#নীল_জ্যোৎস্নার_রাত_ও_তুমি
লেখনীতে- সুমাইয়া জান্নাত
পর্ব-০৪
“তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা রইল।”
~আভাস।
‘আভাস’ নামটা দেখেই চমকে উঠলো হিয়া। এতো বছর পর জীবনের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ব্যক্তির নাম। যার কারণে একসময় হিয়া তার জীবনের সমস্ত রঙ হারিয়ে ফেলেছিল। নিজের অস্তিত্বই প্রায় ভুলতে বসেছিলো। অথচ সেই ব্যক্তির সবটাই ছিল ছলনা। সেই তো ছেড়ে গিয়েছিল হিয়াকে। হিয়া অনেক কষ্টে আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাহলে এতো বছর পরে সে আবার কেন হিয়ার খোঁজ নিচ্ছে? আর আভাস জানলোই বা কি করে যে, হিয়ার বিয়ে হয়েছে?
চিন্তায় মাথা ঝিমঝিম করছে হিয়ার। ‘আভাস’ নামক ব্যক্তিটা একসময় হিয়ার পুরো দুনিয়াটাই ওলোটপালোট করে দিয়েছিল। এখন আবার কি চায়?
আভাস ছিল হিয়ার ক্লাসমেট। ক্লাস সেভেনে সে হিয়াদের স্কুলে এসে ভর্তি হয়। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত হিয়া সবসময় ক্লাসে ফার্স্ট হতো। কিন্তু আভাস এসে তার সেই পজিশন কেড়ে নেয়। সেভেনের অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষায় আভাস প্রথম হয়। হিয়া ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের হলেও আভাস ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সে পড়াশোনাও যেমন করতো তেমনি হাসি-মজা দিয়ে পুরো ক্লাসকে মাতিয়েও রাখতো। তাই অল্পদিনেই তার সাথে হিয়া বাদে ক্লাসের আর সবার সাথে ভীষণ সাখ্যতা গড়ে উঠে। হাফ ইয়ার্লি এক্সামে আভাস যখন হিয়ার প্রথম অবস্থান নিয়ে নেয় তখন হিয়ার ভীষণ খারাপ লাগে। কিন্তু তবুও সে আভাসের সাথে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল কিন্তু আভাস তাকে পাত্তা দেয়নি। পরে বার্ষিক পরীক্ষায় হিয়াই প্রথম হয়। তার পর থেকে আভাস হিয়ার প্রথম অবস্থানটা আর নিতে পারেনি। তাই ক্লাসের বাকি সবার সাথে আভাসের খুব সখ্যতা থাকলেও সে হিয়াকে খুব হিংসে করতো। তবে সেটা ছিল অপ্রকাশ্য। ক্লাস টেনে ওঠার পর তাদের দুজনের মধ্যে বেশ সাখ্যতা গড়ে উঠে। আভাস আর হিয়ার বাসা কাছাকাছি ছিল। রাতের কোচিং শেষে তারা একসাথেই বাসায় ফিরতো। তারপর একসময় আভাস হিয়াকে বলে যে, সে হিয়াকে ভালোবাসে। হিয়া প্রথমে আভাসের কথা বিশ্বাস করে না। ও ভাবে আভাস হয়তো ওর সাথে মজা করছে। কিন্তু আভাস ছিল সিরিয়াস। হিয়া রাজি না হওয়া পর্যন্ত সে হিয়ার পেছনে পড়ে থাকে। তখন তাদের অনেক রাত পর্যন্ত ফোনে কথা হতো। হিয়া আভাসকে পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও সে একরকম আভাসের মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর তাদের টেস্টের রেজাল্ট দেওয়ার পরেই হিয়া আভাসের আসল উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারলো। যে হিয়া সবসময় ৯৮% নাম্বার পেত। সে এসএসসি পরীক্ষার দেড়মাস আগে টেস্টে পেল ৬৯% মার্কস। অথচ আভাস ঠিকই ৯৫% নাম্বার পেয়েছে। আর দেড়মাস পরে হিয়ার এসএসসি পরীক্ষা অথচ কোন সিলেবাস তখনো শেষ হয়নি। হিয়ার মাথায় যেন তখন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আর তখন তাকে স্বান্ত্বনা দেওয়ার জন্যেও কেউ তার পাশে এসে দাঁড়ালো না। হিয়া তার বাবাকেও বলতে পারেনি তার সমস্যার কথা। মা থাকলে হয়তো হিয়া সবটা তাকে বলতে পারতো কিন্তু তার তো মা থেকেও নেই। হিয়া অনেক কষ্টে, দিনের পর দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করে মুভ অন করে। আল্লাহর রহমতে তার পরীক্ষা খুব ভালো হয়। হিয়ার সাথে আভাসের শেষ দেখা হয় তাদের বিদায় অনুষ্ঠানের দিন। আভাস সেদিন একটা মেয়েকে সাথে করে নিয়ে এসেছিল। তার পরিচয় দিয়ে হিয়াকে বলেছিলো, হিয়া ও অনুরিমা। আমার গার্লফ্রেন্ড।
এই ছিল তাদের শেষ দেখা। এর পর আভাসের সাথে হিয়ার আর দেখা হয়নি। সেই থেকে আভাসের প্রতি তার অসামান্য ক্রোধ। নাম শুনেই গা জ্বালা করে। আভাস তো কখনো তার ভালো চাইনি তাহলে হুট করে এমন পার্সেল পাঠানো মানে কি?
হিয়ার ভাবনার মেঘ দূরীভূত হলো নোরার আগমনে। নোরা তার রুমে এসে বললো,
-একি আপু তুমি এখনো রেডি হওনি?
হিয়া তার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
-রেডি হবো কেন?
-আমরা আজ ঘুরতে যাবো। তোমার বর বলেছেন, তিনি আজকে আমাদের সবাইকে ভরপেট ট্রিট দিবেন।
-তোরা যা। আমি যাবো না। আমার পড়া আছে।
-সারাক্ষণ তো শুধুই পড়োই। আজ না হয় আমাদের সাথে একটু ঘুরতে গেলে তাতে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? আর তুমি না গেলে কি ভাইয়ার যেতে ইচ্ছে করবে? তাই তোমাকে অবশ্যই যেতে হবে।
_
পড়ন্ত বিকেল! হিয়ারা নদীর ধারে বেড়াতে এসেছে। এখন বর্ষাকাল। নদীতে ভরা জল। নদীর পাড়ে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। নদীর ধারের পিচঢালা রাস্তাটা খুব সুন্দর। দুই পাশে সবুজের সমারোহ। রাস্তার একপাশে নদীর ধারে সাদা তুলোর মত অসংখ্য কাশফুল ফুটে আছে। দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। আর অপর পাশে বুন ফুলের মেলা। তা থেকে সুন্দর সুবাস আসছে। হিয়া আর প্রত্যয় পাশাপাশি হাঁটছে। হিয়ার কাজিনরা সবাই সামনে। তারা দুজন সবার পেছনে। হিয়া আজ সাদা আর আকাশীর মিশেলে একটা জামদানী শাড়ি পড়েছে। মুখে কোন প্রসাধনী ছোঁয়া নেই। তার ছোট ছোট চুলগুলো ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে আছে। হিয়ার গাঁ থেকে সুন্দর একটা ঘ্রাণ ভেসে আসছে। যা প্রত্যয়কে মাতাল করে তুলেছে। প্রত্যয়ের আজ বিশ্বাস হচ্ছে কবি, লেখকরা তাহলে মিথ্যা বলেনা। সত্যিই মেয়েদের মাতাল করা গন্ধ থাকতে। যা প্রত্যয়ের মতো নারীদ্রোহী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষকেও মূহুর্তেই নাড়িয়ে তুলতে পারে।
নদীর পাড়ে একটা ফুচকার দোকানে আছে। প্রত্যয় সবাইকে ফুচকার ট্রিট দিলো। সেখানে গিয়ে প্রত্যয়ের চোখ আটকালো নাম না জানা এক নীল রঙের বনুফুলের দিকে। হিয়ার সাজের সাথে এই ফুলটাই কম আছে। প্রত্যয় সবার অলক্ষ্যে একগুচ্ছ ফুল ছিঁড়ে নিলো। কিন্তু হিয়াকে ফুলগুলো দিতে তার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। হিয়া আবার কি না কি ভাববে। আর তাছাড়া এখানে সবাই আছে। তাই সে ফুলগুলো তার বুক পকেটে রেখে দিলো। বাসায় গিয়েই না হয় সে ফুলগুলো হিয়াকে দিবে।
_
কাল প্রত্যয় আর হিয়ার প্রত্যয়দের বাসায় চলে যাবে। আজকেও হিয়ার কাজিনদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো প্রত্যয়। হিয়া পড়ছে। তাই সে এখন রুম গেলে হিয়ার হয়তো ডিস্টার্ব হবে তাই প্রত্যয় এখনো রুমে যায়নি। আড্ডার মধ্যে হিয়ার কাজিন রাফি বলে উঠলো,
-দুলাভাই আপনার বউ যে অসাধারণ গান গাইতে পারে আপনি কি জানেন?
তার কথার প্রত্যুত্তরে প্রত্যয় দুঃখ প্রকাশ করে বললো,
-আমি কি করে জানবো? তোমার পড়কুট বোন কি আর আমাকে গান শুনিয়েছে কখনো? সে তো বাসর রাতের পড়ার বই নিয়ে বসে ছিল।
সাথে সাথেই হাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। রাফি বললো,
-হিয়া আপুকে অনেক বলছি। আপু তুমি তো গানটা নিয়ে ভাব অনেক দূর এগোতে পাড়বে কিন্তু তার জীবনের তো আছে ওই একজনই। বই।
আড্ডা শেষে রাত বারোটার দিকে রুমে এলো প্রত্যয়। হিয়া তখন পড়ার টেবিলের বসেছিল। খাতায় কিছু একটা লিখছে। কিন্তু তার মনোযোগ অন্য কোথাও পড়ে আছে। প্রত্যয় নিঃশব্দে হিয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। দেখলো হিয়া খাতায় কলম দিয়ে কিসব আবোলতাবোল লিখছে। মেয়েটার নিশ্চিয়ই কিছু একটা হয়েছে। সে সকাল থেকেই প্রত্যয় তাকে দেখছে হিয়া আজ সারাদিন অন্যমনষ্কই ছিল। এমনকি বেড়াতে গিয়েও তার মধ্যে কোন উচ্ছাস ছিল না। সকালে সেই পার্সেল টা আসার পর থেকেই হিয়া অন্যমনষ্ক হয়ে আছে। প্রত্যয় মৃদু কন্ঠে ডাকলো,
-হিয়া।
হঠাৎ করে পেছন কারো কন্ঠ শুনে সে ধরফরিয়ে উঠে বললো, হুম।
-এনি প্রবলেম? সকাল থেকে দেখছি আপনি বেশ অন্যমনষ্ক হয়ে আছেন।
হিয়া জোরপূর্বক ঠোঁটে একটা হাসির রেখা টেনে বললো,
-না কোন সমস্যা নেই।
প্রত্যয় বুক পকেট থেকে ফুলগুলো বের কর হিয়াকে গিয়ে ও দিতে পারলো না। খুব অস্বস্তি হচ্ছে। তার থেকে এগুলো বরং বুক পকেটেই থাক। মনে হবে তার সাথে হিয়া মিশে আছে। প্রত্যয় সেখান থেকে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো যদিও এখন ঘুম আসবে না। তবুও দূর থেকে তার পড়কুট বউটাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার অনুভূতিটা মন্দ না।
~চলবে, ইনশাআল্লাহ।