জলপদ্ম পর্ব -০৪

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|৪|
নীল আকাশটা আচমকাই কালো মেঘেদের আস্তরণে ঢেকে গিয়েছে।বৃষ্টির পূর্বাভাস।সেই সাথে মৃদু বাতাস।আস্তে আস্তে মৃদু বাতাসের পরিমাণ টা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।রুমের জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে রইলাম।আকাশে মেঘেদের আনাগোনা খুব দ্রুত গতিতে চলছে।মেঘে ঢাকা আকাশ আমার কাছে বরাবরই প্রিয়।এই সময় টা কেনো জানি আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর লাগে।হয়তোবা ওয়েদার ডিমান্ড।আজকেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।সকাল সকাল এইরকম রোমাঞ্চকর ওয়েদার হলে আর কি লাগে।তাই,সিদ্ধান্তঃ নিলাম আজকে আমি রুমেই বসে থাকবো।কানে হেডফোন গুঁজে বারান্দায় বসে বৃষ্টিবিলাস করবো।অবশ্য,এতে আমার জন্য অনেকটাই ভালোই হবে।লজ্জা আর হ্যারাসমেন্ট থেকে বেঁচে যাবো।কালকের ঘটনা মনে পড়লেই অস্বস্তিতে আমার শরীর জমে আসে।ভাগ্যিস সুযোগ করে কাল রাতে রিমির রুমে চলে এসেছিলাম।না হলে,রক্তিম ভাই যে আমার নাজেহাল অবস্থা করে দিতেন।তবে,ঘুম থেকে উঠে যখন নিজের রুমে এসে রক্তিম ভাইকে পেলাম না তখন মনে হলো কালকের ঘটনা টা নিতান্তই স্বপ্ন ছিলো।শুধু শুধু আমি রক্তিম ভাইকে নিয়ে উল্টা পাল্টা ভেবেছি।নিমিষেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।কেনো হলো তাও জানি না।কিন্তু,আমার এখনো শরীর শিরশির করে উঠে রক্তিম ভাইয়ের ছোঁয়ার কথা ভাবলে।এইসব ভাবনার মাঝেই আমি যখন আয়নায় আমার ডান গালের দিকে তাকালাম তখনি আমি যেনো আঁতকে উঠলাম।আমার ডান গালটায় কাঁমড়ের স্পষ্ট দাগটা হাইলাইটের মতো ফুটে আছে।সেই সাথে লালও হয়ে আছে।কাঁমড়ের দাগটা বলে দিচ্ছে কালকের ঘটনা টা আসলেই সত্যি ছিলো।দ্য গ্রেট রক্তিম ভাই আমার কাছে এসেছিলেন।ভাবতেই আমি নিজের কাছে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেলাম।

অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।রান্নাঘর থেকে খিঁচুড়ি,গরুর মাংসের গন্ধ পেয়ে আর রুমে বসে থাকতে পারলাম না।রুম থেকে বের হওয়ার আগে কোনোমতে চুল দিয়ে নিজের ডান গালটা ঢেকে বের হয়েছি।কিছুটা সামনে যেতেই দেখতে পেলাম তনায়া আপুকে।হাতে ফোন নিয়ে একা দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।তনায়া আপুর হঠাৎ মুচকি হাসি দেখে আমার তেমন কিছু বোধগম্য হলো না।তনায়া আপুর সামনে যেতেই রক্তিম ভাই কোথা থেকে এসে হাজির হলেন আমার সামনে।আচমকাই আমার সামনে রক্তিম ভাইকে দেখে আমি কিছুটা চমকে উঠি।আড়চোখে তাকিয়ে দেখে রক্তিম ভাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।উনার চোখে ঠিক সেই অদ্ভুত চাহনি টা বিরাজ করছে।আমি তাড়াতাড়ি উনার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।এলোমেলো পা’য়ে জায়গা প্রস্থান করতেই তনায়া আপু আমার হাত ধরে আঁটকে দিলো।সেই সাথে আমিও থেমে যাই।তনায়া আপু আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি কুঁচকে বললো,

‘রিমঝিম!তুই,চুল দিয়ে তোর ডান চোখের সামনে পর্দা বানিয়ে রেখেছিস কেনো রে!তোকে একদম কানী কানী লাগছে।মনে,হচ্ছে একচোখে দেখিস আরেক চোখে দেখিস না।

আমি পিটপিট করে তাকালাম তনায়া আপুর দিকে।কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না।তনায়া আপু আমার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে হয়তোবা উত্তরের আশায়।কিন্তু,আমার যে কথা গলায় আটকে আছে।আমি কোনোমতে আমতাআমতা করে বললাম,

‘কিছু হয় নি তনায়া আপু।এইটা একটা স্টাইল।’

‘চুল চোখের সামনে পর্দার মতো ফেলে রাখা এইটা আবার কেমন স্টাইল রে রিমঝিম!এইরকম স্টাইল তো কাউকে করতে দেখে নি।’

‘দেখো নি!এইজন্য এখন দেখে নাও।’

বলেই,তনায়া আপুকে পাশ কাটিয়ে চলে আসলাম একপ্রকার দ্রুত গতিতে।আসার আগে আরেকপলক রক্তিম ভাইয়ের দিকে তাকালাম।দেখি!উনি মিটমিট করে হাসছেন।উনার হাসি দেখলেই আমার এখন শরীর জ্বলে উঠে।
—-
লিভিং রুমে এসে সোফায় বসা নিহান ভাইয়াকে দেখে একটা বড়সড় ঝটকা খেলাম।এই বৃষ্টিতে নিহান ভাইয়াকে একদমই আশা করি নি।শুধু তাই নয় নিহান ভাইয়ার সাথে আরো দুটো মেয়েও বসে আছে।মেয়েগুলোকে আমি,তনু আপুর বৌ ভাতের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম।তারাই তো চোখ দিয়ে রক্তিম ভাইকে গিলে খাচ্ছিলো।মেয়েগুলোকে মোটেও আমার পছন্দ হয় নি।আমাকে দেখেই নিহান ভাইয়া সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন।আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘কেমন আছো রিমঝিম!অনেকদিন পর আমাদের দেখা হলো।’

আমি মুখে সৌজন্যমূলক হাসি টানলাম।নিহান ভাইয়ার কথার পিঠে কিছু বলতে যাবো তখনি কোথা থেকে রক্তিম ভাই এসে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘রিমঝিম অনেক ভালো আছে নিহান।পেট ভালো তো মন ভালো।রিমঝিম মুলা খেয়ে খেয়ে পেট পরিষ্কার করছে আর সেই সাথে মনও ভালো করছে।’

রক্তিম ভাইয়ের কথা শুনে নিহান ভাইয়ার মুখের হাবভাব অন্যরকম হয়ে গিয়েছে।সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।আর,আমি অবাক নয়নে তাকিয়ে আছি রক্তিম ভাইয়ের দিকে।উনি যে এতোবড় একটা ডাহা মিথ্যা কথা বলবেন তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।আমি লজ্জায় আর সেখানে দাঁড়ালাম না।তাদের দু’জনকে পাশ কাটিয়ে চলে আসলাম।সিঁড়ির সামনে দেখা হলো মা’র সাথে।মা আমাকে দেখে থামিয়ে দিয়ে বললো,

‘তোর পড়াশোনার নাকি বেহাল অবস্থা রিমঝিম!রক্তিম বললো আমাকে!তুই নাকি ম্যাথে একদম লাড্ডু গুড্ডু!তাহলে,তোকে পড়িয়ে কি আমি ভুল করছি?এখন থেকে রক্তিমকের কাছে ম্যাথ পড়বি।ও যতদিন আছে ততদিন যেনো ম্যাথ বই শেষ হয়।’

মা’র দিকে আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।রক্তিম ভাই জানলেন কি করে আমি যে ম্যাথে দূর্বল।উনি কি জ্যোতিষী নাকি!তার উপর এই কথাটা মা’কেও বলে দিলেন।এখন,তো আমাকে রক্তিম ভাইয়ের কাছে ম্যাথ পড়তে যেতেই হবে না হলে!মা’র বকা থেকে আর রক্ষা পাবো না।আমার এসব ভাবনার মাঝেই,মা জোর গলায় রক্তিম ভাইকে ডেকে পাঠালো।রক্তিম ভাইও বাধ্য ছেলের মতো সুড়সুড় করে মা আর আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।রক্তিম ভাইকে হাতের নাগালে পেতেই মা গড়গড় করে বলতে লাগলো,

‘রক্তিম!আজকে থেকে তুই একটু সময় করে রিমঝিমকে ম্যাথ টা বুঝিয়ে দিস তো।এমনভাবে বুঝিয়ে দিস যাতে পাস করতে পারে।কাল তো তোর কথা শুনে ভয়েই পেয়ে গিয়েছিলাম।মেয়ে আমার ম্যাথে দূর্বল আর তা আমি নিজেও জানি না।’

রক্তিম ভাই!গলা কেশে টি-শার্টের গলাটা টেনেটুনে এটিটিউড ভাব নিয়ে বললেন,

‘তুমি কোনো চিন্তা করো না ছোটমা।আমার হাতে পড়েছে না দেখবে একদম সোজা হয়ে যাবে।কোনো ছাড় দিবো না।’

‘তোর উপর আমার ভরসা আছে রক্তিম।একটু দেখিয়ে দিস রিমঝিমকে।’

আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি রক্তিম ভাইয়ের উপর মা’র আদিখ্যেতা।সেই সাথে,রক্তিম ভাইয়ের এটিটিউড।তাদের এইসব কাহিনী আমার কাছে বিতৃষ্ণা লাগছে।সেখানে আর একদন্ড দাঁড়ালাম না।দু’জনকে পাশ কাটিয়ে চলে আসলাম নিজের রুমে।রুমে এসে ধপাস করে বিছানার মাঝখানে বসে পড়লাম।মুডটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।কই ভাবলাম,নিচে গিয়ে খিঁচুড়ি আর মাংস খাবো কিন্তু,যেয়ে একগ্লাস পানিও খেতে পারলাম না।আজকের দিনটাই লাপাত্তা হয়ে গেলো।সব হয়েছে রক্তিম ভাইয়ের জন্য।উনার তো রন্ধ্রে রন্ধ্রে শয়তানী।আর,সবগুলোই আমার উপরে প্রভাব ফেলে।বিরবির করতে করতে বাহিরের দিকে তাকালাম।এখনো বৃষ্টি হচ্ছে।তবে,আগের থেকে কম।লম্বা একটা হাই তোলে,কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।আমার জন্য অত্যন্ত এখন ঘুমেই বেটার!
—-
টানা কয়েকঘন্টা বৃষ্টি হওয়ার পর বিকেলের দিকে থেমে যায়।তাই,সবাই মিলে সিদ্ধান্তঃ নিলাম বাহিরে ঘুরতে যাবো।বাসার কিছুটা সামনেই একটা পার্ক পড়ে।পার্কের পাশেই ছোটখাটো একটা লেকও আছে।লেকের চারপাশে বাহারী ফুলের গাছও রয়েছে।দূর থেকে জায়গা টা বেশ আর্কষণ করে।
রাস্তা দিয়ে যে যার মতো হেঁটে যাচ্ছি।পার্ক বাসার সামনে হওয়াতে গাড়ি নিয়ে আসি নি।সামনে তনায়া আপু খুব দ্রুত গতিতে হেঁটে যাচ্ছে।আজকে তনায়া আপুর হাবভাব আমার কাছে বেশি একটা সুবিধার ঠেকছে না।এতো তাড়া কিসের তাও বুঝতে পারছি না।আমি আর সেদিকে পাত্তা দিলাম না।আমার পাশে রিমি ফোন নিয়ে ব্যস্ত।পিছন থেকে হাসাহাসির আওয়াজ পাচ্ছি।ওই দুইটা মেয়ে যে রক্তিম ভাইকে দেখে হাসছে তা ঠিকই বুঝতে পারছি।আমার খুব রাগ হচ্ছে ওই মেয়ে দুইটার উপর।আবারও হাসির শব্দ পেতেই আমি একটু পিছন ফিরে তাকালাম।দেখি!সবার পিছনে রক্তিম ভাই ধীর গতিতে হেঁটে আসছেন।উনার সামনেই মেয়ে দুটো।আর তাদের পাশে নিহান ভাইয়া।হঠাৎ আমার চোখ পড়ে যায় রক্তিম ভাইয়ের চোখের উপর।উনি ঠিক সেই চাহনি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।ঠোঁটে মৃদু হাসি।উনার এরূপ লুক দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠলো।তাড়াতাড়ি করে মাথা ঘুরিয়ে নিলাম।রক্তিম ভাইয়ের এই চাহনি দেখলেই আমার কেমন যেনো এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়।আমি আর সাহস করে পিছনে তাকায় নি।রক্তিম ভাইয়ের এই লুক দেখার ক্ষমতা আমার আর নেই।

পার্কের কাছে যেতেই দেখা হলো বাবু ভাইয়ের সাথে।বাবু ভাই আমাদের সবাইকে দেখে বিস্তর এক হাসি দিলেন।বাবু ভাইকে দেখে তনায়া আপুর ঠোঁটে একটা লজ্জামিশ্রিত হাসি ফুটে উঠলো।এবার বুঝতে পারলাম তনায়া আপুর দ্রুত হাঁটার আসল কারণ।আসল কারণটা হলো বাবু ভাই।কিন্তু,আবির ভাই বাবু ভাইয়ের দিকে কেমন একটা বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে।আবির ভাই তাড়াহুড়ো করে তনায়া আপুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।মাথায় একটা টোকা দিয়ে বললো,

‘এতো সেজেগুজে আসলি কোন মতলবে!আর,ঠোঁটে এইটা কি লাগিয়েছিস!কেমন চিকমিক করছে।কোথাও হারিয়ে গেলে তোর এই চিকচিক ঠোঁট দেখে যেনো খুঁজে বের করতে পারি তার জন্য এইসব লাগিয়েছিস!!আর,তোর এই লুকে কোনো মানুষ তাকাবে না সব গরু,বাছুর,ছাগলরা হা করে তাকিয়ে থাকবে।’

তনায়া আপু গরম চোখে তাকালো আবির ভাইয়ের দিকে।মনে হচ্ছে,চোখ দিয়ে জ্বালিয়ে দিবে।কারণ,আবির ভাইয়ের কথাটায় তনায়া আপু বাবু ভাইয়ের সামনে অনেকটা ইতস্তত বোধ করছে।শুধু তাই নয়,আবির ভাই যে বাবু ভাইকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছে তা ঠিকই বুঝতে পেরেছি।বুঝলাম না!আবির ভাই বাবু ভাইকে কেনো সহ্য করতে পারে না।যদি,জানে তনায়া আপু বাবু ভাইকে ভালোবাসে না জানি ওইদিন আবির ভাই কি কুরুক্ষেত্র বাজিয়ে বসে।রক্তিম ভাই পিছন থেকে এসে আবির ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন।পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে বললেন,

‘নারে!তনায়া তোকে অনেক সুন্দর লাগছে।তোর ভাই আবির তো একটা রাতকানা।এইযে,একটু পরে সন্ধ্যা নামবে তাই এখন থেকেই একটু একটু করে তার মধ্যে ইফেক্ট পড়ছে।’

রক্তিম ভাইয়ের কথা শুনে আবির ভাই অসহায় চোখ নিয়ে তাকালো আমাদের সবার দিকে।পিছনের থেকে ওই দুইটা মেয়ে যেনো বেশ মজা পেয়েছে রক্তিম ভাইয়ের কথায়।তাদের হাসি কিছুতেই থামছে না।মনে হচ্ছে এইখানে কোনো সার্কাস হচ্ছে।আর সার্কাস দেখাচ্ছেন রক্তিম ভাই।আমার এবার খুব রাগ হলো মেয়ে দুইটার উপর।ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলাম অসভ্য মেয়ে!ছেলে দেখলেই গড়াগড়ি খাওয়ার ধান্দা।
ওদের থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসছেন।তাহলে,কি উনি আমার কথাটা শুনে নিয়েছেন।ইশশ!যদি শুনে নেয় তাহলে কি ভাববেন উনি।আমি এদিক সেদিক না তাকিয়ে তাদেরকে রেখেই পার্কের ভিতরে চলে আসলাম।নিজেই নিজের কপাল চাপড়াচ্ছি।
—-
সন্ধ্যা হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা পার্ক থেকে বেরিয়ে পড়ি।আকাশে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ। আবারও বৃষ্ট হবে।এইজন্যই একটু আগেই বের হওয়া।তনায়া আপু মুখ ভোঁতা করে আছে।কারণ,বাবু ভাইকে হাতের নাগালে পেয়েও তনায়া আপু একদন্ডও কথা বলতে পারে নি।আবির ভাই সবসময় তনায়া আপুকে চোখে চোখে রেখেছে।বড় ভাই থাকলে যা হয় আর কি।বাবু ভাই,আমাদের সাথে কিছুটা সময় থেকে চলে যায় অন্য রাস্তায়।বাবু ভাই চলে যেতেই আবির ভাইয়ের চোখ-মুখে যেনো খুশির ঝিলিক মেরে উঠে।বেচারি তনায়া আপুর জন্য আমার খুব কষ্টে হচ্ছে।কি ভেবে এসেছিলো আর এসে কি হলো!

বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করে দিয়েছে।সেই সাথে হিমেল হাওয়াও বইছে।জামার হাত কনুই পর্যন্ত হওয়ায় আমার বেশ শীত শীত অনুভব হচ্ছে।হাতের লোমগুলো ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে গিয়েছে।সবাই খুব দ্রুত গতিতে হাঁটছে।আমার সবার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে অনেকটা হিমশিম খেতে হচ্ছে।আমার পিছনেই রক্তিম ভাই আসছেন।পকেটে হাত গুঁজে ফোনে মত্ত হয়ে আছেন।সবাই খুব দ্রুত গতিতে হেঁটে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।পিছনে পড়ে রইলাম আমি আর রক্তিম ভাই।সামনেই একটা বন্ধ টিনের দোকান দেখতে পাচ্ছি।আরেকটু আগাতেই ঝুম করে বৃষ্টি নামতে শুরু করে দিলো।মুহুর্তেই রাস্তার ল্যামপোস্টের আলোগুলো মিহিয়ে গিয়েছে।আচমকাই চারপাশে অন্ধকার হয়ে আসায় আমি ভয়ে আঁতকে উঠি।সামনে আগাতেই গর্তে পা বেজে ধপাস করে পড়ে যাই রাস্তায়।বৃষ্টিতে আমি অর্ধেক ভিজে গিয়েছি।এমনভাবে পড়ে যাওয়ায় পা’য়ে অনেকটাই ব্যথা পেয়েছি।উঠতে খুব সমস্যা হচ্ছে।হঠাৎ অনুভব করলাম একজোড়া হাত আমাকে আগলে নিলো।সোজা করে দাঁড় করিয়ে নিজের বুকে জায়গা করে দিলো।পারফিউমের অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকছে!আমার আর বুঝতে বাকি নেই এইটা যে রক্তিম ভাই।আমি জাপটে জড়িয়ে ধরলাম রক্তিম ভাইকে।রক্তিম ভাইও আমার কোমর চেপে ধরে আছেন।এতোটুকু সময়ে আমারা দু’জনেই ভিজে একদম জুবুথুবু হয়ে গিয়েছি।রক্তিম ভাই আমাকে ধরে সেই টিনের দোকানটার বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন।আমি শীতে কাঁপছি।বৃষ্টির থেকে এখন হিমেল হাওয়া বইছে বেশি।আমার কাঁপন যেনো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।সেই সাথে আবার বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে।আমি শুধু ভাবছি!আজকে এইরকম একটা পরিবেশে রক্তিম ভাই না থাকলে আমার কি হতো।আমি মনে হয় ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতাম।হয়তো অজ্ঞান হয়েই রাস্তায় পড়ে থাকতাম।হঠাৎ কথাটা ভেবেই আমার অনেক ভয় হলো।যার ফলে রক্তিম ভাইয়ের আরেকটু কাছে চলে আসলাম।দু’জন একসাথে থাকলেও আমাদের মুখে কোনো কথা নেই।আমি আবছা আবছা আলোয় রক্তিম ভাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নিলাম উনার মুখের মতিগতি।কিছুই বুঝা যাচ্ছে না উনার মুখের মতিগতি দেখে।রক্তিম ভাই হাত দিয়ে কপালে লেপ্টে থাকা চুল গুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন,

‘পা’য়ে কি বেশি লেগেছে!’

এরূপ ঠান্ডা একটা পরিবেশে রক্তিম ভাইয়ের মিহিয়ে আসা শীতল কন্ঠ শুনে আমি যেনো আরো জমে যাই।বুকের ভিতর সেই আগের অনুভূতি টা কাজ করছে।এই অনুভূতির নাম কি হতে পারে তা আমার জানা নেই।ধরেই নিলাম এই অনুভূতির কোনো নাম নেই।কিন্তু,এই নাম না জানা অনুভূতি টা যে আমাকে ক্ষণে ক্ষণে পাগল করে তুলছে।এমনকি,এখন কথাও আটকে আসছে।অনেক চেষ্টা করেও আমি যেনো মুখ দিয়ে একটা কথাও বের করতে পারছি না।রাগে,দুঃখে আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম।কিছুক্ষণ পর চোখে,মুখে লাইট পড়ায় আমি চমকে উঠি।সামনে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই আমার মুখের উপর ফোনের লাইট জ্বালিয়ে ধরে আছেন।চোখ,মুখ কুঁচকে বললাম,

‘উফফ!রক্তিম ভাই!এইভাবে মুখের উপর লাইট ধরে আছেন কেনো।আমার সমস্যা হচ্ছে তো।’

রক্তিম ভাই আমার কথার উত্তরে বললেন,

‘এইভাবে চোখ বন্ধ করে কাঁপছিলি কেনো।’

আমি রক্তিম ভাইয়ের কথায় বেশ চিন্তায় পড়ে যাই।এই কথার প্রেক্ষিতে কি বলবো তাই ভাবছি।আমাকে চুপ থাকতে দেখে রক্তিম ভাই আমার দিকে দু’কদম এগিয়ে আসলেন।আমি তাড়াহুড়ো করে পিছিয়ে যেতে নিলেই উনি আমার কাঁধ ধরে নিজের সাথে আঁটকে ধরলেন।আমার দিকে পলকহীন ভাবে চেয়ে আছেন,ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে নাড়িয়ে কি যেনো বলছেন।এতো কাছে থাকার পরও আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।শুনার জন্য কানটা এগিয়ে দিতেই রক্তিম ভাই আমার গালে অনেকটা সময় নিয়ে শব্দ করে একটা চুমু খেলেন।শুধু তাই নয়,আমার কানের কাছে এসে হিসহিসিয়ে বললেন,

‘এই গালেই তো কাঁমড় দিয়েছিলাম তাই না।আদর দিয়ে এবার পুষিয়েও দিয়েছি।’

আমার হৃদয়ের গহীনে এক সুপ্ত অনুভূতি বয়ে গেলো।আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,

‘রক্তিম ভাই!কালকে রাতের সব কথা তাহলে আপনার মনে আছে!’

‘মনে থাকবে না কেনো!কি এমন করেছি আমি।যেভাবে বলছিস আমি মনে হয় কালকে রাতে তোর সাথে সেক্সুয়াল সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলাম।’

আমার এখন মনে হচ্ছে!রক্তিম ভাই আগের ফর্মে ফিরে আসছেন।কিন্তু,উনার এতো লাগামছাড়া কথা শুনে আমার কান যেনো গরম হয়ে আসছে।আমি আমতাআমতা করে বললাম,

‘লক্তিম ভাই!বৃষ্টি থেমে গিয়েছে চলুন হাঁটা ধরি।বাসায় ফিরতে হবে তো।’

রক্তিম হেসে উঠলেন।আমার আরেকটু নিকটে এসে বললেন,

‘তুই তো আমার নামও ভুলে গেছিস রিমঝিম।লক্তিম না রক্তিম।’

আমি শুকনো ঢোক গিলে রক্তিম ভাইয়ের দিকে তাকালাম।উনি এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।এতে আমার খুব অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।এইভাবে অনেকক্ষণ থাকার পর রক্তিম ভাই আমাকে অবাক করে দিয়ে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলেন।আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।আমার কাঁধে রক্তিম ভাইয়ের গরম নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারছি।রক্তিম ভাই আমার উন্মুক্ত কাঁধে ঠোঁট বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

‘ভালোবাসার অনুভূতি গুলো খুব রঙিন মনে হচ্ছে।সময়টা যদি এইখানে এইভাবে থেমে যেতো তাহলে পাগলপারা এই প্রেমিক টা একটু শান্তির নিঃশ্বাস নিতো তার প্রেয়সীকে কাছে পেয়ে।’

রক্তিম ভাইয়ের কথায় আমি আগামাথা কিছুই বুঝলাম না।উনি কি বুঝাতে চাইছেন কিছুই আন্দাজ করতে পারি নি।তবে,রক্তিম ভাইয়ের কথা শুনে!আমার চোখ গুলো কেমন নিভু নিভু হয়ে আসছে।সেই সাথে মাথাটাও কেমন ঘুরছে।আমি হাত দুটো বাড়িয়ে দিলাম রক্তিম ভাইয়ের পিছনের দিকে।রক্তিম ভাইয়ের টি-শার্টের পিছন দিকটা মুঠো করে ধরার আগেই আমি রক্তিম ভাইয়ের বুকে ঢলে পড়ালাম।
————-
ছয় ছয়টা মাস কেটে গিয়েছে।সেইদিনের ঘটনার পর থেকে আমি রক্তিম ভাইয়ের কোনো খোঁজ পায়নি।মা’র মুখে শুধু শুনেছিলাম আমি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর রক্তিম ভাই আমাকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন।বৃষ্টিতে ভিজে আমার শরীর নাকি ঠান্ডা বরফের মতো জমে ছিলো।সেইজন্য আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু,আমার এখনো মনে আছে!ওইদিন রাতে কি কি হয়েছিলো।রক্তিম ভাইয়ের কয়েকলাইনের বলা সেই কথাটা এখনোও আমার কানে বাজে।এমনকি,রক্তিম ভাইয়ের এইকয়েক লাইনের কথাটাই যে আমার মনে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।উনার জন্য,আমি আমার মনের গহীনে অনুভূতি খুঁজে পাই।এই ছয়টা মাস উনাকে না দেখে থাকতে আমার দমবন্ধ হয়ে এসেছে।বারবার,শুধু উনার কাছে ছুটে যেতে মন চেয়েছে।আমার অনুভূতি যে প্রবল গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে।কিন্তু,আমি যে রক্তিম ভাইয়ের কোনো খোঁজেই পাচ্ছি না।গভীর রাতে আমার চোখের নোনাজলে বালিশ ভিজে যায়।আচ্ছা!রক্তিম ভাই কি বিশ্বাস করবেন,রিমঝিম উনার জন্য প্রতিটি রাত কেঁদেকেটে ভাসায়।এইভাবে যখন আর পারছিলাম না তখন একদিন আমি মা’কে জিজ্ঞেস করেই ফেলি,

‘মা!রক্তিম ভাই!এখন আর বাসায় কেনো আসেন না।’

মা আমার কথায় সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো,

‘রক্তিমের নাকি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস চলে।তাই সময় করে আসতে পারছে না।আবার সামনে নাকি সেমিস্টার এক্সামও আছে।’

মা’র কথায় আমি কোনো রিপিট করি নি।তবে,আমি জানি রক্তিম ভাই মিথ্যা বলেছেন।কারণ,উনি বড়মা’কে এতোদিন না দেখে থাকতে পারেন না।আর এটাও জানি উনি ইচ্ছে করেই আসছেন না।কিন্তু কেনো আসছেন না!উনি কি আমার সামনে আর আসতে চায় না!নাকি!অন্যকোনো কারণ আছে।

চলবে..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here