জলপদ্ম পর্ব -০৭

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|৭|
হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যে মৃদু আওয়াজে বৃষ্টি পড়াও শুরু হয়েছে।যার ফলে,শীতের প্রকোপ আগের তুলনায় অনেকটা বেশি মনে হচ্ছে।এতোক্ষণ শীতের বস্ত্র পরিধান না করলেও এখন বাধ্য হয়ে কালো রঙের লেডিস ব্লেজার টা পড়ে নিয়েছি।ওড়নাটা গলায় পেঁচিয়ে,পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে বড়ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম।সেখানে ভাপা পিঠার তোরজোর চলছে।মোস্ট প্রবাবলি!এইটা সবারই প্রিয় একটা পিঠা।শুধু তাই নয়!শীত মানেই ভাপা পিঠা,আর ভাপা পিঠা মানেই শীত।দুটো যেনো একে অপরের এপিঠ ওপিঠ।

ফ্লোরে রঙিন পাটি বিছিয়ে রক্তিম ভাই সহ বাকিরা সবাই মিলে আড্ডায় বসেছে।সাথে রিমি আর তনায়া আপুও আছে।আমি এইখানে সেজোমা’র সাথে বসে আছি।সেজোমা আর মেজোমা মিলে ভাপা পিঠার জন্য যাবতীয় সামগ্রী গুলো তৈরি করছে।আর,চুলোর ওইদিকটায় বসে আছে বড়মা আর মা।এইখানে বসে থাকলেও আমার মন পড়ে আছে আড্ডাখানার আসরে।বারবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখছি রক্তিম ভাইকে।বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছেন।সেই সাথে মুখভর্তি খোঁচালো দাড়ি।আহা!!কি সুন্দর লাগছে রক্তিম ভাইকে।ইচ্ছে করছে সারাটাক্ষণ চেয়েই থাকি।কিন্তু,তারিন আপুর হাবভাব আমার কিছুতেই পছন্দ হচ্ছ না।হাসতে হাসতে রক্তিম ভাইয়ের কোলে ঢলে পড়ার মতো অবস্থা!কই বাকি আপুরা তো চুপচাপ বসে হাসছে।তারা তো কারোর উপর ঢলে পড়ছে না।তবে,এতো কিছুর মাঝে একটা জিনিস স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আবির ভাইয়া ওই চশমিশ আপুর দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে।যেনো পলকেই পড়বে না।কিন্তু,চশমিশ আপু আবির ভাইকে পাত্তাই দিচ্ছেন না।বেচারা আবির ভাই!!

কেনো জানি মন টা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেলো।এইখানে বসে থাকতে আর একদন্ডও ভালো লাগছে না।তারিন আপু আর রক্তিম ভাইকে একসাথে দেখলে আমার অন্য এক অনুভূতি কাজ করে।সেই সাথে,মনেও নেমে আসে নিকষ কালো অন্ধকার।এখন,ঠিক এই অনুভূতি টাই হচ্ছে।যা সহ্য করা আমার জন্য খুব কষ্টের হয়ে যাচ্ছে।তাই,নিঃশব্দে ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।হয়তো!আমার এই নিঃশব্দে চলে আসাটা কারোর চোখে পড়বেই না!!

বাহিরের বৃষ্টির দাপট ক্রমশই বেড়ে চলেছে।শীতও এখন আগের থেকে দ্বিগুণ লাগছে।তাও!আমি পশ্চিমের জানালাটা খুলে দাঁড়িয়ে আছে।মৃদু হালকা বাতাসে আমার সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।বাতাসের তাড়নায় আমার চুল গুলো এলোমেলো ভাবে মুখে এসে বাড়ি খাচ্ছে।তাও,আমি সরিয়ে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছি না।থাকুক না তারা কিছুক্ষণ নিজেদের মতো এলোমেলো হয়ে!হাত দুটো ভাঁজ করে বাহিরের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশটার দিকে তাকিয়ে আছি।বারান্দার লাইটের আলোর জন্য উঠোন টা দেখা যাচ্ছে।উঠোনের মাঝখানে বন,খড় গুলো ভিজে অবস্থায় পড়ে আছে।সকালে ঠিক এই জায়গা টাতেই একসাথে বসে রক্তিম ভাই আর তারিন আপু আগুন পোঁহাচ্ছিলেন।কথাটা মনে পড়তেই বুক চিরে এক তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো।ইদানীং অনুভব,করতে পারি রক্তিম ভাইয়ের উপর আমি আরো দূর্বল হয়ে পড়ছি।রক্তিম ভাই আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন।সেই অভ্যাস না জানি কবে আবার বদভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।

আচমকাই কাঁধে কারোর স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠি।চটজলদি করে পিছনে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই আমার অতি নিকটে দাঁড়িয়ে আছেন।রক্তিম ভাইকে এতো কাছে দেখতে পেয়ে আমার হার্টবিট দ্রুত চলতে শুরু করে দিলো।ঠোঁটের কোণে মৃদু কম্পনের হাসি দেখে আমি চোখ দুটো বন্ধ করে নেই।তবে,রক্তিম ভাইকে এইখানে দেখে বেশখানিকটা অবাক হয়েছি।উনি তো তারিন আপুর সাথে আড্ডাখানায় মশগুল ছিলেন।আচ্ছা!রক্তিম ভাই কেনো এলেন এইখানে!আমার জন্য!!নাকি এমনেতেই এসেছেন!!
আমার এসব ভাবনার মাঝেই রক্তিম ভাই আমার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললেন,

‘কিরে!রিমঝিম কোথায় হারিয়ে যাস তুই বারবার।’

আমি পিটপিট করে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।আমতাআমতা করে বললাম,

‘কোথাও না রক্তিম ভাই।’

রক্তিম ভাই বাঁকা ঠোঁটের হাসি নিক্ষেপ করে আমার দিকে তাকালেন।মুখ টা আমার আর একটু কাছে এনে বললেন,

‘আমি সব বুঝি রিমঝিম।তোমাকে এতো মিথ্যা এক্সপ্লেইন করতে হবে না।কারণ,তোমার মতো আমিও যে এমন একজন।’

আমি ড্যাবড্যাব চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।রক্তিম ভাই জিন্দেগীতেও আমাকে তুমি বলে ডাকেন নি।তুই ছাড়া মুখ দিয়ে তো অন্য কোনো সম্বোধনের বুলি ফুটতোই না।আর,আজকে আমাকে তুমি বলে ডাকছেন।আচ্ছা!রক্তিম ভাইয়ের মাথা কি ঠিক আছে!!উঁহুহু!রক্তিম ভাইয়ের মাথায় নির্ঘাত কোনো গন্ডগোল হয়েছে।

‘কি হলো!এতো অবাক হওয়ার কি আছে।বউকে তো তুমি বলেই সম্বোধন করতে হয়।আমিও করলাম আমার ফিউচার বউকে তুমি বলে সম্বোধন।’

আমি যেনো এবার ধোঁয়াশার মধ্যে চলে গেলাম।রক্তিম ভাইয়ের কথাটা মিনিট দশেক সময় নিয়ে ভেবে দেখালাম!সাথে সাথেই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।কিছু বলতে যাবো তার আগেই রক্তিম ভাই বলে উঠলেন,

‘বুঝলি রিমঝিম!বিয়ের পর আমার ফিউচার বউকে তুই ডাকার অপরাধে না জানি নাটক,সিনেমার মতো আমার নাজেহাল অবস্থা করে দেয়।তোদের মেয়েদের বিশ্বাস নেই।তোদের মন বুঝা খুব মুশকিল।দেখবি ভালো করতে গিয়ে খারাপ হয়ে গিয়েছে।না জানি!তোর জামাইয়ের কি অবস্থা করিস তুই।তাই তো আমি এখন থেকে প্র‍্যাক্টিস করছি।যাতে,বিয়ের পর তুমি ডাক টা মিস না হয়।এইসব ছোট মিসটেক করে বিয়ের পর কোনো মারামারি করতে চাই না।শুধু ভালোবাসতে চাই।

রক্তিম ভাইয়ের কথা কর্ণপাত করেই আমার মুখ চুপসে গিয়েছে।রক্তিম ভাইয়ের পিঞ্চ মারা কথাটা আমি মুহূর্তেই বুঝে গিয়েছি।উনি যে তারিন আপুকে বিয়ে করার কথাটা বুঝিয়েছেন!!ছি ছি!বিয়ের পর তারিন আপুকে তুমি ডাকটা সম্বোধন করবেন বলে এতোক্ষণ আমাকে তুমি বলে শুধুমাত্র প্র‍্যাক্টিস করছিলেন!!সাথে সাথে মনের ভাবনায় চলে আসলো রক্তিম ভাই একজন খাটাশ লোক।শুধু তাই নয়,আমার মনে খোদাই করা রক্তিম ভাইয়ের নামের পাশে খাটাশ শব্দটাও নিমিষেই যুক্ত হয়ে গিয়েছে।

আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।রক্তিম ভাইয়ের দিকে তাকাতে পর্যন্তও ইচ্ছা করছে না।তাই,রক্তিম ভাইকে পাশ কাটিয়ে চলে আসার জন্য সামনের দিকে পা বাড়ালাম।দু’এক কদম আগানোর পর পরই রক্তিম ভাই আমার হাত টা শক্ত করে ধরে ফেললেন।আমি রক্তিম ভাইয়ের হাত ধরাকে অগ্রাহ্য করে ঘরের বাহিরে চলে আসলাম।চুপিচুপি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।নিরব,কোলাহলমুক্ত একটা জায়গা হলে বেশ ভালো হতো।অত্যন্ত,কেঁদে মনের ভিতরকার অস্থিরতা গুলো দূর করে দিতে সক্ষম হতাম!!
—-
বৃষ্টির ফলে উঠোন টা কেমন পিচ্ছিল হয়ে আছে।মাঝরাতের দিকেও ঝুম বৃষ্টি হয়েছিলো।বারান্দা থেকেই দেখতে পাচ্ছি বাড়ির সামনে তনায়া আপু দাঁড়িয়ে আছে।কানে ফোন!!তার মানে বাবু ভাইয়ার সাথে কথা বলছে।আমিও তনায়া আপুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য হাঁটতে লাগলাম।কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা হলো চশমিশ আপুর সাথে।আপুর নাম আমার অজানা।আপুকে দেখে আমি মুখে সৌজন্যমূলক হাসি টানলাম।আপু আমার কাছে এসে বললেন,

‘তুমিই তাহলে রিমঝিম।জানো!কতো ইচ্ছে ছিলো তোমাকে দেখার।যাক,অবশেষে পূরণ হয়ে গেলো।খুব মিষ্টি দেখতে তুমি।চয়েজ আছে বলতে হবে।’

কথাটা বলেই আপু তড়িঘড়ি করে চলে গেলেন।আমি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারি নি।তার আগেই আপু দৌড়ে চলে গেলেন।চিন্তায় পড়ে গেলাম।আপুর কথাগুলো আমার কানে মাছির মতো ভনভন করছে।খোলসা করে না জানা অবধি মনে কিছুতেই শান্তি পাবো না।আপাততঃএইসব কথা নিয়ে আর ভাবতে চাই না।কারণ,এখন ভাবতে গেলে মনের উশখুশ আরো বেড়ে যাবে।পাশে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।চুল গুলো এলোমেলো হয়ে সামনে পড়ে আছে।এই শীতেও পাতলা হাফ হাতা একটা টি-শার্ট পড়ে আছেন।বুঝলাম ঘুম থেকে উঠে এসেছেন।লম্বা একটা হাই তোলে বললেন,

‘শিলা তোকে কি বলেছে রে!’

রক্তিম ভাইয়ের কথার ধরণে এতোটুকু আন্দাজ করতে পেরেছি চশমিশ আপুর নাম শিলা।নামটা বেশ সুন্দর।আবির ভাইয়ের নামের সাথেও বেশ মানানসই।আবির-শিলা বা শিলা-আবির।কথাটা ভেবেই আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সামনে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন উত্তরের অপেক্ষায়।আমিও ভাব নিয়ে বললাম,

‘অনেক কিছু বলেছে!আপনাকে কেনো বলতে যাবো।’

‘আমাকে বলতে তুই বাধ্য।কারণ,শিলা আমার বন্ধু।সেই সুবাদে তোর আমাকে বলতেই হবে।’

‘এইটা কেমন লজিক রক্তিম ভাই।এইটা কোন সংবিধানে লিখা আছে।’

‘এইটা আমার সংবিধানে লিখা।এখন তুই এতো পটর পটর না করে বল শিলা তোকে কি বলেছে।’

রক্তিম ভাইয়ের একঘেয়ে কথাবার্তার ধরন দেখে আমার নিজেরেই এখন খুব রাগ লাগছে।বিরক্তির গলা টেনে বললাম,

‘বললো!আমাকে দেখার ইচ্ছা নাকি অবশেষে পূরণ হয়েছে।আরো একটা কথা বললো!চয়েজ আছে বলতে হবে।কিন্তু,এই কথাটা কেনো বললো ঠিক বুঝতে পারি নি।চশমিশ আপু না মানে শিলা আপু তো আমাকে এই প্রথমেই দেখেছেন তাই না!তবে,এই কথাটা কেনো যে বললেন!উমম!বুঝলেন রক্তিম ভাই!শিলা আপুর এই কথাটার মানে আমাকে জানতেই হবে।না হলে আমি দু’চোখের পাতা এক করতে পারবো না।’

রক্তিম ভাই বুকে হাত রেখে খুকখুক করে কেশে উঠলেন।মিনিট পাঁচেক পর গলাটা ঠিক করে মিনমিনে গলায় বলতে লাগলেন,

‘শিলার এইসব কথা কখনোই পাত্তা দিস না।কি বলতে গিয়ে কি বলেছে কে জানে।ওর মাথায় ছিট আছে।বন্ধুমহলের সবাই শিলাকে হাবলি বলে ডাকি।তাই,হাবলির কথা শুনে তুইও ভ্যাবলি হয়ে যাস না।দেখি সামনে থেকে সর।’

আমি রক্তিম ভাইয়ের কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছে।রক্তিম ভাই আর শিলা আপু দু’জনের কথাই আমার মাথা উপর দিয়ে গিয়েছে।এখন মনে হচ্ছে দুই বন্ধু এক ক্যাটাগরির।কপালে ভাঁজ রেখেই ধপাধপ পা’য়ে তনায়া আপুর কাছে চলে গেলাম।তনায়া আপুর মুখে মিষ্টি হাসি লেগে আছে।আমি কাছে যেতেই তা আরো চওড়া হয়েছে।তনায়া আপুকে দেখলেই বুঝা যায় বাবু ভাইয়ের সাথে প্রেম জমে উঠেছে।আমি কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম তনায়া আপুর দিকে।আচ্ছা!প্রেমে পড়লে কি ঠোঁটে সবসময় হাসি লেগে থাকে!!
————-
‘এই রিমঝিম!আমার এই কানে একটু দুল টা লাগিয়ে দে না।কখন থেকে চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।মনে হচ্ছে!কানের ছিদ্র বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’

আমি বিরক্তির দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম রিমির দিকে।জাম কালারের একটা জামদানী শাড়ি পড়েছে।সেই সাথে মুখে একগাদা মেকাপের আস্তরণ।মনে হচ্ছে!কোনো বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে যাচ্ছে।রিমির হাত থেকে কানের দুলটা নিয়ে বললাম,

‘রিমি!তোর সাজ দেখে মনে হচ্ছে তুই কোনো বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছিস।অথচ,আমরা সবাই মিলে একটু গ্রামের পরিবেশ টা ঘুরে দেখবো।’

‘তাহলে তুই কিছুই জানিস না রিমঝিম!আজকে ফটোসেশান হবে।তারিন আপু ডিএসএলআর নিয়ে এসেছে।আপুই তো বললো!আজকে আমাদেরকে শাড়ি পড়তে।গ্রামের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ফটোসেশান হবে আমাদের।আর,তুই এইভাবে কেনো বসে আছিস।যা লাল রঙের শাড়িটা পড়ে নে।একটু পরেই বের হয়ে যাবো আমরা।’

রিমির কথাটা শুনে আমার বিরক্তি যেনো আরো বেড়ে গেলো।আর,শখ কতো!আমি নাকি শাড়ি পড়বো।তারিন আপু কি একবারও আমাকে বলেছেন শাড়ি পড়ার কথা।বাকি সবাইকেই তো বলেছেন তখন কি একটিবারও আমাকে বলতে পারতেন না।তাহলে!কোন সুখে আমি শাড়ি পড়তে যাবো।আর,আমার এতো ইচ্ছাও নেই শাড়ি নামক প্যারা সহ্য করার।মনে মনে এইরকম হাজারো বুলি ফুটিয়ে রিমিকে কানের দুল টা পড়িয়ে দিলাম।এরিমধ্যে,তনায়া আপু হাতে হেয়ার ব্রাশ নিয়ে এসে বললো,

‘রিমঝিম বাবু!দে না একটু খোঁপা টা বেঁধে।আমি শাড়ি পড়েছি তো তাই পারছি না।হাত উঁচু করলেই মনে হচ্ছে শাড়ি খোলে যাবে।’

তনায়া আপুও শাড়ি পড়েছে।অথচ,একটিবারও আমাকে বললো না,তারা সবাই মিলে শাড়ি পড়ছে।তারিন আপু না বলুক!তনায়া আপু আর রিমি তো আমাকে আগে থেকে বলতে পারতো।মনটা আরো খারাপ হয়ে গিয়েছে।মনে হচ্ছে,আমি সবার পর।তবে,ব্যাপার টা কে বাহিরে প্রকাশ না করে হাসি মুখে রিমির কানের দুলটা পড়িয়ে দিয়ে তনায়া আপুর চুল গুলো খোঁপা করে দিতে লাগলাম।
__
ঘরের বাহিরে এসে দেখি উঠোন জুড়ে সব শাড়ি পরিহিতা রমণীরা দাঁড়িয়ে আছে।এখন যেনো আমার মনে খারাপ লাগাটা আরো জেঁকে বসেছে।সবাই শাড়ি পড়ে আছে আর আমি শুধু সিম্পল একটা সিল্কের জামা পড়েছি।আমার গলা ফাটিয়ে কাঁদতে মন চাচ্ছে।আফসোস হচ্ছে কেনো পড়তে গেলাম না।পরমুহূর্তেই নিজের মনকে নিজে শাসিয়ে বললাম,পড়িস নি বেশ ভালো করেছিস।তোকে পড়ার জন্য তো কেউ বলে নি।তাহলে এতো আফসোস করে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।গুনগুন করে গান গেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।এক পাশেই তনু আপু আর বাবলু ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন।বলতে গেলে,তাদের দু’জনকে একদম পার্ফেক্ট কাপল লাগছে।

‘তুমি শাড়ি পড়লে না কেনো রিমঝিম।’

পিছনে তাকিয়ে দেখি শিলা আপু।কালো জামদানী তে শিলা আপুকে একদম পুতুল পুতুল লাগছে।আজকে,আবির ভাই নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে।শিলা আপুকে আমার বলতে ইচ্ছা হচ্ছে এইভাবে মোটেও আসা আপনার ঠিক হয় নি আপু।অত্যন্ত আমার ভাইয়ের দিকটা ভাবা উচিত ছিলো।কিন্তু,এসব কথা কিছুই বলা হলো না।শিলা আপুর কথার পিঠে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,

‘আজকে ইচ্ছা হয় নি আপু।তবে,আপনাকে দেখতে বেশ লাগছে।’

‘তোমাকেও তো এই সাধারণ সাজে ভীষণ মিষ্টি লাগছে রিমঝিম।’

শিলা আপুর কথায় আমি শুধু মুচকি হাসলাম।আর,তেমন কিছু বলি নি।শিলা আপুর ফোন আসায় একটু অন্যদিকে চলে গিয়েছেন।আমি আশেপাশে তাকিয়ে রক্তিম ভাইয়ের খোঁজ করার চেষ্টা চালালাম।সবাই থাকলেও রক্তিম ভাই আর তারিন আপুর কোনো খোঁজ নেই।ব্যাপার টা মনে হতেই আমার খুব খারাপ লাগলো।কেনো জানি খুব অস্থিরতা লাগছে।রক্তিম ভাইয়ের খোঁজ করার জন্য ঘরের দিকে এগিয়ে যাবো তার আগেই দরজার সামনে দুই মানব কে দেখে আমার পা সেখানেই থমকে গিয়েছে।আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি!রক্তিম ভাই আর তারিন আপু হেসে হেসে এদিকেই এগিয়ে আসছেন।দু’জনেই এক কালারের শাড়ি আর পাঞ্জাবি পড়েছেন।রক্তিম ভাই আর তারিন আপুকে একসাথে দেখে বাকি সবাই চিল্লিয়ে উঠলো।এখানে থাকতে আমার আর একদন্ডও ইচ্ছা করছে না।দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে চলে আসলাম সামনের সরু রাস্তাটার দিকে।আশেপাশে কাউকে না দেখে আমি মুখে হাত গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।রক্তিম ভাই আর তারিন আপুকে আমি একসাথে সহ্য করতে পারছি না।ইচ্ছে করছে এক ছুটে রক্তিম ভাইয়ের কাছে চলে যাই।

মাঠের এককোনায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছি।আমার একটু দূরেই সবাই মিলে ছবি তুলতে ব্যস্ত।আমাকে অনেক বলার পরও আমি যাই নি।আসল কথা!আমার একা থাকতে ইচ্ছে করছে।কোলাহলের মধ্যে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগছে না।পা থেকে জুতো জোড়া খোলে তার উপর বসে পড়লাম।সামনের সবুজের ঘেরা প্রকৃতির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি।শহরে এইরকম দৃশ্য দেখা খুবই মুশকিল।আস্তে আস্তে,সূর্য টাও ডুবে যাচ্ছে।কুয়াশায় আচ্ছন্ন পরিবেশে সূর্যের লাল আভা চারপাশে জড়িয়ে পড়ছে।কি অপরূপা সেই দৃশ্য।মন খারাপের মাঝেও আমার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।

‘হাই!আমি নির্ঝর।তোমাকে এইখানে একা বসতে থাকতে দেখে আসলাম।তাছাড়াও,তোমার সাথে আলাদা করে কথাও হয় নি আমার।’

পুরুষালী কণ্ঠ পেয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাইয়ের বন্ধু নির্ঝর ভাইয়া।কথা না হলেও আবির ভাইকে এই নামে ডাকতে শুনেছি।কিন্তু,আমার পাশে বসতে দেখে আমি একটু অস্বস্তিতে পড়ে যাই।দূরে সরে আসতে নিলেই,নির্ঝর ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,

‘ইজি থাকো।এতো ইতস্তত হওয়ার কোনো মানেই হয় না।’

নির্ঝর ভাইয়ের কথায় আমি শুধু মাথা নাড়ালাম।হঠাৎ খেয়াল করলাম নির্ঝর ভাইয়া আমার দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।ব্যাপার টা আমার কাছে মোটেও ভালো লাগলো না।নির্ঝর ভাইয়ার দৃষ্টি যখন আমার গলার দিকে পড়লো তখনি আমি ওড়না টা মেলে দেই।এমন হওয়ায় নির্ঝর ভাইয়া কিছুটা থতমত খেয়ে যান।তা আমি নির্ঝর ভাইয়ার মুখের মতিগতি দেখেই বুঝে নিয়েছি।এরিমাঝেই রক্তিম ভাই কোথা থেকে এসে আমার হাত ধরে টেনে তোললেন।শক্ত করে চেপে ধরে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,

‘এইখানে আর একমুহূর্তও থাকবো না সবাই বাড়ির দিকে হাঁটা ধরো।’

রক্তিম ভাইয়ের কথায় তারিন আপু বিরক্ত হয়ে বললেন,

‘এইটা কেমন কথা রক্তিম।এখনো তো তোর আর আমার ছবিই তোলা হলো না।তার আগেই তুই চলে যেতে চাচ্ছিস।আর,রিমঝিমের হাত ধরে আছিস কেনো।ওকে,নির্ঝরের সাথে থাকতে দে।তুই আমার কাছে আয়।’

রক্তিম ভাই মিহি আওয়াজে চিৎকার দিয়ে উঠলেন।তারিন আপুর দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বললেন,

‘মনে রাখিস তোদের অনুরোধে আমি এইখানে এসেছি।না হলে,আমার একটুও ইচ্ছা ছিলো না।তবে,আমি এইখানে আর একমুহূর্তের জন্যও থাকবো না।এইখানে যদি আর এক সেকেন্ডও থাকি তাহলে আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।আমার জিনিসে কেউ বাজে নজর দিবে।তা আমি থাকতে কখনোই হতে দিবো না।’

রক্তিম ভাই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন।রক্তিম ভাইয়ের হঠাৎ করে কি হলো কিছুই বোধগম্য হলো না আমার।রক্তিম ভাই যে খুব রেগে আছেন তা রক্তিম ভাইয়ের রক্তলাল চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।আমি আর সেদিকে তাকায় নি।হঠাৎ চোখ পড়লো শিলা আপুর দিকে।শিলা আপু আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন।শিলা আপুর হাসির মানে কি হতে পারে তাও আমার অজানা।খুব জানতে ইচ্ছে করছে শিলা আপু আমাদের এইভাবে দেখে হাসছেন কেনো!!আর রক্তিম ভাইয়েই কেনো হঠাৎ করে রেগে গেলেন!!
————-
রাত তখন বারোটা!আশপাশ নিস্তব্ধ হয়ে আছে।তার উপর আরো গ্রামের পরিবেশ।গ্রামে নয়টা মানে অনেক রাত।দাদু বাড়ির একদম ভিতরের রুমটায় আমি একা শুয়ে আছি।আজকে একা থাকতে খুব ইচ্ছে করছে।বারবার শুধু তখনের ঘটনাটাই মনে পড়ছে।রক্তিম ভাইয়ের হাত ধরার মুহূর্ত টা মনে পড়তেই আমার মনের ভিতর এক অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠলো।মুখে আচমকাই লজ্জামিশ্রিত হাসি ফুটে উঠলো।ঠান্ডা,নিস্তব্ধ পরিবেশে দরজার ক্যাটক্যাট আওয়াজ পেয়ে আমি চমকে উঠি।সামনে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে সিমেন্টের দেয়াল টায় হেলান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি তাড়াতাড়ি করে উঠে বসলাম।উঠে বসতেই শরীরে শীত যেনো আরো জেঁকে বসেছে।কম্বল টা গলা অবধি টেনে নিয়ে রক্তিম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘রক্তিম ভাই এতো রাতে আপনি এখানে কি করছেন।’

রক্তিম ভাই,স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,

‘সেই কৈফিয়ত তোকে দিতে বাধ্য নই আমি।’

রক্তিম ভাইয়ের এমন খাপছাড়া কথা শুনে আমি মুখ ভেঙচি মেরে বিরবির করে বলতে লাগলাম,

‘কৈফিয়ত চাওয়ার মতো কি এমন বললাম আমি কে জানে!!’

‘আগে বল!নির্ঝরের সাথে তোর এতো কথা কিসের।’

আমি চট করে সামনে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের মুখপানে।রক্তিম ভাই আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন।রক্তিম ভাইয়ের আগানো দেখে আমি শুকনো কয়েকটা ঢোক গিললাম।রক্তিম ভাই পুনরায় বলে উঠলেন,

‘কি হলো বল।মুখে সুপার গ্লু কেনো লাগিয়ে রেখেছিস।আমার উত্তর চাই রিমঝিম।’

আমি আঁটকে আসা কণ্ঠে বললাম,

‘রক্তিম ভাই!কই এতো কথা বললাম।সামান্য কথাই তো বলেছি।উঁহুহু!একটু ভুল হয়েছে আমি একটাও কথা বলি নি সব তো নির্ঝর ভাইয়া বলেছেন।তবে,নির্ঝর ভাইয়া কিন্তু অনেক সুন্দর।কি সুন্দর করে কথা বলেছেন আমার সাথে।’

আমার কথাটা শেষ হতে না হতেই রক্তিম ভাই আমাকে বিছানায় চেপে ধরলেন।এক হাত দিয়ে আমার দু’হাত ধরে রেখেছেন।আরেক হাত দিয়ে আমার গাল চেপে ধরে আছেন।মজা করে বলতে গিয়ে যে রক্তিম ভাইয়ের এরূপ চেহারা দেখতে পাবো তা মোটেও জানা ছিলো না।রক্তিম ভাই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বললেন,

‘আমার জিনিসে আমি কাউকে ভাগ বসাতে দেই না রিমঝিম।তা তো তুই ভালো করেই জানিস।’

আমি মুখ নড়াচড়া করতেই রক্তিম ভাই গাল থেকে হাত টা সরিয়ে দিলেন।গাল থেকে হাত টা সরাতেই আমি বাঁজখাই কণ্ঠে বলে উঠলাম,

‘উফফ!রক্তিম ভাই!আপনি এইভাবে আমাকে চেপে ধরে আছেন কেনো।আপনি যখন তারিন আপুর সাথে ছিলেন তখন কি আমি কিছু বলেছিলাম আপনাকে!তাহলে,আমি নির্ঝর ভাইয়ার সাথে কথা বললে,বা বসে থাকলে তাতে আপনার কি মশাই!!’

রক্তিম ভাইয়ের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি রক্তিম ভাইয়ের দিকে।রক্তিম ভাইয়ের মতিগতি কিছুই টের পাচ্ছি না।একবার হাসেন তো আরেকবার গম্ভীর হয়ে থাকেন।রক্তিম ভাই আমার হাত দুটো ছেড়ে দিয়ে আমার পাশেই শুয়ে পড়লেন।উপরের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে হাসছেন।আমি এখনো আগের ন্যায় অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।এইভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর রক্তিম ভাই আচমকাই আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলেন।খোঁচাখোঁচা দাড়ি গুলো দিয়ে স্লাইড করছেন।আমি খাঁমচে রক্তিম ভাইয়ের চুল আঁকড়ে ধরলাম।এমন হওয়ায় রক্তিম ভাই আগের থেকে আমাকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছেন।কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম,

‘রক্তিম ভাই!ছাড়ুন আমাকে।এইটা ঠিক হচ্ছে না।’

‘হুশ!ঠিক,বেঠিক দিয়ে আমার কিছুই যায় আসে না রিমঝিম।বেশি নড়াচড়া করলে তোকে কিন্তু এই শীতে পুকুরের পানিতে চুবিয়ে আসবো।এখন,বাকিটা তোর ইচ্ছা।’

রক্তিম ভাইয়ের কথার পিঠে আমি আর কিছু বলার সাহস পাই নি।যতটা সম্ভব শরীর কুঁচকিয়ে রেখেছি।রক্তিম ভাইকে ভীষণ ভয়ংকর লাগছে।সেই সাথে আমার শরীর বেয়ে খুব বাজে রকমভাবে কাতুকুতুর অনুভূতি আসছে।

চলবে..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here