১.
বিয়ের বছর না ঘুরতেই বাচ্চা সমেত নতুন বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো ইহান। নিজের স্বামীর এমন কাজে ইচ্ছের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল কেবল। ইচ্ছের শাশুড়ি শারমিন বেগম ছেলের এহেন কাজে তব্দা খেয়ে গেলেন। স্তব্ধ চিত্তে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। ইহান এমন একটা কাজ করবে তা কারো কল্পনায় ছিলো না। কিন্তু থেমে থাকলেন না নাজমুল সাহেব। গর্জে উঠে বললেন,
“এ বিয়ে আমরা মানি না। এখনি এই মেয়েকে বাড়ির বাহিরে রেখে এসো। বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয় যে মোন চাইলেই বিয়ে করে নিয়ে আসবে। বের করো এই মেয়েকে বাড়ি থেকে।”
“তবে তো আমাকেও চলে যেতে হয়!”
চমকে তাকালেন নাজমুল সাহেব। কেঁপে উঠল শারমিন বেগম ও। কেবল একজনের এতে কোন হেলদোল দেখা গেলো না সেটা হলো ইচ্ছে। শারমিন বেগম মুখে আঁচল চেপে কেঁদে উঠলেন। ইহান ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে আছে। পাশেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। কোলে তার এক মাসের বাচ্চা।
ইচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দিতে সামনে এগিয়ে এলো। হাসি হাসি মুখে শশুরকে উদ্দেশ্য করে বলল,”বাবা এসব কথা নাহয় পরে হবে। এখন তাদের ভেতরে যেতে দিন। আপনি আর মা ও রুমে যান। রেস্ট নিন।”
নাজমুল সাহেবের থেকে চোখ সরিয়ে ইচ্ছে ইহানের দিকে তাকালো। ইহান তার দিকেই মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে। যেন সে কিছু বলতে চায় ইচ্ছেকে। কিন্তু ইহানের চোখের এ দৃষ্টি উপেক্ষা করে কিছুটা উপহাস করেই ইচ্ছে ইহানকে বলল,”আমি কি তবে গেস্ট রুমে শিফ্ট হবো?”
ইচ্ছের চাহনি, কথা বলার ভঙ্গি ভেতর থেকে নাড়িয়ে তুললো ইহানকে। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হানা দিল। কয়েকশো অদৃশ্য ছুড়ি আঘাত হানলো তার বুকে। ইচ্ছের এই নির্লিপ্ততা তাকে পুড়িয়ে মারছে। এর থেকে ইচ্ছে যদি তাকে দু চারটা চড় থাপ্পড় দিতে সেটাও সে হাসিমুখে গ্রহণ করতো। ইহান চাচ্ছে ইচ্ছে রাগুক। রেগে গিয়ে তাকে অনেক বকুক। তবুও একটু স্বাভাবিক হোক। এই ইচ্ছেকে যে তার স্বাভাবিক লাগছে না। এটা তো সেই ইচ্ছে না যাকে সে পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো সে যেটা করেছে তার জন্য এটাই প্রাপ্য। ইচ্ছের তীব্র থেকে তীব্র ঘৃণা পাওয়ারই যোগ্য সে।
“তার কোন দরকার নেই।”
ইহানের বলা কথাটা কেন যেন ইচ্ছের খুব ভালো লাগলো। তার মানে ইহান চায় ইচ্ছেই তার সাথে থাকুক! কিন্তু এই ভালোলাগাটা খানিকের ছিল। ইহান আগের মতোই গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো,”আমি আমার রুম শিফট করে নিব।”
এ সামান্য কথাই যেন ইচ্ছেকে ভেঙে দিল। নিজেকে শক্ত রাখতে চেয়েও পারছে না সে। ঠোঁট কামরে কান্না আটকে নিল সে। পরপরই ব্যস্ত পায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে সে দম আটকে মারা যাবে। ইচ্ছে চলে যেতেই নাজমুল সাহেব বুকে হাত চেপে সোফায় বসে পড়লেন। শারমিন বেগম দৌড়ে এসে তাকে ধরলেন। ইহান বাবাকে এ অবস্থায় দেখে অস্থির হয়ে উঠলো। ব্যাস্ত পায়ে বাবার দিকে এগিয়ে এলো কিন্তু নাজমুল সাহেব হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল ইহান। কিছু বলার মতো মুখও যে সে রাখেনি। নাজমুল সাহেব কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ইহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”তুমি আমার কেউ হতে পারো না।”
______________
“ওর নাম কি রাখবে ইহান?”
রুশার কথায় ইহান ঘোর থেকে বেড়িয়ে এলো। এতসময় সে ইচ্ছেকে নিয়ে ভাবছিল। ইহান দেখলো রুশার কোলে ছোট্ট হাত পা ছড়িয়ে খেলছে এক নবজাতক শিশু। কি আদুরে সে ছোট্ট মুখটা। দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ইহানের বিষন্ন মন ভালো হয়ে গেল। বাচ্চাটাকে নিজের কোলে নিয়ে বলল,” তুমি তো মা। নামটা নাহয় তুমিই দাও। এখানে মায়ের হক সবথেকে বেশি।”
রুশাও মুচকি হেসে ফোন নিয়ে ইন্টারনেটে নাম খুজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ইহান রুশার হাসি মুখটা দেখে নিজেও হাসলো। অনেকদিন বাদে মেয়েটা হাসলো। তার হঠাৎ আবার ইচ্ছের কথা মনে পড়লো। কি করছে মেয়েটা এখন? ইহান খেয়াল করলো বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি ইচ্ছের খুব পছন্দ। বৃষ্টি হলে বারান্দায় বসে বৃষ্টি বিলাস করা ইচ্ছের একটি প্রিয় অভ্যেস। ইহান বাচ্চাটাকে রুশার কোলে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিচের এই বারান্দা থেকে তাদের রুমের বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। তার ধারণা ঠিক হলো। বারান্দায় চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে ইচ্ছে। বৃষ্টি কণা ছুঁয়ে দিচ্ছে তার চোখ,মুখ, ঠোঁট। কতটা আবেদনময়ী লাগছে তার মায়াবতীটাকে। ইহানের ঠোঁট কোণে মিষ্টি হাসি উঁকি দিলো যেন। মোন বারবার যেন বলে উঠলো “এই বৃষ্টিবিলাস রমণী কেবল আমার।”
সে তার মায়াবতী তাকে দেখেই এতটা তৃপ্ত ছুঁয়ে দিতে পারলে তার বিনাশ নিশ্চিত।
বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে হৃদয় ভাঙ্গা এক নারীর কান্নার জল। আকাশ কি তবে এই নারীর দুঃখে সামিল হতেই বৃষ্টি ঝড়াচ্ছে? ইচ্ছে চোখ মেলে তাকালো। রাতের আকাশটায় মেঘের আচ্ছাদনে হারিয়ে গেছে চাঁদ তারাদের অস্তিত্ব। আছে কেবল নিকষ কালো আঁধার। তার মোন আকাশটাও ঠিক এভাবেই আঁধারে ছেয়ে আছে। ইচ্ছের মনে পড়লো সেদিনের কথা যেদিন সে ইহানের পরকিয়ার কথা জানতে পেরেছিল। ইচ্ছে ভেবে পাচ্ছে না যে মানুষটা তাকে একদিন না দেখে থাকতে পারেনা সে কিভাবে অন্য নারীতে আসক্ত হতে পারে। হ্যা বেশ কিছুদিন যাবত ইহান খুব অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। ইচ্ছে জিজ্ঞেস করলে বরাবর কথা ঘুরিয়ে নিয়েছে। ইচ্ছে ভেবেছিল অফিসের কোন ব্যাপারে হয়তো চিন্তিত। তাই ইচ্ছেও তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে ভেবে সময় দিয়েছিল। কিন্তু ইহান অন্য নারীতে…. চোখ খিচে বন্ধ করে নিল ইচ্ছে। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো এ সবটা যেন তার স্বপ্ন হয়। এক দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবে সে। কিন্তু না তেমনটা হলোনা। বারান্দা থেকে এখনো ফিসফিস শব্দ ভেসে আসছে। চোখ ভরে উঠলো ইচ্ছের। চুপ করে শুয়ে পড়লো সে। কিছুক্ষণ বাদে ইহান ও এসে তার পাশে শুয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে নেয় তাকে। কিন্তু অন্ দিনগুলোর মতো ইচ্ছে এই ছোঁয়ায় ভালোবাসা খুঁজে পেল না। মনে হতে লাগলো কেবল পাশের মানুষটি তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। সে ঠকে গেছে। একজন ভুল জীবনসঙ্গী বেছে সে ঠকে গেছে।
ইচ্ছে চোখ মেলে তাকালো। পুরোনো স্মৃতির পাতায় বেশিক্ষণ আটকে থাকতে পাড়লো না। এতে যে কষ্ট কেবলই বাড়বে মাত্র।
রাত গভীর হলে ইহান গেস্ট রুমের পাশের রুমটিতে যেয়ে শুয়ে পড়ে। বিয়ের পর এই প্রথম সে ইচ্ছেকে ছাড়া একা রাত্রিযাপন করছে। নিজের পাশের জায়গাটা ফাঁকা দেখে বুক ভারী হয়ে আসলো তার। কেবল একটা প্রশ্নই তাকে কুড়ে খাচ্ছে “সব ঠিক হয়ে যাবে তো?”
রাতটা নির্ঘুম কেটে গেল সবার। এমন একটা কঠিন মুহূর্তে ঘুম না আসাটাই স্বভাবিক।
সকালের মিষ্টি রোদ চোখে পড়া মাত্র ঘুম কেটে গেল ইচ্ছের। নিজের পাশ হাতরে ইহানকে না পেয়ে উঠে বসলো চট করে। মনে পড়লো ইহান এখন আর তার নেই। তাই তার পাশে ইহানের না থাকাটাই কি যুক্তিযুক্ত নয়? নিজের ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ইচ্ছে। এমন ভাগ্য আর কারো না হোক!
____________
গম্ভীর হয়ে সোফায় বসে পত্রিকায় নজর বুলাচ্ছেন নাজমুল সাহেব। তার পাশেই মলিন মুখে বসে আছেন শারমিন বেগম। গতকাল থেকেই চুপ হয়ে আছেন তিনি। নাজমুল সাহেব গেস্ট রুমের দিকে একবার তাকিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে স্তীকে আদেশের কন্ঠ বললেন তার জন্য চা করে আনতে। সময় নষ্ট না করে শারমিন বেগম ছুটলেন স্বামীর জন্য চা করতে।
চলবে….
#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি