তোমার প্রণয় নগরে পর্ব -২৭+২৮

তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ২৭

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

কনকনে শীতের রাত। বাবার মুখোমুখি বসে থরথর কাঁপছে সায়রা। শীতের প্রবণতায় নয়, বাবার রুষ্ট মুখের গম্ভীর ভাব দেখে। এই প্রথমবার বাবার সাথে দৃষ্টি মিলাতে পারছেনা সে। ঘর ভর্তি লোকজন। অপরাধবোধ, ভয়, আড়ষ্টতা সকল অনুভূতি আজ ঝেঁকে ধরেছে তাকে। মাহির আহমেদ মেয়ের দিকে প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেই মেয়েকে নিয়ে এতকাল গর্ব করে এসেছে সেই মেয়ে কিনা এমন একটা কাজ করল! হুট করে বিয়ে করে নিলো? এত বছরের আদর আহ্লাদ সব কিছু এমনি এমনি ভুলে গেল! কোথায় রইল মানসম্মান নীতিজ্ঞান? পাঁচটা মানুষের সামনে কি করে মাথা তুলে দাঁড়াবেন তিনি? রাগে কষ্টে বুকটা প্রচণ্ড কাঁপছে। জলে চোখ টলটল করছে। কন্ঠে একরাশ ক্রোধতা ঢেলে গজগজ করতে করতে বললেন,

–” বিয়েটাকে তোমরা কি মনে করেছ! ছেলেখেলা এটা? রিতী নেই- নীতি নেই , হুট করে বিয়ে করে নিলে! সমাজে মুখ দেখাব কি করে? এসব করার আগে বাবা মা পরিবারের কথা একবার ভাবলে না তোমরা! আরসাল না হয় পরের ছেলে তাকে বলে কি লাভ। তুই তো আমার মেয়ে সায়রা, তুই কি করে পারলি এমনটা করতে? এসব করার আগে বাবার কথা একবার ভাবলি না? তোর ছোট বড় বাড়িতে আরো দুইটা মেয়ে আছে, তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে তা ভাবলি না! আরসালকে যদি তোর পছন্দই ছিল একঘর লোকের সামনে বিয়ে ভাঙ্গলি কেন! কেন আমাদের মুখে চুনকালি মাখালি!”

সায়রা লজ্জা অপরাধবোধে মাথা নুয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। কান্নার বেগ ধীরেধীরে বাড়ছে তার। আরসাল সায়রার পাশেই বসে ছিল। সায়রার ডুকরে কান্না আরসালের হৃদয় ছিন্নবিচ্ছিন্ন হচ্ছে। আলতো হাতে সান্ত্বনা স্পর্শে সায়রার হাতে হাত ছোঁয়াতেই ছিটকে সরিয়ে দেয় সায়রা। আরসালের দিকে রক্তিম ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সায়রার দৃষ্টি স্পষ্ট বলছে”সব শেষ করে এখন কি চাই আপনার? কেন এই মিছে সান্ত্বনা!” আরসাল বুঝল সেই ভাষা। কিন্তু দমল না সে, আরো পোক্ত করে হাত চেপে ধরল সায়রার! শক্ত আওয়াজে বলল,

–” ছোট আব্বু! মানছি আমরা পূর্বে যা করেছি, ভুল করেছি। কিন্তু আমাদের বিয়েটা কোন ভুল না। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমাদের হুট করে বিয়ে করাটা উচিত হয়নি, কিছু কারণে এমনটা করতে হয়েছে। আমার ভয় ছিল সায়রাকে হারাবার। বড্ড ভালোবাসি সায়রাকে। আপনাদেরকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল না, তবুও যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন দুঃখীত! ”

আরসালের কন্ঠে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ নেই। বরং তার প্রখরতা দেখে মনে হচ্ছে সে অপরাধ না বড় কোন গর্বের কাজ করেছে। হতভম্ব সায়রা। কেউ এতটা কাঠখোট্টা কি করে হয়! বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নেই মানুষটার। বাবা মা বাড়ির ছোটবড় সবার সামনে ভালোবাসার কথা গলা ফাটিয়ে বলছে। লজ্জা ভয়ে মিশে যাচ্ছে সায়রা। আরসালের বাবা আহনাফ খাঁন প্রখর আওয়াজ তুলে বললেন,

–” বেয়াদবির সব সীমানা অতিক্রম করছ আরসাল! কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করছ কোথায় মাথা নুয়ে থাকবে! তা নয় তুমি বড় গলায় ভালোবাসার কথা জানাচ্ছ সবাইকে!”

–” কয়েক মাস আগে তোমাদের সায়রাকে পছন্দ ছিল, বাগদান হয়েছে আমাদের , বিয়ে করাতে চেয়েছিলে! আজ যখন আমরা বিয়ে করেছি তোমাদের সমস্যা হচ্ছে কোথায় বাবা? যদি তোমাদের কোন সমস্যা থাকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেও আমার বউ নিয়ে আমি অন্য কোথাও চলে যাবো। বউকে ভালো রাখার মত যথেষ্ট সামর্থ আছে আমার!”

ছেলেকে ক্ষান্ত করতে গিয়ে নিজেই ক্ষান্ত হয়ে গেল আহনাফ সাহেব। আরসালের রাগ জেদ সম্পর্কে ছোট থেকে অবগত তিনি। তিনি জানেন আরসাল মুখে যা বলে তা করেই ছাড়ে। রাগানো যাবেনা তাকে, দেখা যাবে সত্যি সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। দ্বিতীয়বার বাড়ির দিকে মুখ ফিরে চাইবে না। তখন কি করবেন তিনি। একমাত্র সন্তান আরসাল। সবার সামনে যতই কঠোরতা দেখাক, আড়ালে ছেলের জন্য ঠিকই বুক ফাটে। নিঃসন্দেহে, বলা যায় ছেলেকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন তিনি!
মাহির আহমেদ থম মেরে মেয়ের মুখপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন তিনি। আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে নীরবতা মাড়িয়ে আওয়াজ তুলেন,

–” আমার মেয়ে! বিয়ে করেছিস! ফেলে তো দিতে পারি না! কিন্তু আজকের পর থেকে তোর আর আমার কোন সম্পর্ক থাকবেনা। সমাজের, দুনিয়ার সামনে তুই আমার মেয়ের পরিচয়ে থাকলেও মন থেকে তোকে চিরতরে তেজ্য কন্যা করলাম!”

সায়রা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মাহির আহমেদ জায়গা ছেড়ে ঘরে চলে গেল। নিজেকে দিশেহারা লাগছে সায়রার। সায়রা কান্না ভেজা কন্ঠে বারংবার ‘বাবা,বাবা’ ডেকে যাচ্ছে সে। শুনল না মাহির আহমেদ। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। পাশের ঘর থেকে আরমিন বেরিয়ে এলো। চোখমুখ রক্তিম, ফুলে আছে। সায়রা হতাশা ভারী শ্বাস ফেলে আরমিনের দিকে দু কদম বাড়াতেই আরমিন থামিয়ে দেয়। গর্জন তুলে,

–” এত অভিনয়, এত ছলচাতুরীর কি দরকার ছিল সায়রা? আরসাল ভাইকে তুই ভালোবাসিস! তবে কেন আমাকে মিথ্যা আশা দিলি! তোর পেটে পেটে এত শয়তানি জানা ছিল না আমার!”

–” আপা আমার কথাটা একবার শুনো!”

–” কি শুনবো তোর কথা? কি শুনবো?”

ততক্ষণে আরসাল সেখানে চলে এসেছে। আরসালকে দেখে আরমিনের গর্জন কমে এলোও। ক্ষান্ত হলো না। গজগজ করতে করতে আরসালের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

–” আপনি সেদিন সায়রার জন্য আমাকে রিজেক্ট করেছিলেন? সায়রারই কি সে মেয়ে যাকে এতবছর ভালোবেসে এসেছেন?”

–” যেখানে উত্তর তোমার জানা, সেখানে প্রশ্ন করাটা বোকামি আরমিন”

আরমিন কয়েক পলক আরসালের দিকে তাকিয়ে। অতি কষ্টে হুট করে কেঁদে উঠল সে। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল,

–” আমাকে ভালোবাসলে কি এমন ক্ষতি হতো আরসাল ভাই? আমি কি সুন্দর নাহ! আমি সব দিক দিয়ে সায়রা থেকে এগিয়ে! আমাকে কেন ভালোবাসা যায়না! আমার সামান্য ক্ষীণতাই কি কারণ!”

আরসালের অতি শান্ত উত্তর,

–” ভালোবাসা সৌন্দর্য বা দোষগুণ বিচার করে হয়না আরমিন। না জোর খাটানো যায়। এটা ভীষণ আপেক্ষিক জিনিস। যা হুট করে হয়ে যায়! আমি চিরকাল সায়রাকে ভালোবেসে এসেছি! আর ভালোবাসব! আই থিংক তুমি যথেষ্ট ম্যাচিউর! এমন বাচ্চাদের মত আবদার তোমাকে মানায় না!”

আরমিন কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। সায়রা আরমিনের দিকে এগিয়ে আসতেই ধমকে উঠে। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে,

–” বিশ্বাসঘাতক! ছুঁবি না আমাকে! তোর চেহারাও দেখতে চাইনা আর।”

আরমিনকে ধমকে উঠে আরসাল। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে গর্জন করে,

–” বেয়াদবির লিমিট ক্রস করছ আরমিন! ভুলেও ওর দিকে আঙ্গুল তোলার সাহস করো না। ফল ভীষণ বাজে হবে!”

আরমিন চুপ করল। ফোঁসফোঁস করতে করতে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। সায়রা পিছন পিছন যেতে নিলে, আটকাল আরসাল। গম্ভীর আওয়াজে বলল,

–” ওকে ওর মত থাকতে দে!”

শুনল না সায়রা। আরসালের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাত ছাড়িয়ে পিছুপিছু গেল। আরমিনের দরজার সামনে দাঁড়াতেই দরজা ঠেলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো আরমিন। দরজার কোণা এসে সায়রার ডান পায়ে লাগল। বৃদ্ধাঙ্গুলির নখ উঠে গেছে। গলগল করে রক্ত ঝরছে। ‘মা গো’ বলে মাটিতে বসে পড়ল সায়রা। আরসালের কর্ণকুহরে সায়রার আর্তনাদ পৌঁছাতেই ছুটে আসলো। দেখল- মাটিতে বসে কান্না করছে সায়রা। হাত দিয়ে পা চেপে ধরে কাঁদছে । হাত রক্তে মাখামাখি! গর্জন করে উঠল আরসাল,

— ” বলেছিলাম! শুনলি না তো!”

রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে সজোরে কয়েকবার আরমিনের দরজায় লাথি মারল আরসাল। কেঁপে উঠল সায়রা। আচমকা মাটিতে বসে, সায়রার ওড়নার কোণা ছিঁড়ে আঙ্গুলে বেঁধে দিলো। কোলে তুলে নিলো সামনের দিকে পা বাড়িয়ে। গজগজ করে বলল,

–” এই বেয়াদবের সাথে, তোকে দ্বিতীয়বার কথা বলতে যেন না দেখি!”

উত্তর দিলো না সায়রা। চুপ করে রইল। শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

.
রাত দুইটা। অন্ধকার ঘরটায় টিমটিম হলুদ আলো জ্বলছে। মাথা নুয়ে বিছানায় বসে আছে সায়রা। চোখ তখনো জলে টলোমলো! আরসাল হাঁটু ভেঙ্গে কাটা আঙ্গুলে ড্রেসিং করে দিচ্ছে। ঔষধ লাগাতেই ‘আহ!’ আর্তনাদ করে উঠে সায়রা। চোখ তুলে সায়রার মুখপানে একবার তাকায় আরসাল। ঠোঁট কামড়ে সহ্য করছে। আঁখিদ্বয় জলে ছলছল। চোখমুখ ব্যথায় নীল হয়ে আছে। ধীরেধীরে ফুঁ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয় আরসাল। ব্যান্ডেজ শেষে, সায়রার কোলে মাথা রেখে আবেশে চোখ বুজে নেয়। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। বারংবার নিদ্রায় চোখ ভারী হয়ে আসছে তার। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মাথার তার ধপধপ কাঁপছে। সায়রার হাত টেনে চুলে ডুবিয়ে দিলো! বেশ আবেশ ভারী ঘুমকাতুরে কন্ঠে আবদার করল আরসাল,

–” মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। চুল গুলো একটু টেনে দে!”

দ্বিরুক্তি করল না সায়রা। আরসালের নরম চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে দিলো। আলতো আলতো করে টেনে দিতে লাগল। ধীরেধীরে গভীর ঘুমে ডুব দিলো আরসাল।
তোমার প্রণয় নগরে

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব- ২৮

(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

থমথমে রাতের আঁধার কাটিয়ে সোনালি ভোরের আলো এসে ছুঁইল ভুবন। ঘুম ভাঙ্গল সায়রার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। ঘুমে চোখজোড়া লেগে আসছে বারংবার! মাথা চেপে ধরল সে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, মাথা এখনো চিনচিনে ব্যথা করছে। আশেপাশে চোখ বুলাতেই দেখল- খালি বিছানা। বালিশের উপর সায়রার ওড়না রাখা। দ্রুত হাতে গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নামার জন্য পা বাড়াল। মাটিতে পা ছোঁয়াতেই চাপা আর্তনাদ করে উঠল। গতরাতের চোট এখনো অনেকটাই কাঁচা। শুখাতে সময় লাগবে। এভাবে হুটহাট চলাচলে চোট গাঢ় হয়ে ইনফেকশন হতে পারে! তাই আলতো করে পা নামাল। আরসাল রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে শাওয়ারের আওয়াজ আসছে। তবে কি উনি ফ্রেশ হচ্ছে? বোধহয়!
অন্ধকার ঘরটায় আবছা আলো। জানালায় ময়ুরপঙ্খীবর্ণ ভারী পর্দার আবরণ। ঘরটা বেগনিলাল বর্ণে রাঙানো। ঘরের একপাশে দেয়াল খোঁদাই করা ছোট লাইব্রেরী, সেখানে নামীদামী দেশবিদেশের বিভিন্ন লেখকের বই। মাঝেই সেগুন কাঠের মেরুন মখমলে মোড়ানো সোনালি রাজকীয় গদি। গদির ঠিক উপরে ছোট সাইজের ঝাড়বাতি, যার টিমটিম আলোয় উজ্জ্বল থাকে চারিদিক! এই জায়গাটা ভীষণ পছন্দের সায়রার। আরসালের অবর্তমানে ঘন্টার পর এই জায়গায় কাটিয়েছে সে। এই ঘরটায় হাজার বার এসেছে কিন্তু আজকের অনুভূতি অন্যসব বারের চেয়ে একদমই ভিন্ন! আজ অনুভূতিটা তিক্তার মাঝে মধুর। ধীর পায়ে জানালার দিকে পা বাড়াল সায়রা। এক ঝটকায় ভারী পর্দা গুলো গুছিয়ে নিলো। সকালে কমল আলো মুখ ছুঁয়ে দিলো সায়রার। আলোর তেজ সহ্য করতে না পেরে বুজে নিলো আঁখিদ্বয়। ভ্রু দ্বয় কুঁচকে এলো। পেছন থেকে একজোড়া হাত কোমর চেপে ধরল সায়রার। আচমকা শীতল পরশে কেঁপে উঠল সে। ঘাড় ফেরাতে গিয়ে পারল না সে। পেছনের মানুষটার উন্মুক্ত বুকে আটকাল। গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণটা বলে দিচ্ছে, এটাই তার চিরচেনা অতিপরিচীত মানুষটা! আরসাল! যার সাথে গতরাতে তিন কবুল পড়ে বিয়ে হয়েছে সায়রার।
অকস্মাৎ কোমর চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আরসাল। সায়রার ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে আলতো করে কানে ঠোঁট ছোঁয়াল। আরসালের ভেজা চুলের চুপসে পড়া বিন্দু বিন্দু পানি ঘাড়ে পড়ছে সায়রার। শিহরণে কেঁপে উঠল সে। আবেশে চোখ বুজে নিলো!

–” গুড মর্নিং বউ!”

পেছন থেকে আবেগ মাখা গাঢ় কন্ঠ আরসালের। প্রত্যুত্তর করল না সায়রা। অপেক্ষা করল না আরসাল। ধাঁ করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো সায়রাকে। সায়রার চোখ তখনো বন্ধ। আঁখি পল্লব ভেজা। সায়রাকে কোলে তুলে পাশের ডিভাইনটায় বসল। সায়রা ছাড়া পাবার জন্য মোচড়ামুচড়ি করলে শক্ত করে কোমর চেপে ধরল আরসাল!
আলতো হাতে গাল ছুঁয়ে দিয়ে, মুখ টেনে নিজের কাছে আনল। ম্লান স্পর্শে গাল ছুঁইছে বারংবার! চিন্তিত মুখ করে কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে,

–” কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? পায়ে কি ব্যথা করছে? প্রচুর! ”

দুদিকে মাথা নাড়াল সায়রা। যার অর্থ ‘না , ব্যথা করছে না!’। কপালে চিন্তার রেখা গুছল আরসালের। সায়রার অগোছালো চুল গুলো কানের পেছনে গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

–” তাহলে ফ্যাচফ্যাচ কাঁদছিস কেন? ”

সায়রা এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। নাক টানতে টানতে বলল,

–” আমাকে কেন বিয়ে করলেন? খুব কি প্রয়োজন ছিল?”

চমকাল আরসাল। হতভম্ব দৃষ্টিতে কয়েক পলক সায়রার দিকে তাকিয়ে থাকল। এত অবুঝ কেন মেয়েটা! এত অবুঝ হওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিল! একটু বুঝদার স্বার্থপর হলে কি ক্ষতি হতো?
আরসাল আগের মত গম্ভীর আওয়াজ করে বলল,

–” হ্যাঁ, প্রয়োজন ছিল। অত্যন্ত প্রয়োজন! নিশ্বাস নেওয়াটা যেমন প্রয়োজন তেমনি তোকে আমার জীবনে প্রয়োজন! নিজেকে তুই কি মনে করিস? উদারতার দেবী! উদার মনে বোনের জন্য আমাকে ছাড়ছিলি?”

–” আপনি আমাকে ভালোবাসেন এটা যেমন সত্য, আপুর প্রতি আমার ভালোবাসাটাও ঠিক ততটাই সত্য! আজ আরমিন আপুর আরো সুন্দর জীবন হতে পারতো। শুধু আমার করা একটা ভুলের জন্য আজ আরমিন আপু সবার দৃষ্টিতে দোষী! এই অনুতাপ আমি কি করে গুছাব!”

–” তোদের দুবোনের ভালোবাসা- বাসিতে আমার স্থানটা কোথায় সায়রা? তোদের ভালোবাসা! তোদের অনুতাপ- অনুশোচনা! এসবের মাঝে আমার ভালোবাসা দমে গেল? আমার ভালোবাসার কোন মূল্য নাই?”

চুপ রইল সায়রা। আরসাল উত্তরের অপেক্ষা করল। মিলল না! বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল আরসাল,

–” আমি জানি তুই আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসিস! তুই না বললেও তোর ঐ সরল চোখ তা বলে। তোকে জোর করে আদায় করার ইচ্ছা ছিল না আমার। রাজরানি সাজিয়ে আমার হৃদয়ের সিংহাসনে বসাতে চেয়েছি! কিন্তু…
আমার তোকে হারানোর ভয় ছিল সায়রা। ছোট থেকে দেখে দেখে বড় করলাম আমি! শেষমেশ আমার চোখের সামনে দিয়ে অন্যকেউ নিয়ে যাবে? এত সহজ! এখন সব ভাবাভাবি বাদ। এখন থেকে তুই শুধু আমাকে ভাববি। শুধুই আমাকে!”

ততক্ষণে মাথা নুয়ে নিয়েছে সায়রা। আরসাল বিছানায় সায়রাকে বসিয়ে দিলো। বড় কাবার্ডের ভেতর থেকে দুইটা ব্যাগ বের করে সায়রার হাতে ধরিয়ে দিলো। বলল,

–” এখানে শাড়ি কামিজ দুইটাই আছে বাকি গুলা কাবার্ডে , যেটা ভালো লাগে পর!”

–” কখন কিনলেন এসব?”

–” তোর প্রথম পরিক্ষার পরের দিন”

হতভম্ব চেয়ে থাকল সায়রা। তার মানে সেদিনের সাবধান বানী এমনি এমনি ছিল না! সব কিছু প্রি- প্লান করা ছিল। কাল জাস্ট বোমার মত ফাটিয়েছে। একেই বুঝি, ঠান্ডা মাথার খুনি বলে!
আরসাল ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে। সায়রা ব্যাগ থেকে কামিজ বের করে সামনে ধরল। দেখে মনে হচ্ছে একদম ঠিকঠাক সাইজ । এত পার্ফেক্ট সাইজ উনি জানল কি করে! কিংকত্র্তব্যবিমূঢ় সায়রা!
আরসাল আয়নায় সায়রার বিস্মিত মুখ দেখে বাঁকা হেসে বলল,
–” ডোন্ট ওয়ারী পার্ফেক্ট সাইজ।”

বলেই চোখ টিপল আরসাল। হাত থেকে সাথে সাথে কামিজ বিছানায় পড়ল। লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিলো সায়রা। মুখের উপর এই ভাবে কেউ লজ্জা দেয়? লোকটার লজ্জাশরম কম বলে কি , সায়রাও কম নাকি! বিরবির করে বলল সায়রা,

–” আপনি অসভ্য! চরম নিলজ্জ!”

আরসাল সায়রার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল,

–” একটু বের হচ্ছি! তাড়াতাড়ি ফিরব। তোর যা যা প্রয়োজন কাবার্ডের প্রথম তাক- এ আছে। সাবধান! বেশি হাঁটা চলা করতে হবে না। বেশি খারাপ লাগলে ফোন করবি আমাকে”

সায়রা বাচ্চাদের মত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।
সায়রার ফোন গতকাল আবারো ভেঙেছে আরসাল। তাই পকেট থেকে একটা ফোন বের করে সায়রার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

–” পাসওয়ার্ড তোর বার্থডেট!”

.

গাছে পানি দিচ্ছিল মুনতাহা বেগম। নাস্তা শেষে এটা উনার নিত্যদিনের কাজ। খুরিয়ে খুরিয়ে মুনতাহা বেগমের পেছনে দাঁড়াল সায়রা। অপরাধি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে মনে মনে কথা গুছাচ্ছে। কোথা থেকে শুরু করবে, কি বলে শুরু করবে। আচ্ছা, বড় মাও কি তার উপর রেগে!
পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে। ঘাড় ফিরে তাকাল মুনতাহা। সায়রাকে দেখে প্রফুল্ল কন্ঠে বললেন,

–” চোট নিয়ে ছাদে আসতে গেলি কেন? দেখি দেখি পায়ের কি অবস্থা এখন।”

বলেই পা দেখতে লাগলেন। আফসোস কন্ঠে বললেন,

–” ইশ কতটা কেটেছে। এত নড়াচড়া করতে কে বলেছে তোকে! আবারো রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। তুই বড় হলি না সায়রা! বাচ্চামো এখনো রয়েই গেল!
চল, নিচে চল ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।”

শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল সায়রা,

–” এত কিছু হয়ে গেল! তোমার আমার উপর রাগ হয় না বড়মা?”

মুনতাহা বেগম মিহি হাসলেন। বললেন,

–” রাগ হবে কেন? আমি জানি যা হয়েছে এতে তোর কোন দোষ নেই। আমার রগচটা ছেলেরই দোষ। সেই তোকে জোর করে বিয়ে করেছে তা নিসন্দেহে বলতে পারি। এতে অবশ্য আমার কোন অভিযোগ নেই। আমি সবসময় চেয়েছি তুই আমার আরসালের বউ হ। একমাত্র তুই- ই যার সামনে আমার এই রগচটা ছেলেটা দুর্বল। আমার ছেলেটা অল্পভাষী, রগচটা ঠিকঠাক অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনা। কিন্তু সে তোকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সায়রা। কোনদিন আমার ছেলেটার মনে কষ্ট দিস না। এটা তোর কাছে এক মায়ের আবদার!”

সায়রা মুনতাহাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই দিলো। এই মানুষটা এত বুঝে কেন সায়রাকে!

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here