#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন
|৯|
বড়ঘরের ঠিক মধ্যিখানটায় আমি নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়িয়ে আছি।সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।মা আমার কপালে হাত দিয়ে কেঁদে দিলো।একমাত্র সন্তান হলে যা হয় আর কি।সেজোমা কপালের আঘাতের জায়গা টা পরিষ্কার করে একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছে।আমি আড়চোখে তাকিয়ে আছি রক্তিম ভাইয়ের দিকে।কিছুটা দূরত্ব রেখে বুকে হাত গুঁজে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছেন।রক্তিম ভাইয়ের চোখের দিকে চোখ পড়তেই আমি সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেললাম।রক্তিম ভাইয়ের চোখের চাহনি দেখলে আমার বুকের ভিতরের ধুকপুকানি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়।তার উপর,রক্তিম ভাইয়ের লিপ কিস করাটা বারবার আমার মনে পড়ে যাচ্ছে।বারবার চেষ্টা করছি ভুলে যেতে কিন্তু,তা কিছুতেই পারছি না।অনাঙ্ক্ষিত সেই ঘটনা টা আমার চোখের সামনে ভেসেই উঠছে।কেনো জানি!তখন রক্তিম ভাইয়ের আরো সান্নিধ্য পেতে ইচ্ছে করে।ইচ্ছে করে!রক্তিম ভাইয়ের বুকে মাথা গুঁজে রাখতে।কথাগুলো ভেবে আমি নিজের মনেই নিজে হেসে উঠলাম।আজকের সেই ঘটনাটার পর থেকে আমি যে রক্তিম ভাইয়ের প্রতি আরো দূর্বল হয়ে পড়বো তা কি রক্তিম ভাই বুঝবেন!নাকি না বুঝেই আবারও আমার সাথে এইরকম আরো একটা অনাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবেন।এখন তো আমার রক্তিম ভাইকে কিলার মনে হচ্ছে।নাম দেওয়া উচিত!দ্য কিলার রক্তিম ভাই।
মা আমাকে বসিয়ে দিলো একটা চেয়ারে।আমার পাশের চেয়ারটায় বসে শাসিয়ে বলতে লাগলো,
‘রিমির সাথে থাকলে আজকে তোর সাথে এইটা হতো না রিমঝিম।রিমিকে একা পাঠানোর কি দরকার ছিলো।ভাগ্যিস রক্তিম ছিলো সেখানে।না হলে,তো আজকে খুব বড় একটা বিপদ হয়ে যেতো।’
মা কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।আমি অসহায় চোখে তাকালাম মা’য়ের দিকে।মা’র বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরেছি।এমতাবস্থায় বললাম,
‘আর প্যাঁচপ্যাঁচ করে কান্না করো না মা।দেখো!তোমার মেয়ে ঠিক আছে।কিছুই হয় নি।শুধু মাথায় একটু ব্যথা পেয়েছে।দেখবে দু’দিনের মধ্যেই এই ক্ষত টা ভালো হয়ে যাবে।’
মা আমার কথার পিঠে কিছুই বলে নি।শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছে।মনে,হচ্ছে হাতের বাঁধন একটু আলগা হলেই আমি কোথায় ছুটে পালিয়ে যাবো।
—-
গোসল করে বেরিয়ে এসে দেখি রিমি গালে হাত দিয়ে বিছানার মাঝখানে গোল হয়ে বসে আছে।চুল গুলো গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে আয়নার সামনে এগিয়ে গেলাম।বডি লোশন টা হাতের তালুর মাঝখানে নিয়ে রিমিকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘তোর আবার কি হলো রিমি?এইভাবে গাল ফুলিয়ে বসে আছিস কেনো?’
রিমি আমার দিকে কাঁদোকাঁদো মুখ করে তাকালো।আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,
‘মুখটাকে এইরকম করে রেখেছিস কেনো?কিছু হয়েছে?’
‘রিমঝিম রে!আমি মনে হয় ছ্যাঁকা খেয়ে গেলাম।’
‘কি!তুই প্রেম করছিস কবে থেকে।আমি তো জানতাম তোর আর সিফাত ভাইয়ার শুধু চোখাচোখি হয়।তাহলে প্রেম শুরু করলি কবে?’
রিমির চোখে,মুখে বিতৃষ্ণা ফুটে উঠলো।কিছুটা তিক্ত গলায় বললো,
‘যেখানে প্রেমেই শুরু করতে পারি নি সেখানে তুই এইসব কি বলছিস রিমঝিম।আমি প্রেম করলে তুই জানবি না সেটা কখনোই হবে না।সবার আগে আমি তোকেই জানাবো।’
‘একটু আগেই তো বললি তুই ছ্যাঁকা খেয়েছিস।তো!প্রেম করলেই তো মানুষ ছ্যাঁকা খায় তাই না।আমি ভুলটা কি বললাম।আর যে কেউই তোর এই কথার মানে এটাই বুঝবে।’
‘এইসব বাদ দিয়ে আসল কথা শোন রিমঝিম!আমার তো ধারণা ভুল রে।সিফাত ভাইয়া একটা লুচ্চা।’
রিমির কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।সিফাত ভাইয়ার সাথে লুচ্চা ট্যাগ টা যায় না।নির্ঝর ভাইয়ার সাথে গেলেও যেতে পারে কিন্তু সিফাত ভাইয়ার সাথে ইম্পসিবল।তবে,রিমির কথাও ফেলে দেওয়ার মতো না।এখানে যে কিছু একটা ঘাপলা আছে তার কিছুটা আভাস পাচ্ছি।টেবিলের সামনে থেকে নীল কালারের প্লাস্টিকের চেয়ার টা টেনে নিয়ে রিমির সামনে বসে পড়লাম।ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে বললাম,
‘পাগল হয়েছিস তুই রিমি!সিফাত ভাইয়াকে তুই লুচ্চা বানিয়ে দিলি।ভাইয়া কে কিন্তু এইরকম মোটেও মনে হয় না।’
‘ওইরকম শান্ত,বোকা টাইপ ছেলেগুলোই কিন্তু বেশি ধড়িবাজ হয়ে থাকে রিমিঝিম।তা কিন্তু তুইও জানিস আর আমিও জানি।ভুলে গেলি নাকি কলেজের সাদ ভাইয়ার কথা।দেখতে কেমন বোকাসোকা লাগতো আর শেষে কিনা রুমাকে ছ্যাঁকা দিয়ে একদম ব্যাঁকা বানিয়ে দিলো।এই সিফাত ভাইয়াও হলো এই টাইপেরেই একজন।’
‘তা তো মনে আছে।তবে,সাদ ভাইয়া কিন্তু সেই থাপ্পড়ও খেয়েছিলো রুমার হাতে।রুমার দম আছে বলতে হবে।এবার তুই আসল কথা বল!কি এমন হয়েছে যার জন্য তুই সিফাত ভাইয়াকে লুচ্চার ট্যাগ বসিয়ে দিলি।’
রিমি নাক টেনে টেনে বললো,
‘শিলা আপুর কাছ থেকে শুনেছি সিফাত ভাইয়া নাকি রিসেন্টলি কারোর প্রেমে পড়েছে।আগেও নাকি আরো কয়েকটা প্রেম ছিলো সিফাত ভাইয়ার।’
আমি আড়চোখে তাকালাম রিমির দিকে।বেচারি কি আসলেই কষ্ট পাচ্ছে কি না তা বুঝার চেষ্টা করছি।যতটুকু বুঝতে পেরেছি রিমির মুখখানা একদম নিরপেক্ষ হয়ে আছে।না পজিটিভ আর না নেগেটিভ।রিমির থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে গলা টা পরিষ্কার করে বললাম,
‘এইটার ভিত্তিতে তুই সিফাত ভাইয়াকে লুচ্চার ট্যাগ দিয়ে দিলি রিমি।আমি তো তেমন খারাপ কিছুই দেখলাম না।একটা মানুষ তো একাধিক প্রেম করতেই পারে।প্রথম প্রেমেই যে শেষ প্রেম হবে এইটা কোনো কথা না।আবার,একাধিক প্রেম করলেই যে সে খারাপ ছেলে তাও কোনো কথা না।আর,রইলো রিসেন্টলি প্রেমে পড়েছে!এইটা তো তোকে ঘিরেও হতে পারে রিমি।এই যেমন!সিফাত ভাইয়া তোর প্রেমে পড়লো।তুই উনার রিসেন্টলি প্রেম।’
রিমি কপাল চাপড়িয়ে আমার দিকে অসহায় মুখ করে তাকালো।এমতাবস্থায় বললো,
‘তা হলেও আমি শান্তি পেতাম।তবে,সিফাত ভাইয়া নাকি ফোনে একটা মেয়ের ছবি দেখে মুচকি মুচকি হাসেন।শিলা আপু দূর থেকে আবছা দেখেছিলো ফোনে সেই মেয়েটির ছবি।মুখ বুঝা না গেলেও এইটা বুঝতে পেরেছিলো এইটা একটা মেয়ের ছবি।যদি,আমিই হতাম তাহলে সিফাত ভাইয়া তো আমার দিকেই তাকিয়ে মুচকি হাসতেন।ফোনের তো প্রয়োজন হতো না।’
আমি এবার কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলাম।ব্যাপার টা কিন্তু আসলেই ভাববার বিষয়।মিনিট দশেক ভেবেও মাথায় কিছু আসলো না।রিমির দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘তোর কথায় লজিক আছে রিমি।তবে,তোর ভাবনা ভুলও হতে পারে আবার ঠিকও হতে পারে।এখন কি করতে চাইছিস তুই।’
‘কি কপাল আমার দেখ!প্রেম করার আগেই ছ্যাঁকা খেয়ে স্তব্ধ হয়ে রইলাম।আচ্ছা!রিমঝিম একটা কাজ করলে কেমন হয়?’
‘কি কাজ!তোর মাথায় কি চলছে?’
‘একটা মিশনে নামি চল।সিফাত ভাইয়া যখনি ফোন নিয়ে মুচকি মুচকি হাসবেন তখনি আমি আর তুই মিলে দেখার চেষ্টা করবো সিফাত ভাইয়া কি দেখে হাসছেন বা কোন মেয়ের ছবি দেখে হাসছেন।’
আমি আমতাআমতা করে বললাম,
‘ব্যাপার টা ভালো দেখাবে না রিমি।যদি কেউ বুঝে যায়?’
‘আমার না জেনে শান্তি নেই রিমঝিম।আমার প্রেমিক অন্যকারোর সাথে এইটা আমি জিন্দেগীতেই মানতে পারবো না।’
রিমি সটান করে কম্বল নিয়ে শুয়ে পড়লো।চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছে।আমি পিটপিট করে রিমির দিকে তাকালাম।প্রেম না করেই প্রেমিক হয়ে গেলো সিফাত ভাইয়া!শুধু তাই নয়,ছ্যাঁকাও খেয়ে গেলো।উফফ!রিমি আমার মাথা তালগোল পাঁকিয়ে দিবে।আমি নিশ্চিত এই মেয়ে পাগল হয়েছে।
—-
সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি হামিদ দাদার বাড়ি যেতে হবে দাওয়াতের জন্য।সকালেই যেতে বলেছে হামিদ দাদা।হামিদ দাদা খুব রসিকতার একজন মানুষ।বয়স হলেও আমাদের সবাইকে একসাথে উনার পাশে বসিয়ে গল্প করতে ভুলবে না।সকাল সকাল এই খবর টা শুনে আমি খুশি হয়ে গেলাম।যাক অবশেষে সেই পদ্ম বিলে যাওয়া হবে।হামিদ দাদার বাড়ির ডান পাশেই কিছুটা দূরত্ব রেখে একটা পদ্ম বিল পড়ে।আমার পছন্দের একটি জায়গা।গতবার এসে যখন হামিদ দাদার বাড়িতে গিয়েছিলাম তখনি সেই পদ্ম বিলটা আমার চোখে পড়েছিলো।যা দেখে আমি একমুহূর্তের জন্য থমকে যাই।অপরূপ সৌন্দর্যের মহিমা নিয়ে পদ্ম ফুল গুলো ফুটে ছিলো বিলের আনাচে কানাচে।দেখে মনে হচ্ছিলো পদ্মফুল গুলো আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে।আমি যখন মুগ্ধ হয়ে পদ্ম গুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখনি একঝলক বাতাস এসে আমাকে আরো পাগল করে দিলো।প্রকৃতির মোহে যেনো আমি একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছিলাম।
শুভ্র সাদা আর গোলাপি মিশ্রণের একটা জামা পড়ে আয়নার সামনে এগিয়ে গেলাম।পুরোটা জামা জুড়ে রেশমি সুতা দিয়ে এমব্রয়ডারি করে পদ্ম ফুলের মেলা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।গতবছরেই শখ করে জামাটা কিনেছিলাম।সাজগোছ ব্যাপার টা তেমন পছন্দ না হলেও আজকে খুব ইচ্ছা করছে নিজেকে সাজাতে।গাঢ় করে লেপ্টে চোখের নিচে কাজল দিয়েছি।মাশকারা দিয়ে চোখের পাপড়ি গুলোকে জীবন্ত করে,ঠোঁটে নুড লিপস্টিক দিয়ে চুল গুলো ছেড়ে দিয়েছে।গলায় ওড়না টা পেঁচিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।বের হতেই দেখা হলো সুস্মিতা আপু আর রঞ্জন ভাইয়ার সাথে।দু’জনে একসাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো।আমাকে দেখেই সুস্মিতা আপু মিষ্টি হেসে বললেন,
‘সো বিউটিফুল রিমঝিম!তোমাকে তো আজকে ফুটন্ত এক পদ্ম ফুল লাগছে।আমি ক্রাশ খেয়েছি তোমার উপর।ছেলে হলে ঠিকই প্রপোজ করে বসতাম।’
আমি মুচকি হেসে তাকালাম সুস্মিতা আপুর দিকে।কিছু বলতে যাবো তার আগেই সুস্মিতা আপু পুনরায় বলে উঠলেন,
‘তোমার হাসি দেখেও আমি পাগল হয়ে যাবো রিমঝিম।এতো মিষ্টি করে হাসো তুমি।’
কথাটা বলেই রঞ্জন ভাইয়ার চোখ দুটো চেপে ধরে আবার বললেন,
‘এই রঞ্জন!তুমি তাকাবে না রিমঝিমের দিকে।নজর লেগে যাবে মেয়েটার।’
আমি এবার শব্দ করে হেসে ফেললাম।সুস্মিতা আপুর কান্ডকারখানা গুলো আমার কাছে বাচ্চা মনে হচ্ছে।রঞ্জন ভাইয়া চোখ থেকে সুস্মিতার আপুর হাত টা সরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘তুমি কি হাবিজাবি বলো তো সুস্মিতা।রিমঝিম আমার বোন হয়।ভাইয়ের চোখে বোনদের কখনো নজর লাগে না।’
রঞ্জন ভাইয়া কথাটা শেষ করেই সুস্মিতা আপুর চোখের এককোণা থেকে নিজের আঙুলে একটু কাজল ছুঁইয়ে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন।কানের পিছনে দিয়ে বললেন,
‘এই কাজলের ছোঁয়া টা দেওয়া খুবই দরকার ছিলো রিমঝিম।আমার বউ এই তো আমার বোনকে নজর দিয়ে দিচ্ছিলো।আমি ভাই হয়ে এইটা কীভাবে মেনে নেই বলো তো।যাক,এখন কেউ তোমাকে আর নজর দিতে পারবে না।’
আমি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকালাম রঞ্জন ভাইয়ার দিকে।রঞ্জন ভাইয়ার প্রতিটি কথায় আমি মুগ্ধ হতে বাধ্য হয়েছি।শুধু তাই নয়,রঞ্জন ভাইয়ার প্রতি আমার মনে আলাদা একটা সম্মান চলে আসলো।আজকের দিনটা মনে হয় আমার জন্য খুব ভালো একটা দিন।অতিরিক্ত খুশির প্রকোপে আমার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না।আমি চুপ করে সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছি।সুস্মিতা আপু রঞ্জন ভাইয়ের কাছে এসে বললেন,
‘বোন পেয়ে আবার বউকে ভুলে যেও না রঞ্জন।’
রঞ্জন ভাইয়া গরম চোখে তাকালেন সুস্মিতা আপুর দিকে।সুস্মিতা আপু ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বললেন,
‘আরে!আমি তো মজা করছিলাম শুধু।তুমিও সিরিয়াসলি নিয়ে নিলে।’
এরিমধ্যে শিলা আপু এসে তাড়া দিয়ে বললেন,
‘তাড়াতাড়ি বের হ তোরা।অটো রিকশা নাকি রাস্তার মোড়ের দিকে চলে এসেছে।’
শিলা আপু কথাটা বলেই চলে গেলেন।সেই সাথে সুস্মিতা আপু আর রঞ্জন ভাইও।আমিও সামনের দিকে পা বাড়াবো তার আগেই কোথা থেকে রক্তিম ভাই এসে আমার সামলে দাঁড়ালেন।চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।এমতাবস্থায় বললেন,
‘এতো সেজেছিস কেনো তুই রিমঝিম।তোকে একদম পেত্নী লাগছে।’
আমি হা করে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।একটু আগেই তো সুস্মিতা আপু আর রঞ্জন ভাইয়া প্রশংসা করে গেলেন।আর রক্তিম ভাই এইসব বলছেন।আমার মনটা মুহুর্তেই খারাপ হয়ে গেলো।
‘কাজল টা মুছে ফেল রিমঝিম।তোর চোখ দেখে আমার নিজেরেই খুব ভয় লাগছে।মনে হচ্ছে হার্টফেল করবো।
‘মানে কি রক্তিম ভাই!আমাকে এতোটাই বাজে লাগছে।তাহলে,সুস্মিতা আপু বললো যে আমাকে সুন্দর লাগছে।’
‘তোকে আগেই আমি সাবধান করেছিলাম রিমঝিম!ওদের কারোর কথা তুই বিশ্বাস করিস না।ওরা আমার বন্ধু তো আমি ওদের খুব ভালো করে চিনি।’
রক্তিম ভাইয়ের কথায় আমি আর কিছু বললাম না।রক্তিম ভাইকে এড়িয়ে যেতে নিলেই রক্তিম ভাই আমার পথ আঁটকে দাঁড়ালেন।আমার অতি নিকটে এসে বললেন,
‘কাজলের সাথে লিপস্টিক টাও মুছে ফেল।না হলে কিন্তু আমি নষ্ট করে দিবো তোর লিপস্টিক।’
রক্তিম ভাইয়ের মুখ থেকে তীব্র সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছি।সিগারেটের গন্ধ টা আমার নাকে আসতেই আমার ভ্রু কুটি কুঁচকে গেলো।রক্তিম ভাই সিগারেট খান তা আমার জানা ছিলো না।এতোদিনেও রক্তিম ভাইকে সিগারেট খেতে দেখি নি।তাই আজকে একটু অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে।নাক সিটকে রক্তিম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আপনি স্মোক করেন রক্তিম ভাই।আপনার মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে।’
রক্তিম ভাই পকেট থেকে একটা সেন্টারফ্রেশ খেয়ে নিলেন।চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলেন,
‘মাঝেমধ্যে একটু খেয়ে থাকি।যখন মাথায় বাজে চিন্তা এসে ভীড় করে তখন এইটা খেয়ে নিজেকে শান্ত রাখি।তুই কি রে বুঝবি আমার জ্বালা।তুই তো জ্বালিয়ে যাচ্ছিস আমাকে প্রতিনিয়ত।’
‘মানে!কি বলছেন আপনি রক্তিম ভাই।আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘এতো বুঝে কাজ নেই তোর।আগে এইসব মুছে তারপর বাহিরে যাবি।’
‘আমি পারবো না রক্তিম ভাই।আপনি সরুন তো।বাজে দেখতে লাগলে আমাকেই তো লাগছে।এতে আমার তো কোনো সমস্যা নেই।আমার সমস্যা না থাকলেই হলো।’
রক্তিম ভাই আমার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিলেন।পেটের কাছে হাত রেখে শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,
‘আমি যা বলছি তাই কর রিমঝিম।না হলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।’
আমিও নাছোড়বান্দা হয়ে জবাবে বললাম,
‘পারবো না রক্তিম ভাই।আপনার যা মন চায় আপনি তাই করুন।’
রক্তিম ভাই সাথে সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,
‘কেনো বুঝতে চাইছিস না তোকে এইভাবে শুধু আমি দেখতে চাই।আর কেউ না।অন্য কেউ তোর দিকে তাকালে আমি যে জ্বলে পুঁড়ে শেষ হয়ে যাবো রিমঝিম।’
রক্তিম ভাই গভীর ভাবে আমার ঠোঁটে শব্দ করে চুমু খেলেন।পরপর দু’বার চুমু খেয়ে আমার ঠোঁটের লিপস্টিক টা মুছে দিয়ে বললেন,
‘এতো রঙচঙ মেখে বাহিরে যেতে হবে না।এগুলো আমার পছন্দ না।’
‘কি করলেন কি!রক্তিম ভাই।মুছে দিলেন কেনো?’
‘আমার মুখের উপর তর্ক করিস তুই।বলেছি না এইসব দিয়ে বাহিরে যেতে পারবি না।এখন আর কথা না বাড়িয়ে বাহিরে যা।অটোরিকশা মনে হয় এতোক্ষণে চলেও এসেছে।’
রক্তিম ভাই আমার সামনে থেকে সরতেই আমি গরমচোখে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।কনুই দিয়ে রক্তিম ভাইয়ের পেটের দিকে বেশ জোরে একটা গুতা মেরে দিলাম এক দৌড়।রক্তিম ভাই সাথে সাথেই আহহ্ বলে চিল্লিয়ে উঠলেন।ঘর থেকে বাহিরে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি রক্তিম ভাইয়ের কথা শুনতে পেয়েছি।রক্তিম ভাই চিল্লিয়ে বলতে লাগলেন,তোকে আমি দেখে নিবো রিমঝিম।পরেরবার একা পেলে তোর খবর আছে।রক্তিম ভাইয়ের কথাটা শোনার পরও আমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না।বলতে গেলে রক্তিম ভাইয়ের কথাটাকে আমি একদমই পাত্তা দেয় নি।
—-
পাঁচ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে শুনছি অটোরিকশা এখনোই চলে আসবে।কিন্তু,পাঁচ মিনিট পার হয়ে পনেরো মিনিট হতে চললো এখনো অটোরিকশার কোনো দেখা পাচ্ছি না।সুস্মিতা আপু তো রাগান্বিত হয়ে তাকালো শিলা আপুর দিকে।শিলা আপু জোরপূর্বক হেসে সুস্মিতা আপুকে বললেন,
‘এইতো একটু পরেই চলে আসবে।চিন্তা নেই।আর একটু কষ্ট করে দাঁড়া।’
সুস্মিতা আপু কিছু বললেন না তবে,কপট রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছেন শিলা আপুর দিকে।শিলা আপু শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।
গাছের ছাঁয়ায় আমি আর রিমি দাঁড়িয়ে আছি।এতোক্ষণ রোদের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।তবে,অতিরিক্ত গরম লাগায় আমি আর রিমি এইদিকটায় চলে আসি।আমার আর রিমির মধ্যে টুকটাক কথা হচ্ছে।এরিমধ্যে সিফাত ভাইয়া কোথা থেকে এসে রিমির কানের কাছে চেঁচিয়ে বললেন,
‘আমি কিন্তু লুচ্চা না রিমি।আমি একদম পিউর একজন মানুষ।যার মনে কোনো লুচ্চামি নেই।আছে শুধু অফুরন্ত ভালোবাসা।তাই,আমাকে ভুল বোঝাটা কিন্তু বোকামি হবে।’
আমি আর রিমি কিছুটা চমকে উঠলাম।সিফাত ভাইয়াকে দেখে দু’জনেই টাসকি খেয়ে গেলাম।সিফাত ভাইয়া মুচকি হেসে তাকিয়ে আছেন রিমির দিকে।কিছুক্ষণ এইভাবে থেকে আচমকাই রিমিকে এক চোখ টিপ মেরে জায়গা প্রস্থান করলেন।সিফাত ভাইয়ার এরূপ কান্ডে রিমি তাড়াতাড়ি আমার হাত ধরে বললো,
‘তোকে বলেছিলাম না রিমঝিম!সিফাত ভাইয়া লুচ্চা টাইপের।প্রমাণ পেলি তো।একদম কানের কাছে এসে কি কথাটাই না বলে গেলেন।কান টা আমার এখনো শিরশির করছে।আর,শেষে কিনা চোখ টিপও দিলেন।কি ভদ্র টাই না ভেবেছিলাম আর এখন তার রূপ দেখতে পাচ্ছি।’
‘রিমিরে একদম ঠিক বলেছিলিস।তবে,সিফাত ভাইয়া কি বলে গেলেন তা নিশ্চয় শুনতে পেয়েছিস।সিফাত ভাইয়ার কথায় বোঝা গিয়েছে আমাদের কালকের সব কথাই সিফাত ভাইয়ার অজানা নয়।কেলো করেছে রিমি।এখন কি হবে বুঝতে পারছি না।সিফাত ভাইয়া তো একদম ঘুরে গেলেন।’
রিমি দাঁত খেঁচিয়ে বললো,
‘আমিও দেখে নিবো কি করে আমার।তার আগে জেনে নেই ফোনে কোন মেয়ের ছবি দেখে মুচকি মুচকি হাসেন।এইটা না জানা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।’
রিমির মুখ চোখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছি সিফাত ভাইয়ার নিস্তার নেই।আর,রিমিও না জেনে থামবে না।অটোরিকশা চলে আসায় আর ঘাটায় নি ব্যাপার টা।আবির ভাইয়ের চিল্লানোর ঠেলায় আমি আর রিমি অটোরিকশার দিকে এগিয়ে গেলাম।
————-
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে আমি যেনো মত্ত হয়ে পড়েছি।হামিদ দাদার বাড়িতে একটু আগেই এসে পৌঁছেছি।সবার সাথে কুশল বিনিময় করে আমি দৌড়ে চলে আসলাম সেই পদ্ম বিলটার দিকে।বিলটা জুড়ে পদ্ম ফুলের খেল রয়েছে।গোলাপি টকটকে পদ্ম ফুল গুলো আমার দিকে তাকিয়ে যেনো মিটিমিটি হাসছে।আমি আর দেরি না করে সটান করে দূর্বাঘাসের উপর বসে পড়লাম।সেদিনের মতো আজকেও মৃদু বাতাস বইছে।তবে,আজকের বাতাস টায় আমার খুব শীত লাগছে।বাতাস টা পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসছে।তার উপর শীতের মৌসুম।তবে,আজকের আকাশ টা অনেক সুন্দর।সূর্যের লাল আভা যেনো চারপাশে ছড়িয়ে গিয়েছে।আমি একধ্যানে তাকিয়ে আছি সেদিকটায়।
পাতার মচমচ আওয়াজে পাশে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই এসে বসেছেন।রক্তিম ভাইয়ের ঠোঁটেও মুগ্ধকর হাসি।মনে হচ্ছে,রক্তিম ভাইও এই অপরূপ প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে গিয়েছেন।রক্তিম ভাইকে দেখে আমি আচমকাই বলে উঠলাম,
‘কি সুন্দর তাই না রক্তিম ভাই!ইশশ!এই পদ্ম বিলের মাঝখানে যদি আমার একটা বাড়ি হতো তাহলে আমি সারাটা জীবন হাসি মুখেই কাটিয়ে দিতাম।কোনো আফসোস থাকতো না।’
রক্তিম ভাই আমার কথা শুনে কিছু বললেন না।আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে পড়লেন।বিলের কাছে গিয়ে একটা পদ্ম ফুল ছিঁড়ে এনে মালা গেঁথে আমার গলায় পড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘সব ইচ্ছাই আমি পূরণ করে দিবো তোমার প্রেয়সী।কোনো ইচ্ছাই বাকি রাখবো না।
আমি নিষ্পলক চেয়ে রইলাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।গোধূলির লাল আভা রক্তিম ভাইয়ের চোখে,মুখে জায়গা করে নিয়েছে।যার ফলে,রক্তিম ভাইকে অন্যরকম লাগছে।আমি মুখ ফঁসকে বলেই ফেললাম,
‘রক্তিম ভাই আপনি এতো সুন্দর কেনো!’
আমার কথা শেষ হতে না হতেই রক্তিম ভাই চিল্লিয়ে উঠলেন।মাথায় জোরে একটা টোকা দিয়ে বললেন,
‘তোর চোখ তো খুব খারাপ রিমঝিম।চাচাতো ভাইয়ের দিকে নজর দিচ্ছিস।’
আমি থতমত খেয়ে গেলাম।সেই সাথে কিছুটা লজ্জাও পেলাম।তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে রক্তিম ভাইয়ের দিকে না তাকিয়ে দিলাম এক দৌড়।এখানে আর এক সেকেন্ডও বসে থাকলে রক্তিম ভাই একদম আমাকে পঁচিয়ে নাজেহাল অবস্থা করে দিবেন!!রক্তিম ভাইয়ের মুখ চললে তো আর থামতে চায় না!!
চলবে..