#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২২]
__________
টিমটিমে লাইটের আলোয় রক্তাক্ত দেহখানি পড়ে আছে ওয়াসিমের।মাথাটা বিভৎস ভাবে থেতলে আছে।ইনান খুটিয়ে খুটিয়ে লাশটা দেখতে ব্যস্ত তার পাশেই মিহি থরথর করে কাঁপছে।ইনান আস্তানার অন্য একটি রুমে প্রবেশ করে।সেই রুমের পাশেই একটি ওয়াশরুম।দ্রুত ওয়াশরুমে প্রবেশ করে ছেলেটি হাত মুখ ধুয়ে নেয়।আয়নায় নিজের ক্লান্ত ছাপের মুখটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বেশ কিছুক্ষণ পর তার ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস পাওয়া যায়।আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে বলে,
– মামু আমায় রাজনীতির একটা পর্যায় শিখেয়েছে যেখানে আমাকে হতে হবে স্বার্থপর, পাষাণ।এতদিন এই বিষয়গুলো নিয়ে আফসোস করলেও আজ কিঞ্চিৎ পরিমানেও আফসোস হচ্ছে না।একটু পর যা হবে ভালোর জন্য হবে।অন্তত এই ক্ষেত্রে পাষাণ হয়ে মস্ত বড়ো উপকার হলো আমার।
ইনান থামে, দেয়ালের সাথে হাত ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ে।নিজের ভেতরটায় কেমন বিবশ হয়ে আসছে।নিজের সাথে নিজেই হিসাব মেলাতে পারছেনা সে।আয়নার সামনে আবারো ঘুরে তাকায় ছেলেটি।ভালো ভাবে দৃষ্টি রেখে আপন মনে বলে,
– লিসেন ইনান তুই তো ওয়াসিমকে মারিস নি।তাহলে তোর দোষ আসার প্রশ্নই আসেনা।তাছাড়া একটি পবিত্র মেয়েকে অপবিত্র করেছে সেই শাস্তিত তাকে পেতেই হবে।আমাকে এমন একটা কাজ করতে হবে যেখানে ওয়াসিম মৃত এটাও কেউ জানবে না।মিহি ধ’র্ষি’তা এটাও কেউ যানবেনা।
ইনান মুখে হাত দিয়ে থেমে যায়।তর্জনির আঙুল দিয়ে কপাল ঘষে বেশ রোষ নিয়ে বলে,
– কুত্তার লেজ কখনো সোজা হয় না।তবে যাই করেছিস একটা দিক দিয়ে তুই ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত,তোর কারনেই আমি ইতিবউয়ের দেখা পেয়েছি।তোর কারনে যে মেয়েকে মা’রতে আমি দীর্ঘ দেড় মাস পরিকল্পণা করেছি আজ আবার তাকে বাঁচাতে তোর লাশ গুম করবো আমি।এক ঢিলে তুই পাখি মারার বুদ্ধিটা তোর কাছ থেকে শিখেছিলাম রে।
.
একটি চেয়ারে বসে নিশ্চুপ কাদঁছে মিহি।তার পাশে এসে দাঁড়ায় ইনান।মিহির মাথায় হাত রেখে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলে,
– মিহি এখন যা হবে তা আমাদের সবার জন্য ভালো।তোমার আমার ইতিকা কিংবা সবার জন্য।দেখো ওয়াসিম আর বেঁচে নেই এটা জানাজানি হয়ে গেলে পুলিশের তদন্তে তোমার নাম জড়িয়ে যাবে।তাছাড়া তোমার সাথে যা হয়েছে সেই অন্যয়টা কেউ দেখবে না বরং ওয়াসিমকে মারার দায়ে তোমারে হেরেসমেন্ট করবে সবাই।
– ত..তবে আমি এখন কী করবো ভাইয়া?নিজের উপর নিজেরি ঘৃণা হচ্ছে বেঁচে থাকার মতো কোন পর্যায় আমার কাছে নেই।
মিহির কথায় রুষ্ট হলো ইনান।হাত উচিতে মেয়েটিকে ধমক দিয়ে বল,
– যা হয়েছে সব ওয়াসিমের দোষ তোমার তো তাতে কোন দোষ নেই।নিজেকে অপরাধী ভাবা বন্ধ করো।আর এখন যা হবে তা যেন কেউ না জানে একদম কেউ না।আমার ফ্রেন্ড তোমার মা-বাবা কাউকে কিচ্ছুটি বলবে না।
মিহি নিশ্চুপ মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।মূহুর্তেই ইনানের চোখে মুখে হিংস্রতার আভাস পাওয়া যায়।
কিছু সময় পর আস্তানায় মধ্যে বয়স্ক একজন লোক প্রবেশ করে।যার চেহারায় উষ্কখুষ্ক ভাব।ভড়ভড় করে বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে মদের গন্ধ।ইনান তাকে দেখে এগিয়ে গেলো।
– অজয় বাবু কেমন আছেন?
– আরে কর্তা যে হঠাৎ এই আস্তানায়?কার লা’শ কাটতে হইবো খালি কন আমারে।তয় আপনি তো কখনো কোন লা’শ কা’টানোর নির্দেশ দেন না।যা কাটায় সব বাহরুল কর্তার নির্দেশে করা হয়।আইজগা আপনার তলব পাইয়া আমি সত্যি চমকে গেছি।
লোকটা হেলেদুলে কথাটি বলে পিটপিট চোখ করে তাকায় ইনানের দিকে।ইনান সৌজন্য মূলক হাসি হেসে হাত ঘড়ির দিকে তাকায়।রাত প্রায় সাড়ে আড়াইটা বেজে গেছে।
– অজয় বাবু ওই যে লা’শটা দেখতে পারছেন ছেলেটাকে তো আপনি চেনেন?
– আরে ও…ওয়াসিম না?ওর কি হইছে কর্তা?
– ওয়াসিম আর নেই।আপনাকে একটা অফার করছি লাশটা কেটে আমাদের নদীর পাড়ে যে চিতা আছে সেখানে নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন এবং সব কাজ গোপনে করতে হবে।কাজটা শেষ করলে দশ লক্ষ টাকা পাবেন।আপনি জানেন আমি কথার খেলাপ করি না।
ইনানের এমন প্রস্তাবে শিউরে উঠলো মিহি।ইনানের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।অপর দিকে অজয় বাবু এমন একটা প্রস্তাব পেয়ে তার দু’চোখ চকচক করে উঠে।যার কাজ লা’শ কাটা তার কাছে ওয়াসিমের লা’শ কা’টা নিতান্তই তুচ্ছ কাজ আর এই কাজের জন্য দশ লক্ষ টাকা পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা তার।
– আপনি চিন্তা কইরেন না কর্তা আমি লা’শটা কাইটা গোপনে চিতায় নিয়ে যাবো কেউ কিচ্ছুটি জানবে না।এমন কী বাহরুল কর্তাও না।আর আস্তানা থেকে বাইর হওনের আগে সব পরিষ্কার কইরা রাখমু কেউ কিচ্ছু বুঝবো না।
ইনান একচিলতে হাসি দিয়ে ইশারা করলো অজয় বাবুকে মূহুর্তেই তিনি টানতে টানতে ওয়াসিমের লা’শটা অন্য একটি রুমে নিয়ে যায়।মিহি ধড়ফড়িয়ে এসে ইনানকে হালকা করে ধাক্কা দেয়।
– প..পাগল হয়ে গেছেন আপনি ভাইয়া?ওয়াসিমের লা’শ কাটবেন চিতায় নেবেন।
– এটা ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই।তুমি যদি ঘাবাড়ে যাও শক্ত না হও আমারো আর কিছু করার থাকবে না।আরেকটা কথা মাথায় রেখো ওয়াসিমকে আমি মারিনি মেরেছো তুমি!সম্পূর্ণ দোষ তোমার উপর পড়বে।
মিহি থেমে গেলো।কোন এক গোলক ধাধায় সে পিষে মরছে।পুড়ে যাচ্ছে তার অন্তঃকরণ।
.
বিষণ্ণ রাত্রি।শ্বশান ঘাটের সামনে উপস্থিত ইনান এবং মিহি।আকাশের বিদ্যুত চমকানিতে বিদঘুটে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।শ্বশান ঘাটের পাশে বেশ কয়েকটি কুকুর হাক পরিবেশটা আরো ভয়ংকর করে তুলছে।অজয় বাবু ওয়াসিমের লা;শটা একাই বহন করে ক্লান্ত হয়ে গেছেন।অতিরিক্ত মদ্য পানে দাঁড়িয়ে থাকার জো নেই।
– ক..র্তা এবার কী করবো পুড়িয়ে ফেলবো নাকি?
ইনান দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।চারিদিকের হিমেল হাওয়াতেও সে ঘামছে প্রচন্ড।জীবনে এমন একটি পরিস্থিতি আসবে কখনো ভাবেনি সে।তবে আজ যা হচ্ছে তা নিয়ে মোটেও অনুতপ্ত নয় ছেলেটি।
– না উত্তর দিকে যে জঙ্গলটা আছে সেখানে মাটি চাপা দিয়ে দাও।
– কি কইতাছেন কর্তা?লা’শটা যে ভাবে কাটছি কেউ বুঝবো না এটা কার লাশ যদি চিতায় পোড়ান তবে একদম সব প্রমান দূর হইয়া যাইতো।
– যা বলেছি তাই করুন অজয় বাবু।দ্রুত গর্ত করুন ফজরের আযান দিয়ে দেবে কিছুক্ষণ পর তখন কিন্তু ঝামেলা হয়ে যাবে।
অজয় বাবু বিনাবাক্য স্থান ত্যাগ করলো।দ্রুত মাটি খুঁড়ে ওয়াসিমের লা’শটা পুঁতে রাখে। মাটি চাপা দিয়ে পুরোনো গাছের ডাল, পাতা খড়কুটোর স্তুপ সাজায়।কেউ বিন্দু পরিমানেও সন্দেহ করতে পারবেনা এই জঙ্গলে কারো লা’শ পুঁতে রাখা হয়েছে।সবটা কাজ ইনান দক্ষ্য হাতে শেষ করে।অজয় বাবু ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘাটে ফিরে গেলেন।গায়ে লেগে থাকা র’ক্তের জামাটা খুলে অন্য একটি ব্যাগ থেকে নতুন জামা পড়ে ইনানের সামনে হাজির হয়।
– কর্তা সব কাজ শেষ চলুন এখান থেকে চলে যাই তবেই আর কেউ আমাদের সন্দেহ করতে পারবেনা।
– হুম আপনি আপনার মতো করে চলে যান।আর টাকাটা কাল সকালে পাঠিয়ে দেবো।এই নিন মদটা গলায় ঢেলে সব ভয় দূর করুন।
ইনান অজয় বাবুর দিকে একটি মদের বোতল এগিয়ে দিলেন।মূহুর্তেই লোকটির দুচোখ যেন চকচক করে উঠে।বোতলটি হাতে তুলে স্মিথ হাসেন।
নিরানন্দ পরিবেশটায় বজ্রপাতের শব্দ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।ওয়াসিমের মৃত্যুটা যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা মিহি।সে বাক্যহীন তাকিয়ে আছে মাথা নুইয়ে।ইনান তার অবস্থা বুঝতে পেরে শান্ত সুরে বলে,
– রিসোর্টে ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে যাবে।আর কাল যা যা হবে তাতে ভুলেও মুখ খুলবে না।নিজেকে স্থির এবং চুপচাপ রাখবে।বাকিটা আমি সামলে নেবো।
মিহি মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।ইনান পকেট থেকে ওয়াসিমের ফোনটা হাতে তুলে নেয়।তার ফোন থেকে প্রথমেই খুদে বার্তা পাঠায় সুফিয়ার উদ্দেশ্য।যেখানে লেখা ছিল,
” বিয়েটা আমি করতে পারবো না।এই মূহুর্তে দেশ ছাড়ছি আমি।ভালো থাকিস।”
সুফিয়ার নাম্বারে মেসেজ সেন্ড হতে দ্বিতীয় মেসেজটি করা হয় সাহাব উদ্দীনের নিকট।
“বাবা আমি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি।বিয়েটা করতে পারবো না নিজের যত্ম নেবে মায়ের খেয়াল রাখবে”
খুদে বার্তা পাঠানো শেষে ইনান সিমটা খুলে ভেঙ্গে ফেলে দেয় মাঝ পুকুরে।
.
ফজরের আযানের ধ্বনিতে মুখোরিত চারিদিক।রিসোর্টে ফিরে ইনান রুমে প্রবেশ করে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। গোসল শেষে গা এলিয়ে দেয় ইতিকার পাশে।ক্লান্ত শরীরটা বিবশ হয়ে দু’চোখ সহসা বন্ধ করে নিলো।
সবার চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গলো ইনান এবং ইতিকার।বাইরে চিৎকার দিয়ে কাঁদছে সুফিয়া।দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে সকাল আটটা বাজতে দেখে বিরক্তে মুখ কুচকে নেয় সে।ইতিকা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যেতে নিলেই ইনান পেছন থেকে হাত খামচে ধরে,
– কোথায় যাচ্ছেন ইতিবউ?
– বাইরে কেউ কাঁদছে ছাড়ুন আমায়।
– অপেক্ষা করুন আমিও আসছি।
– দূর ছাড়ুন তো।
ইতিকা ইনানের হাত ছাড়িয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়।তার বুকের ভেতরটায় দুরু দুরু করছে।বিয়ে বাড়ির ভরা মজলিশে কার কী হয়েছে ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।ইতিকা পৌছে সুফিয়াকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পায়।মেয়েটির মাথা কোলে নিয়ে কাঁদছে তার মা।পাশে দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর দৃষ্টিতে ওয়াসিমের বাবা মা।ভরা মজলিশে ছেলেটা মুখে চুনকালি লাগিয়ে কোথায় নিরুদ্দেশ হলো ভেবে কুল পাচ্ছেনা তারা।ইতিকা জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে নাসরিনের কাছে এগিয়ে আসে।
– আম্মা কী হয়েছে?আন্টিরা কাদঁছেন কেন?
– ওয়াসিম চলে গেছেরে মা।এই মেয়েটাকে এখন কে বিয়ে করবে এই মূহুর্তে।
– চলে গেছে মানে?
– ঘুম থেকে উঠে সুফিয়া একটি মেসেজ পায় যেখানে লেখা ছিল ওয়াসিম তাকে বিয়ে করতে পারবেনা।সে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।একই বার্তা তার বাবা মায়ের ফোনেও পাঠায়।
– হায় আল্লাহ কি বলছো এইসব।সুফু আপুর এখন কী হবে?
– সেটাই তো ভাবছি আমি।
অন্তঃকরণের ভেতরটা মুষড়ে উঠলো ইতিকার।ক্রদনরত সুফিয়ার স্বচ্ছল মুখখানা দেখে দু’চোখ ভিজে উঠলো।
অপরদিকে দরজায় হেলান দিয়ে সবার অবস্থা দেখছে ইনান।মিহির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চুপ থাকতে ইশারা করে সে।অলীদ ছুটে আসে ইনানের কাছে।
– এসব কী হচ্ছে?ওয়াসিম চলে গেছে এদিকে সুফিয়া সেন্সলেস হয়ে গেছে।
– কেন তোর কষ্ট হচ্ছে খুব?
– ফাজলামো করিস না ইনান।সুফিয়া আমাদের ফ্রেন্ড তার ভালো মন্দ দেখাত দায়িত্ব আমাদেরো আছে।
– ভালো মন্দ দেখার আমাদের দায়িত্ব ছিলো বলেই বার বার বারন করেছিলাম ওয়াসিমের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় নিয়ে চলতে কিন্তু সে সবটা ঘেটে ঘ করে দিয়েছে।সব কাজে ঘাড় ত্যাড়ামো মানায় না।সে কী অতিত ভুলে গেছে?এমন ধর্ষ……
– হিসস থাম ইনান।ভরা বাড়ি আস্তে কথা বল।সেটা অতীত ছিল।
ইনান থেমে গেলো মুখে যেন কুলুপএঁটে নিয়েছে।
ওয়াসিম কখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় তা দেখার জন্য রিসোর্টের সব সিসি ক্যামেরা চেক করে বাহরুল ইসলামের লোকজন।কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো রাত বারোটার পর সব সিসি ক্যামেরা গুলো অফ হয়ে যায়। যার কারনে ওয়াসিম কোন হদিস পাওয়া গেলো না।ইনান বিষটি নিয়ে প্রথমে ভয়ে থাকলেও পরবর্তীতে নিশ্চিন্ত মনে হাসতে থাকে।সবার সামনে সন্তপ্ত অবস্থায় থেকে মনে মনে বলে,
– মানুষ নিজের জালে নিজেই অদ্ভুত ভাবে ফেঁসে যায়।যেমনটা আজ তোর সাথে হয়েছে ওয়াসিম।সিসি ক্যামেরা অকেজো করেছিস মিহিকে তুলে আনতে কিন্তু দেখ মিহি আমি আমরা দুজনেই বেঁচে গেলাম কেউ যানলো না আমরা কখন বাড়ি ফিরেছি।আর কখন বেরিয়েছি।
_
সারাদিন গড়িয়ে রাত ফিরে এলো এখনো কেউ সিধান্ত নিতে পারেনি সুফিয়ার কী হবে?মেয়েটি ওয়াসিমকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেনা বলে জেদ ধরে বসে আছে।অপর দিকে সুফিয়ার বাবা মোস্তাফিজ ইনানের বাবার হাত ধরে নিশ্চুপ কেঁদে যাচ্ছে।তার কান্নায় ইনানের কাছে ফিরে এলেন ইব্রাহিম।
– কি রে কী করবো আমরা?সুফিয়া মেয়েটার জীবন এইভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমরা চুপচাপ শুধু কি দেখে যাবো?
-বাবা আমি আগেও এই মেয়েকে বারন করেছিলাম ওয়াসিমের মতো ঠকবাজ ছেলেকে বিয়ে না করাই উত্তম শুনেনি সে আমার কথা।
– যা হয়েছে তা শেষ এখন কী হবে সেটা নিয়েই ভাব।অলীদের সাথে যদি সুফিয়ার বিয়েটা হয় তবে কেমন হবে?
মূহুর্তেই প্রতিপন্ন হলো ইনান।হারানো প্রাপ্তি ফিরে পাওয়ার আনন্দে মাথা নেড়ে সায় দেয়।
– তুমি আঙ্কেলের সাথে কথা বলো বাবা।আঙ্কেল চাইলে অবশ্যই বিয়েটা হবে।
.
ভারী বর্ষণে গুমরা পরিবেশ।ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে যে যার রুমে ফিরে যায়।ওয়াসিমের সাথে এখনো যোগাযোগ করার সুযোগ পায়নি কেউ।এক প্রকার হু’মকি ধমকানি তে সুফিয়াকে বিয়েতে রাজি করান তার বাবা মা।অবশেষে অলীদের সম্মোতিতে বিয়েটা সম্পূর্ণ করা হয়।
রিসোর্টের বিশাল বড় ছাদহীন চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে অলীদ।সুফিয়ার রুমে ঢোকার মত সাহস আজ সে পাচ্ছেনা।বিয়ের পর নব বধূর হাতে দু’টো চড় তার গালে পড়ে গেছে।এগুলো ভাবা যায়!কবুল বলার ঘন্টা খানেক পর বউয়ের হাতে ঠাস ঠাস করে দু’টো চড় গালে পড়বে তাও কাঁদতে বারন করায়।
ঘাড়ে কারো হাতের স্পর্শে চমকে তাকায় সে।ইনানকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে।
– এত রাতে এখানে কী অলীদ?আজকের আবহাওয়াটা সুন্দর।বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাক অতীতের আত্মগ্লানী।যা রুমে যা।
– যাওয়া যাবে না সুফু মারবে।
‘মারবে’ শব্দটা শুনেই ভ্রু কুচকায় ইনান।
– মারবে মানে?কী বলছিস এইসব।
অলীদ চুপসে যায়।ইনান তার অবস্থা বুঝতে পেরে আশ্বাস সুরে বলে,
– মারবে না।তুই চুপচাপ রুমে যা আগে।মানিয়ে নে দোস্ত।মেয়েটা যে বোকামি করেছে তুই এখন বুঝিয়ে দে সে ওয়াসিমের থেকেও বেটার কাউকে জীবনে পেয়েছে।
মূহুর্তেই অলীদের ঠোঁটের কোনে হাসি রেখা ফুটে উঠেছে।
.
ইনানকে খুঁজতে খুঁজতে বিরক্ত ইতিকা।বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ ছেলেটার দেখা নেই।অলীদেরো খোঁজ নেই সে নিশ্চই বউয়ের আচঁলে মুখ লুকিয়েছে।কারো দেখা না পেয়ে ইতিকা যখন রুমের যেতে নেয় তখনি দেখা হয় রাতুলের সঙ্গে।
– এই রাতুল ভাইয়া।
রাতুল ঘুরে তাকায় ইতিকাকে দেখে গাঢ় শ্বাস ছাড়ে।
– তোমাকেই খুঁজছিলাম ভাবী।ইনান ভাই বলেছেন তুমি যেন রুমে থাকো।তিনি একটু বাইরে বেরিয়েছেন।
– এই বৃষ্টির মাঝে বাইরে কেন গেলো?
– আমি জানি না।আসো ভাবী আজ একটু আড্ডা দিয়ে সময় কাটাই।অলীদ ভাই নেই আজ একা একা লাগছে।
রাতুলের কথায় সায় জানায় ইতিকা।মূহুর্তেই রাতুলের মাথায় শ’য়তানি বুদ্ধি খেলে যায়।বিড়বিড় করে আপন মনে বলে,
– শ্লা ধান্দা বাজ।একটা সময় তোর বউয়ের পেছনে না যেনে ঘুর ঘুর করায় আমাকে উত্তম-মাধ্যম কেলানি দিয়েছিস।আর এখন তোর বউয়ের সিকিউরিটি বানিয়েছিস আমায়!দাড়া আজ নাস্তানাবুদ করে ছাড়বো তোকে।
_
ভারী বর্ষণের সাথে সাথে আকাশের হাক ক্রমশ বেড়ে চলছে।ইনান রিসোর্টে নিজের রুমে ফিরে আসে।অন্ধকার রুম দেখে বেশ খানিকটা অবাক হয় সে।লাইট জ্বালাতেই চোখের সামনে গোচর হয় উবু হয়ে শুয়ে থাকা ইতিকার মুখ।রুমের চারিদিকে উটকো গন্ধ নাকে আসতেই ভ্রু কুচকে যায় তার।
– ইতিবউ?এই ইতিবউ?
– উহহ
– এই মেয়ে মদ গিলেছিস তুই?কোথায় পেলি মদ?
ইনানের ধমকে চোখ পিটপিট করে তাকায় ইতিকা।
– আমায় আপনি তুই করে বলছেন?বকছেন কেন আমায়?
– ইতিবউ এইসব ছাইপাঁশ কেন গিলেছেন? কে দিয়েছে আপনাকে এইসব।
– বলবো না।
– নাটক করছেন আমার সাথে?
– না বলবো না।
– দুটো চড় লাগিয়ে সব ভং চং ছুটিয়ে দেবো।
– আপনি আমায় মারবেন?আমি চলে যাবো ওয়াসিমের কাছে।
ইতিকা নেশার ঘোরে কথাটি বলে মুখ গোমড়া করে রাখে।ইনান তার মেয়েটির হাত টেনে বক্ষপিঞ্জরে জড়িয়ে ধরে।
– ওয়াসিমের কাছে যাবে মানে?ওয়াসিম এখন কবর বাসী।তার কাছে আমি তোমায় কিছুতেই যেতে দেবো না।
– উহহ ছাড়ুন।
– আমি ধরেছি বলে আজ বেঁচে গেছো ইতিবউ।যদি আমি এখনো আমার দৃঢ়তা ভালোবাসা নিয়ে জড়িয়ে না রাখতাম তোমায় তবে তুমিও খসে যেতে নোলকের মতো।
– এই আপনার চোখে পানি কেন?
ইতিকা ইনানের গালে হাত ছুঁয়ে দেয়।ইনানের চোখের পানি বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে মুছে বুকে মাথা রেখে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।
– তোমাতে আসক্ত হওয়ার আগে আমি অন্য একজনের মায়ায় পড়েছিলাম ইতিবউ।আর সেটা নিতান্তই আমার অতীত।সেই অতীতের রোষ ধরেই আজ এত কিছু।সময়টা আমরা যখন নতুন কলেজে উঠলাম।আমার সাথে ওয়াসিম,সুফিয়া,অলীদ।আমরা চার বন্ধু ছিলাম এক সুতায় এক টানে।আমাদের বাড়ির ড্রাইভার চাচার মেয়ে নোলক।টাকার অভাবে তার পড়াশোনা বন্ধ প্রায়।যেহেতু আমাদের বাড়িতে কোন মেয়ে নেই তাই বাবা মায়ের মেয়েদের প্রতি আলাদা টান ছিল।সুফিয়াকেও খুব আদর করতেন তারা।মা দায়িত্ব নিলেন নোলকের পড়াশোনার।আর সেই সূত্রে নোলক আমাদের বাড়ি থাকতো মাঝে মাঝে।নোলক ছিল ফর্সা নজর কাড়া সুন্দরী।যে কেউ তার প্রতি সহযে আকর্ষিত হতো।আমিও হয়েছিলাম তবে রুপে নয় তার কথার জাদুতে।সবার সঙ্গে মন ভুলানো হাসিতে কথা জমিয়ে রাখতো।তাকেও নতুন দশম শ্রেনীতে ভর্তি করা হলো সবটা ভালোই চলছিল আমিও দিন দিন নোলকের প্রতি দূর্বল হয়ে গেলাম।
অপরদিকে পাড়ার কিছু বাজে ছেলের সাথে ওয়াসিমের মেলামেশা বেড়ে যায়।এই নিয়ে তার সঙ্গে আমাদের বহুবার ঝগড়া হয়েছে কিন্তু ছেলেটি শোধরায় নি।পাড়ার সেই বাজে ছেলে গুলো নোলককে উত্ত্যক্ত করতো সুযোগ পেলেই।এই নিয়ে আমার সাথে তাদের অনেক বার ঝগড়াও হয়েছে।কেটে গেলো বেশ কয়েকমাস, ভালো মন্দ সব কিছু নিয়ে আমরা সুখেই ছিলাম কিন্তু ওয়াসিম সেই ভালোর মাঝে বিষ নিয়ে ফিরলো।সুযোগ বুঝে পাড়ার ছেলে গুলোর হাতে নোলককে তুলে দেয়।তারপর মেয়েটার সাথে চলতে থাকে পাশবিক নির্যাতন।সব ছেলে এবং ওয়াসিম সহ তাকে ধ’র্ষ’ন করে।সবটা জানাজানি হলে আমি যেন সব হারিয়ে ফেলেছিলাম।অন্ধাকার গহিনে হারিয়ে যাচ্ছিলাম বারংবার।তাদের বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে গিয়ে কোন লাভ হয়নি বরং মেয়ের শোকে স্ট্রোক করে মারা যান ড্রাইভার চাচা।এই বিষটি দাগ ফেলে দেয় অলীদ এবং সুফিয়ার মনে।তারপর থেকে আমারা আলাদা।
ইনান থেমে যায় তার গলা ধরে আসছে তবুও বিড়বিড় করে বলে,
– ওয়াসিমের স্বভাব চরিত্র খারাপ মেনে নিলাম তাই বলে সুফিয়াকেও তার জালে ফাসাবে।মেয়েটা বোকা ওয়াসিমের পাল্লায় পড়ছে।তারপর খোঁজ পেলাম ওয়াসিমের প্রেমিকা তুমি চাইলেই মেরে ফেলতে পারতাম কিন্তু মারিনি তার একমাত্র কারন আমি চেয়েছিলাম আমাকে আর তোমাকে দেখে ওয়াসিম জ্বলে পুড়ে যাবে।তাছাড়া নির্দোষ একটা মেয়েকে মারার মতো কলিজা এখনো আমার হয়নি।সব কিছুর উদ্ধে আমি তোমায় রক্ষা করতে পেরেছি এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া।
ইনানের গাল বেয়ে চিবুক থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।ইতিকা তার বুকের সাথে লেপ্টে অবচেতন অবস্থায়।ইনান তার কপালে অধঁর ছুঁইয়ে কিঞ্চিৎ হাসে।
– সত্যিটা তোমাকে জানতে হবে না ইতিবউ।এমন কি ওয়াসিম কোথায় আছে তার হদিসো কেউ জানবেনা।কেননা সব প্রমান ভ্যানিশ করে দিয়েছি।
উক্ত কথাটি বলে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে ছেলেটি আর ভাবতে থাকে সেই বিষন্ন রাতের কথা।
তখন অজয় বাবুর হাতে যে মদের বোতলটি তুলে দেয় ইনান, তার সাথে বিষের মিশ্রণ ছিল।অজয় বাবু শ্বাশান ঘাট পার করে মদের বোতল মুখে দিয়ে বেশ কয়েক চুমুক গিলতেই মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন।তার মৃত্যুতে ওয়াসিমের লা’শকে টুকরো টুকরো করার সব প্রমান হারিয়ে যায়।আর রইলো বাকি মিহি।নিজেকে বাঁচাতে নিজ স্বার্থে কখনো মুখ খুলবে না সে। বিষটি খুব ভালো করেই জানে ইনান।
পৃথিবিটা স্বার্থের।প্রত্যকটা ভালোবাসার মানুষ আমার স্বার্থের।আমার স্বার্থের তাড়নায় আমি তাদের ভালোবাসি।
ইতিকার ঘুমন্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে ইনান দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।ললাটে অধর ছুঁয়ে বিড়বিড় করে বলে,
– তোমার জানা, শোনা, দেখার আড়ালেও অনেক কিছু দৃষ্টির অগোচরে ছিল।
#আগন্তুকের_আসক্তি
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৩]
__________
– মিহিকে এই বাড়িতে নিয়ে আসলে কেমন হয়?
প্রশ্নটি সহজ গলায় ইনান বললেও ইতিকার কানে যেন কথাটি শোনা মাত্রই বিস্ফোরণ
হয়েছে।গোল গোল চোখ নিয়ে বেশ অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকালো মেয়েটি।
– এমন করছেন কেন ইতিবউ?মিহিকে আমাদের বাড়িতে এনে রাখলে সমস্যা কোথায়?
– তাকে রাখবোই বা কেন?হঠাৎ মিহির জন্য দরদ উতরাই উতরাই পড়ছে কেন?
– বোকা মেয়ে আমি কী খারাপ কোন সিধান্ত নিয়েছি নাকি?আপনারা একসাথে থাকবেন, আমাদের বাড়িটাও জমাট হবে।সবাই মিলেমিশে একসাথে বাঁচার মাঝে আনন্দ আছে ইতিবউ!
ইনান কথাটি বলে পেয়ালায় চুমুক বসালো।তার ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস এখনো ছড়িয়ে আছে।ইতিকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে চোখ ছোট করে।শত হলেও ইনানের মুখে একথা মানায় না।
– এই কথা আপনার মুখে মানায় না ইফতিহার ইনান।
ইতিকা বেশ তেজ নিয়ে কথাটি বললো।হাতের পেয়ালাটা টি-টেবিলে রেখে শুধালো ইনান,
– মানায় না?কিন্তু কেন ইতিবউ?
– আব্বা-আম্মাকে ছেড়ে আপনি এক বছর আলাদা ছিলেন।তখন কী আপনার কোন পরিবার ছিল?নাকি এত উল্লাস ছিল?রাতে নেশায় বুদ হয়ে পড়ে থাকতেন আর দিনে মারামারি, মিটিং,মিছিলে যোগদান এটাই তো ছিল আপনার জীবন।
– তখন তো আমার জীবনে আপনি ছিলেন না ইতিবউ।
ইতিকা ফস করে শ্বাস ছাড়লো।ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখে হাতে চিরুনি তুলে নিলো।আপন মনে চুল আছড়াতে ব্যস্ত সে।ইনান যে তার দিকে তাকিয়ে আছে ঘোরে সেদিকেও দৃষ্টি রাখলো না মেয়েটি।
– ইগ্নোর করছেন আমায়?
– না তো।
– মনে তো হচ্ছে ইগ্নোর করছেন।
– যদি করি তবে কী করবেন শুনি?
ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।ইতিকাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ডোবালো।
– আমাকে ইগ্নোর করে লাভ নেই ইতিবউ।এইজীবনে আমার বাবা ছাড়া কেউ আমায় ইগ্নোর করে শান্তি পায়নি।আপনিও পাবেন না।বাবার সাথে অতীতে তো কথাই বলতাম না দুজন দুজনকে ইগ্নোর করে চলতাম।
– বাবা মায়ের প্রতি এত অনাদর আসে কী করে আপনার?যদি আমার মতো এতিম হতেন তবেই বুঝতেন কেউ তো আর দাঁত থাকতে দাঁতের মজা বুঝেনা।
– আমার জীবনের সেই স্বচ্ছ দর্পন আপনি যে আমার ভালো – মন্দের ঘোলাটে আয়নাটা ভেঙ্গেচুরে স্বচ্ছ দর্পনে মুখ দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন।
ইতিকা স্মিথ হাসে।ইনানের হাতের তালুতে শব্দ করে চুমু খায়।
.
দিন দিন শরীরটা নুইয়ে পড়ছে ইব্রাহিমের।আগের মতো চঞ্চল চিত্তে চলাফেরা নেই তার।বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই কাটান।পুত্র বউয়ের আদর শাসন যত্নে বেশ ভালো কাটছে তার দিন।ব্যবসার দায় ভার সবটা পড়েছে ইনানের উপর।ছেলেটাও একা হাতে সবটা সামলে নিচ্ছে নিখুঁত ভাবে।নিজের সংসারের এমন সুখ দেখলে মাঝে মাঝে আফসোস হয় বছর খানিক আগে এই সুখ কেন আসেনি?হাতের পত্রিকাটা রেখে চায়ের পেয়ালা তুলে দিলেন ইব্রাহিম।এক চুমুক মুখে তুলতেই বিরক্তে দু’চোখ কুচকে নেন।বেশ রাগ নিয়ে হাঁকডাক দেন নাসরিনের উদ্দেশ্য।
– এই ইনানের মা তোমায় আমি বলেছিলাম চায়ে একটু হলেও চিনি দেবে।আর তুমি কি করলে?এই চা মুখে তোলার অযোগ্য।
নাসরিন রান্না ঘর থেকে একবার দেখে নিলেন ইব্রাহিমকে।নিত্যদিন সকালে তাদের চায়ের চিনি দেওয়া বিষয়টি নিয়ে ঝগড়া শোরগোল লেগে যায়।তাই প্রতিদিনের মতো আজকেও তিনি চুপচাপ হজম করছেন।চায়ের পেয়ালাটা রেখেব বিড়বিড় করে আপন মনে বকতে লাগলেন ইব্রাহিম।
– আমার ভালো কেউ দেখে না।সবাই আমার বিরোধিতা করছে।এই চা মুখে নিলেই আমার সারাটা জীবন বৃথা মনে হয়।
– আব্বা চিনি আপনার জন্য বিষ!আপনি কী বার বার বিষয়টা ভুলে যান?
ইতিকার গম্ভীর প্রশ্নে চোখ তুলে তাকায় ইব্রাহিম।মেয়েটা কোমড়ে হাত গুজে বড়ো বড়ো চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।যেন পান থেকে চুন খসে গেসে।
– আমি ভুলে যাবো কেন?সব মনে আছে তারপরেও এই চা আমি মুখ তুলতে পারছিনা রে মা।
ইতিকা ইব্রাহিমের পাশে বসে যায়।জড়িয়ে ধরে তার বাম হাত,মাথা এলিয়ে দেয় বাহুতে।
– আব্বা আপনাকে বাচঁতে হবে, সুস্থ হতে হবে।আমাদের জন্য অন্তত।তাই আমাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা আপনার কতর্ব্য।
ইব্রাহিম বেশ যত্ন করে ইতিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।চায়ের পেয়ালায় চুমুক বসিয়ে তৃপ্তি সহকারে তা পান করেন।
– তুই আমার ঘরের চন্দ্রমণি।আমার ঘরের আলো তুই।তোর কথা আমি ফেলতে পারবো না।
মূহুর্তেই টেলিভিশনের একটি নিউজে চোখ আটকে যায় ইব্রাহিমের।ব্রেকিং নিউজ হিসেবে হেডলাইনটি বেশ বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা।
” বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা কর্মী সাহাব উদ্দীনকে তার নিজ বাসভবন থেকে আটক করেছে র্যাব।তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ মাদক পাচার সহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।”
নিউজটা দেখে ইব্রাহিম বাকরুদ্ধ হয়ে যান।ইতিকা তার চাহনী লক্ষ্য করতেই অবাক হয়ে যায়।মুখ দিয়ে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে,
– ওয়াসিমের বাবা গ্রেফতার!
বাক্যটি কর্ণকুহুরে ঠেকতেই এগিয়ে এলেন নাসরিন।তার চোখে মুখে বেশ খুশির ঝলক দেখা গেলো।
– দেখলে ইনানের বাপ সত্যর জয় হয়।অনেক জালিয়ে খেয়েছে এরা।ব্যবসা সম্পত্তি কোন কিছুতেই শান্তি দেয় নি এরা।আর আজ নিজেরাই ফেঁসে গেলো।
– সবটা তো বুঝলাম কিন্তু একবছর পূর্ণ হতে চলেছে ওয়াসিমের কোন খোঁজ খবর পাওয়া গেলোনা।পুলিশ কেস করেও কোন তথ্য মেলেনি।ছেলেটা হঠাৎ কোথায় নিরুদ্দেশ হলো।
ইব্রাহিম বেশ চিন্তিত মুখে কথাটি বলেন।ইনান পেছন থেকে কথাটি শুনে বাকা হাসে।মনে মনে বলে,
– যা হয় ভালোর জন্য হয়।আর যা করেছি ভালোর জন্য করেছি।
.
– এই দ্রুত উঠ আর ঘুমিয়ে থাকিস না।সকাল এগারোটা বাজে।
সুফিয়ার ধাক্কায় ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে অলীদ।পিট পিট চোখ করে তাকায় তার দিকে।মেয়েটির এলোমেলো চুল মুখ ছুঁয়ে পড়ছে।চোখে মুখে পড়ে আছে বিরক্তির রেষ।
অলীদ খপ করে তার হাত জড়িয়ে ধরে হেঁচকা টেনে বিছানায় ছুড়ে ফেলে।সুফয়ার গলায় মুখ ডুবিয়ে আবারো ঘুমের ভান করে শুয়ে যায়।
– অলীদ ছাড় আমায়।এখন রোমান্স করার সময় নয়।বাবা বাজার পাঠিয়েছেন।আজ বুয়া আসবে না।সবটা আমাদের করতে হবে।
অলীদ শুনলো না বরং আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো সুফিয়াকে।সুফিয়া বিরক্ত হয়ে ছেলেটার চুল টেনে ধরে আকস্মিক ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে অলীদ।
– আহ!মেরে ফেলবি আমায়?একটু আদর করতে গেলেও তোর গাঁইগুঁই শুরু হয়।
– কাজ আছে অলীদ উঠ প্লিজ। বাবা এক গাদা বাজার পাঠিয়েছেন।মাছ – মাংস সবটা কেটেকুটে পরিষ্কার কিন্তু আমাদের করতে হবে।
অলীদ উঠে বসে বিরক্তে কপাল কুচকে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।সুফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বেশ জোরে জোরে বকতে থাকে এবং দ্রুত ওয়াশরুমে চলে যায়,
– এই হিটলার শশুড় যার কপালে জুটবে তার আর শত্রুর প্রয়োজন হয়না।আজ অফিসের অফ ডে কই একটু ঘুমাবো বউ নিয়ে সময় কাটাবো তা না করে আমার বারোটা বাজাতে প্রস্তুত তিনি।ভাগ্যিস তোর বাপ, অন্য কারো বাপ হলে এতক্ষণে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তাম।
সুফিয়ার ললাটে ভাঁজ পড়ে।চোখ মুখ ছোট করে অলীদের হাতঘড়িটা হাতের সামনে পেয়ে ছুড়ে মারে।তৎক্ষনাৎ বিকট শব্দে ঘড়িটি ভেঙ্গে কাঁচ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।শব্দ পেয়ে ওয়াশরুম থেকে জোরকদমে ছুটে আসে অলীদ।সুফিয়ার আগুনের চুল্লির সদৃশ মুখটা দেখে চুপসে যায় ছেলেটি।
– এটা ঠিক করেছিস তুই?আমার কত প্রিয় ঘড়ি ভাঙ্গলি কেন?উনিশ থেকে বিশ হলেই তুই সব ভাঙ্গা শুরু করে দিস।আল্লাহ যানে কোন দিন আমায় গলা টিপে মে’রে ফেলিস।
অলীদ কথাটা বলেই দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে মূহুর্তেই আরেকটি কাঁচ ভাঙ্গার শব্দে মৃদ্যু কেঁপে উঠে।চোখ তুলে তাকাতেই দেখে তার ছোট্ট একুরিয়াম টা ভেঙ্গে মেঝেতে পড়ে আছে। মাছগুলো খলবলিয়ে থেমে যায়।নিভন্ত রাগটা মূহুর্তে মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে অলীদের।সুফিয়ার হাতটা টেনে ধরে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।সুফিয়াও কম যায় না পেছন থেকে অলীদকে কিল ঘুষি মেরেই চলেছে।
বার্থ টবে সুফিফার মাথা পানিতে চেপে ধরে অলীদ।সব রাগ আজ যেন সে মিটিয়ে নিচ্ছে।সুফিয়ার ছটফটানো দেখে মূহুর্তেই মাথা তুলে নেয়।নাকে মুখে পানি প্রবেশ করায় বেশামাল ভাবে কাশতে শুরু করে মেয়েটি।
– সরি সুফু তুই আমার রাগটাই বাড়িয়ে দিয়েছিস।নাক জ্বলছে?এই পানি খেয়েছিস নাকি বেশি?
সুফিয়া হেঁচকি তুলে কেঁদে উঠে।নাকের ভেতরটায় অসহ্যকর জ্বালছে।অলীদ দিশেহারা হয়ে পড়েছে।সুফিয়ার চুল,মুখ মুছে দাড় করায় কিছু বলার আগেই সুফিয়া তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।ক্রন্দন চোখে তাকিয়ে মূহুর্তেই বেরিয়ে যায় ওয়াশরুম থেকে।অলীদ মাথায় হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো নির্বেদ দৃষ্টিতে।
সুফিয়া আর অলীদের বিয়ে হয়েছে এক বছর হতে চললো।এই এক বছরে অলীদ অনুভব করেছে আগের সুফিয়া আর বর্তমানের সুফিয়ার মাঝে আকাশ পাতাল তফাত।আগের মেয়েটি ছিল শান্ত শিষ্ট চঞ্চল।আর বর্তমানে মেয়েটি রাগি রুক্ষ।সব সময় রগচটা মেজাজ নিয়ে পড়ে থাকে।তবে সে ভালোবাসায় বড্ড পোষ মানে।শত ঝগড়ার মাঝেও অলীদ আগলে নিলে সবটা ভুলে যায়।
সুফিয়ার বাবার ব্যবসার সিংহভাগ দায়িত্ব অলীদের।মোস্তাফিজ মেয়ে জামাইয়ের যত্নে কোন ক্রুটি রাখেন না।যখন যা প্রয়োজন সবটা না চাইতেই হাজির করেন।দুজনের মেলবন্ধন যেন রাজযোটক।
.
বছর ঘুরে আবার ফিরে এলো সেই বৃষ্টি।দেয়াল ঘড়ির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে চোখে পড়ে রাত বারোটা বাজতে আর মাত্র দুই মিনিট আছে।ব্যাস তখনি বিবাহিত জীবনের একবছর পূর্ণ হবে অলীদ এবং সুফিয়ার।কিন্তু বধূ রাগ করে মটকা মেরে শুয়ে আছে।অলীদ নিঃশব্দে প্রবেশ করলো তার রুমে।মেয়েটি যে ঘুমের অভিনয় করছে তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে।ছেলেটি রান্না ঘরে প্রবেশ করে দ্রুত চা বসায়।পানি ফুটতে অন্য পাত্র থেকে ঠান্ডা পানি হাতে ঢেলে চিৎকার করতে থাকে,এতটাই জোরের চিৎকার সুফিয়া দু’রুম দূর থেকে সবটা শুনতে পায়।
– ও মা হাত পুড়ে গেলো গো।আমার হাত….
সুফিয়া উঠে বসে অলীদের কিছু হলো ভেবে ছুটে চলে যায় কিচেনে।
– এই কী হয়েছে তোর?
– আমার হাত পুড়ে গেছে।
সুফিয়া এগিয়ে গেলো অলীদের হাত ধরতেই চোখ ছোট করে তাকায় তার দিকে।মেয়েটির চাহনী দেখে অলীদের ভেতরটা শুকিয়ে আসে নিশ্চই বুঝে গেছে সবটা।
– ঠান্ডা পানি ঢেলে এইসব নাটক করার মানে কী?আমার মান ভাঙ্গাতে এসেছিস?নাকি অন্যকিছু।
– আহ! আমার রূপবতী বউ, আমার গুনবতী বউ,আমার বুদ্ধিমান বউ সবটা বুঝে নিয়েছে তাইতো এত ভালোবাসি তোমায়!
– ভালো ভালো কথা বলে আমার মান ভাঙ্গাবি?
– তোমার কোন মান আছে নাকি?
অলীদের মুখ ফসকে কথাটা বের হয়ে যায়।দ্রুত গালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।সুফিয়া দ্বিমত না করে চুপচাপ রান্না ঘর ছেড়ে চলে যায়।মেয়েটির ঠান্ডা মস্তিষ্ক নিশ্চই কোন উলটা পাল্টাল কাহিনি আকঁছে।
অলীদ তার পেছন পেছন এগিয়ে গেলে সুফিয়া কোন কথাই বললো না।
– সুফু রাগ করেছিস?এত রেগে যাস কেন সবসময়?ভুলে যাস কেন আমরা ফ্রেন্ড আমাদের মাঝে আগেও ঝগড়া খুনশুটি হয়েছে।এখনো হবে তাই বলে এত বাযে রিয়েক্ট করার কোন মানে হয়না।আমার দিক থেকে আমি সরি।তখন মাথা ঠিক ছিল না তাই..
– ইটস ওকে।
– আয় কাছে আয় একটু আদর সোহাগ করে দি।আজ হুজুরের কাছ থেকে দোয়া শিখে এসেছি যেটা পড়ে ফুঁ দিলে বউরা লাঠির মতো সোজা হয়ে যাবে।
অলিদের কথা শুনে নিঃশব্দে হাসলো সুফিয়া।কাছে এসে জাপটে ধরে অলীদকে।অলীদ হাসিমুখ জড়িয়ে ধরে মেয়েটির কপালে অধর ছুঁয়ে দেয়।
– শুভ বিবাহ বার্ষিকী বউ।এইভাবে আরো আরো যুগ যুগ ঝগড়া করিস।তবে ছেড়ে যাবি না ভুলেও।
#চলবে…..