মৃত কাঠগোলাপ পর্ব -০১+২

( মৃত কাঠগোলাপ গল্পের পরবর্তী পর্বগুলো এই পেইজেই দেওয়া হয়েছে। পড়তে চাইলে, এই পেইজের মধ্যে প্রবেশ করুন।)
(১)
‘ মেয়েটাকে আমার চাই, ওসমান! হয় জীবিত নয়তো মৃত! ডিড ইউ গেট ইট? ‘
ধ্রুবের রাগান্বিত কণ্ঠস্বরে ওসমানের আত্মা ছলকে উঠলো যেন। তরতর করে কাঁপতে লাগলো মধ্যবয়স্ক এ লোক। ওসমানকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধ্রুবের রাগ সপ্তমে চড়ল। সে দাঁতে দাঁত চেপে অদ্ভুত শব্দ করতেই ওসমান ভয়ে জমে উঠল। দ্রুত মাথা নেড়ে জানাল,
‘ আ-আ-আমি চেষ্টা করব, স্যার। ‘

ধ্রুব বাঁকা নয়নে তাকালো। টেবিলের উপর জোরে বাঘের ন্যায় থাবা ফেলে বললো,
‘ চেষ্টা শব্দটা আমার একটুও পছন্দ নয়, ওসমান। করে দেখানো চাই। বুঝা গেছে? ”

ওসমান মাথা নত করে তরতর করে কেঁপে উঠল। বরাবরের মত ওসমানকে কোনো কাজ দেওয়ার আগে ধ্রুব বললো,
‘ যাও, আমার বন্দুকটা নিয়ে এসো। ‘

ওসমান জানে এখন কি করতে চাইছে ধ্রুব। কিন্তু ধ্রুবের কথা অমান্য করার সাধ্য এ ভুবনে কার আছে? ধ্রুবের দ্বিতীয়বার বলার আগেই ওসমান ঝড়ের বেগে ড্রয়ার থেকে ধ্রুবের বন্দুক নিয়ে আসল। বন্দুক ধ্রুবের দিকে এগিয়ে দিল ধ্রুব মানা করে। পায়ের উপর পা তুলে বাবু হয়ে বসে বলে,
‘ বন্দুকে নিজের নাম লিখে একটা গুলি ঢুকাও, ওসমান।”

ওসমান ছলছল চোখে চেয়ে রইলো ধ্রুবের দিকে। কাজের সময় ধ্রুব দেরি সহ্য করতে পারে না। তাই সে চিৎকার করে বলে,
‘ দেরি না করে যা বলছি, তাই করো। ‘

ওসমানের নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। টেনশনে প্রেশার লো হয়ে যাচ্ছে। ধ্রুবের কথামত কাজ না করলে মরন নিশ্চিত। ওসমান আর দেরি করল না। সে দ্রুত নিজের নামে একটা গুলি বন্দুকে প্রবেশ করালো। ধ্রুব মুচকি হেসে হাত বাড়ালো। ওসমান বন্দুকটা তুলে দিল ধ্রুবের হাতে। ধ্রুব নেড়েচেড়ে বন্দুকটা পরীক্ষা করে নিল। অতঃপর গুলি ভরা বন্দুক তাক করলো ওসমানের কপাল বরাবর। ওসমান ঘেমে গেছে। হাঁটু কাঁপছে তার। অতিরিক্ত কাঁপুনিতে হাঁটু খানিকটা বেঁকে গেছে। ধ্রুব ঘাড় দুদিকে ঘুরালো। ঘাড় ফুটে মটমট শব্দ হলো। ধ্রুব ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,
‘ মেয়েটাকে আমার চাই, ওসমান। হয় মেয়েটাকে আমার হাতে এনে দেবে নয়তো নিজের হাতে নিজের নাম লেখা গুলিবিদ্ধ হয়ে মরে যাবে। চয়েজ ইজ ইউরস। ‘

ওসমান ক্রমাগত মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ আ-আমি ওই মেয়েকে যে করেই হোক এনে দেব আপনার হাতে, স্যার। ‘
‘ দ্যাটস মায় ডগ। আ’ম প্রাউড অফ ইউ, ওসমান। ‘

ধ্রুব তাকে কুকুর বলে সম্বোধন করায় অপমানে গা রি-রি করে উঠলো ওসমানের। ধ্রুব হাসল তা দেখে। অন্যকে কষ্ট পেতে দেখলে ধ্রুবের সুখ সুখ অনুভব হয়। ধ্রুব বন্দুক সরিয়ে পকেটে পুড়ে নিল। হাতে থাকা কালো রঙের ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল,
‘ ঘুমাতে যাচ্ছি আমি। ডিস্ট্রাব করবে না আমায়। ‘
‘ জ.জি স্যার। ‘

ধ্রুব নিজের কক্ষে চলে গেল। ওসমান ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। দুহাতের আজলায় ধুলো নিয়ে কপালের উপর ছিটিয়ে দিয়ে বিলাপ করতে লাগল। সৃষ্টিকর্তার কাছে মৃত্যু কামনা করতে লাগল নিজের। ধ্রুবের হাতে বন্দী হয়ে অত্যাচারিত হওয়ার বদলে মৃত্যু ঢের ভালো!
_________________________________
ধ্রুব, এক ভয়ঙ্কর ঝড়ের নাম। ধ্রুব, এক মরণঘাতী অসুখের নাম। ধ্রুব, এক নিষ্ঠুর মানুষের নাম। পাথরের তৈরি মন, কথাটা জীবনে সবাই শুনলেও এমন মানুষ দেখেছে কজন? কিন্তু ধ্রুব হলো এমন একজন পুরুষ, যার মনটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পাথর দিয়ে তৈরি। যে ডান হাতে মানুষ খুন করলে, বাম হাত তা টের পায়না। যে লোক একবার তার আয়ত্তের ভেতর চলে আসে, সে সারাজীবন ধ্রুবের শিকলে বন্দী থাকে। সেই বন্দী লোককে ভুলে যেতে হয় তার পরিবার, তার স্বাধীন জীবন। ধ্রুবের হাতের পুতুল হয়ে বেঁচে থাকে মরার আগ অব্দি।

এই পাথরের মত মনের অধিকারীর জীবনেও প্রেম এসেছিল, বহুবার। প্রেম স্বাধীনতা কেড়ে নেয়না। বরং প্রেম মানুষকে বিশাল আকাশের নিচে শীতল বাতাস অনুভব করতে শেখায়।
কিন্তু ধ্রুবের কাছে প্রেম হলো সম্পূর্ণ আত্মকেন্দ্রিক। তার কাছে প্রেম হলো নিজের কাছে আটকে রাখা। যে মেয়েকে ধ্রুবের মনে ধরবে, সেই মেয়ে সেদিন থেকেই ধ্রুবের হাতে বন্দী হয়ে যাবে। ভালোবাসার ক্ষেত্রে ধ্রুবের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু কথায় আছে না, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। তেমনটা ধ্রুবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ধ্রুবের অতিরিক্ত ভালোবাসায় একসময় সেই মেয়ে হাঁপিয়ে উঠে। মুক্তি পেতে চায় ধ্রুব থেকে। কিন্তু ধ্রুব তাদের মুক্তি দেয়না। বরং শিকলের বেড়াজাল আরো শক্ত করে দেয়। মেয়ে ছটফট করতে শুরু করে, পালিয়ে যেতে চায়। মেয়ে একটুখানি স্বাধীনতার জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে। ধ্রুব তখন সুখ পায়। স্বাধীনতার ক্ষুধা তার পছন্দ নয়। বেশি স্বাধীনচেতা মানুষদের ধ্রুব অপছন্দ করে। তখন সেই স্বাধীনচেতা মেয়ে ধ্রুবের চোখের বিষ হয়ে উঠে। ধ্রুব সবসময় তার আশেপাশে তার পছন্দের জিনিস রাখতে পছন্দ করে। যে জিনিস বা মানুষ তার পছন্দ না, তাকে সে এ পৃথিবী থেকে ভ্যানিশ করে দেয়। সেই নিয়মটা তার ভালোবাসার মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ধ্রুব নিজ হাতে তার প্রেমিকাকে খুন করে ফেলে।
মেয়ের কাছে ধ্রুবের পক্ষ থেকে মৃত্যু-টাই বোধহয় সেরা উপহার। কারণ ধ্রুবের কাছে থাকা একেকটা দিন সে গুমরে মরে। জীবন উপভোগ করতে চাওয়া মেয়েটাও ধ্রুবের অত্যাচারে প্রতি প্রার্থনায় মরণ কামনা করে। যখন ধ্রুব তাদের মেরে ফেলে, মেয়ে তখন মুক্তি পায় ধ্রুবের এই ধ্বংসাত্মক ভালোবাসা থেকে!
ধ্রুব এমন-ই!

এমনই একদিন আয়েশীকে চোখে ধরে ধ্রুবের। উচ্ছল প্রাণের আয়েশী তখন জানতেও পারেনি, সেদিনের পর তার জীবনে এক ভয়াবহ কাল নেমে আসবে। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান ছিল। সেই অনুষ্ঠানে ধ্রুব প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সফল ব্যবসায়ী হিসেবে গেস্ট হয়ে এসেছিল।

আয়েশী আর তার বন্ধু বান্ধব এক ফাঁকা স্থানে বসে গল্পগুজব করছিল। ধ্রুব স্টেজে বসে ফোন স্ক্রল করছিল। এসব ভাষন-টাষন তার ভীষন বিরক্ত লাগছে। মনেমনে ভেবে নিল সে, আর কখনো এসব ফালতু অনুষ্ঠানে আসবে না। প্রচুর বিরক্তিকর অনুষ্ঠান! সবাই অযথা লম্বা লম্বা ভাষন ছাড়ছে। রিডিকিউলাস!

আয়েশীরা ভাষন শুনছে না। বরং তারা গল্প করায় মত্ত! একটু পর মেহমাদ স্যার এসে জানালেন, আয়েশীর নাচের পালা এখন। মেহমাদ স্যারের কথামত আয়েশী দ্রুত মেকাপ রুমে চলে গেল। নাচের কাপড় পড়ে স্টেজের পেছনে এসে দাঁড়ালো। মাইকে জানানো হলো,
‘ এখন নৃত্য পরিবেশন করবেন, অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ইনাইনা শিকদার আয়েশী। ‘

‘ আয়েশী’ নামটা তখন ধ্রুবের কাছে ভীষন অদ্ভুত লেগেছিল। ধ্রুব বিরক্ত হয়ে ভাবলো, এটা আবার কেমন নাম। মেয়েটার জীবনে কি শুধুই আয়েশ আর আয়েশ? ধ্রুব নামের বিষয়টা বেশি একটা পাত্তা না দিয়ে পুনরায় ফোনে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিল। স্টেজে উঠে আয়েশী সবাইকে কুর্নিশ করে নাচ শুরু করল। রবীন্দ্র সঙ্গীত নাচছে আয়েশী। ছোটবেলা থেকে নাচে পারদর্শী হওয়ায় আয়েশীর নাচ দেখে সবাই হা হয়ে গেল। সবাই করতালি দিয়ে উৎসাহিত করছে আয়েশীকে। সবার উচ্ছসিত আওয়াজে ধ্রুব মনের ভুলে একবার আয়েশীর দিকে তাকাল। সঙ্গেসঙ্গে তার নয়নযুগল নৃত্যরত নারীর পানে তীরের ন্যায় আটকে গেল। এ নারীর রূপ ও গুণের ভয়ংকর তেজে ঝলসে যেতে লাগলো ধ্রুবের দু চোখ। দুধ সাদা রঙের মুখ, ফোলা ফোলা গোলাপী রঙের গাল, আর ওই দু চোখ, যেন আস্ত এক মায়ার সাগর! ধ্রুব কেমন যেন ঘোরে চলে যেতে লাগল। এ নারী তো শুধু নারী নয় বরং ভয়ংকরী খুনি। চট করে কেমন নিষ্ঠুরভাবে ধ্রুবের হৃদয়কে খুন করে ফেলল। ধ্রুব ঘোরলাগা চোখে চেয়ে রইলো স্টেজে কোমড় দুলিয়ে নৃত্যরত মোহময়ী নারীর দিকে। বিড়বিড় করে উচারণ করল,
‘ আমার রক্তজবা! ‘
#মৃত_কাঠগোলাপ – ২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

সেই অনুষ্ঠানে ধ্রুবর ভীষন মনে ধরেছে আয়েশীকে। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানে ধ্রুবর নয়ন শুধুমাত্র একজনাতে আটকে ছিল। সে হলো, আয়েশী। আয়েশী যখন নৃত্যের তালে কোমড় দুলায়, ধ্রুবের মনে হয় তার মাথা ধরে যাচ্ছে এক অদ্ভুদ ঘোরে। আয়েশীর হাসি তো হাসি নয় যেন আস্ত এক বিষবাণ! ধ্রুবর পাথরের ন্যায় মন চট করে আয়েশীর প্রেমে নাস্তানাবুদ হয়ে গেল।

নাচ শেষ হলো! আয়েশী স্টেজ থেকে নেমে পুনরায় বন্ধুদের পাশে এসে দাঁড়ালো। ধ্রুব মনেমনে উশখুশ করছে এই অতীব সুন্দরী নারীর সঙ্গে কথা বলার জন্য। তার সুন্দর মুখের মত তার কণ্ঠেও কি জাদু আছে? তার শরীরের মেয়েলি বাঁকের ন্যায় আকর্ষণীয় কি তার আচরণও? ধ্রুবর আর তর সইলো না। ধ্রুব চট করে নিজের চেয়ার ছেড়ে স্টেজ ছেড়ে নেমে গেল। অনুষ্ঠানের অন্যান্য অতিথিরা সবাই ধ্রুবর এমন কাণ্ডে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। অনেকেই তাকে পেছন থেকে ডাকতে চাইলেন। তবে ভার্সিটির ভিসি তাদের আটকে দিলেন। চোখের ইশারায় জানালেন, ‘ ধ্রুবকে না আটকাতে। যদি তারা তাকে আটকায়, তবে ধ্রুবের রাগ উঠবে। আর ধ্রুবের রাগ কতটা ধ্বংসাত্মক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘ ‘
ভিসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরো জানান, ‘ ধ্রুব পেছন ডাকা পছন্দ করে না। তিনি এও জানালেন, ধ্রুব কতটা মারাত্বক খারাপ মানুষ!’

ভিসির কথা শুনে সবার থম হয়ে গেল। কপাল বেয়ে ঘাম ছুঁটল। তরুণ টগবগে এক মানুষ, আর সে কি না এতটা ভয়ানক! এতটা মারাত্মক মানুষের পেছনে লাগতে না যাওয়াই ভালো বোধ হল তাদের! তাই তারা সবাই চুপচাপ নিজেদের চেয়ারে বসে ভয়ার্ত চোখে ধ্রুবকে লক্ষ্য করতে লাগল।

ধ্রুব গায়ের কালো ব্লেজার খুলে হাতে নিল। চুলগুলো হাত দিয়ে একটু পেছনে ঠেলে সুদর্শন হওয়ার চেষ্টা করল। তবে তার কোনো বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। ভার্সিটির অন্যান্য মেয়েরা এমনিতেও ধ্রুবের আচরণে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে! তারা নানা ভঙ্গিমায় ধ্রুবের নজরে পড়ার চেষ্টা করছে। হায়, কি অবুঝ তারা!

আর এক কদম এগুলেই আয়েশী! কিন্তু সেই এক কদম আর বাড়ানো হলো না ধ্রুবর। হঠাৎ আয়েশীর এক ছেলে বন্ধু আয়েশীর হাতখানা নিজের মুঠোয় পুড়ে নিল। ধ্রুব স্পষ্ট লক্ষ্য করলো, ছেলেটার স্পর্শে আয়েশীর মুখে লজ্জার আভা। আয়েশী প্রাণখুলে হাসছে। হঠাৎ হঠাৎ সেই ছেলেটার কাধে মাথা রেখে সুখী সুখী নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ধ্রুবর বুঝতে বাকি নেই, এই ছেলেটি আয়েশীর প্রেমিক পুরুষ! ছেলেটাকে আয়েশীর কাছাকাছি ভাবতেই ধ্রুবর মাথায় রক্ত উঠে গেল। কপালের রগ ফুলে নীল রঙা আকার ধারণ করল। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ধ্রুব দু কদম পিছিয়ে গেল। পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল করে টগবগে রাগ নিয়ে জানালো,
‘ আধা ঘন্টার মধ্যে ওই ছেলেটার লাশ আমি আমার পায়ের নিচে চাই! গট ইট? ‘

কোনো কথা শোনার আগেই ধ্রুব ধাম করে ফোন কেটে দিল। ফাঁকা এক স্থানে দাড়িয়ে ধ্রুব পলক ফেলা বিহীন নজরবন্দী করছে আয়েশী ও তার আশপাশের মানুষজনকে। একবার মেয়েটাকে নিজের হাতে এনে ফেলুক, তারপর বুঝাবে অন্যদের সাথে প্রাণখুলে হাসিমজার করার শাস্তি!

হঠাৎ একজন ওয়েটার ধ্রুবর কাছে এগিয়ে আসলো।
‘ স্যার, এনি ড্রিংকস? ‘

ধ্রুবর মনোযোগে বাঁধা পড়ায়, সে আগুন চোখে ওয়েটারের দিকে তাকাল। ধ্রুবর এমন হিংস্র চাওনি দেখে একপ্রকার গুটিয়ে গেল সেই ওয়েটার। মাথা নত করে চুপচাপ চলে যেতে নিলে, ধ্রুব তাকে আটকায়। তার হাতের ট্রে থেকে একটা ড্রিঙ্কস নিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সেই ওয়েটারকে। ধ্রুবর ধাক্কায় ওয়েটার ট্রে শুদ্ধ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ট্রেতে থাকা সকল কাচের গ্লাস ফটাফট মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়! কয়েকটা কাঁচের টুকরো বিধে যায় ওয়েটারের হাতে পায়ে! ধ্রুবর এসবে লক্ষ নেই। সে হাতে থাকা কাঁচের গ্লাসটা একহাতে শক্ত করে ধরে তখনও চেয়ে আছে আয়েশীর দিকে। ওয়েটার ধ্রুবর এমন নির্লিপ্ততা দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। এক মুহুর্ত কাল বিলম্ব না করে দৌঁড়ে পালিয়ে যায় সেখান থেকে।

আয়েশী ও তার প্রেমিক পুরুষের লীলাখেলা ক্রমশ ধ্রুবর কাছে অসহ্য ঠেকছে। রাগ-টা কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। রাগে ধ্রুবর হাতে থাকা কাঁচের গ্লাসটা এতই শক্ত করে ধরেছে যে একসময় সেই কাঁচের গ্লাস ধ্রুবের হাতেই ভেঙে যায়। ধ্রুব তখনো নির্বিকার। গ্লাসের কাঁচ গুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধ্রুবের হাতে বিদ্ধ হয়ে পড়ে। ধ্রুবর হাত বেয়ে রক্তের স্রোত গড়াচ্ছে! ধ্রুব একপল জখম হওয়া হাতের দিকে তাকালো। অতঃপর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। হাতটা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে হাতের মধ্যে লেপ্টে থাকা সমস্ত রক্ত ঠোঁট দিয়ে শুষে নিয়ে খেয়ে ফেলল। রক্তের নোনতা স্বাদ ধ্রুবর বড়ই পছন্দের!

আয়েশী ও তার প্রেমিক পুরুষ নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে রাস্তা পাড় হচ্ছে। ধ্রুব তাদের পেছনে তার গাড়ির মধ্যে কাঁচ উঠিয়ে বসে আছে। ওই তো সামনে দেখা যাচ্ছে, একটা ট্রাক আয়েশীদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ধ্রুব বাঁকা হাসলো। এবার জমবে আসল খেল! পথের কাঁটা তবে দূর হচ্ছে!

কিন্তু হঠাৎ ধ্রুবর কিছু একটা মনে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে সে চাল বদলে ফেলল। গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে দৌঁড়ে আয়েশীদের কাছে এসে তাদেরকে একটানে রাস্তার মাঝখান থেকে সরিয়ে ফুটপাথে এনে ফেলল। ঠিক তখনি ট্রাকটা শো করে তাদের শরীর ঘেঁষে চলে গেল। একটু হলেও আয়েশী, মৃদুল ও ধ্রুব একসঙ্গে অ্যাক্সিডেন্ট করতে পারত। মৃত্যুভয়ে আয়েশী ভয়ার্ত চোখে খামচে ধরেছে মৃদুলকে। তার পাঁপড়ি কাপছে, ফোলা গাল দুটোতে ভয়ের স্পষ্ট আভা! ধ্রুবের কাছে আয়েশীকে তখন এক অপ্সরীর ন্যায় মনে হচ্ছিল! কিন্তু পরক্ষণেই আয়েশীকে অন্য পুরুষের সংস্পর্শে দেখে ধ্রুবর পূর্বের রাগ তরতর করে বেড়ে গেল। কিন্তু সে দ্রুত তার রাগ সংবরন করে নিল। এখন রেগে যাওয়া মানে তার সাজানো গোছানো প্ল্যানে পানি ফেলা।

সেই ছেলেটার নাম মৃদুল। সেও মৃত্যুভয়ে কিছুটা গুটিয়েই গেছে। মৃদুল একহাতে আয়েশীকে জরিয়ে ধরে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব তখন কাপড়ে থাকা ধুলো ঝাড়ছিল। মৃদুল ধ্রুবকে কৃতজ্ঞতা জানাতে বললো,
‘ ধন্যবাদ, ম্যান। আপনি না থাকলে আজ হয়তো আমাদের আর বাড়ি ফেরা হতো না। রাস্তায়ই মরে পড়ে থাকতাম। থ্যাংকস অ্য লট। ‘

ধ্রুব আয়েশীর থেকে চোখ সরালো। মুচকি হেসে মৃদুলকে বললো,
‘ নট এট অল। এটা আমার কর্তব্য ছিল। বাই দ্য ওয়ে, আমি ধ্রুব! ‘

ধ্রুব হ্যান্ডশেক করার জন্যে মৃদুলের দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিল। মৃদুল ধ্রুবর সাথে হাত মিলিয়ে বলল,
‘ আমি মৃদুল। ‘

সেইদিন থেকে ধ্রুব ও মৃদুলের একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। তারা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু কে জানত, এসবের পেছনে ধ্রুবর এক নির্মম পরিকল্পনা ছিল। ধ্রুবর হাতে অস্ত্র মানায়, কিন্তু বন্ধুত্বের হাত, এ তো অবিশ্বাস্য!
মৃদুলের সাথে বন্ধুত্বের অভিনয় করতে করতে ধ্রুব মনেমনে তাকে খুন করার ভয়ংকর পরিকল্পনা সাজায়। এমন পরিকল্পনা যেখানে, সাপও মরবে আর লাঠিও ভাঙবে না!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here