জলপদ্ম পর্ব -০৬

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|৬|
অবশেষে ছয় ঘন্টা জার্নির পর দাদু বাড়ি এসে পৌঁছেছি।এই বিশাল বড় বাড়িটা দাদা নিজের হাতে করে গিয়েছিলো।শুধু তাই নয়,দাদা ভালোবেসে দাদিকে এই বাড়িটা দিয়ে গিয়েছে।তাই তো!দাদিকে টেনেটুনেও এই বাড়ি থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না।দাদির মুখে এক কথা;এই বাড়িটায় আমি যা শান্তি খুঁজে পাই সেই শান্তি আমি অন্য কোথাও গিয়ে খুঁজে পাই না।এমনকি নিজের বাপের বাড়িও না।তোদের দাদা আমাকে শান্তি দিয়ে গেছেন রে!!
দাদির এই কথাটায় দাদার প্রতি দাদির ভালোবাসার গভীরতা উপলব্ধি করা যায়।এমনকি,দাদির মুখে শুধু দাদারই গল্প শোনা যায়।আমার আর রিমির জন্মের কয়েকমাস পরেই নাকি দাদা মারা গিয়েছিলো।দাদির মুখে শুনেছি শীতের সময় দাদা আমাকে আর রিমিকে জ্যাকেটের বড় বড় দুই পকেটে ঢুকিয়ে এই বাড়ি থেকে ওই বাড়ি ঘুরে বেড়াতো।আমরাও নাকি দাদার জ্যাকেটের পকেটে ঘাপটি মেরে বসে থাকতাম।দাদির মুখে দাদার কথা শুনলে মনের ভিতর জেদ জমে আসে কেনো দাদাকে বড় হয়ে দেখতে পায় নি!কেনো দাদার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি।

বারান্দা থেকে একটা স্টিলের চেয়ার নিয়ে বাড়ির উঠোনের মাঝখানে গিয়ে বসে পড়লাম।ঘরের ভিতর খুব শীত শীত লাগছে।এমনকি,পশ্চিমের বাতাস টায় সারা ঘর এসির মতো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।উঠোনে বসে চারপাশ টা একটু চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম।বাড়ির চারপাশ টায় সবজি বাগানে ভরপুর।তবে,এর মধ্যে মুলা সবজির কদর টা একটু বেশিই।আরেকটু ওইদিকে তাকাতেই চোখ পড়লো সেজোমা’র দিকে।আমার পছন্দের একটি মানুষ।সবসময় মুখে হাসি লেগেই থাকবে।সেজোমা’র কোনো সন্তান নেই।আমাদের কাজিনদেরকেই সেজো’মা নিজের এক একটা সন্তান বানিয়ে ফেলেছে।বাড়ি থেকে চলে আসার আগেই সেজো’মা আমাদের প্রত্যেকের জন্য কেঁদেকেটে ভাসাবে।সাথে করে নিয়ে আসতে চাইলেও আসতে চায় না।দাদিকে ছাড়া সেজো’মা একপাও নড়ে না।তাই তো,দাদি সেজোমা’কে একটু বেশিই পরিমাণে ভালোবাসে।শুধু দাদি না বংশের প্রত্যেক টা মানুষ সেজোমা’কে ভীষণ পছন্দ করে।

ধীর গতিতে সেজোমা’য়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।উঁপুড় হয়ে মুলা তুলছে।আমি পিছনে দাঁড়ানোর ফলে আমাকে দেখতে পায় নি।তাই আমিও যোগ দিলাম সেজোমা’র সাথে।আমাকে দেখেই সেজো’মা মুখে একটা মিষ্টি হাসি টানলো।সুন্দর মুখশ্রী টা লাল হয়ে আছে।ইশশ!কি সুন্দর লাগছে সেজোমা’কে।একদম পাঁকনা টমেটোর মতো।আমি সেজোমা’র দিকে চোখ ফিরিয়ে পাশের ঝুড়িটার দিকে তাকালাম।এক ঝুড়ি ভর্তি মুলা।অবাক হয়ে বললাম,

‘এতো মুলা দিয়ে কি হবে সেজোমা।মুলার নতুন কিছু রেসিপি করবে নাকি তোমরা জা’রা মিলে।’

সেজো’মা হেসে ফেললো।পুনরায় মুলা তোলায় মনোযোগ দিয়ে বললো,
‘না রে রিমঝিম!রক্তিম বলেছে সে মুলা দিয়ে শুঁটকি মাছ খাবে।এইজন্যই তো তুলছি।’

সেজোমা’র কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ বিরতির ঘন্টা বাজালাম।মিনিট দশেক পর আর্তনাদের মতো চিল্লিয়ে বললাম,

‘তাই বলে!এই এক সপ্তাহের মুলা রক্তিম ভাই একদিনেই খেয়ে ফেলবেন।মুলার মতো এইরকম অখাদ্য খাবার খেতেও পারেন বটে।’

কথাটা শেষ করতে পারিনি।তার আগেই রক্তিম ভাই কোথা থেকে এসে আমাদের সামনে হাজির হলেন।হাতে ফোন নিয়ে গুতাগুতি করছেন।গুতাগুতি করলেও আমার দিকে ভ্রুকুটি কুঁচকে তাকিয়ে আছেন।বেশ বুঝতে পেরেছি উনি যে আমার কথাটা শুনে নিয়েছেন।আমি তো ভুল কিছু বলি নি মুলা তো একটা অখাদ্যই খাবার।

রক্তিম ভাই ফোন নিয়ে কিছুক্ষণ গুতাগুতি করে কানে চেপে ধরে বললেন,

‘তোরা রাস্তার মোড়ে চলে এসেছিস!সমস্যা নেই আবিরকে পাঠিয়েছি।রাস্তার মোড়ে একটা টিনের মিনি সাইজের দোকান দেখতে পাবি,ওইখানে কাঁচা হলুদ রঙের টি-শার্ট আর লাল লুঙ্গি পড়া একটা স্মার্ট ছেলেকে দেখবি দাঁড়িয়ে আছে।আরো একটা সহজ উপায় বলে দিচ্ছি চেনার জন্য!দেখবি লুঙ্গিটা হাত দিয়ে ধরে রেখেছে।দেখলে মনে হবে খাঁটি বাঙালী।আসলে কিন্তু,ও বাঙালীর ব ও না।যাই হোক!ওকে দেখলেই সাথে সাথে গিয়ে তার ঘাড় মটকে বলবি তুমি আবির কিনা!দেখবি কাজ হয়ে যাবে।’

ইশশ!কি ছিরি রক্তিম ভাইয়ের কথার।আবির ভাইকে একদম জোকার বানিয়ে দিলেন।তবে,রক্তিম ভাইয়ের কথায় মনে হলো কোনো অতিথি আসছে।যার জন্য,আবির ভাইকে এইরকম সঙ সাজিয়ে তীর চিহ্নের মতো রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।আহারে!বেচারা আবির ভাই।

রক্তিম ভাই আমার দিকে একপলক তাকিয়ে সেজো মা’র দিকে এগিয়ে গেলেন।ঝুড়ি থেকে একটা মুলা হাতে তোলে নিয়ে এপিঠ ওপিঠ করে দেখে বললেন,

‘সেজো’মা মুলা গুলো লাগিয়ে ভালো একটা কাজ করেছো।মানুষ বুঝবে না এইটার মর্ম।এখন তো অখাদ্য বলেই যাবে কিন্তু এইটা যে গ্যাস ত্যাগ করে আর পেট পরিষ্কার করে অনেক বড় উপকার করে তা কেউ বুঝবে না।এখন না বুঝলেও সময় হলে ঠিকই বুঝবে।কথায় আছে না ঠেলার নাম বাবাজী!!ঠেলা আসুক তখন মুলাকে বাপ ডাকতেও ভুল হবে না।’

রক্তিম ভাই কথাটা বলেই আমার দিকে আড়চোখে তাকালেন।রক্তিম ভাইয়ের কথায় আমি ফুঁসে উঠলাম।কথাটা যে আমাকেই ইঙ্গিত করে বলেলেন আমি ঢের বুঝতে পেরেছি।তাও রক্তিম ভাই থামেন নি,মুখ চালিয়ে পুনরায় বলতে লাগলেন,

‘সেজো মা তুমি কি সাপের মতো ফোঁসফোঁসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছো।মনে হচ্ছে,কেউ ফোঁসফোঁস করছে।না জানি কখন ফণা তোলে দেয় এক দৌড়ানি।’

সেজো’মা হেসে ফেললো।রক্তিম ভাইয়ের পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে বললো,

‘রক্তিম এইটা কিন্তু ঠিক না।রিমঝিমকে এইসব বলা তোর উচিত হয় নি।বেচারির নাক মুখ দেখেছিস।’

রক্তিম ভাই পূর্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘যা বলেছি কোনো ভুল বলি নি সেজো’মা।ওকে তো শাস্তি দেওয়া উচিত।মুলার মতো এইরকম একটা উপকারী সবজিকে অসম্মান করেছে।মুলা বেটা যদি কষ্ট পেয়ে পরের বছর শীতে না আসে তখন আমার মতো হতভাগাদের কি হবে।মুলা না খেয়ে খেয়ে পায়খানা জমে একদম কঠিন হয়ে যাবে।একটা সময় বিস্ফোরণ হয়ে আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে পড়বে।কি বিশ্রীকর ব্যাপার!ভাবা যায়!’

একটা মানুষ এইরকম লেইম কথাবার্তা বলতে পারে তা আমার মোটেও জানা ছিলো না।শুধু তাই নয় কথাগুলো মুখেও আঁটকাচ্ছে না,স্বাভাবিক ভাবে বলেই যাচ্ছেন।চলে আসলাম সেখান থেকে।রক্তিম ভাইয়ের হাবভাব আমি কিছুই বুঝি না।একবার আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন তো আরেকবার আমাকে পঁচিয়েও শান্ত হন না।আমার মনে হয় রক্তিম ভাইয়ের মাথায় বিশাল বড় ছিট আছে।যা খুবই গুরুতর!!
—-
বাড়ির সামনের জায়গা টায় দাঁড়ালেই দূরের মাটির রাস্তাটা সম্পূর্ণ দেখা যায়।দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি কতোগুলো ছেলেমেয়ে একসাথে আমাদের বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে।সামনেই নেতা নেতা ভাব নিয়ে হেঁটে আসছে আবির ভাই।হাতের কোণায় লুঙ্গির একপ্রান্ত ধরে রাখা।চোখে সানগ্লাস।আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আজকের আকাশে সূর্যের কোনো দেখা নেই।দিনটা কেমন মনমরা হয়ে আছে।এই রোদমুক্ত একটা দিনে আবির ভাইয়ের চোখের সানগ্লাস দেখে মনে হবে চারপাশ সূর্যের প্রকোপে খাঁ খাঁ করছে।অথচ দিনের অবস্থা একদমই ঠান্ডা।পাশেই রিমি আর তনায়া আপু দাঁড়িয়ে আছে।আবির ভাইকে দেখে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে যাবে এমন ভাব।আমি একবার তাদের অবস্থান পরোক্ষ করে দেখে নিলাম!দেখে এইটা বুঝেছি হাসতে হাসতে গড়িয়ে মাটিতে কখনোই পড়বে না পড়লে সামনের পুকুর টায় গিয়ে পড়বে।কারণ,আমরা পুকুরের পাড় ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছি।তবে,একদিক দিয়ে ভালো হবে এই শীতে পুকুরের এইরকম শীতল পানিতে ডুব দিয়ে তাদের গোসল টা অত্যন্ত সেড়ে যাবে।আমি গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।একবার রিমি আর তনায়া আপুকে দেখছি তো আরেকবার আবির ভাইকে দেখছি।

আবির ভাই একদল ছেলে মেয়েগুলোকে নিয়ে সোজা বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লো।আমাদেরকে দেখেও যেনো দেখে নি।তবে,এই ছেলেমেয়ে গুলোর ভিড়ে আমি তারিন আপুকে দেখেছি।তার মানে,এইসবগুলো রক্তিম ভাইয়ের বন্ধু।এইজন্যই তখন ফোনে তুই করে বলছিলেন।কিন্তু,তারিন আপুকে দেখে আমার মোটেও ভালো লাগে নি।উনি বাদে সবাই আসলে আমি ভীষণ খুশি হতাম।কিন্তু এখন খুশি না হয়ে কান্না পাচ্ছে।আমার নিজেরেই এখন মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না করতে মন চাচ্ছে।চোখে,মুখে বিতৃষ্ণা এনে ধ্যাঁত বলে জায়গা প্রস্থান করলাম।ধপাধপ্ পা’য়ে পাশের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম।ওইখানে একজোড়া শালিক পাখি আছে।শুনেছি,জোড়া শালিক দেখলে নাকি দিন ভালো যায়।তাই,আমার দিনটা ভালো যাওয়ায় জন্য অত্যন্ত ওই জোড়া শালিককে একবার দেখে আসা উচিত।এমনকি মনে মনে ভেবেও নিয়েছি যতদিন তারিন নামক এই ঘূর্ণিঝড় টা আছে ততদিন এই শালিক গুলোকে দেখে আসবো।

বাড়ির ভিতরে এসেও শান্তি নেই।মানুষের হাউকাউ তে মনে হচ্ছে এই বাড়িতে কোনো বড় কেউ থাকে না।সবগুলো পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চা।আরো রাগ লাগছে,তারিন আপুর প্রতি সবার এতো আদিখ্যেতা দেখে।কেনো পাশে তো আরো দুটো আপু বসে আছে ওদেরকে একটু দেখুক না।সব খাবার-দাবার কি তারিন নামক ঘূর্ণিঝড়কেই দিবে।না জানি আবার কখন ঘূর্ণিঝড়ের মতো সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়।তবে,তারিন আপুর পাশে বসা আপুটিকে এক দেখাতেই আমার খুব মনে ধরে গিয়েছে।কি মায়াবী চেহারা।সরু নাকের মাঝখানে চশমাটা ঠেস দিয়ে রেখেছে।নাকে জ্বলজ্বল করছে পাথরের একটি নথ।বাহ্!নথ পড়েও কাউকে এতো সুন্দর লাগে নাকি।হঠাৎ চোখ পড়লো আবির ভাইয়ের দিকে।আবির ভাই একধ্যানে তাকিয়ে আছে আপুটির দিকে।যা বুঝার বুঝে গিয়েছি আমি।আবির ভাইও আপুটিকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে।এই কথাটা যদি আমি তনায়া আপুর কানে পৌঁছে দেই তাহলে তনায়া আপুকে আবির ভাই বাবু ভাইয়ের সাথে দেখা করা থেকে আর আঁটকাতে পারবে না।বুদ্ধি টা ভালোই কাজে দিবে।ভাইবোন দু’জনেই আমার!দু’জনকেই প্রেম করার সুযোগ করে দেওয়া উচিত।যাই হোক!এই আপুটিকে আমার ভাবী করতে কোনো অসুবিধা নেই।কিন্তু,তারিন আপুকে রক্তিম ভাইয়ের সাথে কখনোই না!নেভার!নেভার!নেভার!মানে তিন নেভার!

বাহারী রকমের মিষ্টি টেবিলের উপর দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না।টুপ করে একটা কালোজাম মিষ্টি তোলে নিলাম।যেই না মুখে দিতে যাবো তার আগেই রক্তিম ভাই এসে আমার হাত থেকে কালোজাম মিষ্টি টা খেয়ে নিলেন।আমি রাগান্বিত হয়ে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।আচমকাই কোথা থেকে যে এসে পড়েন তাও বুঝতে পারি না।তাকিয়ে দেখি চোখ,মুখ বন্ধ করে মনের স্বাদ মিটিয়ে কালোজাম মিষ্টি টা খাচ্ছেন।আমি রক্তিম ভাইয়ের সামনে তেড়ে গিয়ে বললাম,

‘এইটা কি হলো রক্তিম ভাই!আমার কালোজাম মিষ্টি টা আপনি খেয়ে নিয়েছেন!টেবিলে কি কালোজাম মিষ্টির অভাব পড়েছে নাকি।’

রক্তিম ভাই স্বাভাবিক ভাবেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘কালোজাম মিষ্টিটায় কি তোর নাম লিখা ছিলো রিমঝিম।যেভাবে বলছিস মনে হয় খোদাই করে মার্বেল পাথর দিয়ে তোর নামটা লিখা ছিলো।হাতের কাছে পেয়েছি ব্যাস খেয়েছি।এইখানে আমার আর তোর বলতে কিছু নেই রিমঝিম।’

আমি রক্তিম ভাইয়ের কথা শুনেও কিছু বলি নি।এখন কিছু বললেই উনি আবারও এইরকম কয়েকটা কথা আবোলতাবোল লজিক দিয়ে বুঝিয়ে দিবেন।যা শুনলে আমার মাথা আর ঠিক থাকবে না।তখন যা ইচ্ছা করে ফেলতে পারি।তাই,এখন চুপ থাকাটাই ভালো মনে করছি।
খুব সাবধানতার সাথে আমি আরেকটা কালোজাম মিষ্টি তুলে নিলাম।কিন্তু এটাও আমার পেটের ভিতর যায় নি।খাওয়ার আগেই রক্তিম ভাই আগের ন্যায় আমার হাত থেকে মিষ্টিটা খেয়ে নিয়েছেন।এবার আমি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।উনি এমন একটা ভাব করে আছেন যেনো এইখানে সেইরকম কিছুই হয় নি।রাগে,দুঃখে আমার কান্না চলে আসার উপক্রম।রক্তিম ভাইয়ের দিকে মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে জায়গা প্রস্থান করার জন্য সামনের দিকে পা বাড়ালাম।কিন্তু যেতে পারলাম না।রক্তিম ভাই আমার হাত ধরে একটু সাইডে নিয়ে গেলেন।দেয়ালের সাথে আমাকে
দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।নিজেও আমার মুখের অতি নিকটে এসে দাঁড়িয়েছেন।যার ফলে,রক্তিম ভাইয়ের বুকের সাথে আমার বুক গলা মিশে আছে।হঠাৎ করে রক্তিম ভাইয়ের এমন কাজে আমি জমে যাই।রক্তিম ভাইকে নিজের এতোটা কাছে আসতে দেখলে আমার যে অবস্থা খারাপ হয়ে আসে।এইযে এখন যেমন হচ্ছে!ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে।শুধু তাই নয় পেটের ভিতর টা কেমন বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে।হার্টবিট খুব দ্রুত গতিতে চলছে।ঢিপঢিপ আওয়াজ টা আমি নিজেও শুনতে পাচ্ছি।ইশশ!কেনো এমন হয় রক্তিম ভাই কাছে আসলে।মনে মনে একশো বকা দিতে ইচ্ছে করছে রক্তিম ভাইকে।কিন্তু,তাও পারছি না।ঠোঁট সহ আমার কণ্ঠনালী যেনো কাঁপছে।

রক্তিম ভাই আমার আরো কাছে আসতেই আমি চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নেই।শ্বাসপ্রশ্বাস আরো দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে দিয়েছে।হঠাৎ অনুভব করলাম রক্তিম ভাই আমার ঠোঁটের চারপাশে কালোজাম মিষ্টি দিয়ে স্লাইড করছেন।যার ফলে,আমার ঠোঁটের চারপাশ মিষ্টির রসে ভরে গিয়েছে।আমি চোখ খুলে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।অদ্ভুত এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।আমার চোখের দিকে তাকিয়েই মিষ্টিটা খুব তৃপ্তি সহকারে খেয়ে একটা ঢেঁকুর তুললেন।আমি রক্তিম ভাইয়ের কর্মকাণ্ডের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।মিষ্টি যেহেতু উনিই খাবেন তাহলে আমার ঠোঁটের কেনো বারোটা বাজালেন।এরিমধ্যেই রক্তিম ভাই আমার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন,

‘এই মিষ্টি টা খুব মজার ছিলো রিমঝিম।অন্যরকম একটা স্বাদ পেলাম।’

আমি পিটপিট করে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।এখনো সেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।আমি নড়াচড়া করতেই রক্তিম ভাই আমার আরেকটু নিকটে চলে আসলেন।নাকে নাক ঘষে বললেন,

‘এতো নড়ছিস কেনো রিমঝিম।চুপ করে একটু দাঁড়িয়ে থাক না।’

আমি বিরক্তির চাহনি নিয়ে বললাম,

‘উফফ!সামনের থেকে সরুন তো রক্তিম ভাই।আমার মুখ ধুতে হবে।ঠোঁটের চারপাশে কেমন চটচট করছে।’

‘তোর ঠোঁট দুটোতে আমি চেটেচেটে মিষ্টির ভাব টা দূর করে দেই।বেশি দেরি হয়ে গেলে দেখবি পিঁপড়েরা বাসা বেঁধেছে।কাছে আয় রিমঝিম।দেরি করা চলবে না।পরে দেখবি মুখ আছে তো ঠোঁট নেই।’

আমি শুকনো একটা ঢোক গিললাম।রক্তিম ভাই নির্ঘাত পাগল হয়েছেন।না হলে এইসব কথা উনি মোটেও বলবেন না।পরীক্ষার আগ অবধি কি রূপ টাই না দেখিয়েছিলেন আমাকে!আর এখন দেখাচ্ছেন অন্য রূপ।পরী টরী ধরলো নাকি।আমার এসব ভাবনার মাঝেই রক্তিম ভাই আমার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন।রক্তিম ভাই মাথাটা আরেকটু নিকটে আনার আগেই আমি নিচে বসে পড়ি।হামাগুড়ি দিয়ে রক্তিম ভাইয়ের কাছ থেকে সরে আসলাম।এমতাবস্থায় বললাম,

‘আপনি খুব বেশরম রক্তিম ভাই।চাচাতো বোনকে কেউ কিস করতে আসে।’

রক্তিম ভাই পাল্টা জবাবে বললেন,

‘চাচাতো বোন যদি আমার বিরহে ব্যথিত হয়ে থাকতে পারে তাহলে তাকে শুধু কিস না অন্য সবকিছুই করতে যেতে পারি।শুধু সময়ের অপেক্ষা আর কি।’

আমি খুকখুক করে কেশে উঠলাম।রক্তিম ভাই জানলেন কি করে আমি যে উনার ব্যথায় ব্যথিত হয়ে ছিলাম এতোদিন।ভয়ে,জিহবা দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিলাম।মুহুর্তেই আমার জিহবা টা মিষ্টির স্বাদে ভরে গেলো।রক্তিম ভাইকে তেড়ে আসতে দেখে আমি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম।দৌড় দিতে দিতে বললাম,

‘রক্তিম ভাই আপনি মনে হয় জ্যোতিষী।সবকিছুই কীভাবে কীভাবে যেনো জেনে যান।ম্যাথে আমার করুণ অবস্থাও জেনে গিয়েছেন আর এখন আমার বিরহের কথাও।আপনি একজন ভয়ংকর মানুষ রক্তিম ভাই।’

এক দৌড়েই বাড়ির বাহিরে বেরিয়ে আসলাম।পিছনে তাকানোর সাহস টুকুও করি নি।আজকের পর থেকে রক্তিম ভাইয়ের সামনে যাওয়া টা খুব ডিফিকাল্ট হয়ে যাবে।তা বেশ বুঝতে পারছি।
————-
বরাবরে মতো আজকেও আমার ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছে।লম্বা একটা হাই তোলে বাড়ির বাহিরে বেরিয়ে আসলাম।আজকের ঠান্ডা টা মনে হয় অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই।কিছুটা সামনে আগাতেই দেখতে পেলাম সবাই মিলে গোল হয়ে বসে আগুন পোঁহাচ্ছে।কিন্তু,একটা দৃশ্য দেখে মুহুর্তেই আমার রাগ মাথায় চড়ে গেলো।তারিন আপু রক্তিম ভাইয়ের সাথে চিপকে আছে।আর,রক্তিম ভাইও হাসি মুখ করে বসে আছে।দিনের শুরুতেই এমন একটা দৃশ্য দেখবো তা কখনোই ভাবতে পারি নি।দৌড় লাগালাম পাশের বাড়ির দিকে।ওই দুইটা শালিককে আবার দেখে আসবো।না হলে আমার মন কিছুতেই শান্ত হবে না।আমার দৌড় দেখেই আবির ভাই চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

‘কিরে রিমঝিম!এইভাবে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছিস।এইখানে এসে বস।আগুন পোঁহাবি।তোর তো শীত রন্ধ্রে রন্ধ্রে।যার জন্য,এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও গোসলের নাম নিস না।’

আমি আবির ভাইয়ের কথায় চেঁচিয়ে বললাম,

‘আবির ভাই!পাশের বাড়ির দিকে যাচ্ছি।ওইখানে দুইটা শালিক আছে।কথায় আছে,জোড়াশালিক দেখলে দিন ভালো যায়।আমার যে দিন ভালো যাওয়া খুব দরকার।’

‘আরো একটা কাজ করিস রিমঝিম!জোড়া শালিক দেখে কলাগাছের সামনে গিয়ে বলবি কলাগাছ আব্বা!দেখবি যা মন থেকে চাইবি সেটাই পেয়ে যাবি।’

আবির ভাইয়ের কথা কর্ণপাত করে আমার ঠোঁটে বিশ্বজয় করা একটা হাসি ফুটে উঠলো।এখন আর দেরি করা চলবে না।পুনরায় দৌড় লাগালাম শালিক পাখি আর কলাগাছের উদ্দেশ্যে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here