিছু জানা বাকি?

ভাবতে ভাবতে আদ্র নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত হলো। স্পৃহার সাথে তো তার আর কোনো সম্পর্ক অবশিষ্ট নেই। তাহলে এতো জানার আগ্রহ কেন জাগছে?
_________________

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। প্রান্তির সাথে আজ আহান আর নীড়ও এসেছে স্পৃহার সাথে দেখা করতে। ওরা বাগানের কাছাকাছি আসতেই দেখলো আদ্র বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে। প্রান্তি অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

-ইনি এখানে কেন?

নীড় অবাক চোখে তাকালেও আহান রাগী স্বরে বললো,

-ক্যান আবার! তোরা কি কিছু বুঝোছ না? ফিডার খাস? আমি নিশ্চিত এ পিহুর সাথে দেখা করতে আসছে। মনটায় তো চাইতাসে……

বলে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে সামনে এগোবে ওমনি নীড় ওকে আটকে দিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললো,

-ওই তোর এই বিগড়ে যাওয়া মেজাজটা একটু সামলা তো! কিছু না জেনে, না বুঝে, একশন নেওয়া শুরু করিস। আগে জেনে তো…….

-কী জানতে বুঝতে কস তুই আমারে বা**? ও এইখানে আসার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে? যত্তসব!!!

ওদের বকবকানির মাঝেই আদ্র নিজের গাড়ি নিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আহান চোখ রাঙিয়ে বললো,

-দেখলি? তোদের জন্য ওর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারলাম না। ধূররর!!! এই শীতের মধ্যেও রাগে গরম লাগতাসে আমার।

প্রান্তি ভ্রু কুঁচকে বললো,

-ওনার কী ব্যবস্থা করতি তুই?

আহান দাঁত কটমট করতে করতে বললো,

-খুন করতাম! খুন!! তবে তার আগে জিজ্ঞেস করতাম এতো দিনে বিয়ে কইরা কয়টা বাচ্চার বাপ হইসে শা**।

আহানের কথা শুনে প্রান্তি আর নীড় মুখ লুকিয়ে হাসলো। তবে সেটা আহানের নজর এড়ালো না।

.

আহান আর নীড় স্পৃহার সাথে দেখা করে গেছে কিছুক্ষণ আগে। স্পৃহার ধারণা আদ্র ওর সাথেই দেখা করতে এসেছিল। তাই প্রান্তিদেরও সেটাই বলেছে। আর প্রান্তিও জানে না যে, প্রণব আর আদ্র একে অপরের খুব কাছের বন্ধু। তাই ওরা ধরেই নিয়েছে, আদ্র স্পৃহার সাথে দেখা করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এ বাড়িতে আসেনি। কিন্তু স্পৃহা বিরক্ত হওয়ায় ওরাও আর বিষয়টাকে নিয়ে ঘাটেনি।

বারান্দার পাশে গায়ে শাল মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্পৃহা। উত্তরে হাওয়া বারবার গা ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর। কিন্তু সেদিকে স্পৃহার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। গালে নোনাজলের লম্বাটে রেখা অনেকটা চকচক করছে। তার দৃষ্টি নিকষ আকাশের কোলে স্থান করে নেওয়া উজ্জ্বল গোলাকার প্রতিকৃতির ওপর নিবদ্ধ। যদিও এখন সে গোলাকৃতির এক পাশে সামান্য ভাটা পড়েছে, তবে তার সৌন্দর্য কোনো অংশে কমেনি।

-মানুষের সামনে শক্ত খোলসে নিজেকে আবৃত করে রাখলেও রাতের একাকিত্বে লুকিয়ে লুকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে নিজের কষ্টগুলো নিজের ভেতরে আবদ্ধ করে রাখাটা কতোটা যৌক্তিক, মিসেস নিস্তব্ধতা?

স্পৃহা খানিকটা চমকে উঠলো। অতি সন্তর্পণে চোখে পানিগুলো মুছে প্রণবের দিকে তাকালো। বিমর্ষ কন্ঠে বললো,

-আপনি? আপনি এখানে কী করছেন?

প্রণব ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,

-দেখতেই তো পাচ্ছেন দাঁড়িয়ে আছি! অযথা প্রশ্ন করছেন কেন বলুন তো?

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এটা কোনো উত্তর হলো? প্রণবের কন্ঠে স্পষ্ট হেয়ালি বিদ্যমান। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে। স্পৃহাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে প্রণব হাসলো। বললো,

-রাগ করলেন?

-না।

-আহিরকে ভুলতে পারবেন, মিসেস নিস্তব্ধতা?

স্পৃহা গ্লানি মিশ্রিত হাসি দিয়ে বললো,

-যদি আহিরকে ভুলে যাওয়াটাকে সফলতা হিসেবে বিবেচনা করেন, তবে এদিক থেকে আমি ব্যর্থ। যখন ওকে ঘৃণা করার কথা ছিল, তখনই আমি ওকে ভুলতে পারিনি। আর আজ যখন আমার চোখের সামনে আহিরের অসহায়ত্ব ও নির্দোষিতা পরিষ্কার, তখন ওকে কীভাবে নিজের মন থেকে সরাই বলুন তো? হয়তো ওকে ভুলতে পারিনি বলেই আমার প্রাক্তন স্বামীর প্রতিও আমার ভালোবাসার অনুভূতি বোধ হয়নি। সব মানুষকে ভোলা যায় না, বিশেষ করে জীবনের প্রথম ভালোবাসা ভুলে যাওয়াটা অসম্ভব!

-কিন্তু দ্বিতীয় ভালোবাসা তো অসম্ভব নয়, তাই না?

-যাদের জীবনে প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ভালোবাসার আগমন ঘটে, তারা অনেক ভাগ্যবান হয়। আর সেটা তখনই সম্ভব হয়, যখন এমন কাউকে পাওয়া যায় যে প্রথম ভালোবাসার মানুষ থেকেও অনেক বেশি অনুভূতিপ্রবণ হয়। যখন বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও প্রেমের যোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী বা অধিকারিণী হয়।

প্রণব হেসে বললো,

-বাহ্! আপনি তো বেশ যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারেন! আমি বিয়ের আগে আমার বউকে আপনার আন্ডারে ট্রেনিং দেওয়াবো, যেন সেও আমাকে অনেক ভালোবাসতে পারে।

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

-ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন নেই। আপনার বউ এমনিতেই আপনাকে ভালোবাসবে। খালি একবার বিয়ের কথাটা মুখ ফুটে বলুন-ই না! বাড়ির সামনে লাইন লেগে যাবে মেয়ের।

প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে বাঁকা হেসে বললো,

-তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আমার ভালোবাসা লাভের মতো যোগ্যতা আছে, রাইট?

স্পৃহা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,

-থাকবে না কেন? নরমালি আপনাকে নিয়ে বাইরের জগতে যে পরিমান মাতামাতি হয়, বাস্তব আপনার ধারেকাছে ঘেঁষাটাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার হওয়া উচিত। অথচ আপনি সবার সাথে কতো সহজেই মিশে যান! এরকম ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষকে ভালোবাসা যাবে না কেন?

প্রণব একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,

-যাক! একটু চিন্তা মুক্ত হলাম। তাহলে বিয়েটা করেই ফেলবো ভাবছি! প্রে করুন যেন আমার বউটা আপনার মতো সুইট হয়!!

স্পৃহা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,

-আমার থেকেও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করেন আপনি। আর ভালো কাউকেই পাবেন, বুঝলেন?

প্রণব মুচকি হেসে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আবার কী মনে হতেই পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বললো,

-বেস্ট জিনিসের থেকে ভালো কিছু এই পৃথিবীতে একজিস্ট করে না, মিসেস নিস্তব্ধতা। বেস্ট সবসময় বেস্ট-ই হয়! বাংলায় যাকে বলে ‘সেরা’।

স্পৃহা থমকালো। বিস্ফোরিত চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। কিন্তু ঘরটাকে জনমানবহীন হিসেবে আবিষ্কার করলো সে। প্রণব চলে গেছে। তাহলে কি স্পৃহা ভুল শুনলো? নাকি প্রণব কোনো অদ্ভুত রহস্যের ইঙ্গিত দিয়ে গেল?
___________________

প্রায় মাস খানেক সময় পেরিয়ে গেছে। স্পৃহা এখন নিজেকে নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত। কিন্তু মূলত স্পৃহাকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে, যেটা ওর অজানা। এতে ওর অতীত নিয়ে চিন্তা চেতনায় কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে।

ভার্সিটি থেকে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো স্পৃহার। পুলকিত চোখে এগিয়ে গিয়ে স্পন্দনকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-কখন এসেছো, ভাইয়া? এতো দিন পর এলে যে?

স্পন্দন হা হয়ে গেল নিজের বোনের এমন আচরণ দেখে। স্পৃহা তার সাথে একদম আগের মতো আচরণ করছে। মেয়েটা সত্যি সত্যিই স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে ভেবে স্পন্দনের মনে অদ্ভুত প্রশান্তি খেলে গেল। চোখেও পানি চলে এলো ওর। কিন্তু সেটা আড়াল করে স্পৃহার দিকে তাকালো সে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেসে বললো,

-একটু ব্যস্ত ছিলাম, তাই আসতে পারিনি।

কথাটা স্পৃহার তেমন বিশ্বাস যোগ্য মনে হলো না। কেননা স্পন্দনের চোখ মুখ-ই বলে দিচ্ছে ও এতোদিন কতোটা কষ্টে নিজেকে সামলেছে। চোখের নিচে কালচে দাগগুলো ওর লুকিয়ে রাখা কষ্টের স্মারক। আর কষ্ট হবেই বা না কেন? যে পরপর দুজন কাছের বন্ধু হারিয়েছে, তার মনের অবস্থাটা বোঝাটা দুঃসাধ্য-ই বটে। আহির আর আয়াফ ছাড়া আর কোনো কাছের বন্ধুও স্পন্দনের ছিল না। অথচ দুজনেই ওকে ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে না ফেরার দেশে। ভেবেই তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের চোখের পানি আঁটকে নিলো স্পৃহা।

-বাড়ির সবার কী অবস্থা, ভাইয়া?

-ভালো। আর একটা সুখবরও আছে তোর জন্য!

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-সুখবর? কী সুখবর?

-যদিও আমি এসব এখন চাইছিলাম না! কিন্তু মেঘার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। তাই অবশেষে বাধ্য হয়েই বিয়েটা এ মাসেই পাকা করতে হলো।

স্পৃহা চোখ বড়বড় করে বললো,

-এই মাসে তোমার বিয়ে? সত্যি??

স্পন্দন মুখ ছোট করে বললো,

-হুম। তাই আজ তোকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি।

-কিন্তু স্পৃহা তো এখন এখান থেকে যেতে পারবে না! আমি যেতে দেবো না।

স্পৃহা কিছু বলার আগেই ঘরে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটলো আর তার ভরাট কণ্ঠ নিঃসৃত বাক্য দুটো কানে ভেসে আসতেই স্পৃহা ও স্পন্দন দুজনেই অবাক চোখে সেদিকে তাকালো।

# চলবে.…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here