তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ২৯
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
বেশ কিছুদিন কেটেছে। ভার্সিটির বন্ধ কাটিয়ে, দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু। নিয়মিত ক্লাস করছে সায়রা। অল্প কিছুদিনেই পুরোপুরি সংসারী হয়ে উঠেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারও বেশ দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছে। পুত্রবধূকে নিয়ে মুনতাহা আফনাফ সাহেবের গর্বের শেষ নেই। বাবা মায়ের সাথে সায়রার সম্পর্ক এখনো আগের মতই। মাহির আহমেদ মেয়ের এত বড় সিদ্ধান্তে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। ক্ষত ভড়তে এখনো বেশ সময় লাগবে! আরসাল সায়রার সম্পর্কটাও আপনি- তুই- তে আটকে।
ভার্সিটিতে সায়রা আরমিন মুখোমুখি হলেও, কথা হয় না। দুজন দুজনকে বেশ এড়িয়ে চলে। বাবার বাড়িতে যাওয়া হয়না সায়রার। বাবার রুষ্টতার মুখোমুখি হওয়ার বিন্দু মাত্র সাহস নেই তার। সম্পর্ক গুলো এত বেশি এলোমেলো হয়ে গেছে যে, তা পূর্বের রূপে ফিরতে এখনো অনেক সময় লাগবে। কিন্তু আজ পাখি বায়না ধরেছে, সায়রাকে যেতে হবেই হবে! আজ পাখির জন্মদিন। ছোট বোনের আবদার ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্যি কই সায়রার। তাছাড়া বাড়ির সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছে। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সায়রা আজ ঐ বাড়িতে যাবে। আর কারো জন্য না হোক, পাখির জন্য যাবে! বিকালবেলা। সূর্যের আলো নরম হয়ে এসেছে। পশ্চিমা আকাশে রক্তিম রঙের ছড়াছড়ি। চারিদিকে শেষ বেলার আলোয় আলোকিত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গোছাচ্ছে সায়রা। সেই ফাঁকেফাঁকে নিজেকেও সাবধানী দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছে। শাড়ির ফাঁকে কোথায়ও আবার পেট দেখা যাচ্ছে কিনা! আরসাল বাড়ি নেই। পাখির উপহার আনতে বেরিয়েছে। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল সায়রার। ফোনের দিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো। পাখি ফোন করেছে। রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে পাখির ব্যস্ত আওয়াজ ভেসে এলো,
–” সায়রুপু!! কই তুমি? আমার সব ফ্রেন্ডরা চলে এসেছে। তুমি এখনো আসোনি! তুমি কি আসবে না?”
–” ওহ পাখি শান্ত হয়ে শ্বাস নে তো আগে! আমি কি বলেছি, আসবো না? উনি বেড়িয়েছে বাড়ি ফিরুক! এক সাথে আসছি। ”
–” সত্যি আসছ তো?”
— ” একদম সত্যি!”
শান্ত হলো পাখি। ফোন রাখল সায়রা। নিজেকে বারংবার আয়নায় দেখছে সে। আজকের দিনটা ভীষণ বিশেষ সায়রার কাছে। পাঁচ বছর আগে এই দিনেই আরসালের সাথে তার বাগদান হয়েছে। আরসালের জীবনের সাথে তার জীবন জুড়েছিল। আর আজ পাঁচ বছর পর আজ এই দিনটাকেই নিজের ভালোবাসার স্বীকারোক্তির জন্য বেছে নিয়েছে। আর কতকাল নিজেকে আরসাল থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে? আর কতকাল নিজের অনুভূতি গুলোকে লুকাবে? সত্যি তো এটাই সায়রা আরসালকে ভালোবাসে। প্রচণ্ড ভালোবাসে! এক ঘরে, এক বিছানায় থেকে নিজের অনুভূতি গুলোকে লুকানো দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে সায়রার। মনে মনে অটুট প্রতিজ্ঞা এঁটেছে সে। আজ নিজের মনে সব কথা সকল অনুভূতি জানাবে আরসালকে। নিজেকে উজাড় করে ভালোবাসবে। নিজেদের মাঝে আর কোন বাঁধা, কোন দূরত্ব রাখবে না!
আজ আরসালের পছন্দের শাড়ি পড়েছে, বেশ সুন্দর করে সেজেছে। হাত ভর্তি শুভ্র কাচের চুড়ি। আরসালের পছন্দ মতই চুল খোলা রেখেছে। সায়রাকে এভাবে দেখে মুগ্ধ হবে কি আরসাল! ভেবেই লজ্জায় আয়না থেকে চোখ সরালো সায়রা। অপেক্ষা করতে লাগল আরসালের ফেরার।
রাত আটটা। সন্ধ্যা বাতি জ্বালানো হয়নি। চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে। বাড়ির সবাই চলে গেছে। শুধু সায়রাই আরসালের অপেক্ষায় বসে। বিয়ের পর এই প্রথমবার বাবার বাড়ি যাচ্ছে সায়রা। আরসালকে ছাড়া বড্ড বেমানান দেখায়। বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন, আরসাল সেই বাড়ির জামাই! তাছাড়া আরসাল কাছাকাছি থাকলে নিজেকে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী লাগে সায়রার। নিজের বড্ড আপনজন মনে হয় আরসালকে। এতদিন যেই মানুষটাকে বাগের মত ভয় পেত আজ সেই মানুষটা তার পরম আপনজন! এটাই বুঝি, বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কের শক্তি!
ঘড়ির কাটা নয়ের দিকে। আরসালকে ফোনের উপর ফোন করছে সায়রা। মোবাইল বাজছে তো বাজছেই। তুলছে না সে! প্রথমদিকে বিরক্ত হলেও, এখন ভীষণ ভয় করছে সায়রার। এর আগে এমন কোনদিন হয়নি। যে সায়রা ফোন করেছে আরসাল তুলেনি! মন বড্ড কু ডাকছে। কোন বিপদ ঘটল না তো আবার?
আরো বিশ মিনিট অপেক্ষা করল। আরসালের কোন খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল সায়রা। ছুটে চলল গেটের দিকে। দরজার সামনে যেতেই কারো সাথে সজোরে ধাক্কা লাগল সায়রার। মাথা তুলে দেখল- থমথমে মুখে তুর্জয় দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ অসম্ভব লাল। সেদিকে গুরুত্ব না দিকে চিন্তাভারী আওয়াজে প্রশ্ন করল সায়রা,
–” তুর্জয় ভাই! উনি কোথায় ? আপনি কি জানেন! সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। উনি এখনো ফিরছে না কেন? একটা গিফট আনতে এত সময় লাগে? আন্দাজ দেখেছেন আপনার ভাইয়ের! ফোনটাও তুলছে না।”
তুর্জয় থম মেরে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সায়রার দিকে। চোখজোড়া টলমল করছে। কন্ঠ বারংবার ভেঙে আসছে। বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো তুর্জয়। ভাঙ্গা আওয়াজে বলল,
–” আরসাল ফোন করেছিল। তোমাকে আমার সাথে যেতে বলেছে সায়রা! বাড়ির সবাই সেখানেই।”
চমকাল সায়রা। ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। মনে সন্দেহ জাগল। রাত দশটা বাজতে চলছে এই রাতে তাকে কোথায় ডাকছে আরসাল। আজ পাখির জন্মদিন সেখানে না গিয়ে এই রাতে বাহিরে যাবে? আর তাছাড়া আরসাল সায়রা কে ফোন না করে তুর্জয়কেই কেন বলল। আর বাড়ির বাকি সবাই বা কোথায় গেল?
বেশ সন্দেহ জাগলেও প্রশ্ন করল না সায়রা। চুপচাপ তুর্জয়ের গাড়িতে চড়ে বসল। মন বড্ড কু ডাকছে তার। হৃদপিন্ড ধপধপ করছে অচেনা এক ভয়ে। চোখ ঘুরিয়ে একবার তুর্জয়ের দিকে তাকাল সায়রা। বারবার চোখ মুছছে তুর্জয়। কাঁদছে কেন তুর্জয় ভাই! সবাই ঠিক আছে তো! ভাবল সায়রা।
মিনিট বিশেকের ব্যবধানে পৌঁছে গেল তারা। গাড়ি থামল এক ব্রিজের সামনে। সামনের দিকে লোকজনের বিশাল ভিড়। এর সামনে আগানো যাবেনা। ধীর আওয়াজে তুর্জয় বলল,
–“এসে গেছি সায়রা!”
–” এখানে?”
শব্দ করল না তুর্জয়। শুধু মাথা নাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। সায়রাও দরজা খুলে সামনের দিকে পা বাড়াল। এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন তুর্জয় ভাই? কয়েক কদম সামনে যেতেই মুনতাহা বেগমের চিৎকার কানে এলো সায়রার। কাঁদছে কেন বড় মা? আঁতকে গেল সায়রা। ভিড় ঠেলে ভিতরে ছুটে গেল। সামনে যেতেই দেখল- মাটিতে বসে চিৎকার করে কাঁদছে মুনতাহা বেগম। পাশেই বাড়ির সবাই। সবাই এভাবে কাঁদছে কেন? এখানে কি হয়েছে! ব্যস্ত দৃষ্টিতে দিশেহারা হয়ে আরসালকে খুঁজতে লাগল সায়রা। মিলল না। দেখা মিলল না তার। খানিক দূরেই আরসালের চূর্ণবিচূর্ণ গাড়ি। ব্রিজের রেলিং ভেঙ্গে অর্ধেক গাড়ি ভিতরে বাকি অর্ধেক গাড়ি বাহিরের দিকে। সামনের কাচ ভেঙে সব চুরমার। চারদিকে পুলিশ ঘিরো করে আছে, তবে কি আরসালের…… সায়রা জমে গেছে। পা আর চলছে না তার। সারা শরীর ভেঙে আসছে। কয়েক কদম সামনে যেয়ে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ল সায়রা। সায়রাকে দেখা মাত্র মুনতাহা বেগমের কান্নার বেগ বেড়ে গেল। সিন্থিয়া বেগম মেয়ের দিকে এগিয়ে এলো। জড়িয়ে ধরল। সায়রা তখনো শান্ত চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ মুখ ভীষণ রকম শান্ত। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সবাইকে এভাবে কাঁদতে দেখে বেশ ঠান্ডা আওয়াজে প্রশ্ন তুলল সায়রা,
–” সবাই এভাবে কাঁদছে কেন মা? কি হয়েছে। গাড়ি এভাবে ভাঙল কি করে? আরসাল ভাই উনি কই? কখন থেকে ফোন করছি ফোন তুলছে না কেন?”
মেয়ের প্রশ্নে মুখ চেপে কেঁদে উঠলেন সিন্থিয়া। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
–” তোর কপাল পুড়েছে, আরসাল নেই মা। ও নেই!”
মায়ের কথায় ছিটকে দূরে সরে গেল সায়রা। ধমকে চিৎকার করে বলল,
–” পাগল হয়েছ তুমি! এসব কি আবোলতাবোল বকছ। উনি নেই মানে। উনার সাথে আমার দুপুরের পরও কথা হয়েছে। উনি এখানেই আশেপাশে আছেন। দেখবে এখনি চলে আসবে। আরসাল ! আরসাল! কোথায় আপনি !”
বলেই গাড়ির দিকে ছুটে গেল সায়রা। এক পায়ে জুতা আছে অন্য পায়ে নেই। শাড়ি আঁচল এলোমেলো। গাড়ির ভাঙ্গা কাঁচ পায়ে বিঁধে রক্ত ঝরছে। সেই দিকে খেয়াল নেই সায়রার। সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে সে। কাছাকাছি যেতেই পুলিশ আটকায়। চিৎকার করে বলে সায়রা,
–” পথ ছাড়ুন! আমাকে যেতে দিন, আমার আরসাল ভিতরে!”
পথ ছাড়ল না পুলিশ। মাথা নুয়ে পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন,
–” মেডাম, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তুমৃত্যু চিরন্তন সত্য। সত্যিটা তো মেনে নিতেই হবে। আপনার হাসবেন্ডের বডি গাড়িতে মিলেনি। আনুমান করা যাচ্ছে পিছন থেকে গাড়ির প্রচণ্ড ঢাক্কায় সামনের কাঁচ ভেঙ্গে নিচে পানিতে পড়েছে। ডুবুরিরা খুঁজছে। এখনো কোন সন্ধান মিলেনি। গাড়ি থেকে উনার ফোন আর ওয়ালেট পাওয়া গেছে। ”
কাঁপা কাঁপা হাতে ওয়ালেট আর ফোনটা নিলো সায়রা। ফোনের আলো জ্বালাতেই স্কিনে ভেসে উঠল, সায়রার হাসি উজ্জ্বল ছবি। নোটিফিকেশনে মিস কল ভেসে আছে। ‘পুতুল বউ’। চিৎকার করে কেঁদে উঠল সায়রা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। দুহাতে মাটিতে প্রচণ্ড আঘাত করছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। কাচের চুড়ি ভেঙ্গে রক্তাক্ত হাত। ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। চিৎকার করে বলছে সায়রা ,
–” সব মিথ্যা! সব মিথ্যা! আপনারা মিথ্যা বলছেন। মিথ্যুক আপনারা। আমার আরসাল আছে। উনি এখানেই আছে”
বুক ফাটা চিৎকার সায়রার। কিছু একটা ভেবে দ্রুত পায়ে উঠে দাঁড়াল সায়রা। ব্রিজের ভাঙা রেলিং- এর দিকে ছুটে গেল। যেই ঝাপ দিতে নিবে পেছন থেকে আরমিন সিন্থিয়া ছুটে গিয়ে আটকাল। ছাড়া পাবার জন্য চাতক পাখির মত ছটফট করছে সায়রা। চিৎকার করে কাঁদছে। ছাড়া পাবার আপ্রাণ চেষ্টা! মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল সিন্থিয়া। সায়রা কাঁদছে তো কাঁদছেই। অসহায় কণ্ঠে বলল,
–” ছেড়ে দেও মা। আমি চিরকাল উনাকে দূরে ঠেলে এসেছি অন্তত শেষ বেলায় উনার সাথে আমাকে থাকতে দেও। এই জীবনের আর কোন মূল্য নেই। আরসাল ছাড়া এই সায়রা অপূর্ণ। আমার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই মা। কোন অধিকার নেই!”
থেমে যাচ্ছে নিশ্বাস। ক্লান্ত আঁখি মানছে না আর। বুজে আসছে বার বার। নিশ্বাস থেমে আসছে, দুনিয়া গলিয়ে আসছে। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে সায়রার। ধীরেধীরে সিন্থিয়ার উপর লুটিয়ে পড়ল। গভীর নিদ্রায় ডুবে গেল!
তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩০
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
” আজ একবছর পাঁচমাস বিশদিন। আপনি নেই আরসাল। আপনিহীন আমার প্রতিটি বেলা এক যুগ সমান। প্রতি প্রহর নিমিষ প্রাণহীন। এই দেহ তো বেঁচে আছে, কিন্তু এতে প্রাণ নেই । নিষ্প্রাণ বেঁচে আছি এতকাল! আমার দিবা কাটে আপনাকে ভেবে, রাত্রি কাটে জেগে। আচ্ছা, আমার অপরাধ কি এতই বড়! যার শাস্তি এত ভয়ংকর! কেন ছেড়ে গেলেন আরসাল! কতটা ভালোবাসি কতটা চাই একবার বলা সুযোগও কি পাওনা ছিল না আমার? আমি আছি, আপনার ছেড়ে যাওয়া সেই গলির মরেই আছি! চিরকাল অপেক্ষায় রইলাম আপনার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি আসবেন,ফিরে আসবেন। আপনাকে যে আসতেই হবে। আপনার পুতুল বউ যে আপনার অপেক্ষায়!”
চোখ মেলে ব্রিজের রেলিং চেপে নিচে জলের গভী্রে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়রা। গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখে মুখে তিক্ত যন্ত্রণার আভাস। ডুকরে কেঁদে উঠে সায়রা। খানিক দূরে তুর্জয়ের গাড়ি থেমে। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে আরমিন বসে। এই দেড় বছরে সায়রা নিজেকে ঘর বন্ধী করে নিয়েছে, ঘরের চার দেয়ালই যেন তার দুনিয়া। অন্ধকার যেন তার ভীষণ প্রিয়। আরসালের স্মৃতি জড়িয়ে ঘরের এক কোনে চুপচাপ পড়ে থাকে। এই দিনদুনিয়ার কোন কিছুর ধ্যান নেই তার। কখনো জোর করেও বাড়ির বাহিরে আনা যায়না তাকে, শুধু মাঝেমাঝে এই জায়গাটায় আরসালের স্মৃতিচারণ করতে আসে। যতবার আসে প্রত্যেকবারই খুব করে কাঁদে সায়রা। চাতক পাখির মত ছটফট করে শুধু।
সায়রাকে কাঁদতে দেখে গাড়ি থেকে নেমে যেতে নিলে, তুর্জয় আটকায় আরমিনকে।বলে,
–” ওকে কাঁদতে দেও! খুব করে কাঁদতে দেও। শান্তি পাবে! ভেতরের যন্ত্রণা গুলোকে অশ্রু সাথে বেরিয়ে আসতে দেও।”
আরমিন আর এক পাও বাড়াল না। গাড়িতে গুটিয়ে বসে রইল। ডুকরে কেঁদে উঠল,
–” এই দুনিয়াতে আমি- ই বুঝি সবচেয়ে নিকৃষ্ট বোন। যে নিজের বোনের জীবন ধ্বংস করতে দিনরাত প্রার্থনা করেছি। আমার জন্যই আজ আমার বোনের জীবন এমন ছন্নছাড়া , এলোমেলো! ঘৃণা হয়, নিজেকে প্রচণ্ড ঘৃণা হয়।”
পাশ থেকে আরমিনের হাতের উপর আলতো করে হাত রাখল তুর্জয়। অন্যহাতে চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল,
–” ভাগ্যের উপর কারো কথা চলে না। নিজেকে দোষারোপ করোনা আরমিন। তোমার প্রার্থনায় আরসাল আমাদের ছেড়ে যায়নি, হয়তো তাদের নিয়তিতেই এক সাথে থাকা লিখা ছিল না! নিজেকে ঘৃণা না ভালোবাসো। নিজের আশেপাশে যারা তোমাকে ভালোবাসে তাদের জন্য বাঁচো দেখবে জীবন কত সুন্দর!”
আরমিন নিমিষ দৃষ্টিতে তুর্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এই মানুষটা তাকে এত কেন বুঝে? আরমিনের প্রত্যেক অন্যায় অপরাধ সবটাকে এত সুন্দর ভাবে কি করে মেনে নেয়! আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করল আরমিন,
–” আমাকে এত কেন বুঝেন? আমার সব অন্যায় অপরাধকে এত ইজিলি কি করে মেনে নেন? কেন?”
তুর্জয় ম্লান হেসে উত্তর দিলো,
–” শুনোনি? তুমি যাকে ভালোবাসো নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসো। তার ভালোটাকেও ভালোবাসো, মন্দটাকেও ভালোবাসো!”
ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরমিন। তুর্জয়ের দৃষ্টিতে এক সমুদ্র ভালোবাসা। বেশ কিছুক্ষণ কাটল। সায়রাকে গাড়ির দিকে আসতে দেখে আরমিনের হাত ছাড়ল তুর্জয়। আরমিন দূরে সরে গেল। সায়রা চুপচাপ গাড়ির দরজা খুলে পিছন সিটে গা এলিয়ে বসল, চোখ বুজে নিলো। আরমিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সায়রাকে দেখছে। মেয়েটা আর আগের মত নেই। ভীষণ পাল্টে গেছে। চেহারায় আগের মত সেই উজ্জ্বল ভাব নেই। শরীর দিনদিন শুকিয়ে কাঠ হচ্ছে। রক্তিম চক্ষু , চোখ জোড়ায় যেম অনন্তকালের ঘুম। শেষবার কবে সায়রাকে হাসতে দেখেছে মনে নেই আরমিনের। চেহারায় সারাক্ষণ গম্ভীর ভাব। সবকিছুতে ছন্নছাড়া অনিয়ম বেখেয়ালি। সেই আগের চঞ্চলা ,হাসি উজ্জ্বল ,লাজুকলতা সায়রা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। প্রিয়জন হারানোর পীড়া বুঝি এমনি তীব্র হয়? চোখ ভরে এলো আরমিনের। আহত আওয়াজে বলল,
–” তুই ঠিক আছিস সায়রা?”
সায়রা চোখ বুজে আগের মত রুখা উত্তর দিলো,
–“আমি ঠিক আছি আপু, বাড়ি চলো! ”
.
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। ড্রইং রুমে বসে পান চিবাচ্ছেন জুলেখা বেগম। মুনতাহা বেগমের অসুস্থতার খবর পেয়ে এসেছেন। পানের ছিট ফেলতে ফেলতে বললেন,
–” আপনাকে আগেই বলেছিলাম ভাবী এই মেয়ে একটা অলক্ষি। এই মেয়েই আমাদের ছেলেটাকে খেয়েছে। কেন যে আরসাল এই মেয়েটাকে বিয়ে করল, আর আপনারাও মেনে নিলেন। যদি আরসাল ওকে বিয়ে না করত তবে আমাদের ছেলে আজ বেঁচে থাকত!”
মুনতাহা বেগম বিরক্ত হলো। জুলেখা বেগমকে শক্ত ভাবে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু দরজায় সায়রাকে দেখে চুপ করে গেল। মুনতাহার পাশে এসে বসল সায়রা। টেবিলের উপর থেকে স্ফিগমোম্যানোমিটার নিয়ে বিপি চেক করল। শক্ত আওয়াজে বলল,
–” বিপি লো, দুপুরে খাওনি তাই না? কেন এমন হেলামি করো । এখন কে ভুগছে? কে কষ্ট পাচ্ছে? আমি বাড়িতে না থাকলেই তোমার যত হেলামি আর অনিয়ম। এমন কেন তুমি বলো তো!”
মুনতাহা বেগম বাচ্চাদের মত অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নুয়ে নেয়। আমতা আমতা করে বললেন,
–” তুই বাড়ি ছিলি না। একা একা খেতে ভালো লাগেনা মা।”
সায়রা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। শাসানোর আওয়াজে বলল,
–” আর যেন হেলামি না হয়। তুমি এখনি খাবে। আমি নিজ হাতে তোমাকে খায়িয়ে দিবো। দিনদিন তুমি বড্ড বেখেয়ালি হচ্ছো। এমন হলে কি হবে?”
পাশ থেকে জুলেখা বেগম ধমক দিয়ে বললেন,
–” বেয়াদব মেয়ে তোমার সাহস কত বড়! ভাবীকে তুমি শাসাচ্ছ! এই মেয়ে এই। তুমি কে হ্যাঁ? এই বাড়িতে কেন পড়ে আছো? এখনো যাচ্ছনা কেন? বুঝেছি এসব নাটক করে সম্পত্তি হাতাতে চাইছ! নিলজ্জ মেয়ে, লজ্জা করেনা! আমাদের ছেলেকে খেয়েছ এখনআবার ভাই ভাবীকে মারতে চাইছ?”
সায়রা চুপ থাকল। আজকাল লোকের এসব কথা আর কানে তুলে না সায়রা। প্রতিনিয়ত এসব কথা শুনতে শুনতে অনুভূতি জিনিসটাই মরে গেছে। সত্যি এখন নিলজ্জ হয়ে গেছে। লোকের এসব অপমান গায়ে মাখে না আর। না অন্যের কথায় ফ্যাচফ্যাচ কাঁদে। এখন শরীর যেন লোহার তৈরি, লোকের হাজারো অপমান অপবাদ কোনকিছুতে ভাঙ্গে না সে! প্রতিবাদী আওয়াজে মুনতাহা বললেন,
–” আমার ঘরের লক্ষি, আমার মেয়ে সায়রা! শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়েই বেঁচে আছি আমরা। এটা সায়রার বাড়ি। সায়রার যা ইচ্ছে ও করবে। খবরদার! আমার মেয়ের সাথে সাবধানে কথা বলবে জুলেখা। বাহিরের লোক এসে আমার মেয়েকে কথা শুনাবে আমি তা সহ্য করব না!”
প্রচণ্ড অপমানে মাথা নুয়ে নিলো জুলেখা বেগম। মনে মনে বেশ কিছুক্ষণ বিরবির করল। তা কারো কান অবধি পৌঁছাল না।
.
ঘরে ফিরে রিদ্ধিকে দেখে বেশ চমকাল সায়রা। ম্লান হেসে রিদ্ধির ছয় মাসের কন্যা রিধিমাকে কোলে তুলে নিলো। রিধিমাও খালামণিকে দেখে খিলখিল হেসে উঠল। যেন তার কত চেনা। রিধিমাকে আদর করতে করতে বলল সায়রা,
–” তুমি আসবে, আগে বললে না যে! জরুরী কোন কাজে এসেছ কি? ”
রিদ্ধি ছিটকে উঠল। আমতাআমতা করে হাসল। রিদ্ধি হুট করে আসেননি। বিশেষ এক কারণেই এসেছে। কি করে বলবে সায়রাকে, যে তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে! রিদ্ধি আমতাআমতা উত্তর দিলো,
–” অনেকদিন হলো তোকে দেখি না। তাই ভাবলাম একটা রাত তোর সাথে এসে থাকি। জানিস তো সামনে সাপ্তাহে আমরা সবাই সিলেট যাচ্ছি। ফ্যামিলি ট্রিপ! তুইও কিন্তু সাথে যাচ্ছিস! ”
সায়রার ঝটপট উত্তর,
–” আমি যাবো না দি , আমার ভালোলাগেনা। তোমরা যাও!”
–” সবাই যাচ্ছে! খালা খালু আহনাফ আঙ্কল মুনতাহা আন্টিও যাচ্ছে!”
–” আমি যাবোনা রিদ্ধিদি! প্লিজ জোর করোনা আমাকে!”
বিরক্ত হলো রিদ্ধি। তেজি কন্ঠে বলল,
–” আর কতকাল সায়রা! আর কতকাল এভাবে কাটাবি ? অতীত ভুলে সামনে আগা। এটা কোন জীবন না। এটাকে জীবন বলে না। ”
–” শ্বাস নিচ্ছি, হাঁটছি চলছি, এটাই তো জীবন। আমি ভালো আছি দি। আমাকে আমার মত থাকতে দেও!”
–” এটা কেমন জীবন যেখানে কোন রঙ নেই। সাদামাটা রঙহীন!”
–” আমার এই সাদামাটা জীবন- ই সয়ে গেছে! রঙিন জীবনের কথা ভাবতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।”
–” ভাগ্যকে পাল্টানো যায়না। তাই বলে কি এভাবেই একাকী কাটিয়ে দিবি সারাজীবন! তোর বয়সী অনেকে এখনো বিয়েই করেনি সায়রা। নিজের জীবনকে আরেকটা সুযোগ দে।”
–” বিয়ে কয়বার হয় দি? আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমার জীবনে একমাত্র পুরুষ আরসাল। উনার স্থান আমি কাউকে দিতে পারবো না দি। তাছাড়া বিয়েই কি সব? একাকী কি বাঁচা যায় না? এই দেখ আমি বেশ ভালো আছি। কি দরকার অন্যকাউকে আমার সাথে জড়িয়ে তার জীবন নষ্ট করার? যাকে আমি ভালোই বাসতে পারবো না তাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে কি লাভ!”
চুপ রইল রিদ্ধি। সে বেশ জানে সায়রার যুক্তির সাথে পেরে উঠতে পারবেনা। তাই বলে সে ক্ষান্ত হবে না। এভাবে চোখের সামনে বোনের জীবন কি করে নষ্ট হতে দিবে সে! এটা কোন জীবন না। সায়রাকে স্বাভাবিক হতে হবে। স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে হবে। জোর করেই সিলেটে নিয়ে যাবে। বাড়ির বড়দের সাথে কথা বলেছে রিদ্ধি। সিলেটে সায়নের বন্ধু আবিরের বাড়ি। রিদ্ধির বিয়েতে সায়রাকে দেখেছে আবির।সায়রাকে ভীষণ পছন্দ তার। আরসালের সাথে সম্বন্ধ পাকা শুনে ব্যাপারটা আর সামনে আগায়নি। সেদিন কথায় কথায় সায়ন থেকে আরসালের এক্সিডেন্টের কথা শুনে খুব আফসোস করেছে, একটা সুযোগ চাইছে। সায়রার অতীত নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই। বড়দের সাথে কথা বলেছে রিদ্ধি। উনাদের কোন আপত্তি নেই। এখন সায়রা রাজি হলেই হয়।
চলবে………