জলপদ্ম পর্ব -০৮

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|৮|
শেওলা পড়া রঙবিহীন ছাঁদের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি।অনেকদিন বন্ধ পড়ে থাকায় ছাঁদের এই করুণ অবস্থা হয়েছে।চারপাশে ঘাস জমে কেমন বড় হয়ে আছে।পরিষ্কার করলে,ছাঁদ টা যে একটা অন্যরকম রোমাঞ্চকর রূপে আসবে তা দেখলেই বুঝা যায়।ছাঁদ থেকে আশেপাশের সবকিছুই দৃশ্যমান।এই যে এখন দেখতে পাচ্ছি রক্তিম ভাই উঠোনের একপাশে দাঁড়িয়ে ফোনে ব্যস্ত হয়ে আছেন।রক্তিম ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাতেই আমি অন্য এক অনুভূতির জগতে চলে গেলাম।সাথে সাথেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম।মুহূর্তেই কালকের রাতের কথা মনে পড়ে গেলো।রক্তিম ভাই বেশ খানিকটা সময় নিয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজে ছিলেন।সেই সাথে রক্তিম ভাইয়ের খোঁচালো দাড়ি গুলোও আমাকে খুব জ্বালিয়েছিলো।গলার পাশ টা কেমন বারবারা জ্বলে উঠছিলো।আমি সরে আসতে নিলেই রক্তিম ভাই আমাকে আরো শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরেন।এখন তো!রক্তিম ভাইয়ের সামনে যেতেই আমার অনেক দ্বিধা বোধ কাজ করবে।শুধু তাই নয়,লজ্জাও খুব আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিবে।আবির ভাইয়ের কথার আওয়াজে পুনরায় উঠোনের দিকে চোখ নিক্ষেপ করে তাকালাম।উঠোন জুড়ে সবাই মিলে ব্যাডমিন্টন কোর্ট তৈরি করছে।আজকে রাতে,ব্যাডমিন্টন খেলা হবে।দর্শক হিসেবে মেয়েরা থাকবে।বিশাল বড় অবিচার করা হচ্ছে আমাদের উপর।শিলা আপু আর তারিন আপু মিলে যখন আবদার করেছিলো মেয়েদেরও এক ম্যাচ খেলতে দিতে হবে তখনি রক্তিম ভাই একবাক্যে না করে দিয়েছিলেন।বলেছিলেন,ছেলেদের খেলা হবে শুধু, তোরা খেলতে পারবি না।তোদের কাজ হলো আমাদের খেলার দর্শক হয়ে থাকা আর আমাদের খানাপিনার সুযোগ সুবিধা করে দেওয়া।রক্তিম ভাইয়ের কাছ থেকে আমি ঠিক এইরকম একটা উত্তর আশা করেছিলাম।আর,মিলেও গেলো তা।রক্তিম ভাইয়ের কথা শুনে শিলা আপু আর তারিন আপু দু’জনেই চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।আর কিছু না বলে সোজা চলে এসেছিলেন।কারণ,শিলা আপু আর তারিন আপু দু’জনেই জানেন রক্তিম ভাই এক কথার মানুষ।কথার কোনো নড়চড় হয় না।হঠাৎ চোখ পড়লো নির্ঝর ভাইয়ার দিকে।আমার দিকে কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন।নির্ঝর ভাইয়ার এরূপ চাহনি দেখলে আমার খুব অস্বস্তি হয়।নির্ঝর ভাইয়ের প্রতি একটা খারাপ ভাবনা চলে এসেছে আমার মনে।নির্ঝর ভাইয়া বাদে বাকি দু’জন ভাইয়াকে আমার খুব ভালো মনের মনে হয়।সিফাত ভাইয়া আর রঞ্জন ভাইয়া।এই দু’জনের সাথে আমার টুকটাক কথা হয়েছে।রঞ্জন ভাইয়া একদম রসিক মানুষ।উনার দু’একটা কথাতেই বুঝে গিয়েছি।তবে,একটা জিনিস দেখে আমার মনের একটা ধারণা চেঞ্চ হয়েছে।সুস্মিতা আপু আর রঞ্জন ভাইয়ার প্রেম দেখে আমার বিশ্বাস হয়েছে,যে বন্ধুদের মধ্যেও প্রেম হয়।যাকে বলে,কঠোর প্রেম।দু’জন দু’জনকে যেনো চোখে হারায়।কেনো জানি!আমার কাছে বন্ধুদের মধ্যে প্রেম অনেকটা পানসের মতো লাগতো।কোনো কিছু একটা মিসিং মনে হতো।তবে,সুস্মিতা আপু আর রঞ্জন ভাইয়াকে দেখে এই ধারণা টা এখন দূর হয়ে গিয়েছে।আচমকাই,রক্তিম ভাইয়ের কর্কশ গলার আওয়াজ পেয়ে আমি কিছুটা চমকে উঠি।সামনে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই রাগান্বিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।সূর্যের ফলে চোখ,মুখ কুঁচকে রেখেছেন।এমতাবস্থায় বললেন,

‘তোকে যেনো এইখানে আর না দেখি রিমঝিম।এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে ঢুকবি,থামলেই কিন্তু খবর আছে।এমনকি ঘর থেকে বেশি বের হবি না।বের হতে দেখলেই তোর পা কিন্তু তোর সাথে থাকবে না।কথাটা যেনো মনে থাকে।’

রক্তিম ভাই আমার উদ্দেশ্যে কথাটা বলেই রক্তলাল চক্ষু নিক্ষেপ করে তাকালেন নির্ঝর ভাইয়ার দিকে।নির্ঝর ভাইয়া সাথে সাথেই আমার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মাথাটা নিচু করে ফেললেন।সবকিছুই আমার এখন বোধগম্য হয়েছে।ব্যাপার টা বুঝতে আমার কিছুটা সময় লেগেছিলো।তবে,যখন বুঝলাম রক্তিম ভাই নির্ঝর ভাইয়ার চোখ থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য ঘরে যেতে বলেছেন তখনি মনের ভিতর একরাশ ভালো লাগা এসে ভিড় করলো।ইচ্ছে করছে মুক্ত আকাশে দু’হাত মেলিয়ে দিয়ে ঘুরতে থাকি।তার মানে!আমার দিকে নির্ঝর ভাইয়ের তাকানোটা রক্তিম ভাই কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না।তাহলে!কি রক্তিম ভাইয়ের মনে আমার জন্যও কোনো অনুভূতি আছে!কথাটা ভেবেই আমি শব্দ করে একটা ফ্লায়িং কিস ছুড়ে মারলাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।সাথে সাথেই রক্তিম ভাই পিছনে ঘুরে আমার দিকে তাকালেন।রক্তিম ভাইকে ঘুরতে দেখে আমি অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি।সেই সাথে লজ্জাও।আমি আশপাশ তাকিয়ে রক্তিম ভাইয়ের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম।উঁহুহু!রক্তিম ভাইয়ের মুখের মতিগতি দেখে কিছুই বুঝতে পারছি না।কেমন একটা রোবটের মতো তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।আমি আর,দেরি না করে নিচে চলে আসার জন্য সামনের দিকে গতি বাড়ালাম।যত তাড়াতাড়ি যেতে পারবো ততই ভালো।রক্তিম ভাই তো!মাঝেমধ্যে ভয়ংকর রূপ নিয়ে হাজির হন আমার সামনে।
—-
গুনগুন করে গান গাইছি আর ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।তারিন আপুকে সামনে দেখে আমি তেমন একটা পাত্তা দিলাম না।পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলেই তারিন আপু শক্ত করে আমার বাম হাত টা চেপে ধরে আঁটকে দিলেন।অগ্যাতা আমাকে থামতে হয়েছে।কিন্তু,আমি বুঝতে পারছি না তারিন আপু কেনো আমার হাত ধরে রেখেছেন!উনি তো আমাকে সহ্যই করতে পারেন না।কথা গুলো ভেবে তারিন আপুর দিকে তাকালাম।তারিন আপু আমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছেন।আমি বার কয়েক চোখের পলক ফেলে বললাম,

‘আমার হাত ধরে আছেন কেনো তারিন আপু?’

তারিন আপু দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,

‘তুমি নিজেকে বড্ড চালাক ভাবো তাই না রিমঝিম।থাকো তো বোকা আর আনস্মার্ট হয়ে।দেখলে মনে হবে ভাঁজা মাছ টাও উল্টে খেতে পারো না।’

আমার খুব রাগ জন্মালো তারিন আপুর কথার ধরণ দেখে।ভ্রু কুটি কুঁচকে তারিন আপুর হাতের বাঁধন থেকে হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,

‘মানে!কি বলতে চাইছেন আপনি তারিন আপু?’

‘কাল তোমার জন্যই রক্তিম আমার সাথে ফটোসেশান করতে পারে নি।এতো কষ্ট করে শাড়ি পড়ে লাভের লাভ টা কি হলো!কিছুই না।কি না কি কারণে রক্তিম তোমার কাছে ছুটে গিয়ে হাত ধরে বললো ও নাকি এইখানে আর একমুহূর্তও থাকতে চায় না।শুধু তাই নয়,আমার সাথে রেগেও কথা বলেছে।শুধুমাত্র তোমার জন্য রিমঝিম।’

আমার রাগ যেনো আরো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।রক্তিম ভাই কেনো এমন করেছিলেন তার প্রপারলি উত্তর আমার কাছে নেই।জানলে ঠিকই তারিন আপুর মুখের উপর বলে দিতাম।শুধু শুধু আমাকে দোষের ভাগীদার করে কি লাভের লাভ টা পাচ্ছেন উনি!

‘তুমি তো এটাই চেয়েছিলে তাই না রিমঝিম!খুশি তো এবার তুমি।রক্তিম আমার সাথে একটাও ছবি তোলে নি।’

এবার নিজেকে ঠিক রাখা খুব দুষ্কর হয়ে গিয়েছে।বিরক্তির সুর টেনে বললাম,

‘রক্তিম ভাই কে তো আমি ইচ্ছে করে বলি নি আমার হাত ধরে সিনেমার নায়কের মতো টেনে নিয়ে যেতে।রক্তিম ভাই নিজেই তো আমার কাছে এসেছিলেন।তখন কেনো আটকাতে পারেন নি।এখন,আমার সামনে এসে ঘ্যানঘ্যান করছেন কেনো?রক্তিম ভাই কেনো আপনার সাথে ছবি তোলেন নি সেটা আপনিই রক্তিম ভাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে নিবেন!আর শুনুন!রক্তিম ভাই আপনার সাথে ছবি তুললো কি তুললো না সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।’

একদমে কথাগুলো বলেই তারিন আপুর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচি মেরে চলে আসলাম।আমার এতো সুন্দর মুডের বারোটাই বাজিয়ে দিয়েছেন।রক্তিম ভাইকে নিয়ে এতোক্ষণ সুখের অনুভূতিতে ভাসলেও এখন খুব রাগ হচ্ছে রক্তিম ভাইয়ের উপর।ধপাধপ্ পা’য়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।চোখ বন্ধ করে বিছানার উপর উঁপুড় হয়ে শুয়ে আছি।আচমকাই ডুকরে কেঁদে উঠলাম।তারিন আপুর কথা গুলো আমার কানে এখনো বাঁশির শব্দের মতো বাঁজছে।এতে করে,আমার কান্নার গতি যেনো আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।
—-
আমগাছের নিচে আমি আর রিমি মোড়া নিয়ে বসে আছি।চারদিকে শীতল বাতাস বইছে।হাত গুলো গুটিয়ে রেখেছি ব্লেজারের পকেটে।রিমির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সে একধ্যানে সিফাত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।সিফাত ভাইয়াও আড়চোখে তাকাচ্ছেন রিমির দিকে।বাহ্!তার মানে রিমি আর সিফাত ভাইয়ার মনে প্রেমের লাড্ডু ফুটছে।আমি গলা পরিষ্কার করে রিমির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম,

‘সিফাত ভাইয়াকে তোর কেমন লাগে রে রিমি??’

রিমি সিফাত ভাইয়াকে দেখায় এতোটায় মগ্ন ছিলো যার ফলে,আনমনেই বলে উঠলো,

‘সিফাত ভাইয়ার চেহারা দেখলে মনে হয় আমি মিষ্টি কুমড়ার দিকে তাকিয়ে আছি।ইচ্ছে করে রেঁধে খেয়ে ফেলি।’

রিমির উত্তরে আমি অনেকটা টাসকি খেয়ে গেলাম।সিফাত ভাইয়াকে তার মিষ্টি কুমড়া মনে হয়!তার উপর খেয়েও ফেলতে মন চায়।আমি রিমির মাথায় হালকা টোকা দিতেই রিমি একটু নড়েচড়ে উঠলো।আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

‘তোর সমস্যা কি রিমঝিম।এতো সুন্দর একটা মুহুর্তে ছিলাম আর তুই সব ভেস্তে দিলি।’

আমি মুখ বেঁকিয়ে বললাম,

‘কি সুন্দর মুহুর্তে ছিলি তা আমি জানি রিমি।লাস্টে তোর কি না সিফাত ভাইয়াকে মিষ্টি কুমড়ার মতো মনে হয়েছে।মানে!অন্য কিছু কি ছিলো না।যদি,সিফাত ভাইয়া শুনেন তাহলে তোর প্রতি জন্মালো সিফাত ভাইয়ার ফিলিংস গুলো এক নিমিষেই উড়ে চলে যাবে।’

‘আমি কি করবো বল রিমঝিম।সিফাত ভাইয়ার চেহারা টা একটু ওইরকমই দেখতে লাগে।তাও,মিষ্টি কুমড়া রান্নার গন্ধ পাচ্ছি।এইজন্য তালগোল পাঁকিয়ে গিয়েছে।তুই তো জানিস মিষ্টি কুমড়া আমার খুব পছন্দ।’

আমি বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালাম রিমির দিকে।রিমি আর রক্তিম ভাইকে আমার খুব আজব লাগে।একজনের মুলা পছন্দ তো আরেকজনের মিষ্টি কুমড়া।দুই ভাই বোন মনে হয় এক গোয়ালের গরু গাভী।রিমির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললাম,

‘তাই বলে,একটা মানুষ কে তুই কুমড়ার সাথে তুলনা করবি।এইরকম করলে প্রেমের প টাও ডিঙিয়ে যেতে পারবি না।’

রিমি থতমত খেয়ে গিয়েছে।আমার দিকে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বললো,

‘প্রেম করার জন্য ট্রাই মারছি আর তুই সেটা বুঝেও গেলি।কীভাবে রে!’

‘তোকে যে কেউ দেখলেই বুঝবে তুই এইখানে প্রেম করতে বসেছিস।বসলি তো বসলি লাস্টে কিনা সিফাত ভাইয়াকে কুমড়া বানিয়ে দিলি।’

আমার কথায় রিমি হেসে উঠলো।সিফাত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘যাই বলিস না কেনো!সিফাত ভাইয়াকে আমার খুব মনে ধরেছে।আমিও খেয়াল করেছি সিফাত ভাইয়া আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে থাকেন।শুধু তাই নয় মুচকি মুচকি হাসেনও বটে।’

‘আমিও তা দেখে নিশ্চিত হয়েছি তোদের মধ্যে কিছু একটা চলছে।তবে,সিফাত ভাইয়া যদি আমার দুলাভাই হয় তাহলে আমি কিন্তু কুমড়া পটাশ বলে ডাকবো।’

রিমি ঠোঁট চেপে হাসছে আর লজ্জা পাচ্ছে।বেচারি লজ্জায় ঠিকমতো হাসতেও পারছে না।আর,ওইদিকে সিফাত ভাইয়া রিমির দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি আর তাদের মাঝখানে না বসে ইচ্ছা করে উঠে আসলাম।অত্যন্ত,চোখাচোখি করেও দু’জনের মনের কথা গুলো প্রকাশ করুক।

ঘরে প্রবেশ করতে না করতেই সেজোমা আমার হাতে একটা প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,

‘রিমঝিম রক্তিম দুপুরে খায় নি।তুই একটু দিয়ে আয় এইটা রক্তিমকে।আমার রূম্পা ভাবিদের বাড়িতে যেতে হবে।চাল কুটে আনতে হবে।ভাবিরাও কতোক্ষণ আগে চলে গিয়েছে।আমি সব সামলিয়ে উঠতে পারি নি বলে তাদের সাথে যেতে পারি নি।’

আমি সেজোমা’র হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে বললাম,

‘চাল কুটে কি করবে আবার?’

‘শীতের পিঠা হবে।তাই তো এতো তোরজোর।’

‘ওইদিন না ভাপা পিঠা খেলাম।আর কতো করবে?’

‘তোরা আছিস তো আর কয়েকদিন।তারপর গেলে তো আর এতো সহজে আসতে পারবি না।তাই মনের শখ টুকু মিটিয়ে দিচ্ছি।ঠিকাছে!তুই এখন তাড়াতাড়ি খাবার টা রক্তিমকে দিয়ে আয়।আমি এখন যাই।’

কথাটা বলেই সেজোমা চলে গেলো।এইজন্য,সেজোমা’কে আমার এতো ভালো লাগে।নরম মনের একজন মানুষ।আমাদের সব কাজিনদের প্রতি সেজোমা’র সমান সমান টান।কারোর জন্য বেশিও না বা কমও না।
—-
দরজায় কড়া আঘাত নাড়তেই রক্তিম ভাইয়ের ভারী গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম।রক্তিম ভাই ভারী গলায় বলে উঠলেন,

‘কে?’

‘আমি রিমঝিম রক্তিম ভাই।’

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খোলে গেলো।রক্তিম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি উনি শুধু ট্রাউজার পড়ে আছেন।গা’য়ে কোনো টি-শার্টের অস্তিত্ব নেই।আমি লজ্জায় রক্তিম ভাইয়ের দিকে তাকাতেও পর্যন্ত পারছি না।

‘কি দরকারে এসেছিস এইখানে?’

আমি চমকে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।সুন্দর মুখশ্রীতে গম্ভীরের চাপ দেখতে পাচ্ছি।আমতা আমতা করে বললাম,

‘আপনার খাবার রক্তিম ভাই।সেজোমা পাঠিয়েছে।’

রক্তিম ভাই মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন।তারপর হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে নিলেন।আমি চলে আসতে নিবো তার আগেই রক্তিম ভাই আমার হাত ধরে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন।দরজা টা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসালেন।আমি রক্তিম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি।বরাবরের মতো আজকেও,আমার হার্টবিট টা দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে।রক্তিম ভাই আমার হাত টা ছেড়ে দিয়ে প্লেট টা টেবিলের উপর রেখে বিছানার মাঝখানে গিয়ে বসলেন।গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘সকালের মতো এখন আমাকে একটা ফ্লায়িং কিস দে তো রিমঝিম।আসলে,দেখতে চাইছিলাম তুই এক্সপার্ট কি না।’

আমি বুকে হাত গুঁজে খুব আয়েসি ভঙিমা করে দাঁড়িয়ে পড়লাম।এমতাবস্থায় বললাম,

‘ফ্লায়িং কিস দিতে গেলে আবার এক্সপার্ট হওয়া লাগে নাকি রক্তিম ভাই।এইটা তো একটা কমন ব্যাপার।’

‘আচ্ছা!!তো কয়জনকে ফ্লায়িং কিস দিয়ে এইটা তোর কাছে কমন ব্যপার হয়েছে রিমঝিম!’

‘কয়জনকে আর!এইতো ধরুন!রনি,ইমন,আমাদের কোচিং এর ম্যাথ স্যার আর আপনি।এই কয়েকজন বাদে আর কাউকে ফ্লায়িং কিস দেয় নি।’

আমার কথা শেষ হতে না হতেই রক্তিম ভাই আমার দিকে তেড়ে আসলেন।হাতের কব্জি ধরে বললেন,

‘এতো গুলো মানুষকে তুই ফ্লায়িং কিস দিয়েছিস রিমঝিম।শেষে কিনা তোর ম্যাথ স্যারকেও দিয়েছিস।তুই তো আমার বংশের মান-সম্মান ডুবিয়ে দিলি রে।ছি ছি রিমঝিম।’

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রক্তিম ভাইয়ের কথাগুলো কর্ণপাত করলাম।হঠাৎ মনে হলো,রক্তিম ভাইকে কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলেছি।ম্যাথ স্যারকে ফ্লায়িং কিস দিয়েছিলাম ডেয়ার কমপ্লিট করার জন্য।আর,রনি ইমন আমার খুব ভালো বন্ধু।তাদের দু’জনের কথা বড়োরা সবাই জানে।এমনকি রক্তিম ভাইও।

‘এইজন্য তো ভাবি!তোর ম্যাথে এতো খারাপ অবস্থা কেনো।ম্যাথ স্যারকে ফ্লায়িং কিস দিতে দিতেই তোর ক্লাসের শেষ ঘন্টা বেজে যায়।যার,ফলে তুই ম্যাথে আগামাথা কিছুই বুঝিস না।ছোট মা’কে বলা উচিত।তোর এইসব কথা ছোট মা’কে না জানিয়ে আমার শান্তি নেই।’

রক্তিম ভাইয়ের কথা শুনে আমি শুকনো কয়েকটা ঢোক গিললাম।আমতা আমতা করে বললাম,

‘রক্তিম ভাই!স্যারকে ফ্লায়িং কিস দেওয়া টা ডেয়ার ছিলো।এর বেশি আর কিছু না।’

‘কলেজ গিয়ে তুই ট্রুথ,ডেয়ারও খেলিস।ওকে,এখন আমি আর তুই ট্রুথ ডেয়ার খেলবো।যা বিছানার উপরে গিয়ে বস।’

আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম,

‘রক্তিম ভাই!অন্য একদিম ট্রুথ,ডেয়ার খেলবো।’

‘এই শীতে আমার শক্ত হাতের চড় খেতে না চাইলে ঝটপট গিয়ে বস।না হলে তোর খবর আছে রিমঝিম।’

আমি সুড়সুড় করে বিছানার মাঝখানে গিয়ে বসলাম।রক্তিম ভাই টেবলের সামনে এগিয়ে গেলেন।খাতার একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে কয়েক টুকরো করে তাতে কিছু একটা লিখে ভাঁজ করে নিয়ে এসে বললেন,

‘এইখানে প্রায় দশ টার মতো কাগজের টুকরো আছে।কাগজের টুকরো গুলো থেকে যেকোনো একটা কাগজ উঠিয়ে আমাকে বল কি লিখা আছে।’

আমি অসহায় চোখে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।রক্তিম ভাই আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন।চোখ দিয়ে ইশারা করতেই আমি একটা কাগজ তোলে নিলাম।কাগজ টা খোলে দেখি বড় বড় করে ডেয়ার লিখা আছে।যা দেখে আমার মুখ ছোট হয়ে গিয়েছে।রক্তিম ভাই আমার পাশে বসে বললেন,

‘কি লিখা আছে রে কাগজ টায়।’

আমি চুপ করে বসে আছি।মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।এইভাবে বসে থাকায় রক্তিম ভাই আমার গাল টেনে ধরে বললেন,

‘এইভাবে বসে না থেকে বল কি লিখা আছে।’

‘ডেয়ার লিখা রক্তিম ভাই।’

‘বাহ্!এই ডেয়ার শব্দ টা মনে হয় তোর জন্য জন্মেছে।তোর কপালে শুধু ডেয়ার এই আসে তাই না।তবে বেশ ভালোই হয়েছে!এখন আসল কথা হচ্ছে তুই প্রস্তুত তো আমার ডেয়ার পালন করার জন্য।’

আমি ভয়ার্ত চক্ষু নিক্ষেপ করে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।রক্তিম ভাইয়ের মুখে বিশ্বজয় করা হাসি দেখতে পাচ্ছি।আমি মাথা নিচু করে বললাম,

‘কি ডেয়ার পালন করতে হবে আমাকে।’

রক্তিম ভাই সাথে সাথে খাবার প্লেট টা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।আমার কোলে মাথা রেখে বললেন,

‘আমাকে এইভাবে খাইয়ে দিবি তুই।তোর সাথে কথা বলে বলে আমার আলসি চলে এসেছে।এখন সবটা খাবার তোর খাইয়ে দিতে হবে।’

আমি সাথে সাথে চিল্লিয়ে উঠলাম,

‘আমি পারবো না রক্তিম ভাই।আপনার খাবার আপনি নিজেই খেয়ে নিন।’

‘ডেয়ার মোতাবেক তোর এখন আমাকে খাইয়ে দেওয়ার কথা।সো!তোর এখন এটাই করতে হবে।না হলে,কিন্তু অনক কিছু করে ফেলবো আমি যা তুই ভাবতেও পারবি না।’

আমি আর একটা শব্দ করারও সাহস পায় নি।রক্তিম ভাইকে খাইয়ে দিতে লাগলাম।রক্তিম ভাই ছোট বাচ্চাদের মতো আমার কোলে বসে খাচ্ছেন আর ফোনে গেম খেলছেন।মাঝে মাঝে আঙুলে কামড়ও বসাচ্ছেন।এবার একটু জোরে কামড় দেওয়ায় আমি আহহ্ বলে অস্ফুটস্বরে চিল্লিয়ে উঠলাম।রক্তিম ভাই সাথে সাথে আমার দিকে তাকালেন।ফোন টা পাশে রেখে আমার হাত টা মুখের কাছে নিয়ে কয়েকটা চুমু খেয়ে বললেন,

‘ব্যথা,সুখ,আনন্দ,কষ্ট সবকিছুই আমি দিবো।তবে,তোমার একটু ধৈর্য ধরতে হবে রিমঝিম পাখি।’

রক্তিম ভাই শব্দ করে আমার নাকের ডগায় চুমু খেয়ে পুনরায় ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।আর,আমি কিছুক্ষণ আগে হয়ে যাওয়া ঘটনা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলাম।রক্তিম ভাইয়ের এরূপ কথা শুনলে আমি প্রচন্ড রকমের ভাবনার তলে ডুবে যাই।যা আমার মাথার উপর দিয়ে বিরাজ করে।
__________
বাজারের পাশে বিশাল বড় একটা মাঠ আছে।সেখানে মেলা বসেছে আজকে নিয়ে তিনদিন হলো।আমি আর রিমি একটা চুড়ির দোকানে গিয়ে ঢুকলাম।বাহারী রকমের কাচের চুড়িগুলোতে কখন থেকে আমার চোখ লেগে ছিলো।অনেক কষ্ট করে ভিড় ঠেলে আমি আর রিমি সেই চুড়ির দোকানটার দিকে এগিয়ে গেলাম।বেশ কয়েকটা চুড়ির ডজন পছন্দ হয়েছে।কিন্তু,পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা ছিলো না বিধায় আমি রিমিকে পাঠাই তনায়া আপুর কাছে কিছু টাকা নিয়ে আসার জন্য।রিমি চলে যেতেই আমি সেখানে বসে আরো কয়েকটা চুড়ির ডজন দেখতে লাগলাম।হঠাৎ করে,হৈ হুল্লোড়ের আওয়াজ পেয়ে পিছনে তাকিয়ে আমি ভয় পেয়ে যাই।কয়েকজন লোক মেলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে।এইদিক টায় তেড়ে আসতে নিলেই আমি সেখান থেকে দৌড়ে অনেকটা দূরে চলে যাই।মুহূর্তেই সব মানুষজনের ভিড় লেগে গেলো।মানুষের ঠেলাঠেলিতে আমি নিচে পড়ে গেলাম।এতে করে আমি হাতে অনেকটা ব্যথা পাই।তার উপর মানুষের পা’য়ের আঘাত তো আছেই।আমি অনেক চেষ্টা করেও যেনো উঠতে পারছি না।মাগরিবের আজানের ধ্বনি কানে আসতেই আমি চমকে উঠি।কোনোমতে সবাইকে ঠেলেঠুলে উঠে আশেপাশে তাকিয়ে রিমিকে খোঁজার চেষ্টা করলাম।রিমির কোনো দেখাই পাচ্ছি না।শুধু পুরুষের মাথা দেখতে পাচ্ছি।বুঝতে পারলাম মেলার চক্করে আমি হারিয়ে গিয়েছি।এই জায়গা টা আমি চিনি না।আজকেই এসেছিলাম সবার সাথে।কিন্তু,এখন কারোর দেখা পাচ্ছি না।সাথে ফোনও নেই।ধূলোবালিতে আমার কাশি উঠার উপক্রম।এমনকি ধূলোবালির কারণে আমি তাকাতেও পর্যন্ত পারছি না।সেই দুই দল এখন লাঠি নিয়ে মারামারি শুরু করে দিয়েছে।আমি বের হতে নিলেই একটা লাঠির আঘাত আমার কপালে এসে লাগলো।আমি ব্যথায় চোখ,মুখ কুঁচকে ফেলি।চোখ,দুটো কেমন নিভু নিভু হয়ে আসছে।আমি দেখতে পাচ্ছি আরেকটা লাঠি খুব দ্রুত গতিতে তেড়ে আসছে আমার দিকে।আমি হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলি।মনে হচ্ছে এই লেগে যাবে আমার মাথায়।কিন্তু,আমার হাত ধরে কেউ একজন জোরে টান দেওয়ায় আমি অনেকটা দূরে সরে আসি।পিছনে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই।রক্তিম ভাইকে দেখে আমি বেশ জোর গলায় কান্না করে দিলাম।রক্তিম ভাই এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে নিয়ে গেলেন পিছনের একটা বট গাছের আঁড়ালে।সেখানে তেমন কোলাহল নেই।আমি ভয়ে এখনো জমে আছি।মনে হয়েছিলো,আমি মনে হয় আর এইখান থেকে বের হতে পারবো না।হুট করেই রক্তিম ভাই আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।গাছের সাথে ঠেস দিয়ে আমাকে নিয়ে নিচে বসে পড়লেন।আমাকে নিজের বুকে ঠায় দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে আছেন।রক্তিম ভাইয়ের ছোঁয়া পেয়ে আমার কান্নার গতি দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।যার ফলে,শরীর টা বারবার কেঁপে উঠছে।রক্তিম ভাই দু’হাত দিয়ে আমার মুখটা আগলে ধরলেন।আমার সারা মুখে রক্তিম ভাই অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলেন।আমি নিঃশব্দে রক্তিম ভাইয়ের সাথে লেপ্টে আছি,আর অনুভব করছি রক্তিম ভাইয়ের চুমুর স্পর্শ গুলো।এইভাবে অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে।আশেপাশের কোলাহল বলতে গেলে এখন আর নেই।চারপাশও কেমন যেনো এক নিমিষেই শান্ত হয়ে গিয়েছে।দূরের ঝোঁপঝাড় থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ ভেসে আসছে।আমি সরে আসতে নিলেই রক্তিম ভাই আমার হাত ধরে আঁটকে দিলেন।হেঁচকা টান দিয়ে রক্তিম ভাইয়ের আরো নিকটে নিয়ে গেলেন।চাঁদের হালকা আলোতে রক্তিম ভাইয়ের চেহারা টা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।রক্তিম ভাই আমার চোখের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন।আমি সাথে সাথেই মাথা নিচু করে ফেললাম।রক্তিম ভাই আমার থুঁতনী টা ধরে মুখটা উপরে তোললেন।আমি চোখ বন্ধ করে রেখেছি।তাকানোর সাহস পাচ্ছি না।আমার শুষ্ক ঠোঁটে আরেকজোড়া ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই আমি পিলে চমকে উঠি।তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই চোখ বন্ধ করে আমার ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরে রেখেছেন।মুহূর্তেই আমার শরীর টা যেনো কারেন্টের শক খেলো।হাত পা কেমন অবশ হয়ে আসছে।শরীর টা মনে হচ্ছে নেতিয়ে পড়ে যাবে।এমন হওয়ায় আমি রক্তিম ভাইকে আঁকড়ে ধরি।রক্তিম ভাইও যেনো আমাকে নিজের সাথে একটু একটু করে মিশিয়ে নিচ্ছেন।

চলবে..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here