জলপদ্ম পর্ব -০৫

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|৫|
বিষন্নতা শব্দটা যেনো আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে।চাইলেও আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না।আরো কয়েকটা দিন কেটে যায়।এই কয়েকটা দিনে আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি রক্তিম ভাই আমার মনে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছেন।আমি এটাও বুঝতে পেরেছি রক্তিম ভাইয়ের প্রতি আমি দূর্বল হয়ে পড়েছি।যাকে বলে ভীষণ দূর্বল।এই কয়েকটা মাস আমি চাতক পাখির মতো ছটফট করেছি শুধুমাত্র রক্তিম ভাইকে একটিবার দেখার জন্য।বৃহস্পতিবার টা আসলেই আমার বুকের ভিতর টা কেমন যেনো ঢিপঢিপ করা শুরু করে দিতো।মনে হতো!শুক্রবার সকালে উঠে আমি রক্তিম ভাইকে দেখতে পাবো।কিন্তু,এইভাবে কেটে যায় অনেকগুলো শুক্রবার তাও আমি রক্তিম ভাইয়ের দেখা পায় নি।শীতের মাঝামাঝি সময় চলছে এখন।বাহিরে কুয়াশা আচ্ছন্ন হয়ে আছে।আজকে অনেকটা ভোরেই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছি।বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকলেও মন আমার নানান ভাবনায় বিভোর হয়ে আছে।মনে মনে শুধু কল্পনার রাজ্যে ভাসছি রক্তিম ভাইয়ের সাথে এইটা করছি ওইটা করছি।ইশশ!ভাবনার মুহুর্ত গুলো বেশ সুন্দর হয়।কিন্তু,বাস্তবে তা আদোও সম্ভব কিনা তা আমার কাছে অজানা।একফালি রোদ্দুর জানালার থাই গ্লাস টা ভেদ করে রুমের মাঝবরাবর এসে পড়েছে।যাক!এতো দিনে সূর্যের দেখা মিলেছে।প্রায় এক সপ্তাহের মতো সূর্যের কোনো দেখা ছিলো না।চারপাশ টা কেমন মনমরা হয়ে থাকতো।আজকে সূর্যের দেখা পেয়ে আমার কিছুটা আনন্দ লাগছে।মনে হচ্ছে,শুষ্কতায় ভরপুর প্রকৃতি টা জীবন্ত হয়ে গিয়েছে।আমি লম্বা একটা হাই তোলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম।বারান্দার থাই গ্লাস টা সরিয়ে দিয়ে গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম।রোদের আলোয় আমার গাছগুলো কেমন জ্বলজ্বল করছে।বাসার নিচের দোকানপাট গুলো থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে।কিছুটা সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম ছাঁদে গিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসবো।যেই ভাবা সেই কাজ।বিছানার উপর থেকে মাফলার টা গলায় পেঁচিয়ে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

সামনের বটগাছটায় একজোড়া পাখি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে।তাদেরকে দেখে আমার মুখে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো।কেনো জানি!আমার কাছে মনে হচ্ছে এই পাখি দুটো শীতের সময়টাকে খুব উপভোগ করছে।ছাঁদের রেলিঙের উপর হাত দুটো ভর করে দাঁড়িয়ে আছি।পাশের বিল্ডিং টার দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম একজোড়া দম্পতিকে।খুব সুন্দর ভাবে এই রোদ টাকে তারা উপভোগ করছে।মেয়েটার ভিজা চুল গুলো খুব যত্ন সহকারে গামছা দিয়ে বেঁধে দিচ্ছে ছেলেটা।ছেলেটার ঠোঁটে মুচকি হাসির ঢেউ।আমি তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিলাম।এই শীতে মনে হয় ভালোবাসার উপলব্ধি গুলো একটু বেশিই হয়।

হঠাৎ চোখ পড়লো সামনের চা স্টলটার দিকে।হাতে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ নিয়ে কাঠের বেঞ্চিটায় বসে আছেন রক্তিম ভাই।আচমকাই রক্তিম ভাইকে দেখে আমি চমকে উঠি।বিশ্বাস এই হচ্ছে না রক্তিম ভাই এখানে বসে আছেন।মনের ভুল ভেবে চোখ কচলে পুনরায় তাকালাম বেঞ্চিটার দিকে।উঁহুহু!মনের ভুল না।রক্তিম ভাই আসলেই বসে আছেন।তার মানে!উনি কাল মাঝরাতেই এসেছেন।এইজন্য,বড়মা আমাদের সবার সাথে খায় নি।রক্তিম ভাইয়ের আসার অপেক্ষায় অপেক্ষারত ছিলো।আর,আমি একটুও বুঝতে পারি নি ব্যাপার টা।মাথাতেই আসে নি রক্তিম ভাইয়ের আসার পূর্বাভাস।আড়চোখে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছেন।গালে চাপ দাড়ির গুলো একটু বড় হয়েছে।কালো জ্যাকেট টার পকেটে একটা হাত ঢুকিয়ে রেখেছেন।রক্তিম ভাইকে এইভাবে দেখে আমি যেনো আরো দূর্বল হয়ে গেলাম।মনের ভিতরে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।মুখে ফুটে উঠলো লজ্জামিশ্রিত একটা হাসি।ইচ্ছে করছে,এক ছুটে গিয়ে রক্তিম ভাইকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি।নিজের এরূপ ভাবনার মাঝেই নিচ থেকে রাহিম চেঁচিয়ে বললো,

‘ওই রিমঝিম!আপু তুমি মুচকি মুচকি হাসছো কেনো।পাগলে টাগলে ধরলো নাকি।’

রাহিমের গলা পেয়ে আমি অনেকটাই থতমত খেয়ে যাই।এই একটা ছেলে সব জায়গায় আমাকে হেনস্তা করেই ছাড়বে।আমি পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলাম সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে শুধুমাত্র রক্তিম ভাই ছাড়া।উনি দিব্বি নিজের মতো চা খেয়ে যাচ্ছেন।মুহুর্তেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।রক্তিম ভাই এতোদিন পরে এসেও আমার দিকে একটিবারও তাকালেন না।অত্যন্ত একপলক তো তাকিয়ে দেখতো।

নিচ থেকে রাহিম পুনরায় বলতে লাগলো,

‘বুঝি না রিমঝিম আপু তোমার মুখের মতিগতি।একবার মিটিমিটি হাসো তো আরেকবার মুখ ফুলিয়ে রাখো।ভূতে, ধরলো নাকি।’

আমি রাহিমের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে কিছু না বলে চলে আসলাম।এতো কিছুর মাঝে রক্তিম ভাই একটিবারও আমার দিকে চোখ তুলে তাকাননি।এইটা যে আমাকে রক্তিম ভাইয়ের দহনে পোঁড়াতে যথেষ্ট তা কি রক্তিম ভাই জানেন!!

ছাঁদ থেকে সোজা ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে পড়লাম।রান্নাঘর থেকে মা’র কথার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।উঁকি দিয়ে দেখলাম বড়মা,মেজোমা আর মা মিলে সব রান্নাবান্নার তোরজোর করছে।টেবিলে সকালের নাস্তা রেডি করা আছে।আমি আশপাশ না দেখে একপ্লেট ভাত আর তরকারি নিয়ে খেতে শুরু করে দিলাম।মা এসে আমাকে দেখে কিছুটা অবাক হলো।তা আমি বুঝতে পেরেছি মা’র মুখের হাবভাব দেখে।আমার এই বা কি করার আছে।রক্তিম ভাইয়ের দেখা না পাওয়ার ফলে আমার খাবারের প্রতি অনেকটা অনিয়ম হয়ে গিয়েছিলো।ঠিকমতো খেতে পারতাম না।শুধু মনের ভিতর অসহনীয় ব্যথা অনুভব করতে পেতাম।কিন্তু,আজকে রক্তিম ভাইকে দেখে মনে হলো আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।আমার মতো সুখী মানুষ হয়তো কেউ নেই।সেই সাথে পেটটাও কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।মনে হলো আমি অনেকদিনের অভুক্ত এক প্রাণী।এখন না খেলে আমার চলবেই না।

মা আমার অতি নিকটে এসে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলো।আমি একপলক মা’র দিকে তাকিয়ে পুনরায় খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।মা আমাকে কাটকাট গলায় বললো,

‘আর কয়টা পরীক্ষা বাকি আছে তোর?’

খেতে খেতেই জবাবে বললাম,

‘এইতো আরো দুটো পরীক্ষা বাকি।আগামীকাল একটা আছে তারপর একদিন গ্যাপ রয়েছে।’

‘ম্যাথ কবে তোর।’

‘লাস্ট এক্সামেই ম্যাথ মা।’

মা’র মুখে হাসি ফুটে উঠলো।এমতাবস্থায় আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘রক্তিমের কাছে কাল থেকে ম্যাথ নিয়ে বসবি।ওইদিনের পর থেকেই বসতো।কিন্তু,দেখলিই তো!রক্তিম ভার্সিটির ক্লাস ছিলো বলে চলে গিয়েছিলো আর গতকাল রাতে এসেছে।ভালোই হয়েছে!তোর ম্যাথ এক্সামের আগেই এসেছে।’

মা’র কথা কর্ণপাত করেই আমার গলায় যেনো খাবার আঁটকে গিয়েছে।ম্যাথ তাও আবার রক্তিম ভাইয়ের কাছে।ম্যাথে তো আমি এমনেই কাঁচা।মাঝেমধ্যে পাস মার্ক তুলতে অনেকটা হিমশিম খেয়ে যাই।সেখানে রক্তিম ভাইয়ের কাছে ম্যাথ পড়া মানে মান-সম্মানের টানাটানি।আমি একগ্লাস পানি খেয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিলাম।মা’র দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘আমি একাই পারবো মা।রক্তিম ভাইয়ের কাছে ম্যাথ বুঝতে হবে না।’

মা আমার কথায় তেলেবেগুনে একদম জ্বলে উঠলো।কটমট করে বললো,

‘আমি তোর কোনো কথা শুনতে চাই না রিমঝিম।আমার কথাই হবে শেষ কথা।কাল পরীক্ষা দিয়ে এসে রক্তিমের কাছে ম্যাথ নিয়ে বসবি।’

আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না।এমনকি মা আমাকে আর কিছু বলার সুযোগও দেয় নি।টেবিলের উপর মাংসের বাটিটা রেখে রান্নাঘরে চলে গেলো।আমিও অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলাম মা’র দিকে।

সিঁড়ির মাথায় তনায়া আপুর দেখা পেলাম।খাচ্ছি আর তনায়া আপুকে লক্ষ্য করছি।সাজগোজ করেছে অনেক।বুঝতে পারলাম বাবুর ভাইয়ার সাথে দেখা করবে।তনায়া আপু নিচে নামার আগেই আবির ভাই তাড়াহুড়ো করে তনায়া আপুর সামনে এসে দাঁড়ালো।ভ্রু কুটি কুঁচকে বললো,

‘কোথায় যাচ্ছিস তুই এই শীতের সকালে।আর এতো সাজগোজ করে কারসাথে দেখা করতে যাচ্ছিস তনায়া।কেমন পেত্নী পেত্নী দেখা যায় তোকে।তুই কি আমার কথা বুঝিস না তনায়া।আমি তোর ভাই হই।তোকে সত্যি টাই বলবো আমি।তোকে সাজলে একটুও ভালো লাগে না।পেত্নী সেজে রাস্তার মানুষদের কেনো ভয় দেখাবি বল তো।যদি হার্ট এটাক হয়ে যায় সেসব মানুষদের।’

আমি মুচকি মুচকি হাসছি আবির ভাইয়ের কথা শুনে আহারে!তনায়া আপুর সব কাজেই আবির ভাই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।আবির ভাইয়ের মুখচোখ দেখে বুঝতে পারলাম ভাইয়া কিছুটা ক্ষেপে আছে।আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম!আবির ভাইকে একবার জিজ্ঞেস করেই বসবো বাবু ভাইয়ের সাথে কিসের এতো দ্বন্দ্ব।পরমুহুর্তেই মেইন দরজার সামনে রক্তিম ভাইয়ের গলার আওয়াজ পেলাম।তাকিয়ে দেখলাম হাতে একটা ব্যাডমিন্টন ব্যাট নিয়ে এদিকেই আসছেন।আমি তাড়াহুড়ো করে প্লেটের বাকি অংশটুকু খেতে লাগলাম।কানে ভেসে আসছে তনায়া আপুর আওয়াজ।আবির ভাইয়ের কথার পিঠে খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বলতে লাগলো,

‘ভাইয়া!তুই কেনো আমার সাথে এমন করিস।আমি এখন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে।’

আবির ভাইয়ের গলার আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি।আবির ভাই ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে বলছে,

‘কতোটুকু বড় হয়েছিস তুই।মাত্র অনার্স প্রথম বর্ষে পড়িস।তাছাড়া খারাপ টা কি বললাম!তোকে সাজলে ভালো দেখায় না।আমি তো অনেক দয়ালু মানুষ।রাস্তার মানুষগুলোকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।ওদের খারাপ হাল আমি করতে দিতে পারি না।’

আমি এবারও হেসে দিলাম।আবির ভাই তো জব্বর ধড়িবাজ।কিছুতেই তনায়া আপুকে সেজেগুজে বাহিরের যাওয়ার পারমিশন দিবে না।আমার খাওয়া শেষ হতেই আমি রক্তিম ভাইকে ডিঙিয়ে বেসিনের দিকে এগিয়ে গেলাম।সোফার মাঝবরাবর পা তোলে বসে পড়লাম।টিভি দেখা উচিত।অনেকদিন হলো টিভির দেখা পায় নি।আর দেখা পাবোই বা কি করে!এতোদিন যে রক্তিম ভাইয়ের জন্য ব্যথিত ছিলাম।আজকে,রক্তিম ভাইকে দেখে আমি একদম আগের মতো ফিট হয়ে গিয়েছি।তবে,রক্তিম ভাই আমার দিকে এখনো তাকালেন না।আমার মাথায় কিছুতেই আসছে না কেনো রক্তিম ভাই আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না।আগে তো এইরকম ছিলেন না।বরং,আগে আমার পিছু না নিলে চলতোই না রক্তিম ভাইয়ের।আমি রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।রক্তিম ভাই ব্যাট টা কাঁধে তুলে তনায়া আপু আর আবির ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন।আবির ভাইকে দেখে বললেন,

‘আজকে সন্ধ্যায় ক্লাবের মাঠে ব্যাডমিন্টনের একটা টুনার্মেন্ট খেলা হবে।রেডি থাকিস আবির।’

আবির ভাই একটা ভাব নিয়ে বললো,

‘আমাকে হারানোর কারোর দম আছে নাকি।ব্যাডমিন্টনের ক্যাপ্টেন মানে আবির।সবাই আমাকে এই নামেই চিনে।গতবছর আমি ছিলাম বলে খেলায় জিতে গিয়েছিলাম।’

‘তুই না!বল বাবু ছিলো বলে খেলায় জিতে গিয়েছিলাম।শেষ ম্যাচে বাবু না থাকলে হেরে বাসায় আসতে হতো আমাদের।কি লজ্জাটাই না হতো!সবার মুখে শুধু একটা কথাই থাকতো নিজের এলাকায় নিজেরাই হেরে এসেছি।’

আবির ভাইয়ের মুখটা বেলুনের মতো ফুঁস হয়ে গিয়েছে।বেচারা আবির ভাই কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকালো রক্তিম ভাইয়ের দিকে।রক্তিম ভাইয়ের মুখে এই কথা টা একদমই মেনে নিতে পারে নি।আর,এদিকে তনায়া আপুর মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।দাঁত কেলিয়ে আবির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘এইরকম মুখ ফুলিয়ে রেখেছিস কেনো ভাইয়া!নিজের মিথ্যে প্রশংসা করতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেলি।’

আবির ভাই খ্যাঁক করে উঠলেন!কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘যা তো!আমার চোখের সামনে থেকে।রাস্তায় গিয়ে এইরকম দাঁত কেলিয়ে মানুষ কে দেখা।অত্যন্ত আমার সামনে থেকে দূর হ।’

তনায়া আপু একপ্রকার দৌড়ে নিচে নেমে আসলো।মুচকি হেসে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।আবির ভাইও মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো।
————-
এক বাসায় থেকেও রক্তিম ভাইয়ের দেখা তেমন একটা পাই না।সারাদিন বাসার বাহিরে থাকেন।এমনকি অনেকটা রাত করেও বাসায় ফিরেন।প্রথম প্রথম ব্যাপার টা সহ্য হলেও এখন আর পারছি না।এখন মনে হচ্ছে,কেনো রক্তিম ভাই এসেছিলেন!আর এসেই কেনো আমার দিকে একটিবারের জন্যও তাকাচ্ছেন না।কথাটা ভাবতেই আমার চোখ দুটো ভিজে উঠলো।চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।এরিমধ্যে দরজার ক্যাটক্যাট আওয়াজ শুনতে পেলাম।তাড়াহুড়ো করে চোখের পানি টুকু মুছে দরজার দিকে তাকালাম।দরজার সামনে রক্তিম ভাই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।এই সময় রক্তিম ভাইকে দেখে আমার কান্নার বেগ যেনো কমার বদলে আরো বেড়ে যাচ্ছে।আটকাতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু,আমি ভেবে পাচ্ছি না রক্তিম ভাই এখন আমার রুমে কি করছেন।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দশটা বাজে।নাক টেনে টেনে রক্তিম ভাইয়ের দিকে একপলক তাকিয়ে উনার শীতল চাহনি দেখে পুনরায় মাথা নিচু করে ফেললাম।

রক্তিম ভাই চেয়ার টা টেনে বসে পড়লেন।আমি মাথা নিচু করে থাকলেও ঠিকই বুঝতে পেরেছি।রক্তিম ভাই গলা কেশে বললেন,

‘মুখটা ধুয়ে ম্যাথ বই নিয়ে এসে পড়তে বস।আমার হাতে এতো সময় নেই।’

আমি চট করে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।মনে পড়লো আজকে উনার কাছে আমার ম্যাথ পড়ার কথা ছিলো।নিমিষেই আমার কান্নার বেগ ছুটে পালিয়েছে।আমি পিটপিট করে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।রক্তিম ভাই এখন আমার দিকে কপাল ভাঁজ করে তাকিয়ে আছেন।আগের শীতল চাহনি এখন আর নেই।আমাকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে রক্তিম ভাই কিছুটা উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,

‘কি হলো যা!মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি বই নিয়ে টেবিলে বস।’

আমি আর একমুহূর্তও দেরি করলাম না।দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।মুখ চোখ ধুয়ে টেবিলে বসে পড়লাম।রক্তিম ভাই ম্যাথ বইটা উল্টে পাল্টে দেখছেন।এইভাবে প্রায় দশ মিনিটের মতো কেটে গেলো।অনুভব করলাম শীত যেনো আমাকে আরো জেঁকে বসেছে।সেই সাথে ঘুমও।কম্বল নিয়ে শুয়ে পড়লেই আমি এখন এক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘুমিয়ে যাবো।ঘুমিয়ে যখন ঢলে পড়ে যাবো তখনি রক্তিম ভাই চেঁচিয়ে বললেন,

‘থাপ্পড় খেতে না চাইলে চোখ থেকে ঘুমকে বাই বাই করে দে।তোর ম্যাথের যে অবস্থা দেখছি পাস করবি কিনা তাই সন্দেহ।’

আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললাম,

‘রক্তিম ভাই!আপনি তো আমাকে এখনো পড়ানোই শুরু করলেন না।তাহলে,বুঝলেন কীভাবে আমি পাস এই করবো না।’

‘তোর ম্যাথ বই বলে দিচ্ছে তোর অবস্থা রিমঝিম।বই একদম নতুন।এক পৃষ্ঠা থেকে অপর পৃষ্ঠায় যেতে আমার অনেক থু থু ব্যয় করতে হচ্ছে।একগাদা থু থু হাতে দিয়েও আমি উল্টাতে পারছি না।তো এবার বুঝ তোর পরিণতি কি।তুই যদি পড়তিস তাহলে বইয়ের এইরকম অবস্থা থাকতো না।দেখলেই মনে হতো!পড়ে ফালাফালা করে দিয়েছিস।’

আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না।রক্তিম ভাই কিছু ভুল বললেন না।ম্যাথ আমি ধরেছি কিনা তাও সন্দেহ আছে।তাই চুপচাপ বসে থাকাটাই শ্রেয় মনে করছি।কোনো রকম ম্যাথ এক্সাম টা গেলেই বাঁচি।
—-
কলেজের সামনের রাস্তাটার ফুটপাত দিয়ে আমি আর রিমি হেঁটে আসছি।দু’জনের মুখেই আনন্দে ধারা বয়ে যাচ্ছে।তার একটাই কারণ,আমাদের দু’জনের পরীক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে।রিমি কমার্সে হলেও একসাথেই শেষ হয়েছে আমাদের পরীক্ষা।আজকে থেকে আমরা একদম নিশ্চিন্তে থাকবো।ইশশ!আমার এখনো মনে পড়ে গণিত পরীক্ষার আগের দুইটা রাতের কথা।রক্তিম ভাই কি বোকা টাই না আমাকে দিয়েছেন ম্যাথ বুঝি না বলে।লাস্টে তো দু’গালে কয়েকটা থাপ্পড়ও দিয়েছেন।এই দুইটা দিন রক্তিম ভাইকে আমার বাঘ মনে হয়েছে।যাক,অবশেষে পরীক্ষা তো শেষ হয়েছে।সামনের একটা দোকানে রক্তিম ভাইকে আড্ডা দিতে দেখে আমি শুকনো একটা ঢোক গিললাম।না জানি দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন দেখে আমাকে আবার জিজ্ঞেস করে বসে কি কি দিয়েছি।ভাবতেই আমার যায় যায় অবস্থা।আমি রিমির আড়ালে মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলাম।তবে,বেশিদূর যেতে পারিনি।রক্তিম ভাইয়ের ডাকে আমাদের থামতে হয়েছে।রক্তিম ভাই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘প্রশ্ন দেখা।’

আমি প্রশ্ন নিতে গিয়ে দেখলাম প্রশ্নের মধ্যে তেঁতুল রেখে দিয়েছে।কলেজে ইশফির কাছ থেকে তেঁতুল গুলো নিয়েছিলাম।রাখার জায়গা পাচ্ছিলাম না বলে প্রশ্নেই রেখে দিয়েছিলাম।প্রশ্নের এরূপ করুণ অবস্থা দেখে আমি নিজেই নিজেকে বকতে লাগলাম।কি করলি রে রিমঝিম তুই।দেখেশুনে কাজ করবি না।এখন আমি কি বলবো রক্তিম ভাইকে।আর,রক্তিম ভাইও আমাকে কি বলবেন।আমার ভাবনার মাঝেই রক্তিম ভাই পুনরায় বললেন,

‘কিরে!প্রশ্ন দেখা!কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো।’

আমার এবার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।আমি জিহবা দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে বললাম,

‘ইয়ে মানে রক্তিম ভাই।প্রশ্ন টা আমি বাসায় গিয়ে দেখাই।’

‘থাপ্পড় দিয়ে তোর গাল ফাটিয়ে দিবো রিমঝিম।প্রশ্নের মধ্যে কি কেউ তেঁতুল রাখে।আবার বলছিস বাসায় গিয়ে দেখাবি!আমি কি কিছু বুঝি না নাকি!’

‘আপনি দেখেও না দেখার ভান করে আমাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন কেনো রক্তিম ভাই।দেখলেন এই তো প্রশ্নের মধ্যে তেঁতুল রাখা!তোহ!আবার বললেন কেনো প্রশ্ন দেখানোর কথা।দোষ তো আপনারও কম না।’

কথাটা বলে আর দাঁড়াতে পারলাম না।রক্তিম ভাইয়ের তেড়ে আসা দেখে রিমির হাত ধরে দিলাম এক দৌড়।রক্তিম ভাইয়ের সামনে থাকা এখন আর সম্ভব না।
__________
এই হাড়কাঁপানো শীতে স্টেশনে বসে আছি।পাশেই রিমি ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে।মা,বড়মা,মেজোমা সামনের চেয়ার গুলোতে বসে আছে।পরীক্ষার শেষ হওয়ার পরের দিনেই বড়োরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রামের বাড়ি ঘুরতে যাবো।সেখানে তনু আপু আর বাবলু ভাইয়াও আসবেন।তার উপর দাদিও সবাইকে একসাথে দেখতে চাইছে।তাই,সবাই একজোট মিলে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া।সামনেই রক্তিম ভাই আর আবির ভাই দাঁড়িয়ে আছে।কিছু একটা নিয়ে হেসে হেসে কথা বলছে।কিছুক্ষণ পরেই ট্রেনের হুইশেল শুনতে পেলাম।সবাই যার যার ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।ট্রেন আসতেই সব মানুষ যেনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে।মানুষে গিজগিজ করছে চারপাশ।আমি আর রিমি একসাথে আগালেও মানুষের ঠেলাঠেলি তে আমি অনেকটা পিছিয়ে যাই।দূর থেকে দেখতে পারছি রিমি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।আমি তাড়াহুড়ো করে সামনে এগিয়ে যেতেই একজনের সাথে ধাক্কা লেগে নিচে পড়ে যাওয়ার আগেই রক্তিম ভাই কোথা থেকে এসে আমার হাতের কব্জি টা শক্ত করে ধরে নিলেন।একপ্রকার দৌড়েই ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
ট্রেনে উঠেও পড়লাম আরেক বিপদে।এতো ভিড় হওয়ায় সিটের কাছে যেতেই পারছি না।ট্রেনও চলতে শুরু করে দিয়েছে।সামনে আগানোর কোনো সুযোগও নেই।আমার পিছনেই অনেকগুলো লোক দাঁড়িয়ে আছে।তারা একে অপররের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।আমার পিঠের সাথে তাদের শরীরও লেগে যাচ্ছে।এতে আমার খুব ইতস্তত বোধ হচ্ছে।আমি একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে নিলাম তাদের অবস্থান টা।আমার অতি নিকটে এতোগুলো পুরুষের মুখ দেখে আমি কিছুটা চমকে উঠি।এরি মাঝেই রক্তিম ভাই আমাক উল্টো ঘুরিয়ে দিলেন।নিজের সাথে চেপে ধরে রেখেছেন।এমন হওয়ায় আমি রক্তিম ভাইয়ের বুকে গিয়ে পড়ি।মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই উনার বিশাল বড় দেহটা দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছেন।লোকগুলো আমার আর রক্তিম ভাইয়ের দিকে বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে থাকলেও রক্তিম ভাই উনাদের কোনো পাত্তা দিলেন না।আমার হাতের ভাঁজে উনার হাতটা ঢুকিয়ে দিয়ে চেপে ধরে রেখেছেন।আর আমি,মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি রক্তিম ভাইয়ের দিকে।এতোদিনে আমার মুখে একটু প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠেছে।মনে হচ্ছে,এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকি সারাটা পথ।

চলবে..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here