#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_ছয়
অয়ন্তিকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরছিল আরশান। রাস্তায় রোজকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে দ্রুত গাড়ি থামালো। ওটা রোজ কিনা বোঝা যাচ্ছে না তাই সে গাড়ি থেকে নেমে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো কালো থ্রিপিচের ওপর কালো লেদারের জ্যাকেট পড়া বাচ্চার মত দেখতে ছোটখাট মেয়েটিকে। মেয়েটি বিরক্তি নিয়ে ফোনে কাউকে অনবরত কল করছে। ওপর পাশ থেকে হয়ত রিসিভ হচ্ছে না। চট করে আরশান নিজের বাম পকেটে থাকা ফোনটা বের করল। সাইলেন্ট করা ফোনে বিশটারও বেশি মিস কল। উপরে জ্বলজ্বল করছে ‘বেবি’ নামটা। আরশান দ্রুত ফোন রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপর পাশ থেকে ভারি দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। আরশান দেখলো দূরে দাড়ানো মেয়েটাও কানে ফোন নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আরশান আবারও ডাকে,
-বেবি! কোথায় তুই?
-রোডে! বৃষ্টির জন্য গাড়ি পাইনি। তুমি কি আমাকে একটু পৌঁছে দেবে দাদাই?
-কালো থ্রিপিচ পড়েছিস? আমার জ্যাকেটসহ!
-কোথায় তুমি?
-আরে তোর সামনেই।সামনের গাড়ির কাছে চলে আয়। আর স্যরি, রিয়েলি ভেরি স্যরি! ফোনটা সাইলেন্ট ছিল তাই রিসিভ করতে পারিনি।
-বুঝেছি। তোমার কুসুম সঙ্গে থাকলে তোমার কি আর কারোর কথা মনে থাকে? রাখো আসছি আমি।
-অভিমানি কন্ঠস্বর! হয়েছে কি?
-কিছু না।
-তোদের মেয়েদের এই ‘কিছু না’ শব্দের মধ্যে অনেক কিছু থাকে। আমাকে বোঝাতে আসিস না, কি হয়েছে সেটা বল।
-চলে যাবো? এত জেরা ভালো লাগছে না।
-এই না, না আয়। পাগলি!
গাড়ির সামনে এসে রোজ দাড়িয়ে রইল। আরশান মৃদু হেসে উঠে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে হাত মেলে রোজকে বসতে বলল। রোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে। মনটা আজ বড্ড বিক্ষিপ্ত। একশ দুই জ্বর নিয়ে টানা দেড় ঘন্টা শো করে, কিছু খারাপ ভালো গল্প শুনে বড্ড ক্লান্ত সে।চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। জানালার কাঁচ বন্ধ করে রোজ মাথা সীটে লাগিয়ে দিল। মৃদু ভলিয়মে এখনও রেডিও বেজে চলেছে। রোজ বিরক্ত হয়, কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু রেডিওর শব্দে মাথা ধরে যাচ্ছে। তাই অনেক কষ্টে ভগ্নস্বরে বলে,
-ওফ ইট দাদাই।
আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকাল। রোজের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত চেহারা দেখে বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠলো। রোজের যে জ্বর সেটা তো ওর খেয়ালই ছিল না। টেক্সটাও নিচে পড়ে গিয়েছিল বলে ভালো করে দেখা হয়নি। মেয়েটা কি সেজন্য দুঃখ পেয়েছে? আরশান গাড়ি থামিয়ে ডান হাত রোজের মাথায় ছোঁয়াতেই শিউরে উঠলো। উত্তাপে হাত জ্বলে উঠল মনে হয়। আরশান রোজের মাথায় পুরো হাত রেখে বলল,
-কষ্ট হচ্ছে অনেক?
রোজের সরল স্বীকারক্তি,
-হুম।আজ কেমন জানি মনে হচ্ছে, সত্যিই আমার কেউ নেই। পৃথিবিতে আমি একা। সবাই চলে গেল, তাহলে আমায় রেখে গেল কেন? দাদাই। কার ভরসায়?
-আমি স্যরি বললাম তো।
-স্যরি শুনতে চেয়েছি? আর যাকে তাকে স্যরি বলার অভ্যাস বদলাও।
-তার মানে শুধু অভিমান না, রাগও হয়েছিস আমার ওপর।
-না।
-বললেই হলো? আমি বুঝি না? জ্যাকেটটা খুলে রাখ।
-উহু ঠান্ডা।
-আরে জ্যাকেটে পানি জমেছে। ওতে ঠান্ডা বেশি লাগবে। কুসুমের ওরনা আছে ওটা পেঁচিয়ে নে।
-লাগবে না।
-আবার রাগ হচ্ছিস? তুই বড্ড জ্বালাচ্ছিস বেবি! এটা একদমই ঠিক না।
-ছুটি চেয়েছিলাম তোমার বাপ দেয়নি কেন? এটা ঠিক?
-তোর শো কে করবে? তোকে ছাড়া ওটা করা অসম্ভব। সবাই তোকে চায়, বুঝিস না কেন?
-তোমার মত একজন প্রয়োজন আমার। কুসুমের যেমন আরশান আছে, রোজের তেমন কোনো মানুষ নেই কেন দাদাই?
-চোখ বুজে রাখ। কথা বলবি না আর।
রোজ কথা বাড়ালো না। চোখ বুজে রইলো। আরশানের দৃষ্টি সামনে থাকলেও মন পড়ে রইল পাশের রমনীটির কাছে। যে মেয়েটা সবার সব সমস্যা মেটায়, সবাইকে হাসায় তাঁর মনের দুঃখ মেটানো এতটা কষ্টসাধ্য কেন? মাঝে মাঝে আরশানের নিজেকে অপরাধি মনে হয়। ওর জন্যই বোধ হয় রোজের আজ এমন অবস্থা। যদি সময় থাকতে মানুষ মূল্য দিতে জানতো, বুঝতে জানতো। তাহলে হয়তো আজ পরিস্থিতি অন্যরকম হত। বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতেই আরশান বুঝলো রোজ ঘুমিয়ে পড়েছে। ভারি নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে, হাত সীট থেকে নিচে পড়ে গেছে। এলোমেলো হয়ে সিটের মাঝে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। আরশান সীটবেল্ট খুলে রোজের মাথা নিজের কোলের ওপর রেখে অয়ন্তির ওরনা দিয়ে সীটের সঙ্গে ওর কোমর বেঁধে দিল যেন ধাক্কায় পড়ে না যায়। রোজ ঘুমের মধ্যেই বিরবির করে বলল,
-আই হেইট ইয়্যু! আই যাস্ট হেইট ইয়্যু। ইউ নেভার লাভ মি। আই নেভার লাভ ইয়্যু। আমি কখনও তোমার কাছে যাবো না। তুমি ভালোবাসা দেখালেও না। কারন আমি তোমাকে ঘৃণা করি, শুধু ঘৃণা।
আরশানের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো রোজের চেহারার ওপর। উষ্ণ তরল পদার্থ টের পেতেই রোজ বা হাতে মুখ চুলকালো। আরশান তা দেখে সযত্নে সে পানি নিজের রুমাল দিয়ে মুছে দিল।রোজ চায়না ওর বিরুদ্ধে ওর অবচেতনায় কোনো পুরুষের ছোঁয়া পেতে। তাই আরশান রোজের সেই চাওয়ার বিরুদ্ধে যেতে পারে না। সজাগ থাকলে সে অবশ্যই হাত দিয়েই রোজের চেহারা মুছে দিত। আরশান নিজের বাড়িতেই রোজকে নিয়ে আসলো। গাড়ি গ্যারাজে রেখে সে রোজকে ডাক দিল। প্রথম ডাকে সাড়া পেল না, পরে আরও তিন-চারবার ডাকতেই রোজ উঠে বসলো। জ্বরের ঘোরে বাচ্চাদের মত করে বলল,
-স্যরি, কষ্ট হলো নাকি তোমার? পায়ে ব্যাথা পেয়েছ?
-থাপড়ে গাল লাল করে দেবো। নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছিস, আর আমাকে নিয়ে চিন্তা! নিজের কথা ভাব। আমি নিজে স্যুপ বানিয়ে দেবো তোকে, ঘরে গিয়ে সেটা খেয়ে ঘুমাবি। বাড়তি কোনো কথা না, ওকে?
-তুমি আমাকে বকছো দাদাই?
-বকবো না? কোনো কথা শুনিস তুই? নাম, আমাকে ধরে হাট।
-আমি তো একা হাটতে পারবো।
-ধরে হাটবি নাকি কোলে নেবো?
-ধরে হাটছি। হাত কই তোমার? আমি দেখতে পাচ্ছিনা।
-চোখ তো খেয়ে ফেলেছিস। কাঁনা! এই নে ধর।
আরশান রোজের হাত ধরতেই রোজ আরশানের হাত চেপে ধরলো। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই আরসালান ভাই ও তাঁর স্ত্রী রজনী ভাবি এগিয়ে আসলেন। রজনী ভাবি উতলা কন্ঠে শুধালেন,
-পিচ্চিটার হলো কি? টলছে কেন? আরশান ওকে ধরে সোফায় বসাও। জ্বর নাকি? মেয়েটা একদম কথা শোনে না। পঁচা মেয়ে।
রোজ অভিমানি গলায় বলে,
-দাদাই আমাকে আমার বাড়িতে রেখে আসো। আমি তো পঁচা। থাকবো না এখানে।
-থাকবো না বললেই হলো? আরশান পানি আনো। ওর গলা শুকিয়ে আসছে। অভীর বাবা ডাক্তারকে ডাকো। মেয়েটার গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
আরসালান ফোন নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়লো। এত রাতে ডাক্তার বাড়িতে আসতে পারবে না, কিন্তু মেডিসিনের নাম নিশ্চই বলতে পারবে। ড্রইংরুমে চেঁচামিচি হতেই আরশানের বাবা আমীর সাহেব চোখে চশমা পড়তে পড়তে নিচে নামলেন। সবাইকে একসঙ্গে নিচে দেখে তিনি বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
-কি হয়েছে? লাইট জ্বালানো দেখে নামতে হলো।
রজনী জবাব দিল,
-রোজের অনেক জ্বর বাবা। আরশান নিয়ে আসলো।
-সেকি! জ্বর কমেনি? আমি যে আসার সময় মেডিসিন দিয়ে আসলাম। নিশ্চই খায়নি। এই মেয়েটা এত জেদি! আরসালান এ্যান্টিবায়োটিক আন। ওর সিম্পিলে কাজ হয় না।
বাবার আদেশ পেতে আরসালান নিজের ঘরে গিয়ে এ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে আসলো। আরশান স্যুপ বানিয়ে এনেছে। আমীর সাহেব নিজ হাতে রোজকে স্যুপ খাইয়ে দিলেন এরপর ঔষধ রোজের মুখের সামনে তুলতেই রোজ বমি করার ভাব নিয়ে বলে,
-ছি! তুমি তো জানো, এসব খাই না আমি। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবো।
-খেতে হবে না। গিলতে হবে। চুপচাপ গিলে ফেল। মানা শুনবো না আমি।
-তুমি পঁচা। তোমরা সবাই পঁচা।
-ঠিক আছে। তুই একা ভালো। তাই ভালো মেয়ের মতো ঔষধটা খেয়ে নে মা।
-খেলে কি দিবা?
-কি চাই?
রোজ ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
-ওনাকে ফিরিয়ে দাও। আমার একা খুব কষ্ট হয়। কষ্ট হয় অনেক। ফিরিয়ে দাও না ওনাকে।
আমীর সাহবে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে রজনীর পানে চাইলেন। সবাই অসহায় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে আছে। সব থেকে করুন চেহারা আরশানের। আমীর সাহেব হাসার চেষ্টা করে বললেন,
-আচ্ছা। আগে খেয়ে নে, তারপর তোর ওনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
রোজ কাঁদো কাঁদো চেহারায় বলে,
-সত্যি তো?
-হুম।
-তিন সত্যি?
-আগে খেয়ে নে। না খেলে কোনো উনি টুনি আনবো না। আমার মেয়ে কি ফেলনা নাকি, যে ছেড়ে যায় তাকে ডেকে আনবো কেন? সে বুঝুক হীরার আর কাঁচের কি তফাৎ।
-আমি তো তাও না। পায়ের ধুলো, তাই পিসে মাড়িয়ে চলে গেল।
-রোজ! (ধমক দিলেন)
-খাচ্ছি তো। কিন্তু তিতা লাগবে।
-আরশান ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম, ফালুদা, কাস্টার্ড, মিষ্টি সব এনে দে। এবার খা মা, আরশান চকলেটও আনছে। ঔষধ খেয়ে ওসব খা, দেখবি তিতা লাগবে না।
-ঠিক আছে।
রোজ ঔষধ খেতে খেতেই রজনীর কোলের ওপর শুয়ে পড়লো। আমীর সাহেব হতাশ চোখে চাইলেন। মেয়েটা কত আশা নিয়ে নিজের একটা ইচ্ছে প্রকাশ করল। আর তারা সেটাও পূরণ করতে পারবে কিনা জানেন না। আরশান বাবার দিকে ফিরে বলল,
-ওকে একা রাখা ঠিক হবেনা। কিছুদিন এখানে থাকুক।
-হ্যাঁ।
-তুমি কি আমার ওপর এখনও রেগে আছো বাবা?
-না।
-তাহলে এভাবে কথা বলছো কেন? সব তো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবুও,
-কারন রোজের এমন অবস্থা হওয়ার পেছনে তোমারও হাত আছে। তুমিও অপরাধি, অন্যায় তুমিও করেছ।
-বাবাহ্!!
-যতদিন না রোজ ঠিক হয়। সুস্থ হয়, আমাকে বাবা ডাকবে না তুমি।
-ঠিক আছে। আমিও দেখবো বেবি কতদিন আমাকে অপরাধি বানিয়ে রাখে। আমার জন্য হলেও ওকে সুস্থ হতে হবে।
-কে তুমি? ওর জীবনে তোমার ভূমিকা কি যে তোমার জন্য ও সুস্থ হবে? পারলে নিজের ভুল শুধরাও। নাহলে,
-নাহলে?
-বলে কি লাভ?তুমি শোনার মত ছেলে? দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ।
কথাগুলো বেশ রেগে বললেন আমীর সাহেব।যার দরুন রোজ ঘুমের ঘোরেও চিৎকার শুনে বলল,
-ঝগড়া করেনা। ঝগড়া ভালো না।
আমীর সাহেব রোজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-তোর এত ভালো হওয়া উচিত ছিল না মা। তোর কঠিন হওয়া উচিত ছিল।
সকালে ঘুম ভাঙতেই কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল রোজ। গন্তব্য লাইব্ররি। কিছু বই কালেক্ট করতে হবে। পড়া বাকি অনেক। অনেক কিছু জানা বাকি। সব জানতে হবে তো।
___________
খাবার টেবিলে অয়ন্তি আসামাত্র আশরাফ মীর্জা গলা পরিষ্কার করে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিলেন। অয়ন্তি বুঝলো বিয়ের ব্যাপার এটা।তাই মেজাজ আগে থেকেই গরম হয়ে গেল। আশরাফ মীর্জা ভণিতা না করেই বলে উঠলেন,
-আমীর খাঁন বলছিলেন, আগামী মাসের শেষের দিকে যদি বিয়েটা।
-আরশানকে চিনি না আমি। চিনতে, জানতে সময় লাগবে। তারপর আলোচনা। অপরিচিত একজনকে হুট করে বিয়ে কিভাবে করবো?
-আচ্ছা।
খাওয়া শেষে অয়ন্তি তৈরি হয়ে নিল। প্রাপ্তকে একবার দেখতে যাওয়া উচিত। কিন্তু আরশান? সে যদি কোনো ভাবে ধরে ফেলে তাহলে তাঁর অদ্ভুত কাজের শুরু হয়ে যাবে। যেটা অয়ন্তি চায়না। লোকটা একটা মহাঅসভ্য। কখন কি করে বসে বলা যায়না। তার থেকে লাইব্ররিতে গিয়ে জার্নালিজমের কিছু বই এনে পড়লে কেমন হয়? কিছুদিন পরই রেজাল্ট দেবে। তারপর সে জার্নালিজমে ভর্তি হয়ে অনার স্বপ্ন পূরণ করবে।যেই ভাবা সেই কাজ। অয়ন্তি গুছিয়ে ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। লিস্টও করেছে কি কি বই আনবে। কিন্তু লাইব্রেরিতে এসে হতাশ হতে হলো।লিস্টের একটা বই’ও নেই। কেউ নিয়ে গেছে। এটা কোনো কথা? বিরক্ত, বিষাদগ্রস্ত চিত্তে বারান্দা দিয়ে হাটতেই অয়ন্তির নজর আটকালো সামনেই ধূসররঙা শার্ট পড়া পুরুষটির দিকে। অয়ন্তি ভালো করে চাইল। আরশানের মত লাগছে। কিন্তু আরশান এখানে কি করবে?তাছাড়া ওর তো শো চলছে এখন। অয়ন্তি মনের ভুল ভেবে পাশ কাটিয়ে যেতেই আরশান অয়ন্তিকে ডাক দিল,
-এই কুসুম তুমি এখানে?
অয়ন্তি দাঁড়ালো না। আরশান অয়ন্তির পেছনে পেছনে এসে গম্ভির কন্ঠে বলল,
-ডাকছি তো।
-আপনি? আমি তো হ্যালুসিনেশন ভেবেছিলাম।
-আমাকে নিয়ে তাহলে কল্পনাও হয়? ভালো ভালো। তা কি কি কল্পনা করেছো?বাচ্চা অবধি পৌঁছেছে কল্পনা?
-অসভ্য।
-ওহ হ্যাঁ। গতকাল তো এটার অর্থ বলতেই গিয়েছিলাম। বলা হয়নি। চলো আজ বলে দেই।
-কি?
-অসভ্যতার সংজ্ঞা। তাও প্রাকটিক্যালে।
বলেই অয়ন্তিকে টেনে লাইব্রেরির মধ্যে নিয়ে গেল আরশান। অয়ন্তি চিৎকার দিতে যাচ্ছিল তখনই ওর মুখ চেপে ধরলো আরশান। ফিসফিসিয়ে বলল,
-লাইব্রেরি এটা। চেঁচিয়ে সবাইকে বিরক্ত করবে না কুসুম।
রোজ গাড়িতে বই রেখে আবারও লাইব্রেরিতে আসে। ভুল করে লাইব্রেরি কার্ড ফেলে গেছে সে। সেটা নিতেই এসেছিল। কিন্তু আরশান আর অয়ন্তিকে দেখে সে দ্রুত চারপাশে নজর বুলালো। এটা প্রেম করার জায়গা?এরা আর বদলালো না। দরজার সামনে দিয়েই একজন স্যার আসছিলেন। রোজ চোখ বড় বড় করে একবার স্যারের দিকে আর একবার আরশানদের দিকে তাকাল। স্যার দরজার কাছে আসতেই রোজ একগাল হেসে এগিয়ে গেল,
-আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন? শরীর ভালো তো?
-আরে রোজ! হ্যাঁ ভালো আছি। তোমার কি খবর?কতদিন পর এলে, তা হঠাৎ কি মনে করে?
-ভালো।কি মনে করে মানে? পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে গেছি বলে কলেজে আসা বারণ তা তো কোথাও লেখা দেখলাম না। আপনাদের ব্যানার বা পোস্টার লাগিয়ে নিষেধাজ্ঞা বলে দেওয়া উচিত ছিল।
-তাই? দুষ্টুমি দেখছি আগের থেকেও বেড়েছে।
-আমি দুষ্টু না।
-হুম, দুষ্টু না মহাদুষ্টু। তারপর বলো লাইব্রেরিতে কি মনে করে? এডমিশনের পড়া কেমন চলছে? মেডিকেল নেবে তো?
-চলছে মোটামুটি। আর মেডিকেল না, জার্নালিজম।
-সেকি! ব্রাইট স্টুডেন্ট তুমি। মেডিকেলের জন্য রাতদিন পরিশ্রম করলে। ওসব জার্নালিস্ট হতে হবে না। প্রচন্ড রিস্ক ওতে। পরিশ্রমও অনেক। তোমার স্যার হিসেবে বলছি, মেডিকেলে ট্রাই করো। সরকারিতে চান্স পেয়ে যাবে।
-জি স্যার! মাথায় রাখবো। তো কোথায় যাচ্ছিলেন?
-লাইব্রেরিতে। নোটস দিতে।
-আমিও যাচ্ছি। আমার কাছে দিন, জমা দিয়ে দেবো।
-আচ্ছা।
স্যার চলে যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো রোজ। উঁকি দিয়ে দেখলো আরশান অয়ন্তিকে জোর করে আটকে রেখেছে। অয়ন্তির লজ্জায় রক্তিম হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে স্মিত হাসে রোজ। প্রয়োজনের অধিক কথা বলা রোজের পছন্দ নয়। আগে ছিল কিন্তু ইদানিং কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। তবুও এদের জন্য কতকিছু বলতে হলো। নোটস অবধি বগলদাবা করে ছুটতে হচ্ছে। আর এদের দেখো। দিন-দুনিয়া ভুলে প্রেমে মশগুল।
#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_সাত
অয়ন্তির মুখের ওপর ঝুঁকে প্রায় পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে আছে আরশান। অস্বস্তিতে অয়ন্তি নড়তেও পারছে না। নড়লেই এই লোক বলেছে,ঘটনা একটা ঘটিয়ে ফেলবে। না জানি কি করে বসে লোকটা। কিন্তু এভাবে তাকায় কেন? পলকহীন নীলচোখগুলো ‘খেয়ে ফেলবো’ টাইপ দৃষ্টি দিয়ে গিলে ফেলছে অয়ন্তিকে। অয়ন্তির দুপাশে হাত রেখে বন্ধন তৈরি করে রেখেছে আরশান। কিন্তু তা বেশিক্ষণ টিকলো না। রোজ এসে, খুক খুক করে কেঁশে সংকেত দিল প্রিনসিপ্যাল স্যারের আগমনের। আরশান রোজকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে সরে দাঁড়ালো। অয়ন্তি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আরশানকে ভীত দেখাচ্ছে, ঘাবড়ে সে শার্টের কলার ঠিক করছে। লোকটা ভয়ও পায় নাকি? রোজকে চেনে না অয়ন্তি তাই সেও কিছুটা বিব্রতবোধ করে বলল,
-তুমি কে?
রোজ অয়ন্তির দিকে ফিরল। মেয়েটা একদম পুতুলের মত সুন্দর। কি মিষ্টি আরশানের কুসুম। এজন্যই বোধ হয় আরশান সব ছেড়ে কুসুমের পেছনে পড়ে ছিল।ইশ! মেয়েটা দারুন ভাগ্যবতী। রোজ নিজের সূদর্শনা হাসি ঠোঁটে বজায় রেখে বলল,
-হাই, আমি সাইরাহ্ এ রোজা! আরশানের বন্ধু তবে বন্ধু কম বোন বেশি। তাই তুমি আমাকে ননদ ভাবতে পারো কুসুম। বাই দ্যা ওয়ে আমরা সেম ব্যাচ, সাইন্স থেকে এক্সাম দিলাম, তুমি তো হিউম্যানিটিস ছিলে। তাই না?
-হুম। তোমাকে কখনও দেখিনি কলেজে।
-আমি ট্রান্সফার নিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে এসেছিলাম তাই দেখোনি। তোমাদের আর আমাদের ক্লাস টাইম আলাদা ছিল সেজন্য তো আরও কম দেখা হয়েছে। তুমি ভারি মিষ্টি ভাবি!
-তোমার কন্ঠ চেনা চেনা লাগছে! আগে শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না।
রোজ অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে বলে,
-দাদাই আমি বাড়িতে ফিরছি। তুমি ভাবিকে নিয়ে কি ঘুরতে যাবে? অবশ্যই ফার্মহাউজ’টা ঘুরিয়ে দেখাবে। ওকে?
আরশান গলা পরিষ্কার করল। লজ্জায় কথা বলতে না পারায় রোজ বিজ্ঞ কন্ঠে বলল,
-লজ্জা পেতে হবে না। আমি কিছু দেখিনি। বাই ভাবি আবার দেখা হবে।
অয়ন্তি কিছু বলবে তার আগেই রোজ চলে গেল। ভারি অদ্ভুত মেয়ে তো অয়ন্তিকে কথা বলর সুযোগই দিলো না। আরশানের তো কোনো বোন নেই, ওরা তো দু ভাই। তাহলে এই বোন কোথ থেকে আসলো? পরে ভাবলো বোন নয় তো, বন্ধু। বন্ধুকে বোনের মত ভাবে আরশান। অয়ন্তি শুকনো ঢোক গিলে বলল,
-এবার বাড়ি যাই?
-না। ফার্মহাউজে যাবো। শুনলে না, বেবি যেতে বলল। আর বেবির কথা অমান্য করার সাধ্য নেই আমার। সো চলো মাই লাভ, চেনাজানার প্রথম ধাপ ফেলা যাক। তুমি আমাকে যতটা চাও চিনে নিতে পারবে এবার।
রোজের কথা শুনে অয়ন্তির মনে হুট করে হিংসার আবির্ভাব হলো। মেয়েটার মূল্য আরশানের জীবনে এত যে ওর সামান্য একটা বাক্যও অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করতে হবে? কে ও? অয়ন্তির মনটা আবারও বিষিয়ে উঠল।মেয়ে যখন একটা হাতেই আছে তাহলে অয়ন্তির পেছনে পড়ে আছে কেন? ক্যারেক্টারলেস আরশান। অয়ন্তিকে ভাবনার সাগরে ডুব দিতে দেখে আরশান ওর নাকের সামনে তুরি মেরে বলল,
-আবার কোন ভাবনায় ডুব দিলে জান?
-রোজা কে আরশান?
-বেবি তো বলল’ই, আমার বন্ধু। কিন্তু বন্ধু কম বোন বেশি।
-বোন বা বন্ধুর কথা মানার জন্য এতটা ব্যাকুল হতে আমি তো কখনও কাউকে দেখিনি।
-আর ইয়্যু জেলাস?
-নো।
-ওকে। জেলাস না হলে জেলাসি মেটানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আর পূর্বে যদি দেখে না থাকো এখন দেখে নাও।
-ক্যারেক্টারলেস!
-কে তুমি? জানি তো। নতুন করে বলতে না। যে মেয়ের হাজার হাজার বয়ফ্রেন্ড সে ক্যারেক্টারলেস হবে এটা স্বাভাবিক। আর আমার হৃদয়টা এতটাই সুবিশাল যে তোমার এই বড় অন্যায়টা’কেও মাফ করে দিয়েছি।
অয়ন্তি কথা বাড়ালো না। আরশান মৃদু স্বরে বলল,
-বেবি আমার বোনের থেকেও বেশি কুসুম। তুমি যেমন আমার প্রেমময়ী ভালোবাসা, বেবি হচ্ছে স্নেহময়ী ভালোবাসা। ওকে হিংসে করা মানে আমার ভালোবাসা অসম্মান করা। এটা তুমি করতে পারো না। বুঝেছো?
-আমার তো অন্যচক্কর মনে হচ্ছে।
আরশান চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। মনে মনে বলল,’শুধু তুমি না, সবারই এমন মনে হয়। ‘ কিন্তু মুখে বলল,
-প্রেমের পড়ার কয়েকটা স্টেপের মধ্যে এটা একটা। সন্দেহ! ভালো ভালো, সন্দেহ না করলে মাঝে মাঝে সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে যায়। সম্পর্কে খুঁনসুটির প্রয়োজন আছে।
-যাবেন?
-যাওয়ার জন্য বেশি ব্যস্ত? কি মতলব আটছো বলো তো? দেখো আমি কিন্তু একদম পিউর ভোলাভালা এক অবুঝ পুরুষ। আড়ালে নিয়ে আমার সতীত্বহরণ করবে না তো?
-ছেলেদের সতীত্ব থাকে?
-মেয়েদের থাকলে ছেলেদের কেন থাকবে না? সবখানে বৈষম্য মেটানোর স্লোগান চলছে আর তুমি সেসব পাত্তা না দিয়ে ভেদাভেদ করার চিন্তায় আছো। এটা ঠিক না।
-গিরগিটি! আপনার মত এত রঙ গিরগিটিও পাল্টায় না।
-কারন গিরগিটির এত রঙ নেই। যতটা ভালোবাসায় আছে। আর ভালোবাসার রঙে যে রঙিন হয় তার রঙের হিসাব একমাত্র সে করতে পারে যে ভালোবাসে। তুমি তো ভালোবাসা কি জানোই না, রঙের হিসেব কি করে করবে? যাই হোক, চলো। আমার শো আছে দুপুরে।
__________________
ফার্মহাউজটা সুবিশাল দৈর্ঘ্যপ্রস্থে নির্মিত। জঙ্গলের বিপরীতে ছোটখাট মাঠের পাশে। গাড়ির হর্ন বাজাতেই দারোয়ান দরজা খুলে দিল। আরশান গাড়ি নিয়ে ঢুকে দারোয়ানের সঙ্গে হেসে কথা বলতে বলতে নামলো। অয়ন্তি চারপাশটা দেখছে। বাড়ির সামনে ঝরণার ফোয়ারা! ডান পাশে বাগানের মত, বাপাশে ফুলের রাজ্য মনে হচ্ছে। অয়ন্তি সেসব দেখতে দেখতে এগিয়ে গেল। আরশান দারোয়ানকে খাবার আনতে বলে পেছন পেছন আসলো।
-দারুন জায়গা তো।
-দারুন? বাসরের প্লানিং এখানে করলে কেমন হবে?
-একদম বাজে।
আরশান মুচকি হাসে।
বাড়ির ভেতরটা চকচক করছে। প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করা হয়, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আরশান বলতে শুরু করলো,
-আমার জীবনের অনেকটা সময় এখানেই কেটেছে। এখানে পিকনিকে আসতাম। এই ফার্মহাউজের প্রতিটা দেওয়ালে, মেঝেতে আমাদের চিত্রকর্ম আছে। আমার বাচ্চাদেরও এখানে আনবো আমি। তুমি আসবে তো?
-না।
-তুলে আনবো!আসবে না মানে, তুমি না আসলে আমার বাচ্চাদের দেখে রাখবে কে?(উচ্চস্বরে বলল)
অয়ন্তি ভয়ে কেঁপে উঠে বুকে থুতু দিল। আরশান সেটা দেখে হাসতে হাসতে কিচেনের দিকে চলে যায়। অয়ন্তি পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছে। তিনতলার একটা ঘর খোলা। অয়ন্তি কৌতুহলী হয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই ওর চোখ পড়লে ঘরের একটা দেওয়াল জুড়ে টানানো বিশাল একটা স্কেচ করা ছবিতে। লম্বা থেকে খাটো হয়ে আসা ছবিটা দারুন লাগছে দেখছে। চেহারা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তা হলো, বাম পাশে সবথেকে লম্বা ছেলেটা, তারপর আরেকটা ছেলে, তারপর আরেকটা ছেলে আর তিন নম্বর ছেলেটার হাত ধরে চোখ টিপে দাঁত বের করে হাসা এক বাচ্চা মেয়ে। তিনম্বর ছেলেটা মেয়েটার দিকেই তাকানো। স্কেচে ভারি মিষ্টি লাগছে দুজনকে। কারা ওরা? আরশান অয়ন্তিকে খুজতে খুজতে উপরে আসল। অয়ন্তি একধ্যানে ছবিটার দিকে চেয়ে আছে দেখে আরশান হেসে বলে,
-আমাদের ছোটবেলার ছবি। আন্টি স্কেচ করিয়েছিলেন। আরসালান ভাই, আমি, বেবি। বেবিকে কেমন দুষ্টু দুষ্টু লাগছে তাইনা? ছোট থেকে ভারি দুষ্টু ও। একবার কি হয়েছিল জানো? আমি যখন প্রথম ওদের বাড়িতে যাই, তখন কিছু চিনতাম না। বাবারা ওদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল, আর আমি গাড়ি থেকে নামছিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই ও আমার ওপর গোবরের পানি ছুড়ে মা’রলো। আমি তব্দা খেয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। আরসালান ভাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আমি তো রেগে মেগে একাকার। বাড়ি ঢুকবো না, চলে যাবো এমন জেদ ধরে গাড়ির ভেতর গিয়ে বসতেই ঝপাত করে আরসালান ভাইয়ের গায়ের ওপর পানি পড়ার শব্দ পেলাম। ভাই হাসি থামিয়ে আমার দিকে ভড়কে তাকালো। তাঁর ওই অদ্ভুত চেহারা দেখে আমি হাসতে হাসতে রাগের কথা ভুলেই গেলাম। তখন পিচ্চিটা এসে কোমরে হাত গুজে বলে, ‘তালা তোমলা?’ আড়াই বছরের পিচ্চি, আর তাঁর এহানো কাজে ভাই আমি দুজনেই কুপোকাত। পরে বুঝলাম পানিগুলো ও নয়। অন্য একজন মে’রেছে। যে একসময় বেবির প্রতিটা কথা শুনতো। কিন্তু বুদ্ধিগুলো তো বেবিরই।
-বেবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ!
আরশান থেমে গেল। অয়ন্তি কৌতুহলী কন্ঠে বলল,
-রোজার হাত ধরে আছে ওটা আপনি? আরসালান ভাই বোধ হয় সবথেকে লম্বাজন।
-ওটা না, আমি আরসালান ভাইয়ের পাশেরজন।
-তাহলে ওটা কে? রোজার দিকে দারুনভাবে তাকিয়ে আছে। আপনাদের বন্ধু নাকি?
-হ্যাঁ।
-কি নাম?
-দুপুর হয়ে এলো। চলো খেতে হবে। তুমি এত বকবক করো কেন?
আরশানের এড়িয়ে যাওয়াটা বেশ বুঝলো অয়ন্তি। মনে প্রশ্নটা চাপা দিয়ে আরশানের পিঁছু পিঁছু আসলো সে। কারন আরশানের খপ্পর থেকে বাঁচা মুশকিল। বাড়ির যা অবস্থা তাতে বিয়েটাও ভা’ঙা অসম্ভব। তাই বিয়েটা যখন হবেই, অয়ন্তির উচিত আরশানের সম্পর্কে জানা। খাবার টেবিলে বসে অয়ন্তি প্রশ্ন করে,
-আপনার পুরো নাম?
-আরশান খাঁন তৈমুর।
-বয়স?
-তেত্রিশে পড়েছে।
-কি?
-কি?
-আমার থেকে পনেরো বছরের বড় আপনি? হোয়াট দ্যা! এত বয়স্ক মানুষের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করল কি করে বাবা? আজব তো!
-আমাকে দেখে বয়স্ক মনে হয়?
-মনে না হলেও, বয়স্ক তো। এইজ ডিফারেন্স এত নিয়ে কাউকে মানা যায় না। লজ্জা করে না নিজের থেকে এত ছোট একটা মেয়ের পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে থাকতে।
-না।
-লজ্জা থাকলে তো লাগবে। নির্লজ্জ।
-বিয়ের প্রস্তাব তোমার বাবা পাঠিয়েছে। আমাকে এসব বলছো কেন? নিজের বাবাকে গিয়ে বলো।
-বলা যাবে না। তারপর বলুন আপনার ইনকাম কত?
-তোমার যত টাকা লাগবে তা তৎক্ষনাৎ পাবে। তাই এই হিসেব তোমাকে রাখতে হবে না।
-খাঁটাশ।
-ধন্যবাদ।
-কি করেন?
-বউয়ের সেবা। আর তাঁর কটুক্তি শোনাই আমার কাজ। পারিশ্রমিক পাইনা, তবে আশা করছি তাকে পরিশ্রমিক হিসেবে পাবো।
-সোজা কথা সোজা করে বলতে পারেন না?
-সোজা বললে বুঝবে না। নেক্সট কুয়েশ্চন?
-বাড়িতে কে কে আছে?
-বাবা, ভাই, রজনী ভাবি, ভাইয়ের তিন ছেলেমেয়ে অভী অয়ন আর রোশনি।
-কি পছন্দ করেন?
– লিস্ট করে তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবো।
-বেয়াবদ একটা।
-তোমার লজ্জা করেনা? পনেরো বছর বড় একজনকে বেয়াদব, অসভ্য, নির্লজ্জ, অভদ্র বলতে? এসব বলার উপযুক্ত কারন এখনও দেখাইনি আমি। যদি রেগে গিয়ে দেখাই? তখন কি করবে? আমার রাগ বাড়ছে কুসুম।
-সময় লাগবে ভাবতে।
-ওকে।
-আর’জে রোজের সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দেবেন? যাস্ট একবার, আর কখনও কোনো অনুরোধ করবো না। প্লিজ!
-কেন?
-কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই আমার।
-সে তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবে না। আর’জে রোজ অতি চুপচাপ থাকা একজন! প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা। তোমার সঙ্গে তো তাঁর অফিসিয়ালি পরিচয়ও নেই। তাই সে মিটিংটা এ্যাটেন্ড নাও করতে পারে।
-সেটা আমি বুঝে নেবো।
-ওকে। সোমবার সকাল ন’টায় তৈরি থেকো।
_______________
রোজের সামনে বসে কফিমগে চুঁমুক দিয়ে আরশান বলে উঠল,
-তুই গতকাল জ্বরের ঘোরে ওর নাম নিচ্ছিলি বেবি।
-কার নাম?
-ওনাকে এনে দাও, আই হেইট ইয়্যু, ইউ নেভার লাভ মি আই নেভার লাভ ইয়্যু! তোমার কাছে ফিরবো না।
রোজের মনে পড়লো ঘটনাটি। তারপর আলতো হেসে বলল,
-পুরোনো অভ্যাস। তাই হয়তো বলে ফেলেছি। সিরিয়াস কিছু না। কিছু কিছু মানুষ চলে গেলেও তাদের স্মৃতির রেশ রেখে যায়। উনি তেমনই একজন। আর আমি তো বলেছিই আমি কাউকে ভালোবাসিনা, বাসবো না।তাকে তো একদমই না। মায়া জমে ছিল বলে তার নাম জপ করেছি। নাথিং এল্স দাদাই।
-সিরিয়াসলি? তুই বলছিলি ওর জন্য তোর কষ্ট হয়। বাবা আমাকে এই নিয়ে অনেক কথা শোনালো। আমিও প্রথমে যখন গাড়িতে বসে শুনলাম, অপরাধবোধে তো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম।
-ধ্যাত! কিসের অপরাধবোধ?আঙ্কেলকে আমি বুঝিয়ে বলবো। আর তোমরা সবাই তো জানো জ্বর হলে আমি আধা মাতাল আর আধা পাগল থাকি। সব কথা ধরতে আছে নাকি? যা যা বলেছি, ভুলে যাও। আর উনি নয় ও, ওকে আমি ঘৃণা করি। বুঝেছ? যে আমার মর্ম বোঝে না তাঁর মর্ম বুঝে লাভ নেই আমার।
-বাঁচালি। কিন্তু কাল তোর অভিমান হয়েছিল কি নিয়ে? কুসুমের আরশান আছে, তোর কেউ নেই। এটার মানে কি হ্যাঁ? জামাই লাগলে বল, আমার ছোট ভাইব্রাদাররা তো তোর উপ্রে ফিদা! ইশারা দিলেই লাইন লেগে যাবে।
-আমার বয়স মাত্র আঠারো! একুশ পার হোক। লাইন তখন লাগিও। এখন লাগবে না।
-কুসুম তোকে সন্দেহ করছিল। সবাই করে, কাহিনি কি বুঝলাম না। আমাদের দেখলে কোন এঙ্গেলে প্রেমিক প্রেমিকা টাইপ লাগে?
-কি জানি! হয়তো আমরা দুজন দুজনকে গুরুত্ব দেই, কদর বুঝি, কেয়ার করি, এসবেই। বাট সেগুলো তো ভাই-বোন হিসেবে।শুধু কি প্রেমিক-প্রেমিকা’রাই ওভাবে কথা বলে? ভাইবোন’রা বলতে পারে না?
-গুড আন্সার।চলার মত! বাট সত্যি করে বল তো বেবি! আমার ওপর তুই ক্রাশড না? তোর উপ্রে কিন্তু আমি বাচ্চাকাল থেকে ক্রাশড। শুধু আমার ঘুড়ির নাটাই কুসুমের হাতে বলে,,
-ক্রাশ নয় ভালোবাসা। ভালোবাসা হলে হ্যাঁ! আমি তোমাকে ভালোবাসি। শুধু তোমাকে না পৃথিবির সকল কিছুকে ভালোবাসি। সকল সৃষ্টিকে। বাট তোমার কুসুমের যে হাল শুনলাম! তোমাকে বিয়ে করে কিনা দেখো। বুইড়া জামাই তো ওর পছন্দ না।
-বিয়ে না করে যাবে কই? তুলে আনবো না। আরশানকে বারো বছর ঘুরিয়ে যেতে পারবে?
রোজকে বোঝানোর জন্য এটা বললেও আরশান স্বস্তি পেলনা। কারন সে অয়ন্তির আজকের কথাগুলো সারা দিন ভেবেছে। সত্যিই কি ওদের এক হওয়া সম্ভব নয়? অয়ন্তি কি ওকে মেনে নিতে পারবে না? আরশানকে মুডে থাকতে দেখে রোজ রসিকতা করে বলে,
-সমস্যা নেই। যদি কুসুম না হয়, বেবি দিয়ে কাজ চালাবে। এমনিতেই তো সবাই ভাবে আমাদের মধ্যে চক্কর আছে। কুসুম ছ্যাকা দিলে আমি মলম লাগিয়ে দেবো। নো প্রবলেম। আমার মনটা আবার সমুদ্রসমান বড়।বুঝলে, নিজে কষ্ট পাবো, কিন্তু তোমাকে তোমাদের কষ্ট পেতে দেবো না।
-তুই আর মলম? তুই তো কা’টা ঘায়ে নুন, লঙ্কার ছিটে দিতে আসবি। বজ্জাত মেয়ে!
রোজ হেসে বলল,
-হতেও পারে! আমাকে দিয়ে নিশ্চয়তা নেই। এখন যাও, পড়তে দাও আমাকে। আর হ্যাঁ, যাওয়ার সময় গেট টেনে দিও। আমি বাইরে যাবো, তখন তালা দেবো।
আরশান যেতে যেতে ভাবলো রোজ কি ওকে সত্যিই মলমের কথা বলল? নাকি পুরোটাই মজা? রোজ তো এমন মজা করেনা। তারপরই ভাবে, ধুর কি ভাবছে ও? রোজ ওকে ভালোবাসবে কি করে? রোজ তো এসব বোঝেইনা। হয়তো আরশান ক্রাশের কথা তোলার জন্য রোজ মশকরা করেছে। হ্যাঁ! এটাই হবে।
ওদিকে রোজ আরশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-ভালোবাসা বুঝি আমি। ভালোওবাসি। কিন্তু বলার জো নেই বলে বলিনা। তোমাদের বুঝতে দেইনা। ওনার কথা তোমরা কেন মনে করিয়ে দাও? তোমরা কি একদমই বোঝো না?ওনার কথা শুনলে আমার কষ্ট হয়। বুকের ভেতরটা পুড়তে শুরু করে। জমে থাকা কয়লা জ্বলতে শুরু করে। আজ তো কথার জালে সবটা চাপা দিলাম। ভবিষ্যতে কি করবো? জ্বর আসলে তেমাদের সামনে যাবোই না, তাহলে ওনার কথা মা-বাবার কথাও ঘোরের মধ্যে বলবো না। তোমরাও তাহলে বুঝবে না দাদাই।
চলবে?
[