বাইজি কন্যা পর্ব ১৯+২০

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_১৯
মুনতাহার চিৎকার, জেবার অস্বাভাবিক উচ্চরব বাড়ির প্রতিটি সদস্যই শুনতে পেলো৷ মুনতাহা জ্ঞান হারালেও জেবা জ্ঞানে ছিলো তাই তার চেঁচামেচি, কান্নাকাটিতেই পুরো বাড়ির পরিবেশ বদলে গেলো। কাজের লোক থেকে শুরু করে অরুণা,শবনম সহ প্রেরণাও ছুটে এলো। প্রথমে তারা থমকালো মুনতাহা’কে জ্ঞানহীন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। অনেকেই ধারণা করে নিলো হয়তো শরীর খারাপ তাই মুনতাহা জ্ঞান হারিয়েছে। জেবার স্বভাব সম্পর্কে সবাই অবগত তাই স্বাভাবিক ঘটনা ভেবেই সকলে এগিয়ে এলো। অরুণা ব্যস্ততার সঙ্গে এসে মুনতাহাকে ধরলো। প্রেরণাকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
-‘ হেরে ছোট বউ এবার কি সুখবর টুখবর পাবো নাকি! ‘
তখনি জেবা হাত উঁচিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,
-‘ ননদিনী…’
জেবার হাত সই সকলেই সোজা জানালা দিয়ে ঘরের ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ফ্যানের সাথে রোমানা’কে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে কেউ ‘ওমাগো’ কেউ ‘হায় হায় ‘ কেউ ‘আল্লাহরে কি সর্বনাশ ঘটলো!’ বলে চিল্লিয়ে ওঠলো। অমন লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে একটি প্রাণও স্বাভাবিক থাকতে পারলো না। নিমিষেই চিৎকার, চেঁচামেচি, ক্রন্দনধ্বনিতে ছেঁয়ে গেলো পুরো পাঁচফোড়ন গৃহ। ওদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী ছিলো শবনম। তাই সকল’কে রেখে সেই প্রথম ছুটে গেলো। কিন্তু ভিতর থেকে দরজা লাগানোতে ভিতরে প্রবেশ করতে পারলো না। কয়েকজন কাজের লোক দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করলো, কয়েক জন ছুটে গেলো বাড়ির অন্যান্য সদস্য’কে খবরটা জানাতে। আর দু’জন কাজের মহিলা মুনতাহা’কে তার রুমে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অরুণা’কে সাহায্য করলো। জেবা এককোণে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। সহজসরল পাগলাটে স্বভাবের মেয়েটা বেহুঁশের মতো কাঁদছে। তার ক্রন্দনধ্বনি শুনতেই কি ভয়ানক লাগছে যেনো এই কান্নায় কারো মৃত্যু শোকের চেয়েও ভয়ানক শোক প্রকাশ পাচ্ছে। অলিওর চৌধুরীর স্বপ্নের গৃহের চারপাশে যেনো আজ শুধু অভিশাপের সুর।
আচম্বিত শোকাভিভূত হয়ে গেলো জমিদার বাড়ি। প্রথমে বাড়ির প্রতিটি সদস্য, তারপর পুরো গ্রামের মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লো শোক সংবাদটি। আশেপাশের প্রায় চার,পাঁচ গ্রামের মানুষদের মাঝেও ছড়িয়ে গেলো। বাড়ির কাজের মহিলা আর শবনম মিলে রোমানার লাশ নামিয়ে গায়ে কাপড় ঢেকে দিলো। পল্লব চৌধুরী শহরে তাই তার ফিরতে বেশ সময় লাগবে। অলিওর চৌধুরী, পলাশ চৌধুরী, প্রণয় চৌধুরী, রঙ্গন চৌধুরী সকলেই বাড়িতে উপস্থিত হলো৷ অঙ্গন কোথায় আছে কেউ জানেনা। বাড়ির এই ভয়ানক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য অলিওরের পাশে দাঁড়ালো পলাশ এবং প্রণয় চৌধুরী। ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে, ওঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে অলিওর চৌধুরী, দু’পাশে তার দুই ছেলে পলাশ এবং প্রণয়৷ রঙ্গন বড়ো ওঠানের এক কোণে মাথা নিচু করে ভূমিতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাড়ির ছোট সদস্য হওয়াতে সকল ঝড় থেকে সে রক্ষা পেয়ে যাবে। কিন্তু যে প্রাণটি তাদের থেকে চিরজীবনের জন্য হারিয়ে গেলো তাকে কি ফিরে পাবে? কঠিন পীড়ায় বক্ষঃস্থল ক্রমাগত চূর্ণবিচূর্ণ হতে শুরু করলো রঙ্গনের। আপনমনে বার বার একটি প্রশ্নই জেগে ওঠলো, কেন সে পালিয়ে গেলো? কেন সে সাহস করে থেকে গেলো না। থাকলে অন্তত আজ রোমানা এই পরিস্থিতির স্বীকার হতো না।

পৃথিবীতে ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি যে অনুভূতি কখনো সুখে বুক ভরিয়ে তুলবে, কখনো এক বুক দহনে হৃদয়’কে দগ্ধ করে তুলবে।ভালোবাসা যেমন তোমাকে গড়ে তুলবে আবার তেমনি ধ্বংসও করে দেবে। ভালোবেসে এক বুক দহনে দগ্ধ হয়ে নিজেকেই ধ্বংস করে দিলো রোমানা। কিন্তু আফসোস রেখে গেলো গুটিকয়েক মনে। বাবা,ভাই’কে অভয় দিয়ে রোমানার কক্ষে পা বাড়ালো প্রণয় কিন্তু তাকে কে অভয় দেবে আজ? রোমানার মৃত্যু তাকে ঠিক কতোখানি নাড়িয়ে দিয়েছে কাকে বোঝাবে সে? এতো সুন্দর মনের একটি মানুষ’কে এতো সহজে, এতো তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলবে তা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি প্রণয়। কেমন যেনো হাঁসফাঁস লাগছে। রোমানার কক্ষ থেকে বেশ দূরে কাজের লোক,জন বসে কান্না করছে। ফাঁসির মরা বলে অনেকে ভয়েই ভিতরে যাচ্ছে না। কক্ষের ভিতরে শবনম ছাড়া শুধু দুটো কাজের মেয়েকে দেখলো প্রণয়। জানালার বাইরে বসে জেবা কাঁদছে। সমস্তটা বুঝে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। গুরুগম্ভীর প্রণয় চৌধুরীর পরিবর্তে আজ এক অন্য প্রণয়কে দেখলো শবনম। তার বিক্ষিপ্ত চেহেরাটি দেখে ডুঁকরে কেঁদে ওঠলো সে৷ আর্তনাদের সুরে বললো,
-‘ ভাই গো এটা কি হয়ে গেলো!’
প্রণয় ধীরপায়ে এগিয়ে এসে রোমানার নিথর দেহের পাশে হাঁটুগেড়ে বসলো। এমন কঠিন মূহুর্তে কঠিন মানুষ’টি একটি হাত বাড়িয়ে রোমানার ললাটে হাতের তালু চেপে ধরলো, ধীরে ধীরে সে হাতটি নিচের দিক নামিয়ে উল্টে যাওয়া দু’টি চোখ বন্ধ করে দিলো৷ তারপর ঘাড় বাঁকিয়ে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শবনমের দিকে, প্রখর সে দৃষ্টিজোড়ায় শীতলতা মিশিয়ে, কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
-‘ ভাবি ওদের নিয়ে বাইরে যান। ‘
সকলকে নিয়ে শবনম বেরিয়ে গেলো। প্রণয় এবার তার শীতল দৃষ্টিজোড়া নিক্ষেপ করলো রোমানার বিধ্বস্ত মুখশ্রী’তে। ক্ষণকাল সে মুখে তাকিয়ে থেকে একহাতে পুরো মুখ বুলিয়ে দিলো৷ তারপর একটু মাথা নিচু করে রোমানার কপালে চুমু খেলো। একটি হাত চেপে ধরে বললো,
-‘ এ পৃথিবী’তে আমি আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ক্ষমাটুকু তোমার কাছে চাইলাম রোমানা,আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও তোমাকে ভালোবাসতে না পাড়ার জন্য, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও তোমার পাশে না থাকার জন্য। ‘
কথাগুলো শেষ করে রোমানার মাথায় হাত বুলিয়ে ওঠে পড়লো৷ আশপাশে সচেতন দৃষ্টি ফেলে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলো। যা খুঁজ ছিলো তা পেয়ে চাপা একটি নিঃশ্বাসও ত্যাগ করলো। কক্ষের একপাশে থাকা টেবিল থেকে ত্বরিতগতি’তে রোমানার লেখা শেষ চিঠিটি নিয়ে নিজের কাছে অতিগোপনে রেখে দিলো৷ রোমানা হয়তো তাকে শেষ কিছু কথা বলে গেছে। সে কথাগুলো সকলে জেনে গেলে গতরাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাও সকলের সামনে প্রকাশ পেয়ে যাবে। যে মেয়েটা আর নেই সেই মেয়েটার জীবনে ঘটে যাওয়া অঘটনটুকু,সর্বনাশটুকু, লজ্জাটুকু আর কেউ না জানুক। আমাদের সমাজটা এমন যে রোমানার আকস্মিক মৃত্যু’তে তারা যতোটা সমবেদনা জানাবে তার জীবনে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনাটুকু জানতে পারলে ধারালো ভাবে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়েও নেবে। হয়তো ঘরের লোকেরাই বলবে, এমন কলঙ্ক নিয়ে মরে যাওয়াই উচিৎ। অমন কলঙ্কিনীর স্থান এই জমিদার বাড়িতে হতে পারেনা! ‘

প্রেরণা বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে। ওদিকে মুনতাহার অবস্থাও সুবিধার নয়৷ জেবাও স্বাভাবিক নেই। অরুণা আর শবনম মিলে সবটা সামলাচ্ছে। এমন অবস্থায় অলিওর চৌধুরীর কাছে খবর এলো, রোমানার বাবার বাড়ির সদস্যরা গেটের বাইরে ভাঙচুর করছে, গ্রামবাসীরাও ক্ষেপে গেছে তাদের ভিতরে আসতে না দেওয়ার জন্য৷ জমিদার বাড়ির লোকজনদের আচরণেই তারা সন্দেহ করছে রোমানা সত্যি আত্মহত্যা করেছে নাকি তাকে খুন করা হয়েছে? গ্রামবাসীদের মনে এমন সন্দেহ ঢুকিয়েছে রোমানার চাচা’রা। রোমানার চাচারাও তাদের ভাতিজির আকস্মিক আত্মহত্যা মেনে নিতে পারেনি। তাই ছুটে এসেছিলো এটা জানতে কি কারণে এমনটা ঘটলো। কিন্তু এসে দেখলো জমিদার বাড়িতে বাইরের একটি সদস্যকেও ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না৷ এতেই তাদের মনে বিরাট সন্দেহ বাসা বাঁধলো। সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসী ভাই’কেও ফোন দিয়ে সবটা জানালো। অলিওর চৌধুরী’কে যখন রোমানার বাবা ফোন দিয়ে হুমকি দেয় তখনি অলিওরের চৈতন্য ফেরে। আজ যদি পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে না যেতো এই হুমকি সহ্য করতোনা সে। কিন্তু পরিস্থিতিতে পরে দাঁতে দাঁত চেপে সবটা হজম করলো। বাইরের মানুষদের সঙ্গে ক্ষমতার জোরে লড়াই করা যায় কিন্তু নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে লড়াই করাটা খুব কঠিন। কারণ এখানে মিশে থাকে আবেগ,ভালোবাসা,শ্রদ্ধা, স্নেহ। তাছাড়া রোমানাও তাদের ভীষণ আদরের,স্নেহের,ভালোবাসার৷ ফাঁসির মরা,আত্মহত্যা, পুলিশ কেস হবেই। তারওপর রোমানার বাবার বাড়ির লোকজন তাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে তাই উপায় না পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো অলিওর। প্রণয় বাবাকে ধরে বললো,
-‘ বাবা চিন্তা করবেন না সবটা সামলে নেবো আমি।’
এদিকে পলাশের মাথায় কূটবুদ্ধি ভর করলো। সে কাউকে কিছু না বলে কারো সহায়তা না নিয়ে রোমানার কক্ষে ঢুকে পুনরায় রোমানা’কে শাড়ি দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলো। এদিকে গেট খুলে দেওয়ায় গিজগিজে মানুষ ছুটে ভিতরে প্রবেশ করলো। প্রণয় পলাশের কর্মকাণ্ডে বাঁধা দেওয়ার সুযোগটুকুও পেলো না। পলাশ তাকে ধমক দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-‘ ফাঁসির লাশ পুলিশ ছাড়া নামাতে হয় না। মাতব্বরি করে নামাইছে, এখন যদি পুলিশ এসে বলে আমরা মেরে ফেলে বলতাছি একাই মরছে,তখন কি হবো আমাদের বিশ্বাস করবো? কিন্তু এই ঝুলা দেইখাই বিশ্বাস করবো যে ফাঁসি দিয়ে নিজেই মরছে। ‘
গ্রামবাসী’রা একে একে প্রত্যেকে গিয়েই রোমানার লাশ দেখতে লাগলো। সকলেই ‘আহারে’ সূচক সমবেদনা জানালো৷ রোমানার চাচারা অলিওর’কে চেপে ধরলো। সমানতালে হুমকি দিতে শুরু করলো,
যদি এর পিছনে তারা কেউ জড়িত থাকে প্রত্যেক’কে কোমড়ে দড়ি বেঁধে জেলে নিয়ে যাবে৷ একদম ফাঁসিতে ঝুলিয়েই মারবে সকলকে! যদিও প্রেরণার অবস্থা, বাড়ির সকলের অবস্থা দেখে কিছুটা হলেও সন্দেহ কমলো তবুও অনেকে স্বস্তি পেলো না।
[২৬]
লাশ স্পর্শ করা নিষেধ, সকলেই অপেক্ষা করছে পুলিশ আসার জন্য৷ বিষয়গুলো পুলিশ অবদি পৌঁছাতোই না যদি রোমানার চাচারা এসে হানা না দিতো৷ গ্রামবাসীরা সকলেই একবার করে লাশ দেখে যাচ্ছে। সকলে প্রকাশ্যে হায় হুতাশ করলেও ভিতরে ভিতরে ঠিক সন্দেহ করছে,কেউ কেউ আবার ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। গ্রামের একজন মহিলা তো বলেই ফেললো,
-‘ আহারে মেয়াডা আত্মহত্যা করলো, জানাজাও পাবো না সারাজীবন জাহান্নামের আগুণে পুইড়া মরণ লাগবো। ‘
কেউ বললো,
-‘ খালি কি জানাজা গোরস্তানেও জায়গা পাবো না৷ ‘
সকলের এমন কথাবার্তা শুনে রঙ্গন ধমক দিলো। রঙ্গনের ধমক খেয়ে মুখটা বেশ কাচুমাচু করে সরে গেলো মহিলারা৷ সন্ধ্যার দিকেই শারমিন সহ বাইজি গৃহের সকলেই খবর পেয়েছে রোমানার আত্মহত্যার। কিন্তু ভিতরে সবাই যেতে পারছে,লাশ মেয়েদের সকলকেই দেখতে দিচ্ছে এই খবর পাওয়া মাত্রই সকলে সেখানে যাওয়ার জন্য শারমিনের কাছে অনুমতি চাইলো৷ শারমিন প্রথমে অনুমতি দিলো না। কিন্তু যখন শাহিনুর কান্নায় ভেঙে পড়লো, আর বললো,
-‘ আম্মা ঐ আপাটা খুব ভালো। আমাকে খুব আদর করতো ঐ যে একদিন ফুল চুরি করতে গেলাম সেদিন ঐ আপা আমাকে আর সখী’কে অনেক আদর করছে। ও আম্মা আমি আপারে দেখতে যাবো। তোমার দুইটা পায়ে পড়ি আম্মা আমারে যাইতে দেও। ‘
শাহিনুরের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত রাজি হলো শারমিন৷ এবং সিদ্ধান্ত নিলো সে নিজেও যাবে সকলের সঙ্গে। বাইজি গৃহের সকলেই পাঁচফোড়ন গৃহে প্রবেশ করলো। আজ আর কারো কোনদিকে খেয়াল নেই৷ আজ আর নেই কোন বিধিনিষেধ। শারমিনের হাতটি শক্ত করে চেপে ধরে বেশ জড়োতা নিয়ে গৃহের ভিতরে প্রবেশ করলো শাহিনুর৷ মায়ের হাত ধরেই প্রথম পা রাখলো জমিদার বাড়ির সদর দরজায়। শারমিন,শাহিনুর সহ সকলেই যখন রোমানার কক্ষে প্রবেশ করলো,তখন কয়েকজন মহিলা পুলিশ রোমানাকে নামিয়ে গলা থেকে শাড়ি খুলছে। হঠাৎ বাইজি চুমকি শারমিন’কে নিচু স্বরে বললো,
-‘ আপা ফাঁসির মরায় তো চোখ উল্টাই থাকে। এর তো চোখ উল্টায় নাই এইডা আসলেই আত্মহত্যা তো? ‘
এহেন কথাশুনে শাহিনুর একটু উঁচু গলায়ই বললো,
-‘ আম্মা এই আপারে কি কেউ মাইরা ফালাইছে! ‘
ভারী বর্ষণের মাঝে আচম্বিত যেমন বজ্রপাত ঘটে ঠিক তেমনি শাহিনুরের বলা কথাটি সকলের কর্ণকুহরে বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত করলো । বিস্ফোরিত কয়েক জোড়া দৃষ্টি পড়লো মা, মেয়ের ওপর। শারমিন’কে নিজ গৃহে দেখে অলিওর অবাক হলো, কেমন যেনো অদ্ভুত এক শক্তিও পেলো। পলাশ আর প্রণয়ের দৃষ্টি স্থির হয়ে রইলো শাহিনুরের নিষ্পাপ মুখশ্রীতে। মহিলা পুলিশ’দের মধ্যে একজন ওঠে এসে শাহিনুরের কাঁধে হাত রাখলো,প্রশ্ন করলো,
-‘ কেন তোমার এমন কথা মনে হলো কেন তুমি কি কিছু জানো? ‘
শাহিনুর অবুঝ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে এক পলক চেয়ে আবার মহিলা পুলিশের দিকে তাকালো। বললো,
-‘ ফাঁসিতে মারা গেলে নাকি চোখ উল্টে থাকে আপার তো চোখ উল্টায়নি। ‘
তরতর করে সুস্পষ্ট ভাবে কথাগুলো বলতেই সকলের হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠলো। শাহিনুরের বক্তব্য শুনে প্রণয়ের পুরো শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেলো। তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে একবার পাশে মেজো ভাই পলাশের দিকে তাকালো। কিন্তু শারমিন আঁতকে ওঠে শাহিনুরের একটি হাত চেপে ধরলো৷ আশপাশে সচেতন দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেলো, পলাশ চৌধুরী কুৎসিত ভাবে,হিংস্র ভাবে, তীব্র ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার নুরের দিকে।
#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_২০
যে বিষয়’টা খুব সহজে নিজেরা মিটিয়ে নিচ্ছিলো সে বিষয়টা খুবই জটিল রূপ ধারণ করলো। শাহিনুরের সহজ মনে করা প্রশ্নটি পাঁচফোড়ন গৃহের প্রতিটি সদস্যের মনে মারাত্মক শঙ্কা বয়ে আনলো। পলাশ চৌধুরী শাহিনুরের স্নিগ্ধ মুখশ্রী’তে, স্বচ্ছ দৃষ্টিজোড়ায় নিজের সর্বনাশ ব্যতিত অন্য কিছুই দেখতে পেলো না। তার সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠলো। মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে ওঠলো কেবল একটি বাক্যই ‘এই মেয়ে’কে শিঘ্রই নিজের আয়ত্তাধীন করতে হবে! ‘ বাবা,ভাইয়ের দিকে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকিয়ে বললো,
-‘ আব্বা, ঐ শালির মেয়েরে আজ আমি…’
বাকিটুকু বলার আর সুযোগ পেলো না। এটুকু বলতেই দিক বেদিক চিন্তা না করেই সকলের সামনে ঠাশ করে পলাশের গালে এক চড় বসালো অলিওর। বাড়ি ভর্তি লোকজন বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো৷ ভয়ে গুটিয়ে গেলো পুলিশ অফিসার নিজেও৷ অলিওর চৌধুরী’র ক্ষমতা সম্পর্কে সকলেই বেশ অবগত । শহরের বিশিষ্ট শিল্পপতি, বড়ো বড়ো নেতাদের সাথে হাত আছে তার। সমানতালে দেশে বিদেশে বড়ো বড়ো শিল্পপতিদের সঙ্গে ব্যবসায়ে সফলতা অর্জন করছেন। ধন,সম্পদ, ক্ষমতায় তার থেকে বলবান বা তার সমানে সমানও গ্রামে,উপজেলায় বা জেলায় আর একটিও নেই। দশটা খুন করলেও সেটা ধামাচাপা দেওয়ার মতো ক্ষমতা, কূটবুদ্ধি কোনটারই অভাব নেই তার। সবটা জেনেও এদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো তদন্ত করতেই হবে। সকলের অবস্থা যখন জীর্ণশীর্ণ তখন পলাশ গালে হাত দিয়ে রক্তিম বর্ণ চোখে বাবার দিকে তাকালো, ক্রোধান্বিত কন্ঠে হুংকার ছড়লো,
-‘ আব্বা…আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন! আমার উদ্দেশ্য সফল হতে যতো সময় লাগবে ততো হিংস্র হবো আমি, ঠিক ততোটাই নৃশংসরূপে সফলতা অর্জন করবো আমি হুহ। ‘
এটুকু বলেই স্থান ত্যাগ করলো পলাশ। তীব্র ক্রোধে শরীরের রক্ত টগবগ করছে তার৷ বাবার প্রতিই বেশী ক্ষিপ্ত হয়েছে কারণ বাবা না থাকলে আজ শারমিন বাইজি,আর তার মেয়ে দু’টোই হাতের মুঠোয় থাকতো তার। পলাশ চলে যেতেই অলিওর চৌধুরী বড়ো একটি দম ছাড়লো তারপর প্রণয়ের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো,প্রণয় চোয়ালজোড়া শক্ত করে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অলিওর প্রণয়কে অমন অবস্থায় দেখে বললো,
-‘ তুমিও কি ওর মতো মূর্খতা করবে? ‘
-‘ আপনার কি মনে হয় আব্বা? ‘
বাবার দিকে না ফিরেই দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্নটি করলো প্রণয়। অলিওর বললো,
-‘ পল্লবের পর যদি আমি কাউকে বিশেষ ভরসা করি সে এক তুমিই। ‘
-‘ তাহলে নিশ্চিন্ত থাকুন, রোমানার মৃত্যু’তে আপনারা কেউ দায়ী না। তাই এই ঘটনার জন্য কোন প্রকার ভোগান্তিও আপনাদের পোহাতে দেবো না। ‘
কথাগুলো শেষ করেই এক পলক শাহিনুরের দিকে তাকালো প্রণয়, পরোক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

অত্যন্ত কৌশলে রোমানার চাচাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করলো প্রণয়। তারাও মানতে বাধ্য হলো যে, রোমানা আত্মহত্যাই করেছে। অলিওর চৌধুরী’র কোন কন্যা সন্তান নেই। বোনের মৃত্যুর পর প্রেরণা বহু শখ করেই রোমানাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। নিজের ছেলেদের থেকেও বেশী আদরে মানুষ করেছেন রোমানা’কে। প্রণয়’কে রোমানা ভালোবাসে বলে বাগ্দানও সেরে ফেলেছেন। কিছুদিন পরই তাদের বিয়ে হবার কথা ছিলো। কিন্তু তার পূর্বেই কি নিয়ে হতাশ হলো রোমানা? কেউ বুঝতে পারলো না। শেষে ধারণা করা হলো,ছোট বেলায় মা মারা গেছে,বড়ো হওয়া অবদি আজ পর্যন্ত নিজের বাবা’কে পাশে পায়নি। এসব নিয়েই হয়তো গভীর চিন্তা করতে করতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। আর সে হাতাশাই তাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছে। মেয়েটা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ কিনা… ঠিক এমন ধারণাই সকলের মস্তিষ্কে চাপিয়ে দিলো প্রণয়। যুক্তি দিয়ে,বুদ্ধি দিয়ে,কৌশল খাঁটিয়ে নিজের পরিবার’কে বাঁচাতেও সক্ষম হলো। আবার পরম আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কও অটল রাখলো। মোটা অংকের টাকা খাওয়িয়ে পুলিশও বিদায় করলো। পুলিশ বিদায় হওয়ার পর ধীরে ধীরে মানুষ জন কমতে শুরু করলো। এতোক্ষণ অতিরিক্ত ভীড় থাকায়,পুলিশের বৈঠক থাকায় কেউ বাড়ির বাইরে যেতে পারেনি।ভীড় কমতে থাকলে শারমিন সিদ্ধান্ত নিলো এবার সে চলে যাবে। তাই শাহিনুরের হাত শক্ত করে চেপে ধরে আগাতে লাগলো সদর দরজার দিকে। তখনি পিছন থেকে শুনতে পেলো,
-‘ না না ফাঁসিতে মরা মানুষ গোসল করাতে পারমুনা আমার ডর করে। ‘
সহসা চরণদ্বয় থামিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো শারমিন৷ দেখতে পেলো অরুণা তাদের বাড়ির কাজের মহিলা সহ,গ্রামের মহিলাদের বলছে,তারা যেনো রোমানা’কে শেষ গোসল করাতে সাহায্য করে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো কেউ রাজি হলোনা। শবনম অরুণা ব্যতিত একটি মানুষও রোমানা’কে গোসল করানোর জন্য এগিয়ে এলো না৷ এমন নির্মম দৃশ্য সইতে না পেরে মান্নাত সহ বাকি বাইজিদের দিকে তাকালো শারমিন। বললো,
-‘ তোদের মধ্যে একজন থাকবি আমার সাথে বাকিরা নুর’কে নিয়ে বাইজি গৃহে ফিরে যাবি। ‘
শারমিনের আদেশ পেয়ে মান্নাত থেকে গেলো। বাকিদের সঙ্গে বাইজি গৃহে ফিরে গেলো শাহিনুর৷ মেয়ে’কে বিদায় দিয়ে শারমিন আর মান্নাত অরুণার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে অরুণার বুকের ভিতর মৃদু কেঁপে ওঠলো। এতো ভীড়ের মাঝে এতোক্ষণ সে খেয়াল না করলেও এবার সুস্পষ্ট ভাবে শারমিন’কে দেখে কেমন যেনো গুটিয়ে গেলো। শারমিন তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
-‘ ভয় পাবেন না বড়ো ভাবি, আমি আপনাকে সাহায্য করার জন্যই এগিয়ে এসেছি। ‘
অরুণা আশপাশে সচেতন দৃষ্টি বুলিয়ে শারমিনের একটি হাত চেপে ধরে কিছুটা দূরে নিয়ে গেলো৷ ফিসফিস কন্ঠে বললো,
-‘ এভাবে সকলের সামনে বড়ো ভাবি বলছো কেন? এই করুণ দিনে তুমি রসিকতা করতে আইসো না। ‘
মৃদু হেসে শারমিন বললো,
-‘ জমিদারের বড়ো গিন্নি আপনাকে অসহায় মুখে দেখতে ভালো লাগলো না, অলিওর চৌধুরী’র বড়ো গিন্নি’কে কি সামান্য কাজের লোকের কাছে অনুরোধ করা মানায়? মানায় না, তাইতো ছুটে এলাম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। ‘
-‘ এক বাইজির থেকে সাহায্য নেবো? তোমার মতো বাইজির করুণা নিতে হবে আজ আমাকে? ‘
চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে ওঠলো শারমিনের। সিনা টান করে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অরুণার দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘ এই বাইজি’কে আপনার স্বামী মন,প্রাণ দিয়ে বসে আছে। যে স্বামী ঘরে দু’টো বউ রেখে পাঁচটি সন্তান রেখেও এক বাইজির ভালোবাসা পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন কাঙালের মতো অপেক্ষা করছে, এই বুড়ো বয়সে এসেও, সে স্বামীর ঘর কি করে করছেন!’
শারমিনের উচিৎ জবাবে কোন উত্তর খুঁজে পেলো না অরুণা। সারাটারাত পেরিয়ে তখন ফজরের আজান দিচ্ছে। অরুণা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শারমিনের বুকে দাউদাউ করে অগ্নি জ্বলছে তবুও সে শান্ত কন্ঠে আবার অরুণা’কে বললো,
-‘ জমিদার গিন্নি আর অপেক্ষা করবেন না। এবার মেয়েটার গোসলের ব্যবস্থা করুন। আমরা আমাদের গৃহে ফিরে যাব শিঘ্রই। ‘
নিয়তির খেলা বড়োই অদ্ভুত। যে গৃহে বাইজিদের প্রবেশ নিষেধ ছিলো আজ সে গৃহে অনায়াসে তারা প্রবেশ করেছিলো। আশ্চর্যজনক ভাবে পাঁচফোড়ন গৃহের চরম বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো শারমিন৷ এ খবর অনেকেই জানলো,আবার অনেকের কাছে গোপনও রইলো। শারমিন বাইজি গৃহের সদস্য ছাড়াও তার গোপন পরিচয়টুকু অলিওর,প্রেরণা আর অরুণা ছাড়া কেউ জানেনা৷ সকলেই এটুকু জানলো বাইজিদের সহয়তায় শেষমেশ গোসল করানো হলো রোমানা’কে। এই নিয়ে গ্রামবাসীরা কানাঘুষা করলো,
-‘ পাপিষ্ঠের শেষ কার্য পাপিদের দ্বারাই সম্পন্ন হলো!’
[২৭]
পাঁচফোড়ন গৃহের প্রতিটি সদস্যই ভেঙে চূরমার হয়ে গেলো তখন, যখন রোমানার জানাজা পড়ানোর জন্য মানুষ খুঁজে পাওয়া গেলো না। মসজিদের ইমাম সরাসরি অলিওর চৌধুরী’কে বললেন,
-‘ আমার নবী যাদের জানাজা পড়ায়নি তাদের জানাজা আমিও পড়াবো না! ‘
(হজরত জাবের ইবনে সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এর সামনে আত্মহত্যাকারী এক ব্যক্তির লাশ আনা হয়, রাসুল (সা.) তার জানাজা পড়েননি।)
নিরুপায় হয়ে প্রণয় খুব রিকোয়েস্ট করে তার এক শৈশব বন্ধু যিনি পাশের গ্রামের মসজিদে ইমামতি করেন তাকে নিয়ে এলো। কিন্তু হতভাগিনীর জানাজা নামাজে নিজেদের লোকজন ছাড়া তেমন কেউ অংশগ্রহণও করলো না। শেষ ধাক্কাটা এতোটাই প্রখর ছিলো যে প্রণয়ের দৃষ্টি’তে রক্ত টগবগিয়ে ওঠেছিলো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা,দুনিয়ার নিষ্ঠুরতায়, সৃষ্টিকতার কাছে, পুরো দুনিয়ার কাছে পাপীষ্ঠ হয়ে জমিদার বাড়ির জঙ্গলের এক কোণে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে ঠাঁই হলো রোমানার। গোরস্থানেও তাকে জায়গা দেওয়া হয়নি। দুনিয়া’তেই এমন ভয়ংকর পরিণতি দেখে হৃদপিণ্ড অস্থির হয়ে ওঠলো প্রণয়ের। রোমানার এই পরিণতি মেনে নিতে বক্ষঃস্থলে তীব্র ব্যথার সঞ্চার হলো।

সকাল দশটা। শোকের তীব্র ছায়ায় পাঁচফোড়ন গৃহ আচ্ছন্ন হয়ে আছে৷ একদিকে রোমানার মৃত্যু অপর দিকে অঙ্গনের চিন্তা। সব মিলিয়ে প্রেরণার অবস্থা খুবই খারাপ। প্রণয় অনেক চেষ্টা করেও অঙ্গনের খোঁজ করতে পারেনি। এদিকে, অঙ্গন দূরবর্তী স্থানে গিয়ে দীর্ঘ একটা সময় একা কাটিয়ে শেষে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো৷ সিএনজি’তে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ শেষ করে নিজের এলাকায় পা ফেললো অঙ্গন। আশপাশের পরিচিত অনেকেই তাকে সালাম দিলো, অনেকে স্বান্তনা বাণী দিলো,অনেকে প্রশ্ন করলো, সে কোথায় গিয়েছিলো? অস্বস্তি হলো,বিরক্ত লাগলো হঠাৎ একটু বেশীই কদর করছে তাকে লোকজন৷ তাই চোখমুখে বিরক্তি ফুটিয়ে গুটিকয়েক জনের দিকে তাকালো। তারা ভয়ে,বিব্রত হয়ে সরে গেলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। অকস্মাৎ একজন বলে ফেললো,
-‘ আহারে মেয়েটা অকালে চলে গেলো। ‘
এটুকু কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই হাঁটা পা থেমে গেলো অঙ্গনের। পা থেকে মাথা অবদি কিছুটা কেঁপেও ওঠলো। বক্ষঃস্থলে মৃদু ধড়াস করে ওঠলো। এক ঢোক গিলে পাশ ফিরে ঐ ব্যক্তির দিকে তাকালো। যে ব্যক্তি কয়েকপল আগে উচ্চারণ করেছিলো,
-‘ আহারে মেয়েটা অকালে চলে গেলো। ‘
অঙ্গন কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ কে অকালে চলে গেলো? ‘
অপর ব্যক্তিটি বললো,
-‘ তুমি বাড়ির খবর জানোনা? ‘
অঙ্গনের কপাল বেয়ে ঘাম নিঃসৃত হতে লাগলো। হাঁসফাঁস কন্ঠে বললো,
-‘ কি হয়েছে? ‘
পাশ থেকে আরেকজন বললো,
-‘ হায় আল্লাহ গো অঙ্গন ভাই সর্বনাশ হয়ে গেছে। তুমি কই ছিলা কাল থেকে,রোমানা আপা আর নাই গো ভাই, ফাঁসি দিয়া মইরা গেছে রোমানা আপা। ‘
কঠিন কোন বস্তু দ্বারা আকস্মিক ভাবে মাথায় আঘাত পেলে মানুষের মস্তিষ্ক যেমন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়,’ফাঁসি দিয়া মইরা গেছে রোমানা আপা’ এটুকু বাক্যতে ঠিক অমনভাবেই অঙ্গনের মস্তিষ্ক চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো৷ ভূমিকম্পের ন্যায় পুরো পৃথিবী ঘুরতে শুরু করলো, চারদিকে নেমে এলো ঘনীভূত আঁধার। নিমিষেই সকলের চক্ষের সম্মুখে অত্যন্ত নিবিড় ভাবে ঘুমিয়ে লুটিয়ে পড়লো ভূমিতলে অঙ্গন। কিন্তু যে অঙ্গন চৌধুরী সকল’কে সাক্ষী রেখে ঘুমালো সে অঙ্গন চৌধুরী আর জেগে ওঠলো না৷ ঠিক বারো ঘন্টা পর হাসপাতালের কেবিনে জ্ঞান ফিরলো নতুন অঙ্গন চৌধুরীর। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে নয় প্রণয় চৌধুরী সহ আরো কয়েক জন ডাক্তারের দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলেই জ্ঞান ফিরেছে তার। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর পাশে শুধু প্রণয়’কে দেখে অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে অঙ্গন প্রশ্ন করলো,
-‘ ভাইয়া আমার রোমানা? আমার রোমানা কোথায়?’
বিস্মিত হলো প্রণয়৷ পরোক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে অঙ্গনের মাথায় হাত বুলালো। বললো,
-‘ অঙ্গন সত্যিটা মেনে নেওয়ার চেষ্টা কর। মেয়েটা অভিমান করে আমাদের সকলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ‘
প্রণয় কথাগুলো শেষ করা মাত্রই অঙ্গন আশপাশে এলোমেলো দৃষ্টি বুলালো। স্যালাইন চলছিলো তার, হাতের রগ থেকে টেনে সুঁচ খুলে অকস্মাৎ প্রণয়’কে আক্রমণ করলো, মাথায় প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে কামড়েও ধরলো। এমন আক্রমণাত্মক পরিস্থিতি’তে সর্বচ্চ শক্তি খাঁটিয়ে অঙ্গন’কে নিজের থেকে ছাড়ালো প্রণয়। তারপর চিৎকার করে নার্সদের ডাকলো। নার্সরা এসে অঙ্গন’কে ধরতেই প্রণয় ত্বরিতগতি’তে একটি ইনজেকশন পুশ করে দিলো। প্রায় দশমিনিট জবরদস্তি চলার পর অঙ্গন ঘুমিয়ে পড়লো৷ প্রণয় রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে বিক্ষিপ্ত চেহেরা নিয়ে কেবিন থেকে বের হলো। কেবিনের বাইরে রঙ্গন দাঁড়িয়ে ছিলো। এমন কঠিন সময়ে রঙ্গন’কে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে বললো,
-‘ পারলাম না রঙ্গন, আমি শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। অঙ্গনের এই সত্যি টা আমি আম্মা’কে কোন মুখে বলবো। রোমানার মৃত্যু, অঙ্গনের মানসিক অসুস্থতা কীভাবে সহ্য করবে আম্মা? ‘
পাঁচফোড়ন গৃহে সর্বপ্রথম অলিওর চৌধুরী জানতে পারলো অঙ্গনের খবর। রোমানার মৃত্যু শোক হয়তো দিন পেরোলে, মাস পেরোলে, বছর গড়ালে কাটিয়ে ওঠতে পারবে। কিন্তু চোখের সামনে অঙ্গনের এই পরিণতি কি করে সহ্য করবে সে ? শতহোক অঙ্গন তার নিজের ছেলে! বক্ষঃস্থল চেপে ধরে বিছানায় বসে পড়লো অলিওর চৌধুরী। প্রণয়ের কাছে খবর গেলো, মা,ভাইয়ের পর এবার তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে এখুনি বাড়ি ফিরতে হবে তাকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here