অজানা পৃথিবী পর্ব -০৬

#অজানা_পৃথিবী
#কলমে_লাবণ‍্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_৬

কোনরকম খাওয়া শেষ করে কুহেলী উপরে উঠে আসতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। সবাইমিলে ওকে আটকে দিলো। নতুন বউকে নিয়ে সব গল্প করতে বসলো। ডাইনিং রুমে তেমন হৈচৈ নেই,নির্জন পরিবেশ। এই বাড়িতে কোনো অবিবাহিত মেয়ে বা ছেলে নেই। যারা আছেন সব মধ্য বয়সী নয়তো বৃদ্ধ। কুহেলী অবাক হলো ভাবলো এতগুলো মানুষের কি শুধু ওই একটামাত্র ছেলে? কিন্তু কেনো? এই বাড়িতে এসে ওর এখনো পযর্ন্ত শাশুড়ির সঙ্গে দেখা হয়নি যদিও শুনেছে কখনও উনি রুমের বাইরে আসেন না। শশুর মশাই কাজের জন্য বাড়ির বাইরে থাকেন। জুবায়ের ফারুকী মানে ওর স্বামী,চাচা চাচি ফুপিদের কাছেই বড় হয়েছে। সবাই ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। যৌথ পরিবার বলে সবাই এক সঙ্গে থাকেন। বাড়িতে কোনো কাজের মানুষ নেই। এরা নিজেদের কাজ নিজেরা করতেই পছন্দ করে। পাশ থেকে ওর চাচি শাশুড়ি বলে দিলো ওকে কোনো রান্না করতে হবে না শুধু সঙ্গে থাকলেই হবে। সবাই খুব শান্তি প্রিয় মানুষ, বাড়িতে কোনো ঝামেলা পছন্দ করেন না। উনি ওকে খুব আন্তরিকতার সহিত সব বুঝিয়ে দিলেন। কুহেলী শুধু মাথা নেড়ে সাড়া দিচ্ছে। মনটা যে আবিরের কাছে পড়ে আছে। বারবার মনে হচ্ছে জুবায়ের লোকটাকে বিশ্বাস করা কি ঠিক হলো? উনি কখন খুঁজতে যাবেন নাকি মিথ্যা বলে সান্ত্বনা দিলেন? এরকম ভেবে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হলো। রাতের খাবার শেষ হয়েছে একে একে সবাই উঠতে শুরু করেছে। জুবায়ের বাইরে আছে তাই কুহুকে সবাই রুমে যেতে বলল। কুহেলী আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। বিশাল বড় বাড়িটার দেওয়ালে চকলেট রঙের আবরণটা খুবই অদ্ভুত লেগেছে ওর কাছে। মনে হচ্ছে লাল রঙের সঙ্গে সামান্য কলো রঙ মিক্স করার জন্য এরকম হয়েছে। একদম বেমানান লাগছে। কুহু দেখতে দেখতে উপরে উঠে আসলো। এসব ভাবতে ভাবতে যখন ও একটা রুমের সামনে দিয়ে আসছিল ঠিক তখনই রুমের দরজা ভেতর থেকে ঠকঠক আওয়াজ হলো। কুহেলী চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। ও এবার দরজায় গিয়ে কান পাতলো, ভেবেছিল ভেতরে কেউ আছে কিন্তু এখন আর আওয়াজ দিচ্ছে না। কুহেলী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসতে গেলো ঠিক তখনই দরজায় দুমদুম করে কেউ আঘাত করতে শুরু করলো। মনে হলো কেউ দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কুহেলী ভয় পেয়ে দৌড়ে আসতে গিয়ে কারো সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে গেলো। পরে বুঝলো জুবায়েরের সঙ্গে ওর ধাক্কা লেগেছে। ছেলেটা ছিটকে পড়েছে ওর থেকে কিছুটা দূরে। কুহেলী ভয়ে ভয়ে হাতে ভর করে উঠে বসতেই আওয়াজ আসলো,

> আরে দেখে চলবে না এখুনি আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে ছাড়তে। বর দেখে পছন্দ না মানলাম, তাইবলে এভাবে কষ্ট দিবা কুহু?

> ঢং করবেন না, মনে হচ্ছে শুধু আপনার একার লেগেছে আমার লাগেনি? আপনার হাতপা তো শক্ত পাথর কিছুই হবে না। ভাঙচুর হলে আমারই হবে।

কুহুর পায়ে চোট লেগেছিলো সেখানে আবারও ব‍্যাথা লেগেছে। ব‍্যাথার জন্য ওর মুখ দিয়ে এমনি কথা বের হচ্ছে। রাগও হচ্ছে। ওকে এভাবে ঝগড়া করতে দেখে জুবায়ের উঠতে উঠতে বলল,

> যাইহোক বউয়ের মুখে বুলি ফুটেছে এটাই আমার জন্য অনেক। বউ মানেই ঝগড়া করবে, থালা বাসন ছোড়াছুড়ি করবে। বরকে নিজের করে রাখতে রাগারাগি করবে, তানা হলে বউ কিসের?

> আপনার বাজেকথা বন্ধ করুন। এবার বলুনতো আপনার বাড়িতে ভূত আছে এটা কি আপনি আগেই জানতেন?

> হুম জানতাম যার বউ ভূত সে জানবে না তো কে জানবে?

কুহেলী সিরিয়াস লুক নিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো,

> আরে ভাই আমি মজা করছি না সিঁড়ির পাশের রুমটা থেকে ভয়ানক আওয়াজ আসছিল আমি ভয় পাইছি। চলুন গিয়ে দেখে আসি।

> কি বলো এসব? বউয়ের মাথায় দেখি ব‍্যামো আছে।

কুহেলী আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত উঠে জুবায়েরের হাত ধরে টানতে শুরু করলো। লোকটা কথা বলতে শুরু করলে থামার নাম নিতে চাইনা। মনটা বেশ ভালো তবে কথায় বলে বেশি ভালোও ভালো না। ভালোর মধ্যে কালো মিশে থাকে। এসব ভাবতে ভাবতে ওরা বন্ধ রুমের সামনে এসে থামলো। জুবায়েরের মুখটা কেমন থমথমে হয়ে আছে। বিষয়টা ও সিরিয়াস ভাবে দেখছে। কুহু ওকে ইশারা করলো রুমের দরজার দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে। জুবায়ের রুমের দরজায় ধাক্কা দিলো। ধাক্কা দিতেই রুমের হাতলের মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট চাবি মেঝেতে পড়ে ঝনঝন করে বেজে উঠলো। দুজনের দৃষ্টি সেই চাবির দিকে। জুবায়ের চাবিটা উঠিয়ে দরজার লক খুঁলে দরজায় ধাক্কা দিলো আর অমনি দরজাটা খুঁলে গেলো। ভেতরটা অন্ধকার দেখে ফোনের টর্চ অন করে লাইট জ্বালিয়ে নিলো। ধুলাবালিতে পূর্ণ তবে গোছানো রুমটা হয়তো কারো বেডরুম ছিল আগে। জুবায়ের এই বাড়িতে বড় হয়েছে কিন্তু কখনও এই রুমটা নিয়ে ওর কোনো কৌতূহল তৈরী হয়নি। ভেবেছিল এটা হয়তো স্টোর রুম আবর্জনা দিয়ে ভর্তি করা। কিন্তু এখান বুঝতে পারলো আসলেই না। রুমের আসবাবপত্রগুলো বেশ পুরাতন আর নকশা করা। এই বাড়ির মানুষগুলো সবাই একটু বেশিই সৌখিন কিন্তু এতোটা না যতটা এই রুমের জিনিসপত্রগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে। রুমের মধ্যে বাথরুম আছে তবে ওটা বন্ধ করা খুলছে না। জুবায়ের আলমারি খুলতে গিয়েও পারলো না। কুহেলী ওসব ভাবছে না ওর মাথায় অন‍্য কিছু ঘুরছে আর সেটা হচ্ছে ওই আওয়াজটা। যদি রুমের মধ্যে কেউ না থাকে তাহলে আওয়াজটা কে করলো? ওকে এভাবে ভাবতে দেখে জুবায়ের ওর চোখের পাপড়ি ধরে টেনে দিলো আর ও চমকে উঠে পিছিয়ে গেলো। ও হাচি এসে গেছে চোখের পাপড়িতে টান পড়ার জন্য। ছেলেটা হঠাৎ এই সিরিয়াস মোমেন্টে এমন করবে এ ভাবতে পারেনি। কি ভয়ানক পাজি। ও হাচি দিয়ে ভ্রু কুচকে তাকালো। জুবায়েরের মিটি মিটি হেসে বলল,

> চমকে উঠলে তোমাকে ভীষন সুন্দর লাগে। রুমে চলো তোমাকে দেখবো আমি।

> মামা বাড়ির আবদার নাকি? ভূত খুঁজে বের করতে না পারলে রুমে আজ আপনার জায়গা নেই বলে রাখলাম।

কুহেলী রেগেমেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ও চলে যেতেই জুবায়ের আলমারিটা খুঁলে ফেলল। কুহূ থাকলে ঝামেলা হতো কি দেখতে কি দেখতো পরে আবার ভয় পেতো এমনিই কি সব বলছে।ওকে সরিয়ে দেবার জন্যই ও এরকম করলো। আলমারির মধ্যে ভর্তি করা ছেলেদের পোশাকে। ও একে একে সবগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো।কোনো যুবকের পোশাক এগুলো ও আর ড্রয়ারে একটা সোনালী ফ্রেমে বন্দি পেন্টিং রাখা। ও ভালো করে দেখতে চাইলো কিন্তু ততক্ষণে বাড়ির অনেকেই চলে এসেছে। সকলের মুখে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে জুবায়েরের দাদুর। উনি তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে পেন্টিংটা নিয়ে আলমারিটা লক করে সবাইকে বের করে রুমে আবারও দরজা লাগিয়ে দিলেন। উনি এবার গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

> অযাচিতভাবে কারো রুমে প্রবেশের অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে? পারমিসান নিয়েছো?

> সরি দিদু আসলে এই রুমটা বন্ধ ছিল তাই ভাবছিলাম ভেতরে কি আছে একটু দেখি। রুমটা কার ছিল দাদু?

> কারো না। সবাই রুমে যাও।

উনি লাঠি ভর দিয়ে চলে গেলেন সঙ্গে বাকিরা সবাই। কিছু একটা নিয়ে সব বেশ চিন্তিত আছে। জুবায়ের কিছুই বুঝলো না তাই নিজের রুমের দিকে এগিয়ে চলল। কুহু রুমে এসে বসে আছে। চেঞ্জ করতে হবে, শাড়ি পড়ে ঘুমানোর অভ‍্যাস নেই। কিন্তু এই একটা শাড়ি ছাড়া এখানে কিছুই নেই আগামীকাল ভাইয়াকে বললে পাঠিয়ে দিবে রাতটা কোনরকম পার করলেই হবে। চোখের ঘুমগুলো মনে হচ্ছে হাওয়াই উবে গেছে কিছুতেই ঘুম আসছে না। এসব ভাবতে ভাবতেই জুবায়েরের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে কুহুর পাশে গিয়ে বসলো। কুহু ওর মুখের দিকে থাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে লোকটা এরকম চুপচাপ কেনো? ওকে এভাবে আড়চোখে তাঁকাতে দেখে জুবায়েরের ঠোঁটে হাসি ফুটলো,

< এভাবে চোরের মতো চুরি করে কেনো দেখছো? সোজাসুজি দেখো, বর হই পার নই। > আপনি কি কখনও সিরিয়াস হতে পারেন না? আমি চিন্তিত আছি আর আপনি শুধু মজা করেন।

> এতো টেনশন করে কি হবে শুনি? জীবন সুখের হবে যদি তুমি এটাকে উপভোগ করতে পারো বুঝলে? আর আমাদের বাড়িতে কোনো ভূতটুত নেই সো এসব আজেবাজে চিন্তা না করে ঘুমিয়ে যাও।

> আপনিও কি আমার পাশে ঘুমাবেন?

> না ছাদে ঘুমাবো। চুপচাপ থাকো আমার মুড অফ।

> আপনার আবার মুডও অফ হয়?

> ঘুমের মধ্যে ডাকলে আমার প্রচন্ড রাগ হয়। সেদিন তোমাকে কিসব আজেবাজে কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম মনে আছে? আমি এমনিই, কখনও সহজ আবার কখনও রাগী। তুমি আমার বউ তাই আমার সব রূপের সঙ্গেই পরিচিতি হবে।

> হু ফুলোন দেবী, আমি না আপনি বুঝবার পারছি। ঘুম পাচ্ছে ঘুমালাম।

> আচ্ছা।

জুবায়ের পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। কুহেলী ওর দিকে ঘুরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। রুমের লাইটা অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। দরজা বন্ধ কিন্তু জানালা খোঁলা আছে। বর্ষাকালের জন্য যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছে। যখন বৃষ্টি থামে তখন গরমের জন্য কেমন অস্থির লাগে। প্রাকৃতিক বাতাসের জন্য জানালা খোঁলা রুমের ফ‍্যান বন্ধ রাখা। কুহু প্রায় ঘুমিয়ে গিয়েছিল ঠিক তখন ওর মনে হলো জানালা ধরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ও উঠে বসলো বাইরে চাঁদের আলো কিন্তু জানালায় আলো নেই। জুবায়েরের দীর্ঘ ঘন নিশ্বাসে জানান দিচ্ছে সে ঘুমের অতল গহীনে হারিয়ে গেছে তাকে জাগ্রত করা বৃথা। কুহুর চোখ জানালাই আটকে আছে। লোকটা ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভয়ে ওর শরীরে কাটা দিচ্ছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here