আমার আকাশে তারা নেই ২ পর্ব -০২

#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি

২.
নাস্তার টেবিলে সবাই নিরবতা বজায় রেখে চুপচাপ খাচ্ছে। ইহানের পাশে যেখানে এতদিন ইচ্ছে বসতো আজ সেখানে রুশা বসেছে। ইচ্ছে আর বসলো না। নিজের খাবারটা নিয়ে উপরে রুমে চলে গেল। আর যাই হোক চোখের সামনে নিজের স্বামীকে অন্যকারো পাশে দেখার মতো মনোবল তার নেই। ইচ্ছে চলে যেতে ইহান ও খাবার রেখে উঠে গেল। তার গলা থেকেও যে খাবার নামবে না। রুশা নির্বাক হয়ে সব দেখে গেল কেবল। এই খাবার তার কাছে বিষের মতো ঠেকছে। কিন্তু তাকে তো খেতে হবে। তার বাচ্চাটার কথা মাথায় রেখে তাকে চলতে হবে। এতকিছুতো কেবল এই বাচ্চাটার জন্যই।
_______

“ইহানের আম্মা?”

নাজমুল সাহেবের ডাকে হন্তপায়ে ছুটে এলেন শারমিন বেগম। আজকাল সে মানুষটাকে বড্ড ভয় পায়। হুটহাট করেই রেগে যায় যেন।

“ইচ্ছেকে ডাকো। সাথে তোমার গুণধর ছেলেকেও।”

অন্যদিন হলে শারমিন বেগম তেতে উঠতেন। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলতেন,”হ্যা তো ছেলে দোষ করলেই তখন আমার হয়ে যায় আর ভালো কিছু কররে তখন বুক ফুলিয়ে হাঁটে কে শুনি?”
কিন্তু আজ এমন কিছুই হলোনা। শারমিন বেগম বিনা বাক্যে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
_______

“ইচ্ছের ব্যাপারে কি ভাবলে?”

“কি ভাববো?”

ছেলের উল্টো প্রশ্নে চটে গেলেন নাজমুল সাহেব। পাড়লে তিনি থাপরে ইহানের দু চারটা দাঁত ফেলে দিতেন। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেন। এই শেষ বয়সে এসে ছেলের সাথে কোনরূপ ঝামেলা সে করতে চায়না। কন্ঠে আগের থেকে দ্বিগুণ গম্ভীরতা রেখে বললেন,”তোমার জন্য খামোখা মেয়েটা তার জীবন কেন নষ্ট করবে?”

ইচ্ছে চমকে শ্বশুরের দিকে তাকালো। সে তো এই বিচ্ছেদ চায়না। ইহানের স্মৃতি নিয়েই সে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। তার কোন সমস্যা হবে না। যদি আরো একবার সম্ভব হয় তবে সে ইহানকে নিজের করে চাইবে। সে চাইবে ইহান যেন কেবল ইচ্ছের হয়ে যায়। সেখানে তারা ব্যাতীত অন্য কোন মানবসত্তা থাকবে না।
ইহান ইচ্ছের দিকে তাকালো। চোখে চোখ পড়তে ইচ্ছে চোখ নামিয়ে নিল। ইহান হাসলো। এ হাসিতে রয়েছে কেবল দীর্ঘশ্বাস আর হতাশা। শুকনো মুখে বাবাকে বলল,” ও যদি চায় তবে আমি বাঁধা দিবো না। মুক্তি দিয়ে দিব।”

কথাটা প্রবলভাবে ধাক্কা খেলো ইচ্ছের ছোট্ট হৃদয়ে। অবাক হয়ে ইহানের দিকে তাকালো। এটা সত্যিই ইহান তো? ইহান কিভাবে বলতে পারে তাকে মুক্তি দেয়ার কথা? তবে কি ইহানের দেওয়া প্রতিশ্রুতি গুলোও মিথ্যে ছিল? কেবলই ছলনা ছিল সেসকল কিছু?
ইচ্ছের চাহনি অগ্রাজ্য করে বেরিয়ে গেল ইহান। ইচ্ছের চোখে চোখ রাখার সাহস তার নেই। এক প্রকার পালিয়ে গেল ইচ্ছের সামনে থেকে। সেদিকে নির্মিশেষ চেয়ে রইল ইচ্ছে। কষ্টগুলো অশ্রু হয়ে চোখে জমতে শুরু করলো। বুকের ভেতর শূন্যতা গ্রাস করলো। এত কষ্ট কেন হচ্ছে তার? তার প্রেম, ভালোবাসা স্বামী নামক মানুষটাকে হারিয়ে ফেলেছে তবে?
____________

বাসের ছিটে মাথা হেলিয়ে বসে আছে ইচ্ছে। দৃষ্টি তার অদূরে। পাশ থেকে শাঁ শাঁ করে ছুটে চলছে বাস ট্রাক। শিতল বাতাসে উড়ছে রেলমি চুল গুলো। অগোছালো ভাবে কয়েকবার মুখের সামনে থেকে চুল সরিয়ে কানে গুজে নির সে। কিন্তু লাভ হলো না। আবারো দমকা বাতাস এলোমেলো করে দিল সবটা। ইচ্ছে হাল ছেযড়ে দিল। ছিটে পুরো শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। বদ্ধ চোখের কোণ গড়িয়ে ঝড়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা পানি। বিরবির করে বলল,”আমি তো মুক্তি চাইনি ইহান। আমিতো নিজেকে বাঁধতে চেয়েছি আপনার বাহুডোরে। আপনার বুকে নিজের বসতি গড়তে চেয়েছি। কিন্তু কি পেলাম? এটাইকি প্রাপ্য ছিল আমার?”

বাস যখন গন্তব্যে পৌঁছালো তখন প্রায় রাত আটটা। একটা সিএনজি ভাড়া করে বিশ মিনিটের মাথায় নিজ গৃহে পৌছালো ইচ্ছে। দোতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়াতেই বুক কেমন কেঁপে উঠলো।কতদিন বাদে বাড়িতে পা রাখলো সে!

আজকাল শরিরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে মোরশেদ মোরলের। বুকে ব্যাথাটা বেরেছে। ওপারে যাওয়ার সময় হয়তো ঘনিয়ে এসেছে। নাহার তার পাশে বসে কাঁথা সেলাই করছে। ছোট মেয়েটা বড় হয়েছে। বিয়ে সাদি তো দিতে হবে নাকি? মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে নকশি কাঁথা পাঠাতে হবে তার জন্য সে বাজার থেকে সাতটা নতুন শাড়ি কিনে এনেছে। পুরনো শাড়ি দিয়ে সেলাই করা কাঁথা তো আর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি পাঠানো যায় না। কলিং বেলের শব্দ শুনে হাতের কাজ রেখে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। ইচ্ছেকে দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। পরক্ষণেই আল্লাদি হয়ে বলল,”ইচ্ছে! তুই এলি যে! ভেতরে আয় ভেতরে আয়। তা জামাই বাবাজি কোথায়?”

“মা আমি ভেতরে আসি?”

নাহার অপ্রস্তুত হয়ে সরে দাঁড়ালো। ইচ্ছে ভেতরে ঢুকলেও নাহার দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ইহানকে খুঁজতে লাগল। তা দেখে ইচ্ছে আলতো হেসে বললো,”মা ইহান আসেননি। আমি একাই এসেছি।”

ইচ্ছের কথায় নাহার মুখ কালো করে ফেলল। ফের বলল,” সে কিরে তুই একা কেন এলি? জামাইকেও সাথে নিয়ে আসতি। কতদিন দেখিনি। ছেলেটা একটু ঘুরে যেত।”

“সে অন্য একদিন এসে ঘুরে যাবে বরং। আমি কিছুদিনের জন্য বেরাতে এসেছি। তোমাদের কথা মনে পড়ছিল খুব।”

ইচ্ছের উত্তরে নাহার সন্তুষ্ট হল না। আরো কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই ভেতর থেকে মোশতাক মোড়ল হাক ছাড়লেন।

“কে এসেছে নাহার? কোথায় হারিয়ে গেলে?”

নাহারের হাত থেকে বাঁচতে ইচ্ছে ভেতরে বাবার দিকে ছুটলো। দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো বাবাকে। দীর্ঘ দিন পর বাবা মেয়ের এক সুন্দর সাক্ষাতের সাক্ষী হলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নাহার। বাবা মেয়ের এ অপূর্ব সাক্ষাতের সুন্দর দৃশ্য মুগ্ধ করলো তাকে। আনমনেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।

________________

“এভাবে চলে আসাটা তোমার উচিত হয়নি।”

নাহারের শক্ত কন্ঠে বলা কথাটা ইচ্ছেকে ব্যাথিত করলো। সে করুণ চোখে তাকালো নাহারের দিকে। তার এমন করুণ চাহনি মোশতাক মোড়লের হৃদয় নাড়িয়ে দিল কিন্তু নরম হলোনা নাহার। তারমতে ইচ্ছের এভাবে চলে আসাটা মারাত্মক ভুল হয়েছে। বিয়ের পর মেয়েদের কেবল একটাই বাড়ি হয়। সেটা হলো স্বামীর বাড়ি। হাজার ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে হলেও স্বামীর ঘরে পড়ে থাকতে হবে। স্বামীর ভিটে ছাড়া যাবে না। বাপের বাড়িতো মেয়েদের আসল ঠিকানা নয়। বহুদিন পর ইচ্ছে আগের সেই কঠোর নাহারকে দেখতে পেলে যেন।

খুব ছোট থাকতেই ইচ্ছে তার মাকে হারায়। ছোট্ট ইচ্ছেকে একাহাতে মানুষ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল মোশতাক মোড়লকে। অনেক ভেবেচিন্তে দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ছোট্ট ইচ্ছেকে দেখাশোনা করখর জন্য মা হয়ে আসে নাহার। অযত্নে ইচ্ছেকে বড় না করলেও কড়া শাসনে রেখেছেন সবসময়। বিন্দুমাত্র ভুল সে গ্রহণ করেননি কখনো। তার জন্য ইচ্ছেকে পেতে হয়েছে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি। একবার স্কুল থেকে তার নামে কমপ্লেন আসায় পুরো রাত ছাদে বন্ধি করে রাখা হয়েছিল ছোট ইচ্ছেকে। ভয়ে চিৎকার করেছে, কেঁদেছে মেয়েটা হাজার অনুনয় করে মাফ চেয়েও লাভ হয়নি। ভয়ে হারিয়ে ফেলেছিল। একসপ্তাহেও জ্বর কমলো না। মোশতাক মোড়ল তখন কিছু কাজের জন্য ঢাকায় ছিলেন। এসবের কিছুই জানতে পারেননি তিনি। ফিরে এসে মেয়ের এমন অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। নাহার ও ছাদে আটকে রাখার কথা চেপে গেল। ইচ্ছের ও সাহস হলোনা বাবাকে সব বলার। মা যদি আবার ছাদে বন্ধ করে দেয়? সে ভয়ে সেও চেপে গিয়েছিল। ইচ্ছের যখন বয়স আট তখন তাদের ঘরে আরো এক অতিথির আগমন ঘটে। নতুন এক খেলার সাথি হয় তার। তার নাম রাখা হয় নদী। দুজন একসাথে বেড়ে উঠতে থাকে। যদিও নদীর বেলায় নাহার ছিল খুবই কোমল। ইচ্ছের খুব মোন চাইতো নদীর মতো মায়ের সাথে ভাব করতে কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। এভাবেই নাহারের কড়া শাসনের মাঝে বেড়ে উঠেছে সে। স্কুল শেষ করে কলেজে উঠতেই বিয়ের জন্য সম্বন্ধ আসতে লাগলো। মেয়ে ছোট এখনো এ কথা বলে সেসব সমন্ধ ফিরিয়ে দিতে লাগলো মোশতাক মোড়ল।
কলেজের কোন এক প্রগ্রামে শাড়ি পরিহিত ইচ্ছেকে দেখেছিল ইহান। রূপে মুগ্ধ হয়ে পরদিনই বাবা সমেত এসে হাজির হয়েছিল মোড়ল বাড়িতে। মোশতাক মোড়ল সরাসরি না করে দেন। কিন্তু ইহান মিষ্টি হেসে মোশতাক মোড়লের হাত নিজ হাতে তুলে নেয়। সাবলিল কন্ঠে বলে,

“আপনি আর কতদিন দায়িত্ব পালন করবেন আঙ্কেল? বয়স হয়েছে আপনার। এখন এতটা দায়িত্বের ভার বহন করা সত্যিই কষ্টকর আপনার জন্য আমি জানি। ভালো হয়-না যদি আপনার একটা মেয়ের দায়িত্ব এই ছেলেটার হাতে তুলে দেন? আমি প্রমিস করছি খুব করে আগলে রাখবো আপনার রাজকন্যাকে।”

চমৎকার লাগলো কথাটা। মোশতাক মোড়ল মুগ্ধ হলেন এত সুন্দর কথার অধিকারী ছেলেটার উপর। কিন্তু সে যে মেয়ের জন্য অন্য একটা হাত বাছাই করে রেখেছেন। তাকে কিভাবে ফেরাবেন তিনি? এলাকার মোড়ল তিনি। কাউকে কথা দিয়ে সে কথার খেলাপ করা তাঁর কাম্য নয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মানা করে দিলেন ইহানকে। তার খারাপ লেগেছিল কিন্তু সে যে ওয়াদাবদ্ধ!

নাজমুল সাহেব হতাশ হয়ে ছেলেকে সাথে নিয়ে ফিরে যেতে চাইলেন। কিন্তু ইহান এক পা ও নড়লো না। সে তার বউ সমেত এ বাড়ি থেকে বের হবে বলে জেদ করলো। বাড়ির সামনের উঠানে পাতানো চেয়ারে গো ধরে বসে রইল সে। ছেলেকে বোঝাতে ব্যার্থ হয়ে এক প্রকার রাগ করেই একা একা বাড়ির পথে চললেন নাজমুল সাহেব। এমন একরোখা বজ্জাত ছেলেটা যে সে জন্ম দিয়েছে এটা ভাবতেই রাগে শরীর কেঁপে উঠছে তার। কতটা নির্লজ্জ ছেলে হলে এভাবে একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্য তার বাড়ির উঠানে বসে থাকে! লজ্জায় মুখ থমথমে হয়ে গেল তার। দু ঠোঁটের মাঝথেকে ভেসে আসলো ক্ষীণ শব্দ,”অসভ্য ছেলে।”

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here