#শুধু_তুই
—–(সিজন২)
#পর্বঃ০৯
#Rifat_Amin
রেস্তোরাঁটা সাধারণ হলেও, সিকরেট রুমটা অসাধারণ বলা যায়। ছোট্ট রুমটাতে দুটো ডাইনিং আর একটা আরাম করার জন্য বিছানার ব্যবস্থা করা আছে। পুরো রুমটা সাদা রং করা। তাই ভিতরে ঢুকেই অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ির সেই আতঙ্কের পর আমার শরীরের নাজেহাল অবস্থা। তা ছাড়াও খিদা তো লাগছেই! প্রহরভাই রুমের দরজাটা বন্ধ করে বিছানায় বসে বললেন,
‘ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে আয়। ‘ (প্রহর)
আমি আদেশ শোনামাত্র ফ্রেস হতে গেলাম। ওয়াশরুমটাও যথেষ্ট মানসম্মত। বাইরে থেকে দেখে কেউ বলতেই পারবে না এমন একটা রেস্টুরেন্টে এমন সুযোগ সুবিধা আদৌ পাওয়া সম্ভব!
পাঁচমিনিট পর ফ্রেস হয়ে এসে দেখলাম প্রহরভাই বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে রয়েছেন। চোখদুটো বন্ধ করা। পরনে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। ফরমাল ড্রেসআপ হলেও যথেষ্ট সুদর্শন লাগছে তাকে। মাথার উপর হাইস্পিডে ফ্যান ঘুরছে। সেই বাতাসে প্রহরভাইয়ের হালকা লম্বা চুলগুলো চড়ুই পাখির মতো এদিক-ওদিক ছুটছে। বুকের উপর দুটো বোতাম খুলে দেয়া। হায়তো গরমের কারণে৷ কিন্তু সেই সুযোগে আর তীব্র বাতাসে বুকের উপর থেকে শার্ট হালকা সরে গিয়ে লোমশ শক্তপোক্ত বক্ষ ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। আমি চোখ সড়িয়ে নিলাম। ঠিক তখন দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। প্রহরভাই চোখদুটো খুলে পিটপিট চোখে তাকালেন। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি? উনি চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দরকার দিকে এগিয়ে গেলেন৷ দরজা খুলতেই সামনে এই রেস্টুরেন্টের মালিক চলে আসলো৷ পেছনে দুটো ছেলে। হয়তো সার্ভেন্ট। সেরকমেই তো পোশাক-পরিচ্ছদ দেখছি। প্রহরভাইকে দেখার সাথে সাথেই মুচকি হেসে বললেন,
‘ আপনার ডিনারের জন্য আমাদের রেস্টুরেন্টের সব থেকে ভালো বিরিয়ানি এ্যারেন্জ করছি স্যার। আপনি শুধু বিরিয়ানি চেয়েছিলেন, আরো কিছু লাগবে? ‘ (মালিক)
‘ জি না। থ্যাংস এ লট’ (প্রহর)
‘ পেছনের দু’জনকে দেখছেন? ওদেরকে বললাম যে বিখ্যাত রকস্টার প্রহর খান আমাদের এখানে এসেছে। ওরা তো বিশ্বাস করতেই চাইলো না৷ টেনশন করিয়েন না স্যার। এরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানবে না৷ এরাই আপনার খাবার-দাবার সার্ভ করবে৷ তাই বলতে হলো। ‘ (মালিক)
প্রহরভাই বিনিময়ে মুচকি হাসলেন৷ কথা বললেন না৷ দোকান মালিক আবার বললো,
‘ আজ রাতটা এখানে থেকে যেতে পারেন স্যার। উনি কি ম্যাডাম? ‘ (মালিক)
শেষ কথাটা আমার দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন উনি৷ প্রহরভাই হাসি অটুর রেখে বললেন,
‘ হ্যাঁ। তবে আমরা ঘন্টাখানেক থেকেই চলে যাবো। রাস্তায় ঝামেলা হয়েছিলো তাই এখানে উঠতে হলো ‘ (প্রহর)
প্রহরভাইয়ের কথায় বড্ড অবাক হলাম৷ উনি আমাকে উনার সামনে স্ত্রীর পরিচয় দিলেন কেনো? আমি তো ম’রে গেলেও এরকম একটা খচ্চর মানুষকে বিয়ে করবো না। দোকানমালিক আমাকে দেখে মুচকি হেসে সালাম দিলেন৷ আমি ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে সালামের জবাব দিলাম৷ অতঃপর উনি বললেন,
‘ আপনি থেকে গেলেই খুশি হতাম স্যার। আচ্ছা আমি চলি। কোনো দরকার হলে ওদেরকে জানাবেন ‘ (মালিক)
দোকান মালিক চলে গেলেন। অতঃপর সেই সার্ভেন্ট দুটোর পাল্লায় পড়লো প্রহরভাই। দুটো ছেলেই আমার সমবয়সী মনে হচ্ছে। ওরা খাবার ডাইনিংয়ে সার্ভ করতেই প্রহরভাইকে জানালেন ওরা প্রহরভাইয়ের বিরাট ফ্যান। ছ্যাঁ! এরকম একটা মানুষের আবার পাখা! প্রহরভাই বিভিন্ন ভাবে ওদের সাথে হেসে হেসে কথা বললেন। কারণ কথা না বললেই হয়তো কাল নিউজে সব খবর বেড়িয়ে যাবে। হয়তো লিখবে ” মাঝরাতে এক সাধারণ রেস্টুরেন্টে অপরিচিত মেয়েকে নিয়ে উঠলেন বিখ্যাত রকস্টার প্রহর খান। ” খাবার রেডি করে দিয়ে প্রহরভাইয়ের সাথে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে সেলফি তুললেন দুজন। অতঃপর প্রহরভাই একপ্রকার জোর করেই রুমের বাইরে পাঠিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমার দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,
‘খেতে বস। আমি ফ্রেস হয়ে এসে যেনো দেখি তোর প্লেটে কিছু নেই। ‘ (প্রহর)
প্রহরভাই চলে গেলেন ফ্রেস হতে। আমি ধপ করে ডাইনিংয়ে বসে পড়লাম। খিদায় পেট জ্বলে যাচ্ছে একেবারে। ইচ্ছে তো করছে সবকিছু খেয়ে নেই একসাথে৷ বাট তা কি আর সম্ভব? প্রহরভাই না আসা পর্যন্ত কিছুই খাওয়া যাবে না। মানসম্মান বলেও তো একটা কথা আছে। আমি বসেই রইলাম পাঁচমিনিট। একটু পর উনি বের হয়ে দেখলেন আমার প্লেটে খাবার যেমন ছিলো তেমনই আছে। ভাবলাম হয়তো রাগ করবেন উনি৷ কিন্তু আমার ধারণায় জল ঢেলে দিয়ে ভদ্র ছেলের মতো টেবিলে বসে নিজের প্লেট থেকে খাবার তুলে আমার সামনে ধরলেন। আমি বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকালাম। এটা কি সেই প্রহর ভাই? আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকতেই উনি কপট রাগের স্বরে বললেন,
‘ আমি কতটা সুদর্শন সেটা জানি। কিন্তু এখন আমার দিকে না তাকিয়ে খাবারটা নে ‘ (প্রহর)
কথাটা বলেই উনি খাবারের প্লেটটা সহ হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি আর আটকাতে পারলাম না নিজেকে। যদিও বা আটকাতাম, তাহলে আজ মা’ইর খেয়েই রাত কাটাতে হতো।
উনি বিরিয়ানির লোকমা এগিয়ে দিতেই আমি সেটা মুখে পুরে নিলাম। অতঃপর অনুভব করলাম, এক আকাশ লজ্জা ভীর করেছে মনে! আমি যে এই অদ্ভুদ খারাপ মানুষটার হাতে কিছু খাচ্ছি। সেটা ভাবতেই লজ্জায় ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে। আমি নতজানু হয়ে বললাম,
‘আর খাবো না ভাইয়া ‘ (আমি)
‘ একবার নাকি খাওয়া ঠিক না। আরেকবার নে ‘ (প্রহর)
‘ না থাক। আমি নিজের হাতেই খাচ্ছি ‘ (আমি)
‘ এইযে আবারো কথার অবাধ্য হচ্ছিস। আমি সাধে কি তোর প্রতি রাগ করি? ‘(প্রহর)
যা বুঝলাম, আমি উনার সাথে কথায় পেরে উঠবো না। এমন ভাব দেখাচ্ছে, যেনো দেশের প্রসিডেন্ট উনি। তাই আমার উচিৎ উনার সব আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা। আমি কোনো কথা বলে নিশ্চুপ থাকলাম। আরেকবার বিরিয়ানির লোকমা এগিয়ে দিতেই সেটাও মুখে পুরে নিলাম। অতঃপর উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি মুচকি হাসছে।
আশ্চর্য তো! হাসির কি হলো আবার ?
‘ হাসছেন কেনো? ‘ (আমি)
‘ এমনি ‘ (প্রহর)
‘ এমনি কেউ হাসে? নিশ্চই ভূতে ধরেছে। ‘ (আমি)
‘হাসছি তার কারণ, রুমের দরজা কিন্তু বন্ধ করা। এখন আমি যদি তোর সাথে খারাপ কিছু করি? ‘ (প্রহর)
‘ ছিহহ!! আপনাকে আমি কত বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা করি। তার এই প্রমাণ? আপনি খুবই খারাপ প্রহরভাই ‘ (আমি)
উনি শব্দ করে হাসলেন। অতঃপর আবারো একলোকমা বিরিয়ানি এগিয়ে দিলেন। আমি মুখে পুরে অনুভব করলাম এই পর্যন্ত পাঁচ ছ’বার খাওয়া হয়ে গেছে। উনি কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললেন,
‘ এটা কিন্তু পুরোপুরি সত্য বললি না। তুই আমাকে বিশ্বাস করিস! এটা আমি জানি। কিন্তু শ্রদ্ধা ? এটা কি আদৌ কি আমি বিশ্বাস করতে পারবো? ‘ (প্রহর)
আমি চুপ করে রইলাম। উনি যে আবারো কথার জালে আমায় ফাঁসালেন। তা ভালোই বুঝতে পারছি। আমি কোনো জবাব দিলাম না। উনি আবারো বিরিয়ানির লোকমা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ যে সম্পর্কে বিশ্বাস, সম্মান, আত্মত্যাগ থাকে। সেই সম্পর্ক হাজার বছর টিকে থাকে। আমি আশা করছি খুব তারাতারি তুই আমাকে সম্মান করবি। করতেই হবে। (প্রহর)
আমি ভ্যাবলার মতো উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কথার মাথামুন্ডু তেমন বুঝলাম না। দেখতে দেখতে আমি উনার প্লেটের সব বিরিয়ানি গায়েব করে ফেললাম। উনি আমার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ একটু রেস্ট নে। আমার খাওয়া হলেই এখন থেকে চলে যাবো।’ (আমি)
আমি আবারো নিশ্চুপ থাকলাম। হঠাৎ প্রহরভাইয়ের কল আসায় উনি খাওয়া অবস্থায় ফোনটা রিসিভ করলেন।
‘ আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন? ‘ (প্রহর)
‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম মি. প্রহর খান। আমায় চিনতে পেরেছেন মি. রকস্টার? ‘ (মাহিম)
মাহিমের কন্ঠ চিনতে একটুও ভুল করলো না প্রহরভাই। ফোনটা স্পিকারে রেখে বাম হাত দিয়ে গ্লাস উঠিয়ে পানি খেলেন। আমি যে একটু হেল্প করবো তারও সুযোগ পেলাম না। উনি পানি খেয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। তো কি কারণে স্মরণ করলেন আমায় দি দেন রকস্টার মাহিম? ‘ (প্রহর)
‘ ওটা “দি দেন” হবে না ইয়ার। শীঘ্রই “এট প্রেজেন্ট” হতে চলেছে। শুনলাম দেশে ফিরেছেন! তো এই কারণে ফোন দিলাম যে, আপনার সব থেকে ছোট্ট, মিষ্টি বোনটা কিন্তু রোজ স্কুলে যায়। খেয়াল রাখবেন। ‘ (মাহিম)
‘ পিপিলিকার পাখা গজায় ম’রিবার তরে। প্রবাদটা মনে আছে? তোর ঐ সুস্থ, সুন্দর দেহে যদি প্রাণ রাখতে চাস তাহলে আমার বোনের কাছ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে থাকবি। ‘ (প্রহর)
প্রহরভাইয়ের শক্ত চাহনি আর তীব্র কন্ঠে আঁতকে উঠলাম আমি। ওপাশ থেকে শুধু হাসির শব্দ আসলো। অতঃপর লাইনটা কেটে গেলো বোধহয়। আমি উনার দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললাম,
‘ এই মাহিম আমায় ফোন দিয়েছিলো গতকাল ভোরবেলা। আপনি চিনেন? আমি)
‘ তুই আমাকে জানাসনি কেন? ‘ (প্রহর)
গম্ভীর কন্ঠে কথাটা বললেন প্রহরভাই। আমি আবারো ভয়ে চুপসে গেলাম। কঁপাকাঁপা কন্ঠে বললাম,
‘ ভ’ভেবেছিলাম ম’মজা করছে কেউ। ‘ (আমি)
প্রহরভাই কথা বললেন না। সামনে রাখা বিরিয়ানিটুকুও খেলেন না। আমি কিছু বলার সাহস পেলাম না।
——-
এখন ঘড়িতে রাত ন’টা। পুরো রুম অন্ধকার করে নিশ্চিন্তে বিছানার এককোণে আরাম করে শুয়ে ফোন টিপসে সারা। আর কানে হেডফোন লাগিয়ে প্রেমের গাওয়া গানটার অডিও রেকর্ড শুনছে। তখন ফারহান বাসায় পৌঁছে দেয়ার পর ভয়ে অন্তর আত্মা শুঁকিয়ে গিয়েছিলো সারার। ভেবেছিলো আজ নিশ্চই সবার মা’ইর খেতে হবে। কিন্তু সে যখন বাসায় ফিরলো, তখন কেউ কোনো বাজে প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং সবাই খুব স্বাভাবিক আচরণ করছিলো। যা কোনো ভাবেই কাম্য নয়। যদিও সানভি ছিলো না বাসায়। এই কথা ভাবতেই খট করে দরজা খুলার আওয়াজ হলো। সারা ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে চোখ খুলে দেখলো সারার বাবা সাজিদ হোসেন রুমে প্রবেশ করেছেন। সারা মুচকি হেসে বললো,
‘ কেমন আছো বাবা? ‘ (আমি)
‘ আমার কি খোঁজ খবর কখনো নিয়েছিস? আমাকেই আসতে হয় আমার মায়ের সাথে কথা বলতে। ‘ (সাজিদ)
‘ সারাদিন বিজনেস আর বিজনেস । খোঁজ নেয়ার ওয়ে রেখেছো? ‘ (সারা)
কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সারা। সাজিদ হোসেন মেয়ের কষ্টটা বুঝলেন। বিছানায় বসে বললেন,
‘ মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাবার বাড়ি থেকে শশুরবাড়ি যেতে হয়। সেটা তো জানিস মা। তোর ভাইয়া আর মা মিলে খুব ভালো একটা পাত্র ঠিক করেছে। এবার অন্তত বিয়েতে রাজি হয়ে যা। সবাই খুশি হবে। ‘ (সাজিদ)
বাবার কথা শুনে সারা হতভম্ব হয়ে গেলো। তাহলে এটাই ছিলো সবার এতক্ষণ ভালো ব্যাবহারের কারণ?
#শুধু_তুই
—-(সিজন২)
#পর্বঃ১০
#Rifat_Amin
পরদিন ফজরের আযান কানে পরা মাত্র ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেই ছোট্ট সাদা আবদ্ধ দেয়ালের মাঝে। আমরা এখনো সেই রেস্টুরেন্টে আছি ভাবতেই ভীষণ অবাক হলাম। মনে করতে চেষ্টা করলাম ঠিক কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম আমি! কিন্তু মনে পরছে না। চারপাশে এখনো আযানের মধুর ধ্বনি প্রবাহিত হচ্ছে। রুমে অস্পষ্ট ডিম লাইট জ্বলছে। কিন্তু প্রহরভাই কই? আমি ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে দেখলাম উনি চেয়ারে বসে ডাইনিংয়ের মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। সাথে সাথেই বিছানা থেকে উঠে পড়লাম আমি। আমাদের না কাল রাতেই চলে যাওয়ার কথা ছিলো? শিট! এই লোকটার সাথে গতকাল বের হওয়াই কাল হলো!
একা ছোট্ট একটা রুমে উনার সাথে একটা রাত পার করে দিয়েছি ভাবতেই শিউরে উঠলাম আমি৷ লাইটের সুইচ খুঁজে রুমের লাইট জ্বালালাম। উনার সামনে গিয়ে কোমল স্বরে উনাকে ডাকলাম,
‘ এইযে হ্যালো। উঠে পড়ুন। শুনছেন। ‘ (আমি)
প্রহরভাই একবার নড়েচড়ে বসলেন। অতঃপর আমার দিকে একবার দৃষ্টি রেখেই আবার ডাইনিংয়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন৷ আমি অবাক হলাম! দেখলেন জলজ্যান্ত আমি মানুষটা দাঁড়িয়ে আছি উনার সামনে৷ তবুও ঘুমালেন! আমি এবার একটু জোরেসোরে ডাকলাম,
‘ উঠবেন না নাকি প্রহরভাই? উঠুন! সকাল হয়ে গেছে! ‘ (আমি)
উনি আবারো মাথা তুললেন। আমি দিকে ঘুমু ঘুমু দৃষ্টিতে তাকিয়েই আবারো ঘুমাতে যাবেন তার আগেই হাত দিয়ে উনার মাথা ধরলাম। সাথে সাথেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন উনি। ঝট করে মাথা তুলে বললেন,
‘ ঘুমিয়ে পড়েছিলি কেন? রেডি হ! অনেক লেট হয়ে গেছে। ‘ (প্রহর)
‘ শুধ অনেক লেট হয়ে যায়নি প্রহরভাই। পুরো রাতটাই পার করে ফেলেছেন। ‘ (আমি)
প্রহরভাই ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। মাথার এলোমেলো চুলগুলো দুহাতে একবার টান মেরে পকেট থেকে ফোন বের করে যখন সময় চেক করলেন। তখন ভ্যাবলার মতো আমার দিকে তাকালেন একবার। অতঃপর তেজ দেখিয়ে বললেন,
‘ ঘুমিয়ে পরেছিলি কেন? তোর জন্য আমার পুরো রাতটা বাজেভাবে কেটে গেলো ‘ (প্রহর)
‘আমার জন্য কেনো হবে? আমি না’হয় একটু রেস্ট নিতে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। তাই বলে আপনিও! তাইতো এমন হলো। ‘ (আমি)
প্রহরভাই চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। শরীরের শার্টটা এখনো শরীরেই লেপ্টে আছে। তবে উনার সবকিছুই যেনো এলোমেলো! তবে এই এলোমেলো পুরুষটাকে বেহায়ার মতো আকৃষ্ট করছে মন। উনি হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘ আমি বসে বসে চিন্তা করতেই হঠাৎ দেখলাম তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস। ভাবলাম আমিও একটু রেস্ট নেই। কিন্তু কে জানবে ঘুমিয়ে পড়বো? ‘ (প্রহর)
‘হইছে। এখন এখান থেকে কখন যাবেন সেটা বলেন? ‘ (আমি)
উনি শরীরের শার্টটা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে মারলেন। সাথে সাথেই ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম আমি। অতঃপর ধীরপায়ে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার কাছে। আমার কাছাকাছি আসতেই আমি পিছিয়ে যেতে লাগলাম। ভয়ভয় কন্ঠে বললাম,
‘ক’কি হলো ভ’ভাইয়া। ‘(আমি)
উনি নেশাখোর দৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে আসতে একেবারে আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলেন। অতঃপর বললেন,
‘ আজ বিকালে চিটাগং রওনা দেবো। সো এখন ঘুম দরকার, ভীষণ ঘুম। বুঝলি কিছু! সো ডন্ট টক এন্ড লেট মি স্লিপ’ (প্রহর)
প্রহরভাই ঠান্ডা, শীতল গলায় কথাটা বলেই উনার মাথাটা আমার মাথার ঠিক ডান সাইডে রাখলেন। আমাদের মাঝে এখন শরীরের দূরত্ব আর নেই বললেই চলে। উনি উনার মাথাটা আমার চুলের দিকে এগিয়ে নিয়েই চুলের ভীতর নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলেন। আমি সাথে সাথেই ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। নিজের হাতের সর্বশক্তি খাটিয়ে উনার বুকে হাত দিয়ে একটু ধাক্কা মারতেই ঠাস করে বিছানায় পরে গেলেন উনি। সাথে সাথেই পুরো রুমে বিকট আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হলো। উনার মাথাটা বিছানায় লাগতেই মাথা চেপে ধরে বিছানায় শুয়ে রইলেন উনি। অতঃপর সেকেন্ড কয়েক অতিবাহিত হওয়ার পর যন্ত্রণার স্বরে বললেন,
‘ তুই কি শয়তান মেয়ে রে! নির্দোষ এক পুরুষের উপর এমন টর্চার করছিস! এখনি তো মাথাটা ফেটে যেতো আমার। ‘ (আমি)
‘আজ আম্মিকে যদি আপনার চরিত্র সম্পর্কে অবগত না করছি! তাহলে আমার নামও রশ্নি নয়। তখন দেখিয়েন। মাথার সাথে আপনার টসটসে গালদুটোও ফা’টিয়ে দিবে। ‘ (আমি)
‘ ওরে পিচ্চি। আ’ম এডাল্ট নাউ। আম্মি বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছে। সো কিছুই বলবে না আমায়। ‘ (প্রহর)
‘ আপনি সত্যিই একটা চরিত্রহীন। ‘ (আমি)
—
আজ রেডিওতে শো আছে। তাই প্রেম সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই শাওয়ার নিয়ে রেডি হচ্ছে যাওয়ার জন্য। একটা জরুরী কাজে আজ ফারহানকেও ডেকেছে প্রেম। এমন সময় সারার ফোন এলে প্রেম ফোনটা রিসিভ করে স্পিকারে দিলো,
‘গুড মর্নিং প্রেম’ (সারা)
‘ইউ টু। এত সকালে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠো? (প্রেম)
‘ জ্বি। তোমার জন্য দুটো নিউজ আছে। একটা গুড আরেকটা ব্যাড। বলো কোনটা আগে শুনবে? ‘ (সারা)
‘ওভিয়েসলি গুড। কজ ব্যাড নিউজ বলতে কিছু হয় না। সেই ব্যাডকে গুডে কনভার্ট করার ক্ষমতা প্রেমের আছে। ‘ (প্রেম)
সারা এবার হাসলো। বিয়ের কথা শোনার পর থেকে সারারাত সে মন খারাপ করে বসে ছিলো। কিন্তু এখন প্রেমের সাথে কথা বলে অটোমেটিকলি মন ভালো হয়ে গেছে।
‘ তাই নাকি? আচ্ছা শুনো, ভালো খবরটা হলো আমার ইউটিউবে রুম ডেকোরেশন আর বিভিন্ন ধরনের শখের জিনিস বানানোর একটা চ্যানেল আছে নিশ্চই জানো? ‘ (সারা)
‘ হুম জানি, একদিন বলেছিলে। তো এখন সেখানে আমার গানের ভিডিওটা আপলোড করার পর থেকে অনেক ভিউ আসা শুরু করেছে তাইতো? ‘ (প্রেম)
সারা উৎফুল্ল হয়ে বললো,
‘এক্সাক্টলি প্রেম। অনেকে কমেন্ট করেছো “আপু তোমাকে আর ভাইয়াকে হেব্বি মানাচ্ছে”। ‘ (সারা)
প্রেম হাসলো,
‘ আচ্ছা। তো এখন খারাপ সংবাদ টা বলো শুনি ‘ (প্রেম)
সারা একটু মৌনতা বজায় রেখে বললো,
‘ না থাক। ভালো মনটা আর খারাপ না করি। ‘ (সারা)
‘আহা বলো না। বললাম না, খারাপ সংবাদকেও ভালোতে রুপান্তর করা প্রেমের কাছে কোনো ব্যাপার না। ‘ (প্রেম)
‘ বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। যদিও আমি না করে দিছি৷ তবে এবার মনে হয় মানবে না। ‘ (সারা)
প্রেম মুচকি হেসে বললো,
‘তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। যা হবে ভালোই হবে ‘ (প্রেম)
‘কিছু ভালো হবে না। আমার তোমাকে চাই চাই চাই’ (সারা)
বরাবরের মতো প্রেম হাসলো। কিন্তু এবার কোনো কথা বললো না।
কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোনটা কাটলো প্রেম। অতঃপর রেডি হয়ে প্রহরভিলার গেটের বাইরে আসতেই প্রেয়সীকে বাগানে ফুলগাছগুলোকে যত্ন করতে দেখা গেলো। ফারহান এখনো আসেনি তাই প্রেম একটু এগিয়ে গেলো প্রেয়সীর দিকে। প্রেয়সী প্রেমকে দেখার সাথে সাথেই দৌড়ে ওর কাছে চলে এসে বললো,
‘রেডিওতে যাও? আমার চক্কেত কই?, ‘ (প্রেয়সী)
প্রেয়সী দৌড়ে আসতেই ওকে কোলে তুলে নিলো প্রেম। গালে একটা চুমু এঁকে বললো,
‘ আমার রুম থেকেই তো প্রতিদিন নাও পিচ্চু। ওখানেই আছে ‘ (প্রেম)
প্রেয়সী খুশি হলো৷ অতঃপর ছোট ছোট চোখদুটো পিটপিট করে চেয়ে বললো,
‘এ্যাকতা কান কতা চুনবা দাভাই’ (প্রেয়সী)
প্রেম প্রয়সীর মতো এক্সপ্রেশন দেখিয়ে বললো,
‘বলো শুনি তোমার কান কথা ‘ (প্রেম)
প্রেয়সী প্রেমের কানে ফিসফিস করে বললো,
‘ ব্যলো (বড়) দাভাই আর মিষ্টু আপু দুদনি কাল লাত(রাত) তেকে হাওয়া। মাইক্লো নিয়ে কোতায় চলে গেচে’ (প্রেয়সী)
প্রেয়সীর বাচ্চা বাচ্চা কথার ভাবার্থ বুঝতে অসুবিধা হলো না প্রেমের৷ কথাটার অর্থ বুঝতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো প্রেম। ঠিক তখনি বাইরে বাইকের হর্ন শুনতে পাওয়ায় বিষয়টা নিয়ে আর ভাবলোনা প্রেম। প্রেয়সীকে ওখানে নামিয়ে দিয়ে নিজের বাইকটা নিতে আবারো রুমে ঢুকলো সে।
বাইকটা নিয়ে এসে প্রেম গেট পার হবে ঠিক তখনি ফারহান বললো,
‘ গুড মর্নিং ব্রো ‘ (ফারহান)
‘রাখ তোর গুড মর্নিং। এত লেট করে আসছিস। এখন তারাতাড়ি চল ‘ (প্রেম)
দুজনই বাইক স্টার্ট করে বেড়িয়ে পড়লো রাস্তায়। পুরো রাস্তাটা একদম ফাঁকা। বসন্তের শেষ সময় হওয়ায় আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। সূর্যটা উঠে পুরো পৃথিবীকে নতুন দিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তবে সুর্য মশাই এই ইট পাথরের দেয়াল ভেদ করে উঁকি দিতে পারেনি এখনো। গাছের পাতাগুলো ঝরে গিয়ে একদম ন্যাড়া হয়ে আছে। তারই ফাঁকে ফাঁকে নতুন গজানো কচি পাতাও দেখা যাচ্ছে। প্রেম গাড়ি চালানো অবস্থায় বললো,
‘কাল আমাদের পুরাতন বাড়িটা দেখে কি বুঝলি? ‘ (প্রেম)
‘প্রথম কথা হলো বাড়িটা তিনতলা বিশিষ্ট। নিচের তলা বাদ দিয়ে উপরের দুইটা তলাই ভাড়া থাকে মানুষ। সেই বাসা ভাড়ার টাকা কি তুই নিস? ‘ (ফারহান)
প্রেম গাড়ির স্পিড স্লো করে বললো,
‘ হুমমমমম। ওখানে লোক রেখেছে মামা। উনিই সবকিছু দেখাশোনা করেন। তবে নিচের তলাটা ভাড়া দেয়া হয়নি কারণ ওখানে আমরা থাকতাম। তখন আমি খুব ছোট। কিছু কিছু মনে পড়ে! সবটা না। প্রহরভাই হয়তো জানবে। সব থেকে বড় কথা হলো তখনকার দিনে শুধু টেলিফোনেই সব যোগাযোগ হতো। সেগুলো তো আর এখন রেকর্ড হয়ে থাকবে না। যদি কখনো আব্বু অথবা আম্মুর কোনো ডায়েরী পেতাম। তাহলে না’হয় বুঝা যেতো কোনো শত্রু আদৌও ছিলো কি না। ‘ (প্রেম)
ফারহান ক্ষন কাল মৌনতা বজায় রেখে বললো,
‘ তোর বাপ জানি কি করতো? ‘ (ফারহান)
‘ রেডিও স্টেশনের এমডি। আমাদের ওটাই একমাত্র বিজনেস ছিলো। সবটা প্রহরভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি। ‘ (প্রেম)
‘ধুর তা তো জানি। ইফতেখার উদ্দিনের টিভি চ্যানেলটায় পারলে আমারে জয়েন করাস তো। তুই বলছিলি তোর বাপ যখন এমডি ছিলো রেডিওর তখন যে ম্যানেজার রেডিওতে ছিলো। সে এখন চ্যানেলের ম্যানেজার তাইতো? আমার মাথা আউলাই যায় ভাই। প্রহরভাইয়ের সাথে কথা না বললে আসলে কিছু জানা যাবে না। আমরা অনেক কিছুই হয়তো জানি। তবে তা পার্ফেক্ট নয়’ (ফারহান)
চলবে?
চলবে?
(রেসপন্স চাই প্রিয় পাঠক)