#এটা_গল্প_হলেও_পারতো
পর্ব—-১১
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
দোকানদারের কথা শুনে টনক নড়ে গেলো তিয়াশ আর রাত্রির।তার সাথে কথা শেষ করে যতদ্রুত সম্ভব বাড়ির ভেতরে পা বাড়ালো তারা।বেশ পুরনো একটা বাড়ি,ভেতরে তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই।আর থাকবেই বা কিকরে,মানুষ থাকলে তবে তো সাড়াশব্দ থাকবে।ঘরের মেইন দরজাটা ভেতর থেকেই খুলে রাখা হয়েছে তাই ভেতরে ঢুকতে বেগ পেতে হয়নি কারোর।বাড়ির ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো।কিন্তু অদ্ভুত ব্যপার কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।অথচ সেই দোকানদারের ভাষ্যমতে কান্না রহমান এই বাড়িতেই থাকে।
—-কি হলো, বাড়িতে তো কেউ নেই?(তিয়াশ)
—হুমম,তাই তো দেখছি।
—তাহলে ঐ দোকানদার কি বললো?
–মিথ্যে বললো না তো আমাদের!
—কাম অন,ওনার আমাদের মিথ্যে বলে কি লাভ!কেন শুধু মিথ্যে বলতে যাবেন আমাদের।
—তাও ঠিক,হয়তো আগে সত্যি কেউ ছিলো,এখন আর সে নেই।
—এক্সাইটলি,আমিও তাই ভাবছি।কান্না রহমান এমনিতেই মানসিক বিকারগ্রস্ত।এই ধরণের মানুষের ব্যপারে কিছু বলা যায় না।যখন যা খুশি করতে পারে।
—সে সব ঠিক আছে,কিন্তু এখন ওনাকে খুঁজে না পেলে কি হবে বলুন তো,
—আচ্ছা চলো বাইরের বাইরে গিয়ে খোঁজ করি, কিছু জানবার মতো পেলে পেয়েও যেতে পারি।
—হুম।
এই বলে তিয়াশ রাত্রির হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো ঠিক তখন একটা শব্দ ভেসে আসলো উপরের ঘর থেকে।কোনো কিছু পড়ে যাবার শব্দ।তিয়াশ আর রাত্রি সেই শব্দকে অনুসরণ করতে করতে ছুটে যায়।শব্দটা স্টোর রুমের দিক থেকে আসছে।আগে এইদিকে খুঁজতে আসেনি ওরা।তাছাড়া তখন কোনো সাড়াশব্দও ছিলো না এখানে।স্টোর রুমে ঢুকে দুজনের চোখ ছানাবড়া।নিজেদের সামনে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলাকে দেখতে পায় ওরা।তার মানে নিশ্চিত ইনিই কান্না রহমান।উনি ছাড়া আর কেই বা থাকবে এই বাড়িতে।
রাত্রি এগিয়ে গেলো তার দিকে।ঘরটা বেশ অন্ধকার।তিয়াশ গিয়ে ধূলোকনায় জর্জরিত বন্ধ জানালাটা খুলে দিলো।অমনি কিছুটা আলো ভেতরে এসে ঠিকরে পড়লো।চারপাশটা আলোকিত হয়ে যায়।
কান্না রহমান প্রথমে রাত্রিকে দেখে বেশ ভয় পেয়ে যান।কিন্তু পরে বুঝতে পারলেন যারা তার কাছে এসেছে তারা তার জন্য ক্ষতিকারক নয়।ভয়ের মাত্রা কমে গেলো।ক্ষীণ কন্ঠে রাত্রি আর তিয়াশকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।
—তোমরা আমার মেয়েকে দেখেছো,আমার মেয়েকে দেখেছো তোমরা!?
—কে তোমার মেয়ে,আর সে কোথায় আছে এখন?
(দোকানদারের কাছ থেকে সবটা জানা সত্ত্বেও রাত্রি তাকে প্রশ্ন করে!কারণ উনি মুখ খুললে হয়তো আরো অনেক অজানা কথা বেরিয়ে আসবে)
—সে তো আর নেই এখন আমার কাছে!
—নেই,কোথায় গেছে সে?
—না না,ভুল বলছো গো তোমরা,সে যায়নি তো।তাকে চুরি করে নিয়ে গেছে,ঐ ডাইনিটা আমার মেয়েকে চুরি করে নিয়ে গেছে।
—কে আপনার মেয়েকে চুরি করে নিয়ে গেছে?
—ঐ ডাইনিটা,তোমরা ওকে খুঁজে দিতে পারো।
—আপনার মেয়ে কবে চুরি হয়েছে,আর কিভাবে চুরি হলো,
—আমি এতো কিছু জানি না,শুধু এইটুকু দেখছি ও আমার মেয়েকে চুরি করে নিয়ে গেছে,আর আমার কাছে একটা মরা বাচ্চা রেখে গেছে।আর কিছু জানি না আমি,সবাইকে এতো করে বললাম কেউ বিশ্বাস করলো না আমার কথা, কেউ বিশ্বাস করলো না।সবাই পাগল বলে আমায়।
কান্না রহমানের কথা শুনে বোঝা গেলো উনি মোটেও মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ নন।যদিও কথাবার্তার ধরন ভীষণ এলোমেলো,পাগলাটে ধরণের।কিন্তু সেগুলো নিছক ওনার মনের কল্পনা নয়,হয়তো সব সত্যি।
—আচ্ছা শুনুন মা,যে মহিলা আপনার বাচ্চা চুরি করে নিয়ে গেছে তাকে দেখলে চিনতে পারবেন তো আপনি?
—কি বললে, তুমি আমাকে মা বলে ডাকলে?জানো এই ডাকটা শোনার জন্য কতোগুলো বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি আমি। কেউ মা বলে ডাকে না আমায়।পাগল বলে তাড়িয়ে দেয়। তুমি আমায় মা বলে ডাকলে,আমার মেয়েকে খুঁজে দাও না।দাও না খুঁজে।
মা ডাকটা একান্ত মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে রাত্রির মুখ থেকে।কিন্তু ভদ্রমহিলা এই ডাকটা শুনেই যেন পুরো সতেজ হয়ে উঠলেন।মুখে হাসির রেখা ফুঁটে উঠলো তার।
—আমি কি বলেছি,আপনি ঐ মহিলাকে চিনতে পারবেন দেখলে?
—পারবোনা মানে,একশো বার পারবো।ঐ ডাইনির চেহারা আজো ভুলিনি আমি।তোমরা জানো তো আমি খুব ভালো ছবি আঁকতাম এক সময়ে।ওর একটা ছবি এঁকে রেখেছি আমি।দেখবে তোমরা দেখবে?
কান্না রহমানের কথা শুনে তিয়াশ আর রাত্রি পরস্পরের দিকে তাকায়।তারা ভাবতেও পারছে না একটু পরে কি ঘটবে।কান্না রহমান সত্যিই কি রাত্রির মায়ের ছবি দেখাবে নাকি অন্য কারো।এটা ভেবেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে রাত্রির।
—হ্যাঁ,দেখান।আমরাও দেখতে চাই কে আপনার এতো বড়ো সর্বনাশ করলো।(তিয়াশ)
—দাঁড়াও,দাঁড়াও।একটু দাঁড়াও।আমি আনছি।
এই বলে কান্না রহমান পেছনের দিকে চলে গেলেন।একটু পরে হাতে একটা ড্রয়িং নিয়ে ফিরে আসে সে।অনেক বছর আগেই একে রেখেছে বলে মনে হচ্ছে।ড্রয়িংটা এনে তিয়াশ আর রাত্রির সামনে ধরলো কান্না রহমান।ছবির দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে হা করে তাকিয়ে রইল দুজনে।তাদের মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না।এটা আর কারোর নয়,রাত্রির মায়েরই ছবি।কান্না রহমান তার সুনিপুণ হাতে রাত্রির মায়ের অবয়ব স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলতে শতভাগ সফল হয়েছেন।যদিও ছবিটা এখন বড্ড মলিন।কিন্তু এই মলিনতা ভীড়েও নিজের মাকে চিনতে ভুল করেনি রাত্রি।মাথায় দুহাত হাত ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো রাত্রি।তিয়াশও হাঁটু গেড়ে ওর পাশে বসে।
—-এটা আমি কি দেখলাম তিয়াশ সাহেব,আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
—তুমি যা দেখেছো আমিও তাই দেখেছি।তুমি প্লিজ এখন এতোটা উত্তেজিত হয়ো না।
—উত্তেজিত হবো না, কি বলছেন আপনি এগুলো,সামনে আমার নিজের মা দাঁড়িয়ে আছে অথচ আমি কিছুই বলতে পারছি না তাকে।(ক্রন্দনরত স্বরে)
—চুপ,একদম চুপ।এখন এই কথা ওনার সামনে ভুলেও বলা যাবে না।উনি আরো বেশী উত্তেজিত হয়ে যাবেন।যদি তাই হয় আমরা আমাদের পরবর্তী কোনো কাজ করতে পারবো না।প্লিজ নিজেকে একটু সামলাও।প্লিজ।হাতজোড় করছি তোমার কাছে।
—আপনি আসলে আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছেন না,
—তোমার মনের অবস্থা আমি ছাড়া কেউ ভালো বুঝতে পারে না, ট্রাস্ট মি। আমি সব ঠিক করে দেবো।এখন দয়া করে নিজেকে সামলাও।সবটা এভাবে নষ্ট করে দিও না।
কান্না রহমান লক্ষ্য করলেন এরা দুজন নিজে বসে কোনো বিষয়ে কথা বলছে।
—এই তোমরা দুজনে কি কথা বলছো,আমার মেয়েকে খুঁজে দিবে কিনা বললে না তো,
—হ্যাঁ,কথা দিচ্ছি।আপনার মেয়েকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেবো আমি।আর আপনার ডাইনিকেও।তখন আপনিই তার শাস্তি দেবেন।(তিয়াশ রাত্রিকে দাঁড় করাতে করাতে বললো)
—তোমরা সত্যি বলছো,আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।সত্যি তোমরা আমার মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবে?
—হ্যাঁ,দেবো।আর খুব শীঘ্রই।
এটা শুনে কান্না হাততালি দিতে দিতে আনন্দে প্রায় লাফানো শুরু করে দিলেন।এদিকে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত।নিজের মায়ের এই দূর্দশা দেখতে পারছে না সে।এই দুঃসময়ে মাকে কিছু বলতেও পারছে না সে।এর থেকে যন্ত্রণাদায়ক আর কি হতে পারে একটা মেয়ের জন্য।
—আচ্ছা,কাল সকালে আমাদের সাথে আপনাকে বেরেতো হবে।আপনি যাবেন তো আমাদের সাথে?
—বেরোতে হবে,না না,আমি বেরোবো না।ওরা সবাই আবার পাগল বলে ক্ষেপাতে আসবে আমায়।
—না,এবার আর কেউ কিছু করতে আসবে না। আমরা যেভাবে বলবো সব কথা শুনবেন।ঠিক আছে।বলেছি না আপনার মেয়েকে খুঁজে দেবো। তাকে খুঁজতে হবে না?
অবশেষে কান্না রহমান ওদের সাথে বেরোতে রাজি হলেন।রাতটা এই বাড়িতেই থাকার পরিকল্পনা করলো তিয়াশ।একজন লোক আছে যে কান্না রহমানের জন্য তিনবেলা খাবার দিয়ে যান।সেই খাবার খেয়েই এতোগুলো বছর বেঁচে আছেন উনি।ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে সে উত্তর দেয় খাবারের ব্যবস্থা তার স্বামীই করে রেখেছে গিয়েছিলেন।যিনি কিনা এখন দেশের বাইরে থাকেন।যাই হোক দুটো রুম পরিষ্কার করে তাতে তিয়াশ আর রাত্রি শুয়ে পড়লো।কান্না রহমান তার ঘরে।অনেক চেষ্টা করেও রাত্রি তাকে ওর ঘরে আনতে পারেনি।
–
–
–
রাত প্রায় দুটো তখন।হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো রাত্রির।বুঝতে পারলো নিজের বিছানায় আর নেই সে।কেউ তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।চিৎকার করার বা কিছু দেখার উপায় পর্যন্ত নেই।কারণ তার মুখ আর চোখ তখন একটা শক্ত কাপড় দিয়ে বাঁধা।লোকটা রাত্রিকে একটা ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলো।তারপরে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।রাত্রি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো।লোকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে তার দিকে।তারপর ওকে পেছন থেকে খুব বাজেভাবে জড়িয়ে ধরলো।তার উষ্ণ নিঃশ্বাস রাত্রি নিজের ঘাড়ের ওপরে উপলব্ধি করতে পারছে।এরপর লোকটা রাত্রির মুখের বাঁধন খুলে দিলো।
—কে,কে তুমি?দেখো আমার সাথে একদম খারাপ কিছু করার চেষ্টা করবে না বলে দিচ্ছি,
লোকটা তখনো চুপ,কোনো কথা বলছে না।রাত্রি এই মুহূর্তে তিয়াশের প্রয়োজন অনুভব করছে ভীষণভাবে।ও নিশ্চয়ই নিজের ঘরে অঘোরে ঘুমাচ্ছে।
রাত্রি এরপর বুঝতে করলো ওর বুকের ওপর সে ধারালো কিছু রেখেছে।হয়তো ছুড়ি হবে।তারপর সেটা ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে লাগলো।একপর্যায়ে লোকটা ছুড়ির অগ্রভাগ দিয়ে রাত্রির চোখের বাঁধন এক টানে খুলে দিলো।এরপর সে রাত্রিকে নিজের দিকে টেনে নেয়,তার ছুড়িটা রাত্রির গলা বরাবর।লোকটার হিংস্র চেহারা দেখে দেখে আঁতকে উঠলো রাত্রি!অস্পষ্ট স্বরে সে বলে উঠলো :
—তিয়াশ তুমি…..!!!!
চলবে,