“দেখ মা, এভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত নিস না।আগে সবটা একটু ভালো করে চিন্তা কর তারপর না হয়”
মায়ের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই আরোহি বলে ওঠে,
“আমার যা ভাবার আমি ভেবে নিয়েছি মা।এটা নিয়ে আমার আর ভাবার দরকার নেই। প্রয়োজনে আমি আজকেই ইহান ভাই কে বিয়ে করব।কিন্তু কোনো ভাবে আায়ান কে আমার থেকে দূরে যেতে দেব না।ওকে আমি জন্ম দেয়নি কিন্তু আয়ান আমারই সন্তান। আর ওকে সারাজীবনের জন্য কাছে রাখতে হলে যদি ইহান ভাই এর দ্বিতীয় বউ হতে হয় আমার কোনো আপত্তি নেই। ”
কথা গুলো বলেই আয়ানকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল আরোহি। আর পিছন ফিরে তাকালো না।তিন মাস বয়স আয়ানের।ওর জন্মের ২ ঘন্টা পর থেকেই ও আরোহির কাছে আছে ।আর এই তিন মাসে একবার ও আরোহি আায়ানকে নিজের থেকে দূরে করেনি।
আরোহির যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে মিসেস আতশি।নিজের মেয়ের সিদ্ধান্ত মন থেকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু যে অন্যায় তারা তার মেয়ের সাথে করেছে তাতে মেয়েকে সরাসরি না বলার ও উপায় নেই।
দরজার কাছে দাড়িয়ে মেয়ের সব কথা শুনলেন মি. আজমল। আজ হয়তো তাদের করা ভুল এর মাসুল এভাবেই দিতে হচ্ছে তাদের।
হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনলেন মিসেস আতশি। উঠে গিয়ে দরজা খুললেন তিনি।দরজার ওপাশে শুকনো মুখে দাড়িয়ে আছে তার বড় বোন আরশি।যে ঝড় আতশির মধ্যে চলছে সেই ঝড় যে তার বড় বোনের মধ্যেও চলছে তা খুব ভালো করে জানে আতশি।
“ভেতরে এসো আপা।”
কথাগুলো বলেই ঘরের ভিতরে চলে গেল আতশি।
নিজের ছোট বোনের বাড়িতে ঢুকতে কেমন জড়তা কাজ করছে আরশির। অথচ ৪ দিন আগেও এই বাড়িতে সময়ে অসময়ে এসেছেন তিনি বিনা দ্বিধায়।
আরশি বেগমকে দেখে আজমল সাহেব ও ড্রয়িং রুমে এসে বসলেন। সাথে আতশি ও।চুপচাপ বসে আছে আরশি। অনেক কথা সাজিয়েছেন কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছেন না তিনি।তখনই আতশি বলে উঠল,
“আপা আরোহি কোনো মতে আয়ানকে আলাদা করতে চাচ্ছে না।ও বলেছে প্রয়োজনে ও ইহানকে বিয়ে করবে কিন্তু কিছুতেই আয়ান কে দূরে যেতে দেবে না।”
বোনের মুখে এমন কথা শুনে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল আরশির।তিনি ও তো এমনটায় ভেবেছিলেন কিন্তু ইহান এক বাচ্চার বাবা আর এক বাচ্চার বাবার জন্য একটি কুমারী মেয়ে কে চায়তে যেনো কোথাও একটা বাধছিল তার।সে যতই নিজের বোনের মেয়ে হোক না কেনো।
জ্বলজ্বল চোখে বললেন আরশি,
“তুই আমার আপন বোন আতশি। আমি তোর সন্তানকে নিজের সন্তানের মতোই ভেবেছি এতদিন।যদি এমনটা সত্যি হয় যে আরোহি আর ইহানের বিয়ে হলো, তাহলে আরোহিকে কোনো কষ্ট পেতে দেব না আমি।”
তখন আতশি বেগম বলে উঠললেন,
“আপা, আমি তোমাকে ও চিনি আর ইহান কে ও।তোমরা যে আরোহিকে কখোনো কোনো কষ্ট পেতে দিবে না সেটা আমি জানি এমনকি আরোহির বাবা ও।তাই আমার মনে হয় আমাদের দেরি না করে আরোহি আর ইহানের বিয়েটা তারাতাড়ি দিয়ে দেওয়ায় ভালো।”
মনের মধ্যে জড়তা থাকলেও সেই জড়তা উপেক্ষা করে কথাগুলো বললেন আতশি।আতশি জানে ইহান খুব ভালো ছেলে। ছোট বেলা থেকে চেনে সে। তার মেয়ের যে ও বাড়িতে কোনো অসুবিধা হবে না সেটা ও জানেন তিনি।তবে আফসোস একটায় তার মেয়ে ওই বাড়িতে ইহানের দ্বিতীয় বউ হয়ে যাবে সাথে আায়ানের মা।
“আজ সন্ধ্যায় তোর আর আরোহির বিয়ে ইহান।এজন্যই তোকে এই বিকেলে অফিস থেকে আসতে বলা।”
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বিষ্ময়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ইহান কি বলছে তার মা। তার আর আরোহির বিয়ে!
“এসব কি বলছ মা?আরোহির সাথে কেনো আমার বিয়ে হতে যাবে?ও আায়ানের দেখা শোনা করছে মানছি তাই বলে ওকে আমায় বিয়ে কেনো করতে হবে মা?”
বলে ওঠে ইহান।
“দেখ বাবা আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোদের ভালোর জন্যই নিয়েছি।আর তার থেকে বড় কথা আরোহি ও রাজি এই বিয়েতে।”
ইহানের মায়ের এ কথায় আরো বেশি অবাক হয়ে গেল ইহান। আরোহি রাজি! হঠাৎই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল ইহানের ঠোঁটে। আজ সব কিছু শেষ হওয়ার পর আরোহি তার জীবনে আসবে। তার এই রংহীন জীবনে।কিন্তু ইহান নিজের মনকে যখন হাজার রঙে সাজিয়েছিল আরোহির জন্য তখন আরোহি আসেনি। আরোহি তখন নিজেকে প্রস্তুত করেছিল অন্যের রঙে নিজেকে সাজাতে।আর এই ভুল ভাবনাটায় ইহানের জীবনটা ওলট পালট করে দিল।
ছেলের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আতশি বেগম আবার ও বললেন,
“তুই না করিস না বাবা। এতে তোদের সবার ভালো হবে। মেয়েটা কে ও আর অপমান হতে হবে না।আয়ানকে ও আর দূরে সরাতে হবে না।”
মেনে নিল ইহান মায়ের কথা।ইহান ও দেখতে চায় জীবন তাকে কোন মোড়ে এনে দাঁড় করায়।
সন্ধ্যার সময় কাজি নিয়ে হাজির হন ইহানের বাবা আরোহিদের বাড়িতে। ইহান তার মা ও আরোহির বাবা মা ও সেখানে আগে থেকে উপস্থিত। পরিবেশ টা যথেষ্ট স্বাভাবিক করে রেখেছেন সবাই।
কিছুক্ষণ পর ৩ মাস বয়সি আায়ানকে কোলে নিয়ে হাজির হলো আরোহি।পরনে সাধারণ থ্রী পিচ যা সচারাচর বাড়িতে পরে আরোহি। মুখে কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই।
আরোহিকে এমন রূপে দেখে অবাক হলো সবাই। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না।মেয়েটাকে বিয়ের সাজে সাজতে বলবে কোন মুখে। একবার এই সাজই যে তার জীবনে অমাবস্যা নামিয়ে এনেছিল।
কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। ইহান দেখল আবার সেই একই শব্দচয়ন শুধু পাত্রীর নাম আর পাত্রীর বাবা মা এর নাম আলাদা।তবে পাথক্য একটায় সেদিন কারো উপর অভিমান করে কবুল বলেছিল আর আজ মনে এক অজানা সুখ নিয়ে।
আরোহিকে যখন কবুল বলতে বলা হলো তখন বিনা দ্বিধায় কবুল বলে দিল সে।কোনো জড়তা ছিল না কন্ঠে কিন্তু মনের মধ্যে যে কি ঝড় বয়ে গেল তা জানতে পারল না কেউ।
বিয়ে পড়ানো শেষ হলো একটু আগে। সবাই মিষ্টি মুখ ও করল।আরোহির ইচ্ছা না থাকা সত্তেও একটু মিষ্টি খেল। কারন সে এখান কোনো ঝামেলা চায় না।
রাতে খাওয়ার পর্ব মিটিয়ে আরোহিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বললেন আরশি বেগম। আতশি বেগম আর আজমল সাহেব ও না করলেন না।তার মেয়ে যে একটা স্বাভাবিক জীবন পাচ্ছে তাতেই তারা খুশি। সবাই চায় আরোহি ও ইহান আয়ানকে নিয়ে একটা স্বাভাবিক সংসার করুক।
আরশি বেগম ইহানের ঘরটি সাজাতে চেয়েছিলেন কিন্তু আরোহি সেটা হতে দেয় নি।আয়ানের অজুহাত দিয়ে বিষয় টা এড়িয়ে গেছে সে। আর আরশি বেগম ও জোর করেন নি।কারন সবটা স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে সেটা তিনি জানেন।
ইহানের ঘরে পা রাখার সাথে সাথে আরোহির সারা শরীর শিরশির করে উঠল। এই সেই ঘর যে ঘর নিয়ে হাজারো সপ্ন বুনেছিল, সে ঘরে আজ তারই বউ হয়ে এসেছে। না একটু ভুল হলো তার সন্তানের মা হয়ে এসেছে। তার বউ নয়।বাড়ির সবাই ভবেছে আরোহি ইহানের বউ আর আয়ানের মা হওয়ার জন্য বিয়ে টা করেছে। কিন্তু আরোহি জানে সত্যি টা আলাদা।আরোহি শুরু মাত্র আয়ানের মা। আর কিছুই নয়।
আয়ান ঘুমিয়ে গেছে একটু আগে। আরোহির ও ক্লান্ত লাগছে, একটু ঘুমানোর দরকার।ইহান এখোনো ঘরে আসেনি। আয়ানকে ঠিক ঠাক ভাবে শুয়িয়ে দিয়ে আরোহি একটা বালিশ নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল।এই ৩ মাস আয়ানকে নিজের সাথে নিয়ে ঘুমিয়েছে আরোহি।আজ ও সেটা করতে পারত কিন্তু ইহানের সাথে এক বিছানায় আরোহি ঘুমাবে না।একেই হয়তো বলে অভিমান।
সোফায় শোয়ায় প্রথমে একটু অসস্তি হলেও আস্তে আস্তে সেটা ঠিক হয়ে যাচ্ছে।হঠাৎই আরোহির মনে পড়ে গেল ৪ দিন আগের ঘটনা। যার জন্য আয়ান দূরে সরে যাচ্ছিল আরোহির থেকে। আরোহিকে বাধ্য হয়ে ইহানকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
আয়ানের জন্মের ২ ঘন্টার পরই আয়ানের মা মানে মায়া মারা যায়।তবে মৃত্যু এর আগে মায়া আরোহির হাতে আয়ানকে তুলে দিয়ে বলে,
“না জেনে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি আমি।ক্ষমা চাওয়ার মুখ ও নেয় তবে আমি জানি আমার সন্তানই আমার করা অন্যায় সুধরাতে পারবে।তাই আজ ওকে তোমার হাতে তুলে দিলাম আরোহি।ওকে কখনো নিজের কাছ ছাড়া করো না।আমায় কথা দাও তুমি ওকে সব সময় আগলে রাখবে।”
সেদিন ডাক্তার যখন জানায় মায়ার অবস্থা ভালো না তখন মায়া আরোহিকে ডেকে এই কথাগুলো বলেই আয়ানকে আরোহির হাতে তুলে দেয়।
মৃত্যু পদযাত্রী মায়ার কথা সেদিন ফেলতে পারেনি আরোহি। আর আজ ও মায়াকে দেওয়া কথা রাখতে ইহান কে বিয়ে করেছে আরোহি।তবে এসব কিছুর মধ্যে আর একটা সত্যি আছে আরোহি নিজে ও আয়ানকে খুব ভালোবাসে, নিজের সন্তান ভাবে।আর সেটা মন থেকেই।
এতদিন আয়ানকে আরোহিই সামলেছে। আরশি বেগম নিজের নাতিকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু আরোহি দেয়নি। দুটো কারনে এক মায়া আর দুই আরশি বেগম অসুস্থ তাই। ওনার হাই প্রেসার ও ডায়াবেটিস এর সমস্যা আছে। যার জন্য আয়ানকে সামলাতে ওনার কষ্ট হতো।আতশি আর আরশি বেগমদের বাড়ির দূরত্ব বেশি না হওয়ায় আরশি বেগম আর অমত করেনি।এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যেতে ১০ মিনিটের মতো লাগে।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল।কিন্তু ইহান প্রতিদিন রাতে আয়ানকে দেখতে যেত।আর সেটাই এলাকাতে বাজে ইঙ্গিতে ছরিয়েছে কিছু মানুষ। আরোহি আর ইহানকে নিয়ে অনেকেই খারাপ মন্তব্য করছিল। এমনকি আরোহির পরিবার কে নানা ভাবে হেনোস্তার স্বীকার হতে হয়।এসব কিছু খুব একটা গায়ে মাখে না আরোহি কিন্তু ৪ দিন আগে ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে আসছিল আরোহি আর তার খালামনি আরশি বেগম।আর সেদিন পথে কিছু মানুষ আরশির সামনেই আরোহিকে অনেক বাজে ইঙ্গিতে কথা বলে।আরোহি এসব গায়ে মাখে না কিন্তু সেদিন এলাকার কিছু খারাপ ছেলে আরোহিকে পতিতাদের সাথে তুলনা করে এমনকি একজন আরশির সামনেই আরোহির কাছে রেট জিজ্ঞেস করে। এই অপমান সেদিন আরোহি মানতে পারেনি আর আরশি বেগম তো কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন আয়ানকে নিজেদের কাছে এনে রাখবে কিন্তু আরোহি তাতে রাজি হয় না।
তারপর সকলে মিলে আরোহি আর ইহানের বিয়ে ঠিক করে ওদের বিয়ে দিয়ে ৷তবে আরোহি ও আগে থেকে বলে সে ইহানকে বিয়ে করতে রাজি কিন্তু আয়ান কে নিজের থেকে আলাদা করতে নয়।এসব কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় আরোহি।
অনেক সকালে ঘুম ভাঙে আরোহির কিন্তু নিজের দিকে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় আরোহির।এটা কি করে হলো
#তোমাতেই_বিমোহিত
#পর্বঃ২
#লেখিকা আরোহি জান্নাত। (ছদ্মনাম)
অনেক সকালে ঘুম ভাঙে আরোহির কিন্তু নিজের দিকে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় আরোহির।
নিজেকে বিছানায় দেখে বেশ অনেকটায় অবাক হয় আরোহি। আরোহির স্পষ্ট মনে আছে সে কালকে সোফাতে ঘুমিয়েছিল তাহলে এখানে এলো কখন।তখনই সোফার দিকে চোখ যায় আরোহির।ইহান সোফাতে ঘুমাচ্ছে। তারমানে ইহান আরোহিকে বিছানায় নিয়ে এসেছে।আর নিজে সোফায় ঘুমিয়েছে। ইহান এর দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে আরোহি।ঠিক আগের মতোই আছে। এক বছর আগে যেমনটা ছিল ঠিক তেমনটা শুধু মনুষটার ভেতরটা বদলেছে।এই এক বছর আগে এই মনুষটার মনের কোথাও একটা আরোহি ছিল কিন্তু এখন সেই জায়গায় আয়ানের মায়ের বসবাস। না আর ভাবতে চায় না আরোহি। ভাবতে চায় না সেই অতীত।
নিজেকে কিছু টা সামলে নিয়ে আয়ানের দিকে তাকালো আরোহি। ছেলেটা বড্ড শান্ত। এই ৩ মাসে আরোহিকে একটু ও সমস্যায় ফেলে নি।প্রথম এক মাস আরোহির একটু অসুবিধা হয়েছিল তবে এখন একটু ও অসুবিধা হয় না। আর এর বড় কারন হলো আয়ান মাঝ রাতে কান্না করে না। একটু পরেই আয়ান উঠে যাবে তাই তারাতাড়ি ফ্রেশ হতে গেল আরোহি। ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখে আয়ান উঠে গেছে। মুচকি হাসলো আরোহি আয়ানকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল সে।বাড়িতে থাকতে ও আরোহি ঘুম থেকে ওঠার পরে আয়ানকে ঘরের বাইরে নিয়ে যেত, আজ ও তার ব্যাতিক্রম করলো না।বাইরে যাওয়ার আগে আরো একবার ইহানের দিকে তাকালো আরোহি কিন্তু অভিমানগুলো যে বড্ড বেশি তাই তারাতাড়িই চোখ ফিরিয়ে নিল আরোহি।
রান্নাঘরে লতা বেগম সকালের নাস্তা বানাচ্ছেন। আজ প্রায় ৩ বছর ধরে লতা বেগম এই বাড়িতে আছেন।আরশি বেগম অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই তিনি এই বাড়িতে কাজ করেন। লতা বেগম কে দেখে সৌজন্য হাসলো আরোহি এই মানুষটিকে বেশ পছন্দ করে আরোহি। আরোহিকে দেখে লতা বেগম ও হাসলো বলে উঠল,
“আরে আরোহি মামুনি তুমি উঠে পড়েছ।আায়ান বাবা ও তো উঠে পড়েছে দেখছি।”
আরোহিও হাসি মুখে বলল,
“হ্যাঁ লতা ফুফু উঠে গেছি আমরা। আচ্ছা আমাকে এক কাপ চা আর একটু গরম পানি করে দাও তো আয়ানের খাওয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে।”
মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো লতা বেগম। আরোহি ও আয়ানকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসল। তখনই আরশি বেগম ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হন। আরোহি আর আয়ানকে দেখে মুখে আপনাআপনি হাসি ফুটে ওঠে তার। হাসিমুখেই আরোহির পাশে এসে বসেন তিনি।আয়ানকে আরোহির কোল থেকে নিয়ে আদর করতে থাকেন। এই প্রথম আয়ান নিজের বাড়িতে রাত কাটিয়েছে।দাদি হিসেবে তৃপ্তির হাসি যেন সরছে না আরশি বেগমের মুখ থেকে। আয়ানকে মন ভরে আদরের পর আরোহিকে জিজ্ঞেস করেন আতশি,
“মা রাতে তোর কোনো অসুবিধা হয়নি তো? নতুন জায়গায় ঘুম ভালো হয়েছে তো?”
খালামনির কথায় হাসিমুখে জনায় আরোহি তার কোনো অসুবিধা হয় নি।
আরশি বেগম ইহান এর কথা জিজ্ঞেস করতে চায়লেন তবে তা আগেই ইহান ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসতে বসতে বলল,
“ফুফু আমার চা টা দাও।”
সকলের উপস্থিতি টের পেয়ে একেবারে সকলের জন্য চা বানিয়ে আনলো লতা বেগম।সকলকে চা এগিয়ে দিয়ে আরশির কাছ থেকে আয়ানকে কোলে তুলে নিলেন তিনি। বললেন,
“আপামনি আপনারা চা খেয়ে নাস্তা করে নিন।ততক্ষণ আয়ান বাবা আমার কাছে থাকুক।”
লতা বেগমের কথা শুনে কেউ না করল না।ইহান চা খাচ্ছে আর খবরের কাগজ পড়ছে তবে তার মনোযোগ আরোহির দিকে কাল সারারাত এই মেয়েটার সাথে একই ঘরে ছিল সে ভাবতেই মনের মধ্যে কেমনটা অনুভূতি কাজ করছে।
আজ ১ বছর ১ মাস ১৩ দিন মেয়েটা তার সাথে কথা বলে না। এমনি ঠিক করে ইহানের দিকে দেখে ও না।আজ এই মেয়েটা তার স্ত্রী কিন্তু তাও কত দূরত্ব তাদের মধ্যে। মেয়েটা তাকে এখোনো ক্ষমা করতে পারেনি সে জন্যই তো কাল রাতে ওভাবে সোফায় ঘুমিয়েছিল। হঠাৎই কালকে রাতের কথা মনে পড়ে গেল ইহানের। গতকাল রাতে ইহান কিছুতেই ঘরের ভিতরে যেতে পারছিল না। কোথাও একটা বাধছিল।কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পর নিজের সাথে যুদ্ধ করে অনেক রাতে ঘরে ঢোকে ইহান। ঘরে ঢুকে দেখে আয়ান বিছানায় ঘুমাচ্ছে আর আরোহি সোফায়।আরোহিকে সোফাতে দেখে ভ্রু কুচকে যায় ইহানের।তবে আরোহি যে তার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে চায় না সেটা ও বুঝে নেয় ইহান। তাই আরেহিকে সোফা থেকে উঠিয়ে খাটে শুয়িয়ে দেয় ইহান আর নিজে সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে।
ব্রেকফাস্ট সেরে ইহান রেডি হচ্ছে অফিসে যাবে বলে।তখনই আরশি বেগম ঘরে ঢোকেন ইহানকে অফিসের উদ্দেশ্য তৈরি হতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকায় ইহানের দিকে।তারপর এগিয়ে এসে বলে,
“তুই আজ অফিসে যাবি ইহান?”
“হুম।” তৈরি হতে হতে উত্তর দেয় ইহান।
“আজ অফিসে না গেলে হয় না?” ( আতশি)
ইহান জানে তার মা তাকে কেনো যেতে দিচ্ছে না। তিনি চাচ্ছেন আজ যেনো ইহান বাড়িতে থেকে আরোহিকে সময় দেয়।কিন্তু তিনি তো জানেন না যে ভাঙ্গন একবার ইহান আরোহির মধ্যে ধরেছে তা সহজে মিটবে না।
“আসলে মা অফিসে তো আগে থেকে জানানো হয় নি। আর এভাবে হুট করে ছুটি নেওয়া ও সম্ভব না। তাই আমাকে অফিসে যেতেই হবে।”
মায়ের কথা কাটাতে এই কথাগুলো বলে উঠল ইহান।
আরশি বেগম ও দেখলেন ইহানের কথায় যুক্তি আছে তাই আর ইহানকে আটকালেন না।ইহানকে এতদিন ভাই হিসাবে দেখেছে আরোহি আর ইহান ও আরোহিকে বোন হিসাবে দেখেছে এটায় ধারনা আরশি বেগমের তাই এই সম্পর্ক টা যে সহজে স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতো হবে না এটা জানেন আরশি।তবে তিনি ও তাড়াতাড়ি করতে চান না।সব কিছু ধীরে ধীরে ঠিক হবে এটায় তার বিশ্বাস।
ড্রয়িং রুমে আরোহি আর আয়ান কেউই নেয়।ইহান এর খুব ইচ্ছা করছে আয়ান আর আরোহিকে একবার দেখে তারপর অফিস যেতে কিন্তু সে আরোহিকে ডাকতে পারছে না।যে মেয়েটির সাথে এতদিন কথা বলে না তাকে এভাবে হুট করে ডাকা যায় না।তখনই ইহান বলল,
“মা আয়ান কোথায়? একটু ডাকো তো?”
ইহানের ধারনা আয়ানকে ডাকলে আরোহি ও আসবে ফলে দুজনকেই দেখা হবে ইহানের।তবে ইহানের সে ধারণা ভুল প্রমান করে আরশি বেগম আয়ানকে নিয়ে বাইরে এলেন।আশানকে দেখে ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠল ইহানের। কিন্তু আরোহি বাইরে না আাসায় বেশ খারাপ ও লাগল।আয়ানকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করে তাকে মায়ের হাতে তুলে দিল ইহান।তারপর বেরিয়ে গেল সে।
এতক্ষণ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ইহানকে দেখছিল আরোহি।ইহান যে আায়ানকে আদর করার সময় বারবার এই ঘরের দিকে তাকাচ্ছিল সেটাও বুঝতে পারছিল সে, তবে ইচ্ছা করেই বাইরে আসিনি আরোহি।
বছর খানেক আগে ও এই বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল আরোহির।আর এই বাড়িতে সব থেকে কাছের ছিল ইহান। আরোহির ছোট খাটো সব বিষয়ে ইহান থাকত।তেমনি ইহানের ও প্রতিটা বিষয় ও আরোহির মতামত নিত। কিন্তু এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ইহান আরোহির জীবনটাকে পাল্টে দিয়েছিল।
বছর খানেক আগে ও বাড়িটা যেমন ছিল আজ ও তেমনই আছে। তেমন কোনো কিছুর বদল ঘটেনি। তাই আরোহির ও অসুবিধা হচ্ছে না।
সারাটা দিন ভালোই কাটল আরোহির। পরিচিত বাড়ি আর পরিচিত লোকজন হওয়ায় কোনো অসুবিধা হলো না।
এই বাড়িতে পুরো একদিন কাটিয়ে দিল আরোহি কিন্তু এখোনো ইহানের সাথে কথা বলেনি সে।শুধু তাই নয় ইহান আয়ানকে দেখতে গেলে আরোহি ঘরের মধ্যে থাকত কথা বলা তো দূর সামনে অবদি আসত না। তাও মাঝে মধ্যে ছোটো খাটো কারনে ইহানের সামনে আসলে ও কথা বলেনি সে।
সন্ধার একটু পরেই বাড়ি ফিরে এলো ইহান। অন্য দিনের তুলনায় অনেক তারাতাড়ি এসেছে আজ।আরশি বেগম ও বেশ খুশি হলেন ইহান তারাতাড়ি ফেরায়।
আরোহি ইহান এর ঘরে বসে আয়ানকে ফিডার খাওয়াচ্ছিলো। ইহানকে ঘরে ঢুকতে দেখে তাকালো তার দিকে।ইহান এর চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।তবে কোনো কথা বলল না।এক মুহূর্তের জন্য ভাবল ইহানকে একটু পানি এনে দিলে সে সেটা খেয়ে তৃপ্তি পেত তবে নিজের ইচ্ছে টাকে সাথে সাথেই মাটি চাপা দিল সে। ভাবল সে এখানে আয়ানের মা হয়ে এসেছে। ইহানের বউ নয়।
তবে ভালোবাসা জিনিস টা যে বড্ড খারাপ। প্রমিক পুরুষের একটুখানি কষ্ট যে হাজার রাগ হাজার অভিমান সাথে সাথেই ভাঙতে সক্ষম।
ঘরে ঢুকেই আয়ান আর আরোহিকে দেখে যেনো নিমিষেই ক্লান্তি টা দূর হয়ে গেল ইহানের। ওদেরকে একটু দেখে নিয়ে ইহান ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে গেল।
আয়ানের খাওয়া শেষ হলে তাকে নিয়ে ঘরের বাইরে গেল আরোহি।আয়ানকে লতা বেগমের হাতে দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে শরবত বানাতে লাগল।আজ অনেক দিন পর সেই শরবতটি বানাচ্ছে আরোহি।শরবতটি একদম সাধারন লেবুর শরবত কিন্তু ইহান এর খুব প্রিয়। আরোহি এই বাড়িতে আসলেই ইহান এই শরবত বানাতে বলত আরোহিকে।এই শরবত নাকি সকল শরবত এর থেকে বেস্ট।পুরানো সেই কথাগুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল আরোহির।
শরবত বানানো শেষ। তবে, সেটা কি নিজে ইহানকে দেবে নাকি লতা বেগমের হাত দিয়ে পাঠাবে সেটায় ভাবছে আরোহি।অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো
চলবে,
)