গল্প:#বাক্সবন্দী_চিঠি
লেখক: Ninika Jaman Noor
পর্ব:১
ইতু আজ দুই বছর পর তার বাড়ি ফিরছে।দুই বছর আগে যখন বাড়ি ছেড়ে ছিলো তখনো মনে হয়েছিলো সেখানে আর কখনো ফেরা হবে না।বুকে মাঝে একরাশ কষ্ট আর অভিমান নিয়ে কুমিল্লা থেকে চট্রগ্রাম চলে গিয়েছিলো।
ইতু বাসে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ভাবতে লাগলো কিভাবে ওই শহরে পা রাখবে?
ওই শহরটাতে যে আবির নামটাও জড়িয়ে আছে।
বহু কষ্টে তার মায়া কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।সেখানে গিয়ে আবার পুরনো ক্ষত তাজা করতে চায়না সে।আচ্ছা চাইলেই কি মায়া কাটিয়ে উঠা যায়? না,শুধু ক্ষনিকের জন্য মনটাকে ভুলিয়ে রাখা যায়।ইতুও দুই বছর ধরে তাই করে যাচ্ছে।
কাল রাতে অনু ফোন করে বলে দিয়েছে দুই দিন পর তার বিয়ে ইতু যদি না আসে তাহলে সব সম্পর্ক একেবারেই শেষ করে দিবে।এক প্রকার বাধ্য হয়েই ফিরতে হচ্ছে তাকে।যেখানে আবিরের মুখও দর্শন করতে চায় না সেখানে তারই বোনের বিয়েতে যাচ্ছে সে।ইতু কানে হেডফোন গুজে দিয়ে অতিতের কথা ভাবতে লাগলো। _________________
ইতু তখন সবে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।বরাবরই সে ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট।তাই বলে যে সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে থাকতো তেমন নয়।পড়ার জন্য একটা নির্ধারিত সময় আছে তার।শুধু সে সময়টায় তাকে পড়তে দেখা যায়।তখন দুনিয়া উল্টে গেলেও কেউ তাকে পড়ার টেবিল থেকে তুলতে পারবে না।শুধু মাত্র একজন ছাড়া।সেই একজনের ডাক ইতু কখনো অগ্রাহ্য করতে পারে না।আর তিনি হলেন ইতুর দ্যা গ্রেট আবির ভাইয়া।আবিরের একডাকে ইতু তার কাছে গিয়ে হাজির হয়।ছোটবেলা থেকেই ইতু আবিরের সবকথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসছে।যবে থেকে প্রেম কি তা বুঝতে শিখেছে তবে থেকেই সে আবিরের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।এই কথা আবির না জানলেও তার বোন অনু যানে।অনু আর ইতু দুইজন কলিজার বান্ধবী।একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারতো না।আর অনুর ভাই হচ্ছে আবির।পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার সুবাদে তাদের দুই পরিবারেও অনেক মিল।
আবিরের বাবা শফিক হাসান আর ইতুর বাবা আব্দুল কাদের অনেকবছর ধরে ব্যবসাও করছেন একসাথে।তাতে দুই পরিবারের সম্পর্কটা আরো গাঁঢ়ো হয়েছে।
ইতু বিছানায় বসে গল্পে বই পড়ছিলো।তখনইআবির ইতুদের বাসার নিচে এসে ইতুকে কল দিলো।ইতু ফোনের দিকে তাকিয়ে আবিরের কল দেখেই দ্রুত কলটা রিসিভ করলো।
“ইতু আমি তোর বাসার নিচে তাড়াতাড়ি বাইরে আয়।”
ইতুকে কিছু বলতে না দিয়ে আবির কলটা কেটে দিলো।
ইতু বই রেখে দৌড়ে নিচে যেতে গিয়ে আবার রুমে এসে আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে নিলো। চুল ঠিক করে আবার দৌড়ে দিলো।ইতুর মা শারমিন বেগম ইতুকে এমন দৌড়াতে দেখে কিছু বলতে গিয়ে বাইরে আবিরকে দেখে থেমে গেলো।মুচকি হেসে কাজে চলে গেলো।ইতু দৌড়ে বাইরে এলো।আবির বাইকের সাথে হেলান দিয়ে একধ্যানে ফোন টিপছে।অতি লম্বা, সুদর্শন, স্মার্ট একটা ছেলে আবির। হোয়াইট টি শার্ট, থ্রি কোয়াটার কালো প্যান্টে এতো আর্কষনীয় লাগছে যে ইতু আরেকবার আবিরের প্রেমে চিত্পটাং হয়ে পড়লো।আবিরের সামনে গিয়ে হাঁপাতে লাগলো ইতু।
আবির ওর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বললো,”তুই যে একটা গাধী যানিস তুই?তোকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছি তাই বলে বাতাসের গতিতে আসতে তো বলিনি।”
ইতু দম নিয়ে মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে বললো,”তাড়াতাড়ি আসতে বললে তো তাই ভাবলাম খুব ইমপটেন্ট কিছু।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।শুন তোকে একটা কাজ করতে হবে।”
ইতু খুশি হয়ে মুচকি হেসে বললো,”বলো কি কাজ করতে হবে?”
আবির ইতুর হাতে একটা গিফট বক্স আর চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললো,”এগুলো এক্ষুনি কুহুকে দিয়ে আসবি।মেয়েটা আমার ওপর রাগ করে কল ও রিসিভ করছে না।তুই এগুলো লুকিয়ে ওকে দিবি।ঠিকমতো দিয়ে আসতে পারলে তোর পছন্দের এক বক্স চকলেট পাবি।”
কুহুর নাম শুনে ইতুর মুখটা কালো হয়ে গেলো।আবির কেনো ওকে দিয়ে বারবার এইসব পাঠায় ইতু বুঝতে পারে না।আবিরের প্রেমিকা কে এইসব দিতে হবে ভাবতেই ইতুর কান্না পায়।তার উপর আবির তাকে চকলেটের লোভ দেখাচ্ছে।ইতু তো এমনিতেই কাজটা করে দিতো।
পরক্ষনেই একটা কথা মনে পড়তেই ইতুর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে।
আবির বললো,”কিরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে হাসছিস কেনো?যা এখন।”
“ভাইয়া তোমার বাইকে করে আমাকে দিয়ে আসো না।”
“ইসস শখ কতো।আমার বাইকের পিছনের সিট একমাত্র কুহুর জন্য।তোর জায়গা নেই আমার বাইকে।তাছাড়া পরের গলিতেই তো ওদের বাসা বাইকে করে ছাড়তে হবে কেনো?”
ইতুর মনটা কালো বাদলে ছেয়ে গেলো।”কি হয় একটু বাইকে করে ছেড়ে দিয়ে আসলে?তোমার কাজেই তো যাচ্ছি।আবার বলছে পিছনের সিট কুহু আপুর জন্য বরাদ্দ করা।হুহ উঠবো না তোমার বাইকে।একদিন নিজে ডেকে এনে উঠতে বলবে দেখে নিয়ো।”
“কিরে ভাবুকরাণী তোর ভাবনা শেষ হলো?এইবার দয়া করে এগুলো পৌঁছে দিয়ে আয়।”
ইতু মাথা নিচু করে হাঁটা ধরলো।পরের গলিতেই কুহুদের বাসা।আবির আর কুহু চার বছর ধরে রিলেশনশীপে আছে।এই চার বছর ধরে ওদের ডাকপিয়ন হচ্ছে ইতু।ইতু এই কাজটা করে দুটো কারনে।প্রথমটা হলো আবিরের কথা অমান্য করার সাহস ইতুর নেই আরদ্বিতীয়টা হলো আবিরের চিঠি।কুহু আবিরের সব চিঠি ইতুকে দিয়ে পড়ায় আর ফেলে দিতে বলে।কুহুর কাছে গিফটাই মূখ্য।কিন্তু ইতু কখনো চিঠিগুলো ফেলে দেয়না।যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দেয়।মাঝে মাঝে সেই চিঠিগুলোর উত্তর ইতু লিখে রাখে।কেবল আবিরকে দেয়া হয় না।নিজের কাছে বাক্সবন্ধী করে রাখে।
ইতু কুহুদের বাসায় ঢুকার আগে গিফটা আর চিঠিটা ভালো করে উড়নার নিচে লুকিয়ে রাখলো।ভিতরে ঢুকে দেখলো কুহুর বাবা সোফায় বসে পেপার পড়ছে।ইতু তাকে দেখে সালাম দিলো।
“আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল।”
“ওয়ালাইকুমআসসালাম।কেমন আছো ইতু মা?বাসার সবাই ভালো আছে?”
“আলহামদুল্লিলাহ সবাই ভালো আছে।আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও ভালো আছি। তোমাকে তো এখন দেখাই যায় না।কতোদিন পর এলে।”
“আঙ্কেল আমার তো পরীক্ষা চলছিলো তাই আসতে পারিনি।”
“ওহ হ্যাঁ। তা পরীক্ষা কেমন হলো?”
“জি ভালোই হয়েছে।”
“ভালো তো হওয়ারই কথা।আফটার অল তুমি একজন ব্রাইট স্টুডেন্ট।আমি জানি ফিউচারে খুব ভালো করবে না।এইভাবে পড়ালিখা চালিয়ে যাও অনেক উপরে যেতে পারবে।”
“জি।কুহু আপু বাসায় আছে?”
“হ্যাঁ ওর রুমেই আছে।যাও গল্প করো গিয়ে।আমি তোমাদের জন্য নাস্তা পাঠাতে বলি।”
ইতু একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো।এতোক্ষন আটকে রাখা দমটা ছেড়ে দিলো।এই লোকের মনে হয় বেশী কথা বলার বাতিক আছে।ইতুকে দেখলেই কথার ঝুড়ি খুলে বসেন।
ইতু কুহুর রুমে ঢুকে দেখলো কুহু নেইল পলিশ লাগাচ্ছে।ইতুর এখন কুহুকে দেখে ইচ্ছা করছে এই নেইল পলিশটা ওকে খাইয়ে মেরে ফেলতে।ওকে দেখেই মনের ভিতর পুষে রাখা রাগ টগবগ করতে থাকে।ইতু নিজের ভাবনা দেখে নিজেই হকচকিয়ে গেলো।কি ভয়ংকর একটা কথাই না ভাবছিলো সে।”আচ্ছা আমি কি আবির ভাইয়ার প্রেমে পাগল হয়ে গেছি?কিসব উল্টা পাল্টা ভাবছিলাম?আমি তো এমন নই।”
“কিরে ভাবুকরাণী ওখানে দাড়িয়ে আছিস কেনো?ভেতরে আয়।”
ইতু কুহুর পাশে বসে মুখটা গম্ভীর করে বললো,”ওই নামে তুমি আমাকে ডাকবে না।”
“কেনো? আবির তো তোকে এই নামে ডাকে।”
“আবির ভাইয়া ডাকলেও তুমি ডাকবা না।”
কুহু ইতুর গাল টেনে বললো,”আচ্ছা ঠিক আছে ডাকবো না।এখন বল এতোদিন পরে হঠাত্ কি মনে করে এলি?”
ইতু ওড়নার নিচ থেকে গিফট বক্স আর চিঠি দিয়ে বললো,”আবির ভাইয়া পাঠিয়েছে।”
গিফট বক্স দেখে কুহু লাফিয়ে উঠলো।তাড়াতাড়ি খুলে দেখলো একজোড়া কানের দুলো।কানের দুল দেখেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠলো কুহুর।আয়নার সামনে দাড়িয়ে কানে দিয়ে দেখলো কিছুক্ষন।তারপর ইতুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,”ইতু এগুলো তুই নিয়ে যা।”
ইতু অবাক হয়ে বললো,”আমি কেনো নিবো?আবির ভাইয়া তো এগুলো তোমার জন্য পাঠিয়েছে।”
কুহু চোখ মুখ কুঁচকে বললো,”বালের একটা গিফট দিয়েছে।দুইশো টাকাও দাম হবে না এটার।আমি এইসব সস্তা জিনিস পরি না।তুই রেখে দে।”
ইতু চমকালো কুহুর কথা শুনে।একটা মানুষ ভালোবেসে গিফট টা দিয়েছে সেখানে কুহু শুধু দামটাই দেখছে?ইতু মনে মনে তাচ্ছিল্য করলো।আবির ভাইয়া কি দেখে এই মেয়ের প্রেমেপড়েছে ইতু বুঝতে পারেনা।কানে ঝুমকো জোড়ার দিকে তাকিয়ে হাসি ফুটলো।এইগুলো ও সে যত্ন করে রাখবে।আবির এর কোনো জিনিস সে ফেলে দেয় না।
কুহু বিছানায় শুয়ে ফোনে মগ্ন হয়ে গেলো।
ইতু হাত কচলাতে কচলাতে বললো,”আপু চিঠিটা?”
“ফেলে দে পড়ার দরকার নেই।”
ইতুর মেজাজ খারাপ হচ্ছে।মেয়েটা এমন কেনো?ইতু আর এক মিনিট ও বসলো না হনহন করে বেরিয়ে গেলো।পিছন থেকে কুহু কয়েকবার আওয়াজ দিলো ইতু শুনলো না।
বাসায় এসে ইতু চিঠিটা খুললো।
প্রিয় কুহুপাখি
এতোরাগ করো কেনো বলতো? রাগ করেছো ভালো কথা ফোন কেনো তুলছো না? তুমি যানো না তোমার সাথে কথা না বলে আমি থাকতে পারি না।”তোমাকে যখন দেখি
তার থেকে বেশী দেখি
যখন দেখি না।
চুড়ুই পাখিরা যানে আমি কার প্রতিক্ষায় বসে আছি।
~সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়”
চিঠিটা পড়ে ইতু সেটাকে কিছুক্ষন বুকে জড়িয়ে রাখলো।নাকের কাছে ধরলো গ্রান নেয়ার জন্য।এই চিঠিতে যে আবিরের ছোঁয়া আছে।আবিরের প্রতি ইতুর ভালোবাসার পরিমাপ সে নিজেই করতে পারে না।
ইতু উঠে আলমারির কোনা থেকে একটা মাঝারি আকারের কাঠের বাক্স বের করলো।কলম দিয়ে চিঠির উপর লিখলো ১০২।এই চার বছরে আবিরের লিখা ১০২নং চিঠি।
চলবে……
(