#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:৩৪
-” তরী! তোমাদের বিয়ে হয়েছে মাস দুই পেরিয়ে গেছে। তাহলে তুই এখন নববধূর মতো লজ্জা পাচ্ছিস কেন? তুই কি জানিস, তোর লজ্জা পাওয়া মুখটা দেখতে কতোটা হেল্পলেস লাগে?”
বুকে হাত রেখে মাথা উঁচু করে ভাইয়ার দিকে অবলোকন করলাম। তিনি পলকহীন চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। ধীরে ধীরে নিজের বন্ধনে আবদ্ধ রাখা হাতটা সরিয়ে নিলেন। সন্ধর্পনে হাতটা রাখলেন আমার বুকের বাম পাশের ক্ষত স্থানটায়। আয়াসে চোখ খিঁচে গ্ৰথণ করে নিলাম। তিনি অসহায় স্বরে বললেন,
-” বেশি ব্যাথা করছে তরী রানী? আ’ম স্যরি! আমি আমার তরীকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারি নি।”
দুই অধর নাড়িয়ে শব্দ উচ্চারণ করার পূর্বেই অধরে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিল অরিশ ভাইয়া। বাঁধ সাধলেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন,
-” কথা বলার দরকার নেই। টান পড়ে রক্ত বের হবে। ক্ষতটা আরো জোড়ালো হবে।”
আমি তবুও অধর জোড়া নাড়িয়ে উচ্চারন করার চেষ্টা করলাম। শব্দ বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণ নির্বিকার ভাবে কথা বলার চেষ্টা করে গলা চেপে ধরলাম। শব্দহীন স্বরে আওড়াতে লাগলাম,-” আমি কথা বলতে পারছি না।”
পুনরায় কথা বলার চেষ্টা করতেই ধমকে উঠলেন অরিশ ভাইয়া। আঙুল তুলে বললেন,
-” চুপ! একদম চুপ! আরেকবার নড়াচড়া করলে রাস্তায় ফেলে আসবো।”
বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। আমি নিশ্চুপ হয়ে আধ শোয়া হয়ে আছি। মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই ডাক্তার সমেত প্রবেশ করলেন অরিশ ভাইয়া। আমাকে চেক করতে শুরু করলেন। একসময় বললেন,
-” ধীরে ধীরে কথা বলার চেষ্টা করো তো?”
অসহায় চোখে অরিশ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তিনি সায় দিতেই গলা ধরে শব্দ উচ্চারণ করার চেষ্টা করলাম। বরাবরের মতো এবারও ব্যর্থ হলাম। অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। ডাক্তার মিথিলা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-” কেঁদো না! আমি যা ধারণা করেছিলাম তাই হয়েছে। জ্ঞান থাকাকালীন সময়ে বেশ কয়েকদিন তুমি কথা বলো নি। নির্বাক হয়ে ছিলে। তারপরে তোমার গুলি লেগেছে। নির্বাক রাখলেও ভয় পেয়েছো। জ্ঞান ফেরার পর কথা বলার জন্য গলায় পেসার দিয়েছো। তাই সাময়িক সময়ের জন্য কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছো। চিন্তা করো না, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে!”
ডাক্তার চলে গেল। আমি ঝাঁপসা চোখে চেয়ে আছি। আমার যতোদূর মনে আছে চারদিন সেখানে ছিলাম আর প্রতিদিন “ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও” বলে মিনতি করেছি। তাহলে কিভাবে সম্ভব।
______________
গ্ৰীষ্মের কাঠফাঁটা রৌদ্রের খেলায় মেতে উঠেছে প্রকৃতি। এই আকাশ জুড়ে রোদের খেলা, এই মেঘের লুকোচুরি। রাত থাকার ফলে সূর্যের সোনালী আভার দেখা নেই। তবে ঝড়ো হাওয়া বইছে চারদিকে। রাস্তার ধুলো বালি উড়ছে। অরিশ গাড়ি থামিয়ে রাস্তার এক কিনারায় বসে আছে। এই সময়ে গাড়ি চালানোর ফলে এক্সিডেন্ট করার সম্ভাবনা থাকে। জনশূন্য হতে চলেছে চারিদিক। অরিশ কাঁচ খুলে দিলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভারী দীর্ঘ শ্বাস নিলো। এই হাওয়াতে তরীর শরীরের সেই মাতাল করা সুবাস ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে তার সন্নিকটে তরীর অবস্থান। কিন্তু তরী তো হসপিটালে। তার কেবিনের দরজা জানালা হয়তো এতোক্ষণে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। বাটন চেপে কাঁচ বন্ধ করতে চাইলে চোখ আটকে গেল অদূরে ফুল বিক্রেতা একটি ছেলের দিকে। অরিশ হাসলো মৃদু। দরজার লক খুলে বেরিয়ে এলো। ছেলেটির দিকে দৌড়ে গেল। এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ পড়ে আছে। অরিশ ফুল গুচ্ছ হাতে নিয়ে নিলো। সারাদিন রোদে থাকার ফলে শুকিয়ে গেছে। ছেলেটির অপর হাত থেকে চকলেটের প্যাকেট নিয়ে নিলো। দুটো এক হাতে নিয়ে প্যাকেট হাতরে একটা এক হাজার টাকার নোট বের করে ছেলেটির দিকে এগিয়ে দিল। ছেলেটি হাতে নিয়ে এপিঠ ওপিঠ করে মলিন কন্ঠে বলে,
-” সাহেব টাহা তো ভাঙতি নাই!”
-” আমি কি তোমার কাছে ভাঙতি চেয়েছি? হাওয়া বইছে, ঝড় উঠতে পারে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও..
ছেলেটি কদাচিৎ হাঁ হয়ে অরিশের মুখপানে চেয়ে আছে। ছেলেটির দিকে না চেয়ে নিজের গাড়িতে এসে বসলো অরিশ। বোতলের ছিপি খুলে হাতে পানি নিয়ে গোলাপের উপর ছিটিয়ে দিলো। ফুলের মিষ্টি সুবাস নিয়ে ফন্ট সিটের উপর রেখে দিলো। তর ডিঙিরানী ফুলগুলো দেখলে খুশিতে আত্মহারা না হয়ে গেলেই হয়। চকলেটের প্যাকেট থেকে তিন টা চকলেট বের করে শার্টের পকেটে রেখে দিলো। প্রথমে তরী কে এই চকলেট বের করে দিবে। তখন তরী মুখ ভার করে রাখবে। চিবিয়ে চিবিয়ে শব্দহীন স্বরে আওড়াবে,
-” অরিশ ভাইয়া! মাত্র তিনটা চকলেট। তুমি জানো না, আমি চকলেট ভালোবাসি। তাহলে! তুমি আমার মনের কথা পড়তে পারো না। তাই তো?”
বলেই তরী মুখ ফিরিয়ে বসে থাকবে। অরিশ তখন চুপটি করে চকলেটের প্যাকেট বের করে তরীর হাতে ধরিয়ে দিবে। ফুলিয়ে রাখা নরম কোমল গালগুলো আলতো হাতে টেনে দিয়ে বলবে,
-” আমার তরী রানীর কথা তার অরি কী কখনো ভুলতে পারে? আমার তরী রানীর কথা জানতে, তার মন পড়তে হয় না। আমার আর তরী রানীর হৃদয় তো একই। তাই সে কিছু চাইলে আমার হৃদয় তা জানিয়ে দেয়।”
তদানীং তরী খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে। সেই হাসির শব্দ অরিশ মুগ্ধ নয়নে, নয়নের ভাঁজে বন্দী করবে।
.
ঝড়ো হাওয়া কমে এলেই অরিশ ফাস্ট ড্রাইভ করে হসপিটালের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে। কেবিনের সামনে আসতেই ফাঁকা এলোমেলো, অগোছালো, লন্ডভন্ড কেবিন নজরে এলো তারা। হয়তো ওয়াশরুমে গেছে, ভেবে কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করলো অরিশ। তরীকে ফিরতে না দেখে সেদিকে গেল। কিন্তু দেখা মিললো না তরীর। খাবার, ফুল আর চকলেটের প্যাকেট বেডের উপর রেখে খুঁজতে বের হলো সে। কোথাও দেখা পেল না তরীর। পুরো হসপিটালে এক চক্কর দিয়ে রিসেপশনে এসে থামলো। এদিক ওদিক আরো একবার পর্যবেক্ষণ করে ত্রুব্ধ কন্ঠে বলে,
-” তরী! তরী কোথায়?”
-” কোন কেবিনের পেশেন্ট স্যার?”
-” ৩৫৮!”
কিছু বলার বিনিময়ে ঘামতে দেখা গেল মেয়েটিকে। অরিশ নিজের উত্তর না পেয়ে বিচলিত হয়ে উঠলো। টেবিলের উপর আঘাত করলো। মেয়েটি অতিশয় ভীত হয়ে উঠলো। ম্যানেজার ছুটে এলো।
-” স্যার! থামুন! আমরা পেশেন্টকে খুঁজতে পাঠিয়েছি। এরা এক্ষুনি নিয়ে আসবে!”
রুদ্ধ কন্ঠে বলে,
-” এক্ষুনি নিয়ে আসবে মানে কী? কোথায় তরী?”
-” আসলে স্যার, পেশেন্ট ড্রাসের অভাবে পুরো হসপিটাল মাথায় তুলে ফেলেছে। আমরা কেউ তাকে সামলাতে পারিনি। সে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেছে। আমাদের নার্স, স্টার্ফরা তাকে ফিরিয়ে আনতে গেছে।”
-” ওয়ার্ট? আপনাদের হসপিটাল থেকে একজন অসুস্থ পেশেন্ট চলে গেল কিভাবে, আশ্চর্য? আমি..
অরিশ বাক্যের সমাপ্তি টানলো না। হসপিটালের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল। ছুটতে ছুটতে গিয়ে দেখা পেল তরীর। তরী আগে আগে ছুটছে আর বাকিরা পেছনে পেছনে ছুটছে। পাগলের মতো বিহেব করছে। কখনো কখনো মাথায় বেড়ে উঠা কৃষ্ণের ন্যায় কেশ সমূহ টেনে ধরছে। রক্তে ভিজে গেছে জামা কাপড়। অরিশ তরীকে দুই হাতে আগলে ধরলো। হাত দুটো পিছমোড়া করে ধরলো। বিনিময়ে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দিল অরিশকে।
ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। হাওয়া কমে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজলে হিতে বিপরীত না হয়ে যায়। অরিশ দুই হাত সামনে এনে কাম ডাউন করলো। তরীর জন্য আলাদা করে রেখে দেওয়া চকলেট তিনটা বের করে এগিয়ে দিল তরীর নিকট। তরী ছুটে এসে ঝড়ের বেগে চকলেট নিয়ে খেতে লাগলো। বৃষ্টির পানিতে চুইসে চুইসে গলে পড়ছে চকলেট। গালের চারিপাশ গলিত চকলেটে মেখে গেছে।
সময় নষ্ট না করে তরীর বাহুতে ইনজেকশন পুশ করলো। মিনিট পাঁচেক পেরুবার আগেই নির্বোধ হয়ে গেল তরী। গাঁ হেলিয়ে পড়ে যেতে নিলে হাত পেঁচিয়ে ধরে ফেললো অরিশ। গলিত চকলেট গুলো ঘসে ঘসে তুললো সে। ততক্ষণে বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে সকলে। বৃষ্টিতে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে জামা কাপড়। স্টার্ফরা তখন নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তরীর দিকে। অরিশ তরীর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলে,
-” তাড়াতাড়ি গিয়ে কেবিন গুছিয়ে নিন। কুইক!”
ঝড়ের গতিতে প্রস্থান করলো সকলে। একহাতে তরীকে জড়িয়ে ধীরে ধীরে নিজের শার্টটা খুলে তরীর গায়ে পেঁচিয়ে দিলো। অরিশ দাঁড়িয়ে রইলো না। মৃদু ঝুঁকে জ্ঞানহীন তরীকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। গতিহীন স্থির পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে গেল সামনে দিকে।
#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️🔥[রহস্য উন্মোচন:০১]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৫
মাথার চুল থেকে চুইসে চুইসে পানি ঝরছে। পানিতে ফ্লোর ভিজে গেছে। আশে পাশে কোথাও টাওয়ালের চিহ্ন মাত্র দেখছি না। আমি যেদিন নিখোঁজ হয়ে গেছিলাম, সেদিনও সুন্দর করে বেলকেনিতে রোদে দিয়েছিলাম। আরো একবার বেলকেনির দিকে খুঁজতে যেতেই ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেলাম। এই নিয়ে তিনবার পড়েছি। ব্যাথায় কোমড়টায় জং ধরে গেছে। নিজের রাগ দমিয়ে রাখতে না পেরে পরপর দুটো চড় মারলাম মেঝেতে। উল্টো হাতের পিঠে আঘাত পেলাম। ঠোঁট উল্টো পা ছড়িয়ে বসে রইলাম। জানালার গ্ৰিলে বসে থাকা ময়না পাখিটা আমার এই অবস্থায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। একদম অরিশ ভাইয়ার মতো হাঁসি। বিরাগী হয়ে বললাম,
-” যেমন বিলাতি ইঁদুর, তেমনি তার পাখি! দুটোই হাড় বজ্জাত।”
আমার কথা শুনেই তাল মেলাতে লাগলো পাখিটা। তবে পুরোটা মেলাতে পারলো না। শুধু বলল,
-” হাড় বজ্জাত! হাড় বজ্জাত!”
আমি ফট করে উঠে দাঁড়ালাম। একে একে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা জিনিস পত্র গুলো একটা একটা করে ছুড়লাম। কিন্তু পাখিটা এক চুল পরিমানও নড়লো না। গ্ৰিলে লেগে সবগুলো নিচে পড়ে গেল।
আচম্বিতে আওয়াজ পেয়ে ছুটে এলো অরিশ ভাইয়া। দরজার দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বেই লাফ দিয়ে বেডের উপরে উঠে গেলাম। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম ভাঁজ করে রাখা ব্লাঙ্কেট টা মেলে নিলাম। সেটার ভেতরে একদম ঢুকে বসে রইলাম। ফাঁক দিয়ে চোখ বের করে ভাইয়ার কাজ কর্ম দেখলাম।
অরিশ ভাইয়া এসে সবগুলো জিনিস গুছিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলেন। পানি গুলো মুছলেন। সন্দিহান স্বরে বলল,
-” তরী! তোর রুমে পানি এলো কি করে?”
উত্তর দেওয়ার জন্য কদাচিৎ হাঁ করতেই খক খক করে কেশে উঠলাম। তবুও ব্লাঙ্কেট সরালাম না। কারন, অরিশ ভাইয়া বারবার গোসল করতে বারণ করেছে। কিন্তু আজ হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরেছি। শরীর থেকে মেডিসিনের গন্ধ আসছে। অরিশ ভাইয়া ধমকে বললেন,
-” তরী! মাথা তোল?”
তবুও তুললাম না। ধৈর্য হারা হয়ে অরিশ ভাইয়া নিজেই ব্লাঙ্কেট সরিয়ে দিলেন। চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছি। ততক্ষণে আমার জামা ভিজে ব্লাঙ্কেট, চাদর ভিজে গেছে। পুনরায় আবার ধমকে উঠলেন,
-” তোকে গোসল করতে বারণ করেছি না আমি? আমার কথা অমান্য করেছিস ঠিক আছে, চুল মুছিস নি কেন?
-” টাওয়াল কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না তো!” ঠোঁট উল্টে বললাম।
মুখ কালো হয়ে গেল আমার। অরিশ ভাইয়া নিরবে হাসলেন। কাবার্ড থেকে টাওয়াল বের করে চুল মুছে দিলো। অতঃপর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে দিল। দুই গাল টেনে বলে,-” আমার ডিঙিরানী দিন-দিন ডিঙির মতো ফুলে ফুলে যাচ্ছে।”
-” তাই বুঝতে!
আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখল। কানের লতিতে কামড় দিয়ে বলে,
-” উম!”
অপূর্ব ভাইয়ার প্রবেশ ঘটলো। তার হাতে ফটো ফ্রেম। তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
-” তরীর সাথে আমার কথা আছে!”
অরিশ ভাইয়া উঠে যেতে চাইলে অপূর্ব ভাইয়া নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। ফ্রেম টা আমার হাতে দিলেন। চমকে উঠলাম ভিশন। আমি একনজর ছবির দিকে তাকিয়ে অপূর্ব ভাইয়ার দিকে চাইলাম। কৌতূহল নিয়ে বললাম,
-” এটা তো ভাইয়া আর আমার ছবি। ভাই যাওয়ার আগে সাথে নিয়ে গেছিলো। এটা তোমার কাছে কি করছে?”
-” কারণ আমিই তোর তারুণ্য ভাই!”
ফ্রেমটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে শব্দ হলো মৃদু। চোখের কার্নিশ গড়িয়ে জলকণা ঝড়লো। অরিশ ভাইয়ার দিকে জিজ্ঞাসু চাওনি দিলাম। সে হেঁসে সায় দিলেন আমায়। অবিকল সেই ছোটবেলার মতো দেখতে। ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আওড়ালাম, “কেন এতো দিন আমার থেকে দূরে ছিলে ভাইয়া?” তারুণ্য ভাইয়া এতো দিন আমার কাছে ছিলো। কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারি নি। ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরলেন দৃঢ় করে। গালে হাত রেখে বললেন,
-” কাদিস না খুকি। তোর ভাইয়া তো চলে এসেছে! আর এই লুকোচুরি থাকবে না আমাদের মাঝে, আজ তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিবো। ”
তারুণ্য ভাইয়া কিয়ৎক্ষণ চুপ করে রইলেন। আমার পাশে বসে বুকে জড়িয়ে নিলেন আমায়। মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে শুরু করলেন,
-” বাংলাদেশ ত্যাগ করে অন্যদেশে পাড়ি জমাই। মেডিকেলে ভর্তি হই। ভালোই চলছিলো পড়াশোনা। তবে সবকিছুর মাঝে তোদের কে খুব মিস্ করতাম। এমনি এমনি কেটে গেল কয়েক মাস। প্রায়ই মামা টাকা পাঠাতো। কিন্তু প্রতিবার টাকা চাইতে কেমন অস্বস্তি হতো। তাই একটা লাইব্রেরীতে কাজ নেই। পার্ট টাইম কাজ করতাম। এভাবেও কেটে গেল মাস দুই। হঠাৎ একদিন একটা মেয়ে এলো। ধাক্কা খেল আমার সাথে। লাল জামা পরিহিতা। মেয়েটা বাংলাদেশী ছিলো। আমার দিকে দূর থেকে চেয়ে থাকতো। আমি কাজের ফাঁকে মেয়েটাকে খেয়াল করতে পারি নি। একবারও দেখি নি। এর পর থেকে প্রায়ই আসতো। প্রতিবার বই খুলে দূর থেকে চেয়ে থাকতো। আমাকে দেখা শেষ করে চলে যেত।
তারপর কিছুদিন মেয়েটা এলো না। আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুলের দিকে চেয়ে থাকতাম। কারণ তাই আমি মিস্ করতে শুরু করি।
দিনটা ছিল সোমবার। বর্ষণমুখর সন্ধ্যা। জনশূন্য হয়ে গেছে রাস্তা ঘাট। লাইব্রেরী বন্ধ করে হোস্টেলে ফিরব আমি। তখন দেখতে পেলাম মেয়েটি একটি টুলে বসে কাঁদছে। কেন জানি খুব কষ্ট হলো। হয়তো দেখতে দেখতে এমন হয়েছিল। এগিয়ে গেলাম মেয়েটির দিকে। কাঁধে হাত রাখতেই মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে কেঁদে দিয়েছিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, তার জীবনের কথা। তার নাম ছিল আভা। আভার মা ছোটবেলায় মারা গেছিলো। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলো। বছর ঘুরতেই তার বাবা মারা যায়। দেশে ছেড়ে বিদেশে চলে আসে। শুরু হয় আভার উপর অত্যাচার। সেদিন আভাকে প্রচুর মেরেছিল, তাই কাঁদছিল।
আমাদের বন্ধুত্ব হলো।
তারপর থেকে প্রতিদিন আভা আসতো। তার সব কষ্টগুলো আমার সাথে শেয়ার করতো। একসাথে বসে কথা বলতাম। ঘুরতে যেতাম। ওর মনের সব ইচ্ছে গুলো পূরণ করার চেষ্টা করতাম। আমাদের বন্ধুত্ব টা আর বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ রইল না। ভালোবাসায় পরিণত হলো।
১৪ই ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আভার জোড়াজুড়িতে ঘুরতে বের হই আমরা। কাছাকাছি একটা ছোট পাহাড়ে। বাসে করে রওনা দিলাম। ভালোবাসা দিন ছিল বিধায় ভালোবাসার জুটি ছিল শুধু। পাহাড়ের উঁচু উঁচু পথ বেয়ে পৌঁছাই। সারাদিন আভা আমার ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে ছিলো। প্রথমবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিল। এতোটাই উত্তেজিত ছিলো খুশিতে আমার এই ডান গালে..
কিন্তু বেশিক্ষণ সেই হাসি স্থায়ী রইলো না। ফেরার পথে..
আর বলতে পারলো না তারুণ্য। তার গলা থেমে থেমে যাচ্ছে। কাঁপছে। অরিশ ভাইয়া এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। তারুণ্য গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করলেন। ফাঁকা গ্লাসটা বেডের উপর রাখলেন। পুনরায় বলতে শুরু করলেন,
-” ফেরার পথে নারীপাচার কারীদের কবলে পড়ি আমরা। ছেলেরা তার গার্লফ্রেন্ডকে বাসে রেখে পালিয়ে যায়। তারা সব মেয়েদের নিয়ে যায়। কিন্তু আমি তো তেমন প্রেমিক নই। আভাকে ছাড়তে রাজি নই। জোরজোরির পর্যাযে তাদের চক্রের মেন লিডারের গায়ে হাত তুলি। এটাই ছিলো আমার দোষ। আমাকে আধমরা করে বেঁধে রাখে। আভাকে আমার সামনে ধর্ষ..
তারুণ্য কেঁদে উঠলো। শব্দহীন সেই কান্না। তবে তার ভেতর টা পুড়ে যাচ্ছে। অরিশ তাকে সামলাতে লাগলেন। আমি কাতর চোখে তাকিয়ে রইলাম। নত স্বরে বললাম,
-” আভা কোথায় এখন!”
-“নেই!”
-” বুঝলাম, কিন্তু কোথায় আছে?”
নিজের পড়নের শার্টটা খুলে ফেললেন। দৃশ্যমান হলো পোড়া দাগ। পিঠের অবস্থা শোচনীয়। আগুনে পুড়লে এমন হয়।
-” আগুনে পুড়ে মারা গেছে আমার আভা।”
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)