তুই হবি শুধু আমার পর্ব -০৪+৫

#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_চার

দরজার সামনে গিয়ে আরশান দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। অয়ন্তি এদিক সেদিক উঁকি দিয়ে আরশানের দিকে তাকায়।দেওয়ালে হেলান দিলেও দরজার অর্ধেক আরশানের শরীরে বন্ধ হয়ে আছে। বাকি অর্ধেকে উঁচু ল্যাগেজ ভর্তি। ঠেলেঠুলেও তা সরানোর উপায় নেই। ভেতর থেকে তপ্ত বাতাস আসছিল বলে, অয়ন্তি এখানে শীতল বাতাসের মাঝে দাড়িয়ে ছিল কিন্তু জার্নি করায় শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। গোসলের প্রয়োজন! সবাই ওকে ফেলে ঢুকে গেল কি করে? আরশানের নির্নিমেষ দৃষ্টি অয়ন্তিকে বরাবরের মত ভীত করে তুলল। ধমক দেওয়া লোকটা ওর দিকে এভাবে তাকায় কেন? তখন মা’রামা’রিই বা করছিল কেন? ভেতরের কথাগুলো স্পষ্ট শোনেনি অয়ন্তি। শোনার প্রয়োজনও নেই, ভেতরে ঢুকতে হবে। এটাই ওর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। আরশানের দিকে চেয়ে অয়ন্তি অস্ফুটকন্ঠে বলল,
-ভাইয়া একটু সরুন। আমি ভেতরে যাবো।

ভাইয়া ডাক শুনেই আরশানের চেহারার হাসি বিলিন হয়ে গেল। কালো মেঘের আনাগোনা দেখা দিল তাঁর শুভ্র মুখশ্রীতে। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠলো। আরশান ভ্রু কুঁচকে সরে দাড়াতেই ভেতরে থাকা চারজন শব্দ করে হেসে ওঠে। তাদের হাসির কারন জানেনা অয়ন্তি। তাই চুপচাপ পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অনা অয়ন্তিকে যে কোনো ঘরে যাওয়ার কথা বলে পাঠিয়ে দেয়। অয়ন্তিও পুরো বাড়িতে চোখ বুলিয়ে দো’তলার একটা ঘরে চলে গেল। মাহিন সকৌতুকে বলল,

-ওহে ভায়া! চিলিক মা’রে, অন্তরে?

আরশানের ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো, বন্ধুদের সামনে হেরে যাওয়ার পাত্র নয় সে। নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে সে ভাব নিয়ে বলল,

-চিলিক মা’রবে কেন? ভাইয়া, ভাই যাই বলুক না কেন! তা থেকে সাইয়্যা, জামাই আমি বানিয়ে নিতে জানি। বয়স নিয়ে টেনশনে ছিলাম, এখন যখন গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছি তখন আর থামাথামি কিসের?

অনা ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
-থামাথামি কিসের মানে? তোর মত ই’তর’রে বিশ্বাস করবো আমি! তাই মনে হয়? খবরদার! ওর সঙ্গে কিছু করার কথা মাথাতেও আনবি না।নাহলে তোর বাপের রেডিও সেন্টার আর তোর ব্যাবসার নামে এমন রটনা ছড়াবো যে কাইন্দা কূল পাবা না চাঁন্দু!

সায়ন হেসে বলে,
-তা আর বলতে! জার্নালিস্ট ম্যাডাম কিন্তু মারাত্মক মহিলা হয়ে উঠেছেন আরশান। সাবধানে থাকিস, তাঁর ব্যাগে অলটাইম ক্যামেরা থাকে। সেটা কখন, কোথায় ফিট কইরা দেয়! আমরা তো বিবাহিত, বউ সব দেখে, জেনে নিয়েছে। তাই প্রবলেম নেই। কিন্তু তুই! তোরটা ভাইরাল হইলে তো লাভের ওপর লাভ।

সায়নের কথায় কেউ হাসলো না। সায়ন সিরিয়াস মুখ করে সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলে,
-হাসির কথা কইলেও তোগো হাসি আহে না। যা আমি একাই হাসমু! আরশান মাহিন যখন ই’ত’রামির লিস্টে আসে তখন কিছু হয় না, আর সায়ন কিছু বললেই সে লুচ্চা! যা, থাকুমই না তোগো লগে। সৌফি আসো বেবি আমরা ঘরে যাই, ঠান্ডা পানিতে গাত্র চুবানোর প্রয়োজন।

সায়ন চলে যেতে লাগলে সবাই হেসে দিল।মাহিনও চলে গেল উপরের একটা ঘরে। আরশান সোফায় বসে এখনও কাঁপছে। অনা পাশে বসে আরশানের কাঁধে হাত রাখে।

-জানিস সেদিন তোর কথা শোনার পর তোর ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল।বারবার ভাবছিলাম আট বছরের এক বাচ্চার প্রেমে পড়েছিস? আর সেই বাচ্চাটা কে? আমার অয়ন। রাগে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল আমার। ভেবেছিলাম তোর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখবো না। আমাদের ব্যাচের সবাই মাস্টার্সের পর চাকরি-বাকরি করে, এক একজন যখন বিয়ে করে নিচ্ছিল তখন সায়ন তোর কথা বলল। চার চার’টা বছর কে’টে গেল আরশান, তুই দেশে ফিরিস’নি। আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলে জানলাম তুই নাকি বলেছিস দেশে ফিরবি না।বিয়ের কথা দশবছরের আগে মাথাতেও আনবি না। তখন বুঝলাম তোর এহানো পরিবর্তনের কারন। কিন্তু তুই নিজে একটু হিসেব কর, অয়ন তোর থেকে তেরো বছর দু’মাসের ছোট। পাঁচ-ছয় বছর হয় তাহলে সেটা মানিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু এতটা গ্যাপ? অয়নের মন মস্তিষ্ক এখনও পরিপক্ক হয়নি। সবে ষোলো’তে পা দিয়েছে ও। জীবনের নতুন অধ্যায় সম্পর্কে জানতে শুরু করেছে। আর সেখানে তোর বয়স আটাশ! অয়ন যে একদম বাচ্চা তা নয়, বুঝতে শিখছে, হয়তো বোঝে। কিন্তু ভবিষ্যৎ? তুই ওর জন্য যেভাবে ডেসপারেট হচ্ছিস ও তো তেমন নাও হতে পারে।তোকে ভালোবাসা, তোর ভালোবাসা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার আরশান। তোকে আমি কলেজের প্রথমদিন থেকে চিনি। আমি জানি অয়ন তোর কাছে কতটা ভালো থাকবে। কিন্তু অয়নের কথাটাও ভাব। ও তোকে মানবে না। দেশে চল, তোর বাবা-মা অপেক্ষা করছে তোর জন্য। প্রয়োজন হলে তোর জন্য আমি মেয়ে খুজবো। দরকার পড়লে মাহিনরে ছেড়ে আমি তোরে বিয়ে করে ফেলবো।

মাহিন সিড়ি দিয়ে নামছিল, অনার কথা শুনে সে চকিত দৃষ্টিতে নিচে তাকাল। এরপর ব্যস্তভঙ্গিতে বলল,
-এসব প্লানিং চলছে নাকি? বউ কিন্তু বাসি হইয়্যা গেছে আরশান। ভাইবা কাজ করিস। দেখা গেল রেডিমেড বাচ্চা পাচ্ছিস! নিজের বংশের বাত্তি নিভাইয়া আমার বাত্তি লইয়া টানাটানি ভালা না, বুঝলা মামা।

অনা চোখ রাঙালো। মাহিন তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে অনার পাশে শুয়ে অনার কোলে মাথা রাখলো। অনা মাহিনের চুল টেনে দিতে দিতে বলে,

-অয়নকে ভুলে যা আরশান। মুভ অন কর লাইফে। এভাবে আর কতদিন চলবে? আট বছর আগে তোর প্রেমের বয়স পার হচ্ছিল, এখন কি বিয়ের বয়স থেমে আছে? তোর ফ্যামিলি, তুই, তোদের রেপুটেশন এতো ভালো। যেকোনো মেয়ের বাবা তোকে তার মেয়ে দিতে প্রস্তুত। বাস্তবতায় চোখ না বুলিয়ে তুই মরিচিকার পেছনে কেন ছুটছিস? অয়নকে এখানে এনেছি শুধুমাত্র তোকে দেখাবো বলে। অয়ন নিজের জীবনে খুশি, তোকে সে মনেও রাখেনি। তাহলে তুই কেন ওকে ভালোবেসে কষ্ট পাবি? আমি তোকেও সমান ভালোবাসি আরশান তাই বলছি নিজের জীবন নষ্ট করিস না। আঙ্কেল বলছিলেন অরুনির সঙ্গে তোকে ভালো মানাবে।

আরশান মাথা নিচু করে সবটা শুনছিল। এবার মাথা তুলে তাকাল সে। এরপর কঠিন গলায় বলল,
-তোর চাচাতো বোন অরুনি? তোরা কি আমাকে সস্তা প্রডাক্ট পেয়েছিস অনা? যার তার ঘাড়ে গছিয়ে দিতে চাচ্ছিস। আরশান খাঁন এতটাও সস্তা না।কুসুম আমাকে ভালোবাসবে কি বাসবে না, তা জানি না। কিন্তু আরশান কুসুমকে ছাড়া আর কাউকে চায় না। কুসুম আমার না হোক, অন্যকারো হবে। আমি শুধু চাইবো ও যার’ই হোক, যার কাছেই থাকুক, ভালো থাকুক। সুখে থাকুক। কিন্তু আমি ওকে ছাড়া অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করবো না। ভালোবাসতে পারবো না। ও ছাড়া আমি কাউকে চিন্তাতেও রাখতে পারি না অনা। ট্রাস্ট মি! আমার জন্য তোদের কারোর কোনো সমস্যা হবে না। তুই বাবাকে নিয়ে ভাবছিস তাই না? বাবা সত্যটা জানলে তোদের ভুল বুঝবে, কষ্ট পাবে সেটা নিয়ে ভাবছিস? আমি কাউকে বলবো না সত্যটা। শুধু তোরা চারজনই জানবি।তবুও আমার ওপর প্রেসার ক্রিয়েট করিস না। আমি কোনো বিয়ে-টিয়ে করতে পারবো না। আর রইল বাকি বংশরক্ষা। আরসালান ভাই তো বিয়ে করেছেন। দুটো ছেলেও আছে। ভাবি আবারও সন্তানসম্ভবা, মেয়ে হবে এবার। ব্যাস হয়ে গেল প্রবলেম সল্ভড।

-তার মানে তুই অয়নকে ছাড়বি না?

-না।

মাহিন হাই তুলে বলল,
-বাচ্চা বড় হতে দে। তারপর দেখ ওর মতামত কি হয়। দেন বিয়ের চিন্তা করিস। বাট আমার একটা ডাউব্ট থেকে যাচ্ছে। অয়ন বড় হতে হতে তুই বুড়ো হয়ে যাবি তখন তোর টাওয়ারে কারেন্ট থাকবে তো?

আরশান হতভম্ব চোখে চাইল। অনা মাহিনের চুলগুলো মুঠো করে জোরে টান দিতেই মাহিন ‘আহ’ করে উঠল। শব্দটা শুনে সায়ন সৌফি বেরিয়ে আসে। সায়ন কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-দিনে দুপুরে কিসব সাউন্ড করছিস ভাই! বাড়িতে যে দুইখান সিঙ্গেল পোলাপান থুরি একটা কচি মাইয়া আর একটা বুড়ো ভাম আছে সেদিকে নজর দিবি না?আমরা তো ঠান্ডা থাকুম ওরা কি করবে?

অনা পাশ থেকে কুশন তুলে ছুড়ে মারল সায়নের মুখে। এরপর কয়েকটা আঞ্চলিক গালি দিয়ে বলল,
-অয়নকে আনাই ভুল হইছে। তোদের মত অশ্লীল, অসভ্য, বেয়াদবগুলো আমার ছোটবোনটার কি হাল করবি তা বোঝা হয়ে গেছে। তাই আমি একটা কথা ক্লিয়ারলি বলতে চাই।

আরশানের দিকে ফিরলো অনা।
-অয়নকে পেতে হলে ওকে এসব অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখতে হবে আরশান। আমাকে কথা দিতে হবে বিয়ের আগে অয়নের সঙ্গে কোনো কিছু করবি না। নট এ্যা সিঙ্গেল লাভ টাচ! এমন কি ওকে টেরও পেতে দিবি না তুই ওর ওপর এট্রাক্টেড।ও যদি স্বেচ্ছায় তোকে চায়, বাড়িতে কারোর কোনো আপত্তি থাকবে না। বাবার সঙ্গে কথা বলেই এসেছি আমি। অয়ন যা চাইবে তাই হবে, সেজন্য সবার বিশ্বাস রক্ষা করার দায়িত্ব তোর। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম তুই ওকে কতটা চাস্। জানা হয়ে গেছে এবার মাহিন্না ও সায়ন্নার কি করবি তা তুই জানিস। মাথায় রাখিস আমার বোন যেন অকালে না পাঁকে। হুহ!

অনা গোসলের উদ্দেশ্যে উঠতেই, আরশান জামার হাতা ভাজ করতে লাগল। মাহিন, সায়ন হাসার চেষ্টা করে বলে,
-তোর জিগারের দোস্ত লাগি আমরা। আমাদের মা’রতে পারবি না তুই। তোর হাত কাঁপবে দোস্ত, তুই মনে মনে কষ্ট পাবি। আমরা জানি।

আরশান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-রিয়েলি? তো আমারও জানা উচিত। আমি মনে মনে কতটা কষ্ট পাই! তোরা সবগুলো মজা নিছিস আমার প্যারা দেখে। এবার আমার পালা।

অয়ন্তি জানালার পাশে দাড়িয়ে আরশানদের হাতাহাতি দেখছে। অয়ন্তির আরশানকে মনে নেই। মনে থাকার কথাও না। যখন আরশান ওদের বাড়িতে গিয়েছিল তখন অয়ন্তির বয়স সার্টিফিকেট অনুযায়ী ছয় বছর এগারো মাস চলছিল। হাতে গোনা কয়েকটা দিন পরেই সাত বছরে পড়বে এবং বাস্তবিক বয়স আটে পড়বে। আর আরশান সবে একুশে পা দিয়েছিল। সেই হিসেবে স্মৃতিশক্তি প্রখর হলেও অয়ন্তির স্মৃতিতে আরশান নাম স্থায়ীত্ব লাভ করেনি। অনার অনেক বন্ধুই তো বাড়িতে এসেছে।সবার নাম মনে রাখার মত ইচ্ছে অয়ন্তির তখন জাগেনি। আর সবার নাম মুখস্থ করাও অসম্ভব ব্যাপার ছিল। আজও তো আরশানকে চিনতো না সে, যদি না অনা আসার আগে জানাতো। প্রথম আলাপ থেকেই আরশান অয়ন্তির অপছন্দের তালিকায় যুক্ত হলো। ছোটবেলার ধমকের গল্প, এখন মা’রামা’রি! অয়ন্তি তো ভয় পায় এসব। আর যা ভয় পাওয়া হয় তার সঙ্গে সহজ হওয়া কঠিন বিষয়। অয়ন্তি বিছানার ওপর বসে ভাবতে থাকে, এত বন্ধু থাকতে অনা’রা দেশ পাড়ি দিয়ে এই বাজে বন্ধুর কাছে কেন এসেছে? যে মানুষ কথায় কথায় ঝারি দেয়, কেমন মাদকতায় পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অপ্রস্তুত করে দেয় সে আসলেই একটা বাজে লোক। ভালো মানুষ কি এভাবে তাকায়? ব’খা’টেদের মত দৃষ্টি দেয়? একদমই না। কিন্তু তবুও অয়ন্তির চোখ বারংবার আরশানের ওপর গিয়ে আটকাচ্ছে। অনার সব বন্ধুদের থেকে আরশান দেখতে শুনতে ভালো। শুভ্র চেহারা, পেশিবহুল দেহ, উচ্চতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরিবার, আর তাঁর চোখ। নীল চোখ এই প্রথম দেখেছে অয়ন্তি। পুরো বিদেশিদের মত চোখ আরশানের। আচ্ছা আরশান কি বিদেশি? বাজে মানুষটার প্রতি অয়ন্তির মনোভাব কি বদলাচ্ছে?কিছুসময় পূর্বে ভয়ে ভয়ে যাকে বাজে বলল, তাঁর কথাই এখন ভাবছে সে।কেন ভাবছে? অয়ন্তি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে মন খারাপ করে বসে রইল খাটের কোনায়। আরশান নামক জটিল ধাঁধাটা সমাধান না করা পর্যন্ত, স্বস্তি পাবে না সে। আরশানের দৃষ্টি, ব্যবহার, আর এমন স্বভাবের কারন কি? সেটা জেনেই ছাড়বে অয়ন্তি। জীবনে প্রথম কোনো ছেলের ব্যাপারে জানতে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছেটাকে পূরণ করা অতি আবশ্যক। তাছাড়া আরশান তো বাইরের কেউ না, অয়ন্তির অনাপির বেস্টফ্রেন্ড। তাই সমস্যা হলে তা সামলানোর জন্য অনা তো আছেই।
#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_পাঁচ

অয়ন্তি যে ঘরে থাকার কথা ভেবেছে তার ডান পাশের ঘরটা আরশানের। বা’পাশে অনা’রা থাকবে। আর নিচে কিচেনের পাশের ঘরটায় থাকবে সায়ন ও সৌফি। অনা ল্যাগেজ থেকে অয়ন্তির জামা-কাপড় বের করে খাটের ওপর রেখেছে। অয়ন্তি সেগুলো তুলে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-আমরা কত দিন থাকবো এখানে?
-কেন কোনো সমস্যা হচ্ছে?
-না। কিন্তু অপরিচিত একটা মানুষের বাড়ি এভাবে না বলে এসে, থাকার পরিকল্পনা করা কি ঠিক অনাপি?
-অপরিচিত কে? আরশান হচ্ছে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর বাড়ি মানে আমারও বাড়ি। আর তোরও বাড়ি!
-আমার বাড়ি? কিভাবে? উনি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড না।
-ওত বুঝতে হবে না তোকে। আলমারিতে জামাগুলো তুলে রাখ। এক সপ্তাহ থাকবো এখানে।

অয়ন্তি আলমারিতে জামা-কাপড় তুলে রেখে অনার দিকে ফিরে চাইল। অনা বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। অয়ন্তি নিশ্চই এবার প্রশ্নে প্রশ্নে ওর মগজ খেয়ে ফেলবে।এই মেয়েটা এত প্রশ্ন কেন করে?বোকা একটা। অয়ন্তি প্রশ্ন না করে ঘরের জিনিসগুলো দেখতে থাকে। অনা নিজের কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়তেই অয়ন্তি গুনগুনিয়ে গান গাইতে শুরু করল। মন ভালো থাকলে অয়ন্তি গুনগুন করে। এটা ওর অনেক পুরোনো অভ্যাস। আরশান অনাকে খুজতে ওর ঘরে আসতেই অয়ন্তির গান ওর কানে ভেসে আসলো।আরশান থমকে দাঁড়ালো। অয়ন্তি বিছানার চাঁদর ঝারছে। মাঝে মাঝে খাটের ওপর থাকা থ্রিপিচের ওরনা শাড়ির মত পেঁচিয়ে আয়নার সামনে হেলেদুলে নাচছে। ঘোমটা দিচ্ছে, মুখ ঢাকছে, লাজুক হাসছে। আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পাগল হয়ে গেল নাকি মেয়েটা? আরশান গলা খাঁকড়ি দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
-এহেম!!

অয়ন্তি ত্বরিত গতিতে পেছনে ফেরে। আরশান গম্ভির কন্ঠে শুধাল,
-অনা কোথায়?
-গোসল করছে।
আরশান মেঝেতে চোখ বুলিয়ে অয়ন্তির দিকে তাকাতেই অয়ন্তি চোখ-মুখ খিচে ফেলল।
-আমি আসলে, আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। হাত থেকে পড়ে গেছে সব। আমি ইচ্ছে করে করিনি। সত্যি!
-নিজের গায়ের ওরনা আগে খুলে তারপর গোছাও।

অয়ন্তি আরশানের কথাটা ঠিকঠাক শুনলো না। ব্যস্ততা নিয়ে এগোতেই ধপাস করে পড়ে গেল মেঝেতে। আরশান বুকের ওপর দু’হাত গুজে অয়ন্তির দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইল। অয়ন্তি ব্যাথা পেয়েছে কিনা বোঝা গেল না। চেহারার ভীত চাহুনির অর্থ আরশানকে ভয় পাওয়া। মেয়েটা পড়ে ব্যাথা পেল অথচ ব্যাথার কথা না ভেবে অযথা আরশানকে ভয় পাচ্ছে ব্যাপারটা আরশানকে প্রচন্ড বিরক্ত করল। আরশান এগিয়ে এসে ওকে জিজ্ঞেস করতে চাইল, ও ব্যাথা পেয়েছে কিনা। তার আগেই অয়ন্তি ভ্যাভ্যা করে কেঁদে উঠলো।আরশান ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকাল। কোমল কন্ঠে বলল,
-ব্যাথা পেয়েছ? দেখি ওঠো!

অয়ন্তির দিকে এগিয়ে আসলো আরশান। তা দেখে অয়ন্তি আরও জোরে কেঁদে উঠল। কি অদ্ভুত! আরশান দূরে সরে দাড়ায়। অনা অয়ন্তির কান্না শুনে দ্রুত গোসল সেরে বের হতেই দেখল অয়ন্তি মেঝেতে বসে কাঁদছে আর আরশান ওর সামনেই দাড়িয়ে আছে। অনার কপালে ভাঁজ পড়ল।আরশানের দিকে তাকাতেই ওদের চোখাচোখি হলো। আরশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-খাবার রেডি! নিচে আয়।
-আসছি।

খাবার টেবিলে আরশানকে দেখা গেল না। সায়নকে নিয়ে বেরিয়েছে সে। অয়ন্তির ভেজা চোখ দেখে মাহিন কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
-কি হয়েছে আমার ছোট বউটার?
-পড়ে গেছি ওরনায় বেঁধে।
-ওহ। তা কিসের ওপর পড়েছ? নরম কিছু নাকি শক্ত!
অনা চোখ রাঙালো। মাহিন থেমে যেতেই অয়ন্তি নাক কুচকে বলে,
-মেঝেতে। কি শক্ত, হাটু ফুলে গেছে।অনাপি বরফ দিল তাও ফোলা কমেনি।
-আরশানের ঘরে বাম আছে। লাগিয়ে নিও, ফোলা আর ব্যাথা দুটোই কমে যাবে।

সন্ধ্যায় আরশান সিগারেট নিয়ে ছাদে উঠল। রোজকার অভ্যেস হয়েছে এটা। দিনে একটা আর রাতে একটা টান না দিলে মস্তিষ্ক কাজ করেনা। চারপাশ অন্ধকারে নিমজ্জিত। যৎকিঞ্চিৎ আবছা আলো আছে তবে তা না থাকার সমান। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাতেই একটা রিনরিনে কন্ঠস্বর ভেসে আসল আরশানের কানে,
-বাচ্চাদের সামনে সিগারেট খেতে হয়না।

আরশান সবে ঠোঁটের ভাজে সিগারেট রেখেছিল।কন্ঠটা শুনে সে ডানে বামে চোখ বুলালো। কাউকে দেখতে না পেয়ে সে পেছনেও ঘুরল। আজব! ছাদে তো কেউ নেই। ঠিক তখনই টাঙ্কির ওপর থেকে ধপ করে কিছু একটা পড়লো ওর সামনে। আচমকা এমন ঘটায় ভয়ে দুকদম পিছিয়ে গেল আরশান। আরশানকে ভয় পেতে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে অয়ন্তি। জামার ময়লা ঝেরে সে গম্ভির গলায় বলল,
-আমার দিকে ওভাবে তাকান কেন?
আরশান হকচকালো।
-কিভাবে?
-চোরদের মত।
-চোরদের মত? তুমি চোরদের দৃষ্টি জানো নাকি?
-অয়ন্তি সব জানে।
-কি জানে?
-সব জানে, সব।
-ওকে! তো বলো আজকে আকাশে কয়টা তারা দেখা যাচ্ছে।
-যে কয়টা উঠেছে সে কয়টা। যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর।
-বাহ!
-ধন্যবাদ। এবার বলুন, ওভাবে কেন তাকান? ওভাবে কারা তাকায় জানেন? বখাটে, ইভটিজার’রা।
-তাই?
আরশান অয়ন্তির দিকে এগিয়ে আসতেই অয়ন্তির ভরা কনফিডেন্স মিইয়ে গেল। পিঁছিয়ে গিয়ে সে থতমত খেয়ে বলে,
-একি এভাবে এগোচ্ছেন কেন?
-তুমি পিছিয়ে যাচ্ছো বলে।
-তো আপনি এগিয়ে আসলে আমি তো পিছিয়ে যাবোই। তাইনা?
-কেন?
-কারন…
-কারন?
-কারন বলতে পারবো না।
-বাচ্চা মেয়ে বাচ্চার মত থাকবা। এসব নাটক আমার সামনে করবা না। যাও, অনার কাছে গিয়ে চাঁদের বুড়ির গল্প শোনো।
-অভদ্র।
-কি বললে? (ধমকের সুরে।)
-অনাপি! অনাপির কাছে যাচ্ছি। (তোতলাতে তোতলাতে বলে।)
-গুড।
যেতে যেতে অয়ন্তি পেছনে ফিরে কাঁপা কন্ঠে শুধাল,
-আপনি কি বিদেশি? বিদেশিদের মত চোখ। আপনার গায়ের রঙও অনেক সাদা।কোন দেশে থাকতেন আগে? আপনার চোখের রঙ কি সত্যিই নীল?নাকি লেন্স দিয়ে,
-এই তুমি যাবে? ( বিরক্ত হয়ে চেঁচাল আরশান।)

অয়ন্তি দাঁড়ালো না আর। একছুটে নিচে চলে গেল। তা দেখে। মৃদু হাসে আরশান। যাক, অয়ন্তি তাঁর চেহারার ওপর অন্ততো নজর দিয়েছে, মনের খোজ না’ইবা নিল।



-এই বেয়াদব! এসব কি?

অয়ন্তির কন্ঠে আরশানের চেতনা ফিরলো। স্মৃতিচারণ থেকে বাস্তবে ফিরে সে নিজের চেহারা যথাসম্ভব গম্ভির করার চেষ্টা করল । এরপর অয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বলল,

-বেয়াদব? আর আমি? গাড়ির ভেতর আসতে বলেছি দেখে কোলের ওপর এসে পড়লে তুমি। আর বেয়াদব হলাম আমি?

অয়ন্তি ভড়কে গেল। তবুও কন্ঠের তেজ কমলো না। সে কোলের ওপর এসে পড়েছে মানে? আরশানই তো ওকে টান দিল। ওভাবে কেউ হ্যাচকা টান দিলে ব্যালেন্স সামলে রাখা যায়? অয়ন্তি নিজের শরীরে লেপ্টে থাকা শার্টটা আরশানের গায়ে ছুড়ে দিয়ে বলে,

-এসব কি? কি করেছেন আমার সাথে?

আরশানের ভাবলেশহীন উত্তর,
-যাস্ট ঘাড়ে চুমু খেতে চেয়েছিলাম।তুমি তোমার লোহার মত হাত দিয়ে এমন চর মা’রলে যে চুঁমুর নেশা কর্পূরের মত উবে গেল। রোম্যান্টিক মোমেন্টে এমন টর্চার কিন্তু ভালো না মাই লাভ! তুমি এমন করলে আমিও এমন করতে বাধ্য হবো।

অয়ন্তি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। লোকটা ওকে মা’রবে? কিন্তু ওসব ভাবার সময় নেই অয়ন্তির। লোকটাকে থা’প্প’ড় মে’রেছে এটা শুনে ওর নাচতে ইচ্ছে করছে। আহা! কি সীন! দ্যা গ্রেট রেডিও জকি আরশান খাঁনের গালে জেসমিন মীর্জা অয়ন্তির হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ছাঁপ। জার্নালিস্ট হওয়ার পর অয়ন্তি নিশ্চই এমন একটা নিউজ ছবিসহ ছাঁপাবে। অয়ন্তি ভাবনাতে এত হারিয়ে গেল যে আনমনেই হেসে উঠলো। আরশান শার্ট পড়তে পড়তে বলে,

-এভাবে হাসবে না মাই লাভ! তোমাকে এভাবে হাসতে দেখলে আমার বাসর বাসর ফিলিং আসে।

অয়ন্তি মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,
-স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে না। তাই আমাকে পাওয়ার এই স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিন।

-আফসোস!তুমিময় কোনো কিছুই ছাড়তে পারবো না। পারলে আগেই ছেড়ে দিতাম। এবার জলদি গুড নাইট কিস দাও, ঝড় থেমে গেছে। কিস দিয়ে দ্রুত বাড়ি যাও।

-হোয়াট?

-ইংলিশ বোঝোনি? ওকে বাংলায় বলছি। ওকে বালিকা স্যরি ওহে যুবতি আমাকে তুমি শুভরাত্রির মিষ্টিমধুর এক চুঁম্বন দিয়া দ্রুত পলায়ন করো। নাহলে তোমার পিতা আমাদের এই রাতে এভাবে ধরিতে পারিলে, ধরে বেঁধে বিবাহ করিয়া দিবেন। এর থেকে ভালো বাংলা আসে না আমার। সো ডু দ্যাট ফাস্ট, কিস মি!

-নেভার। আমি কিস করবো? তাও আপনাকে?অসম্ভব।

আরশান আগেই গাড়ি লক করে চাবি পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিল। অয়ন্তি চারপাশে চোখ বুলিয়ে যখন চাবি খুজে পেল না তখন আরশানের দিকে করুনচোখে তাকাল। আরশান ঠোঁট চেপে হাসছে। অয়ন্তি আসফাস করে উঠে বলল,

-আমি আমার হাসবেন্ড ছাড়া অন্য কাউকে চুঁমু দেবো না।

আরশান ফ্রন্টসিটে এসে বসলো। এরপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মিররে তাকিয়ে চুলগুলো ঠিক করলো। গাড়ি চলা আরম্ভ করতেই অয়ন্তি হতচকিত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে। দ্রুততার সঙ্গে বলে,

-একি কোথায় যাচ্ছেন? গাড়ি থামান। থামান বলছি। আমি বাড়ি যাবো তো।

-না।

-না মানে? এই রাতে আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? থামান গাড়ি। আমি কিন্তু চিৎকার করবো।

-করো। এমনিতেও এত রাতে তোমার চিৎকার শোনার অপেক্ষায় কেউ বসে নেই। তবে চাইলে গভীর রাতে আমাকে শোনাতে পারো। আমি শুনবো, শুধু চিৎকার না, গালি, হাসি, কান্না,ন্যাকামি গলা সব শুনবো। কিন্তু তোমার এতসব কিছু শুধু আমি এবং আমিই শুনবো। বুঝেছ?

-না। আপনাকে কেন শোনাবো? আপনি কে?

-কেউ না। কিন্তু দ্রুতই কেউ হবো।

-মানে?

-যাস্ট একটা কিস বলেছিলাম। দিলে না, বললে বিয়ের পর জামাইকে দেবে। বাট আমি যা চাই তা না পাওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি হয়না। যখন বলেছি কিস নেবো তখন নেবোই। তার জন্য যদি এখন বিয়ে করতে হয়, করবো। তোমার পরিবার যদি কিছু জিজ্ঞেস করে দ্যান বলবো তুমি আমাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছে কারন তুমি আমাকে দেখার পর থেকে স্থির থাকতে পারছো না। বিয়ের জন্য, বাসরের জন্য পাগল হয়ে গেছ তাই মাঝ রাতে আমাকে ডেকে কাজি অফিসে যাচ্ছো। আর এটা সবাই চোখবুজে বিশ্বাসও করবে। কারন তুমি আমার সঙ্গে সত্যিই যাচ্ছো। কোনো মতলব না থাকলে তুমি বাড়ির বাইরে, আমার গাড়িতে এত রাতে কেন আসবে জান?

অয়ন্তির চেহারা রাগে জ্বলে উঠলো। সাংঘাতিক মানুষ তো। এমন মানুষ অয়ন্তি জীবনেও দেখেনি। বানিয়ে বানিয়ে কি সব বলছে? এই ব্যাটাই তো ওকে ভয় দেখিয়ে নিয়ে আসলো। অয়ন্তি রেগে আরশানের বা’হাতে কামড় বসিয়ে দিল। মুহূর্তেই গাড়ি থেমে যায়। অয়ন্তির কাজে হতভম্ব আরশান। বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেছে সে। অয়ন্তি গাড়ির লক খুলেই দৌড় দিল। তা দেখে আরশানের মেজাজ তুঙ্গে। এটা কোন এরিয়া তা কি সে জানে? এমন বোকার মত কাজ করার চিন্তা ওর মাথায় আসলো কি করে? আরশান রেগে থম মেরে বসে রইল। কারন সে জানে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর কুসুম নিজ থেকেই ফিরে আসবে।

গাড়ি থেকে বের হয়েই দিক বিবেচনা না করে ছুটতে থাকল অয়ন্তি। এই লোককে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। কিন্তু কিছুদূর এগোতেই কয়েক হালি কুকুরের সামনে পড়তে হলো। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসলো। অয়ন্তির ভয় লাগে প্রাণী। বিড়াল দেখলেও সে ভয়ে দৌড় দেয়। আর এগুলো তো বাছুরের সাইজের কুকুর। এত বড় কুকুর কোথ থেকে আসল? এই রাতে বাইরে কি করে এরা? অদ্ভুত, বাড়ি থাকতে পারে না? তারপর আবার ভাবল অয়ন্তি, এদের তো বাড়ি নেই। ভয়ানক এই প্রাণীগুলোর অবশ্যই বাড়ি থাকা উচিত,কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠতেই অয়ন্তির কেঁদে ফেলার জোগাড় হলো। এরা চেঁচায় কেন? কামড় দেবে নাকি? অয়ন্তি পেছন ফিরে জোরে হাটতেই বুঝলো কুকুরগুলোও আসছে।এরা আবার আসে কেন?অয়ন্তি ভয়ে আবারও চোখ বুজে দৌড় লাগালো। গাড়ির কাছে আসতেই আরশান গাড়ির দরজা খুলে দেয়। অয়ন্তি ভেতরে ঢুকে জোরে দরজা লাগিয়ে হাঁপাতে লাগলো, এরপর উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

-আরে গাড়ি চালাচ্ছেন না কেন? কুকুরগুলো কি বাড়ি নিয়ে যাবেন? ব্যাকসিটের দরজা খুলে দেবো? দ্রুত চলুন।

আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অয়ন্তি রেগে তাকাতেই আরশান বলল,
-কামড়ে যে হাতের গোশত খেয়ে ফেললে সেই গোশত আগে ফেরত দাও। নাহলে গাড়ি নড়বে না। বরং আমি তোমাকে গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো। কুকুর আর তুমি সারারাত গল্পগুজব করে সকালে ঠিকানা চিনে একা একাই বাড়ি চলে যাবে।

-কি?

-বাংলাও বোঝো না?

অয়ন্তি কেঁদে ফেলল। বাইরে কুকুরের ডাকে ভয়ে ওর বুক কাঁপছে। ভয় পেলে অয়ন্তির মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। হাত পা কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে, মাথা ঘুরে ওঠে। বাড়ির কেউ থাকলে অয়ন্তি তাঁর কোলে ঝাপিয়ে পড়ে ভয় মেটাতো। এখনও তো তারও উপায় নেই। ডান পাশে বসা নিষ্ঠুর মানুষ তো ওর ভয়, কষ্ট বুঝতেই পারে না। আরশান নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসে। দারুন জব্দ হয়েছে ওর কুসুম। আরেকটু জব্দ করা উচিত। সকালে মিথ্যা বলার শাস্তিস্বরূপ। বাচ্চা নিয়ে ওসব কিভাবে বলতে পারলো কুসুম? ওসব শুনে আরশানের ভেতরটা যে জ্বলছিল তার পরিবর্তে একটু ভয় দেখালে ক্ষতি কি? পরে না’হয় ভয়টাও ভেঙে দেওয়া যাবে। আরশান রাশভারি কন্ঠে বলল,

-আচ্ছা গোশত ফেরত দিকে হবে না। বিষে বিষে বিষক্ষয় করে দিলেই হয়।

-ম,মানে?

-যেটা নেওয়ার জন্য এতদূর আসলাম সেটা আমাকে দিলেই আমি গাড়ি ঘোরাবো।

অয়ন্তির কান্না থেমে গেল। স্তব্ধচোখে ক্ষণিক তাকিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। পরক্ষণেই নিজের কাজে নিজে হতবাক হয়ে গেল অয়ন্তি। হাসলো কেন ও? হাসি পেল কেন এমন মুহূর্তে? আরশান কি ওর প্রেমিক? নাকি স্বামী যে এমন কথায় লজ্জা আসবে। লজ্জা পাবে না অয়ন্তি, কিছুতেই না। কিন্তু লজ্জা তো লাগছে, আর তা বেশ আয়োজনের সহিত ঘিরে ধরছে অয়ন্তিকে। মাথা নত করে বসে রইল অয়ন্তি। অচেনা এক অনুভূতি অয়ন্তির সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে তুললো। দুহাতের নখ ঘসে অয়ন্তি সামনে তাকায়। আরশান স্টিয়ারিং’য়ে আঙ্গুল রেখে গুনগুন করছে। রেডিও চালালে মন্দ হয়না। রোজ এখনও আছে? কয়টা বাজে? দেড়টা? আরশান রেডিও চালাতেই একটা গান বেজে উঠল, অন্য ফ্রিকোয়েন্সিতে তার মানে আড়াইটা বাজে, রোজের শো শেষ। আরশান মৃদু ভলিয়মে গানটা চালিয়ে রাখলো,

সার্দিকি রাতো’মে হাম শো’য়ে রাহে
এক চাঁদার মে
হাম দোনো, তানহা হো না কোই ভি রাহে
ইশ ঘার মে।
জারা জারা বেহেকতা হ্যায় মেহেকতা হ্যায়!!!

আরশান দুষ্টু হেসে বলে,
-রোম্যান্টিক ওয়েদার, রোম্যান্টিক সং, রোম্যান্টিক ফিল, আহা! সবকিছু বুঝি রোম্যান্টিক কিছু ঘটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তোমার কি মনে হয় কুসুম? রোম্যান্টিক কিছু হলে ভালো হবে না?

অয়ন্তির লজ্জা বেড়ে গেল। লোকটাকে আস্ত চিবিয়ে খাওয়ার চিন্তা মগজ থেকে বেরিয়ে গেল ঠিক কিন্তু রাগ বের হচ্ছে না। মাঝরাতে তুলে এনে এভাবে হেনস্থা করা কি ভদ্রলোকের কাজ?অয়ন্তিতে লজ্জায় নুইয়ে পড়তে দেখে আরশান অয়ন্তির দিকে ঝুঁকে বলে,

-একি তুমি লজ্জা পাচ্ছো নাকি? সকালে টেক্সট করে বলেছিলাম না? বাসর রাতে হিসেব চুকানোর মত ভদ্র জামাই আমি। এখন বেশি কিছু করবো না, তোমার এই লজ্জা দেখে কিছু করার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। বুঝলে! আমার আবার লাজুক মেয়ে পছন্দ না। এরা রোম্যান্সে বাঁধার সৃষ্টি করে। যাও আজকের মত মাফ। তবে কিস তো তোমাকে দিতেই হবে। তুমি স্বেচ্ছায় দেবে নাকি?

-না। এসব হবেনা এখন। আমাকে ভালোবাসলে আমার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ নিশ্চই করেন।

-সেজন্যই তো জিজ্ঞেস করছি।নাহলে চেপে ধরে কবেই চুঁমুটুমু খেয়ে ফেলতাম। তুমি তালপাতার সেপাই আমাকে আটকাতে পারতে না।

-আপনার সঙ্গে আমার মাত্র একদিনের পরিচয়।আপনি আমাকে হয়তো আগে থেকে চেনেন কিন্তু আমি তো চিনি না। পরিচয় হতেও তো সময় লাগে বলুন।

আরশান জবাব দিল না। পুরোনো ক্ষতে যেন নতুন করে ঘা লাগলো। গাড়ি স্টার্ট দিল আরশান। বুকের ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল মুহূর্তেই। এত পরিচিত, এত কাছের কুসুম ওকে চিনতে পারছে না। ব্যাপারটা মাথায় আসতেই চোখ ভিজে আসে। কিছু সময় বাদে আরশান রুদ্ধ কন্ঠে বলে,

-হুম। সময় নাও, আমি বোধ হয় তাড়াহুড়ো করছি অনেক। কিন্তু সময় দিচ্ছি, এর মানে এই না যে তুমি তোমার নতুন প্রেমিকের কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করবে। তুমি শুধু আমার কুসুম। তুমি যদি কারোর হও সেটা শুধু আমার হবে। কথাটা মনে রেখো।

অয়ন্তি সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়। আরশানের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? কন্ঠ, শব্দ কেমন কাঁপাকাঁপা কেন? কাঁদছে নাকি? কিন্তু কাঁদছে কেন? অদ্ভুত মানুষ তো। অয়ন্তি ভাবলো একবার জিজ্ঞেস করবে কিন্তু তার আগেই আরশান ভেজা কন্ঠে বলে,

-নামো। বাড়ি চলে এসেছি। বেশি রাত জাগবে না। বেশি চিন্তাও করবে না। বেশি চিন্তা করলে তোমার মাথাব্যথা বাড়বে। গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। ওকে?

অয়ন্তি মাথা নাড়লো। বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে অয়ন্তি আরশানের গাড়ির দিকে তাকায়। নীলচোখটা ভেজা। শুভ্র চেহারার মলিনতা অয়ন্তির ভালো লাগলো না। মানুষটা বেয়াদবই ভালো, এমন নরমশরম স্বভাবে তাকে একদমই মানায় না। অয়ন্তি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেট লাগিয়ে নিজের ঘরে এসে খাটের ওপর বসতেই টের পেল ওর গায়ে ওরনা নেই, বরং আরশানের শার্ট আছে। তখন না শার্টটা ছুড়ে মা’রল? তাহলে এটা কোথ থেকে আসলো। পরক্ষণেই মনে পড়ে, টি-শার্ট দিয়েছিল শার্ট তো গায়েই ছিল, যেটা সে ওরনা ভেবে আগলে রেখেছিল। তখনই ফোনে একটা ম্যাসেজ আসল,

“ওরনা রেখে দিলাম। আমার শার্টের বদলে।তাই এখন ওসব নিয়ে চিন্তা না করে জামা-কাপড় বদলে ঘুমাও। জামা তো ভিজে গিয়েছিল।পাল্টে নিও, ”

আরেকটা ম্যাসেজ,
“ভালোবাসি কুসুম।”

অয়ন্তি বেখেয়ালে হাসে। কৌতুহলবশত শার্টটা নাকের কাছে টেনে ঘ্রাণ নেয়। বন্ধুদের প্রেমিককে গল্প বহুত শুনেছে সে। প্রেমিক না হলেও, জীবনে প্রথম কোনো প্রেমিকজাতের পুরষের শার্ট পেয়েছে সে। এটুকু সাধ পূরণ করা যেতেই পারে। ঘ্রাণ নিয়ে অয়ন্তি ভাব নিয়ে বলে,
-মন্দ না, ঘ্রাণটা বেশ। তবে মানুষটা, একদমই ভালো না।
বলেই উচ্চস্বরে হাসলো অয়ন্তি। ভাগ্গিস আরশান এটা শোনেনি। তাহলে এই হাসির অন্য মানে বের করে ফেলতো অদ্ভুত মানুষটা!

চলবে?

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here