#তৃনভূমি
#ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৪
সারা বাড়ির কোথাও সুমনার কোনো খোঁজ পেলাম না। আমার শরীরের তাপমাত্রা এতো সময় ১০৩ ছাড়িয়ে গেছে। আর এক পা হাঁটার শক্তি পাচ্ছি না। কি শুরু হলো এসব! কোনো রকম ঘরে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। ঘরে ঔষধ আছে কিনা জানি না, একটা ঔষধ খেতে পারলে হয়তো ভালো লাগতো, জ্বর কিছুটা কমে যেতো কিন্তু ঔষধ খোঁজার শক্তি আমার শরীরের নেই। শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি। এমন সময় সোহাগ আসলো।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো একপ্রকার। কি হয়েছে কে জানে, দূত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে কপালে হাত দিলো।
–” তোমার শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সরি আমার দেরী হয়ে গেলো ঔষধ আনতে। দেখি এই স্যান্ডউইচটা খেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও তো। ”
আমি কৃতজ্ঞ চোখে ও-র দিকে তাকালাম। সেই সাথে নিজের কাছেও লজ্জিত হলাম। জ্বর হলে আমি ভাত খেতে পারি না একদমই, শুধু বমি আসে। তার জন্য সোহাগ বাইরে গেছিলো স্যান্ডউইচ আর ঔষধ আনতে আর আমি কিনা ও-কে সুমনার সাথে ভেবে সন্দেহ করছিলাম। কিন্তু আমি-ই বা কি করবো আমার মন একদমই মানতে চায় না। সুমনাকেও খুব একটা ভালো মনে হয় না। আমাকে এমন কিছু একটা করতে হবে যাতে সোহাগ নিজেই আর কখনো ও-ই মহিলার আশেপাশে না যায়।
সোহাগ খুব যত্ন করে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। আমার চোখের কোণে অশ্রু টলটল করছে, সুখের কান্না হয়তো। সোহাগ খুব যত্ন করে চোখের কোণের অবাদ্ধ পানিগুলো মুছে দিলো। তারপর কপালে চুম্বন করে বললো, ” অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমার তাই না? একটু কষ্ট করে খেয়ে নাও তারপর ঔষধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো, একটু হলেও ভালো লাগবে। ”
আমি বাধ্য মেয়ের মতো খাবার আর ঔষধ খেয়ে নিলাম। আসলে স্বামী এতো যত্ন পাওয়ার ভাগ্য সব মেয়ের হয় না। অনেকের স্বামীর ধারনাও সুমনার মতো হয়। তারা মনে করে বউদের সেবা করলে হয়তো মান সম্মান চলে যায়। বউয়ের খেয়াল রাখলে সমাজ বউ পাগল নাম দেয়। আরে বিপদে পড়লে এই বউ ছাড়া কেউ তোমার পাশে আসবে না। যারা তোমাকে বউ পাগল বলে তাদের মানসিক সমস্যা আছে। একদিন অসুস্থ হয়ে দেখো বউ ছাড়া কেউ তোমার পাশে বসে তোমার সেবা করবে না। ( এখানে শুধু বউকে নিয়ে বলছি, কেউ বলবেন না যে মা দেখে বোন দেখে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিপদের সময় আপন মানুষরাই পাশে থাকে। সে যে কেউ হতে পারে।)
ঔষধ খাওয়ার পর সোহাগ একটা বাটিতে পানি আর কাপড় নিয়ে আসলো। তারপর কাপড় ভিজিয়ে কপালে জলপটি দিতে লাগলো। মাঝে মাঝে মুখটাও মুছিয়ে দিচ্ছে। পানির স্পর্শে আমার ঠিক কতটা ভালো লাগছে জানি না তবে সোহাগের স্পর্শ আমাকে কষ্ট ভুলে থাকতে সাহায্য করছে।
।
পরেরদিন সকালে আমার জ্বর কমে গেলেও শরীর অনেক দূর্বল হয়ে আছে। ফজরের নামাজ পড়ে আবার শুয়ে আছি। খাবার রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। সোহাগও আমার পাশে বসে কাজ করছে। ঘন্টা খানেক শুয়ে থাকার পর উঠে গেলাম। সোহাগ অফিসে যাবে, ও বাইরের খাবার একদমই খেতে পারে না। তাছাড়া কাল আমার জন্য ও-র অনেক কষ্ট হয়েছে। আমার কষ্ট হবে বলে সারারাত ফ্যানও চালায়নি। আমি বিছানে থেকে নামতে যাবো এমন সময় সোহাগ আমার হাত ধরে ফেললো।
–” কোথায় যাচ্ছো তুমি? ”
–” রান্না করবো না বুঝি?”
–” তোমার না শরীর খারাপ, তুমি রান্না করতে পারবে তো? ”
–” হুম পারবো হুহ। একদিনে জ্বরে কিছু হয় না আমার। ”
–” হয় কিনা তাতো আমি খুব ভালো করেই জানি। এসব কথা আমাকে বলে লাভ আছে কোনো? আমি তো তোমাকে বেশ কয়েকদিন ধরো দেখছি। ”
–” সত্যি আমি ঠিক আছি। তুমি একদম গল্পের নায়কদের মতো বউ পাগল, বাস্তবে এমন হয় নাকি?”
–” আমি গল্প বা বাস্তব বুঝি না। যার সাথে সারাজীবন কাটাবো ঠিক করছি, তার খেয়াল রাখাটাও আমার দায়িত্ব। এতে আমি ন্যাকা বোকা যা-ই হই আমার সমস্যা নেই। ”
আমি ও-র কথায় মুচকি হাসলাম। রেগে গেছে জনাব আমার। সোহাগ একহাত দিয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে আমার দিকে উঠে এলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ” আমি বদলে গেলে তুমি ঠিক থাকবে তো প্রেয়সী? যদি তুমি ঠিক থাকতে পারো আমিও বদলে যেতে পারবো। ”
আমি সোহাগকে জড়িয়ে ধরলাম। অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
–” না আমি একটুও থাকতে পারবো না, একটুও না। তুমি কখনো বদলে যাবে না। ”
সোহাগ মুচকি হেসে একহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, অন্যহাত নিয়ে কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বললো, ” তাহলে বলো কেন শুনি?”
–” আমি কি বলদে যেতে বলেছি নাকি? শুধু নিজে নিজে বেশি বোঝে!”
মুখ গোমড়া করে কথাগুলো বললাম।
–” পাগলী একটা! দেখি চলো তুমি কি রান্না করো আমিও দেখি। ”
সোহাগও আমার পিছন পিছন রান্নাঘরে চলে এলো। মিটসেফের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার কাজ কর্ম পর্যবেক্ষণ করছে। রাইস কুকারে আলু সিদ্ধ আর ডিম সেদ্ধ ভাত বসিয়ে দিলাম। শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না যে অন্যকিছু রান্না করবো। সোহাগ ফ্রিজ থেকে ডিম বের করলো।
–” আপনি ডিম দিয়ে কি করবেন? আমি তো ডিম সিদ্ধ দিলাম। ”
–” আগে তুমি আমাকে তুমি বলবে নাকি আপনি বলবে তাই ঠিক করো তারপর না হয় আমি উত্তর দিবো। ”
আমি মুখ বেঁকিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলাম। এই ছেলেটা শুধু পেঁচিয়ে কথা বলে। সোহাগ ডিম দিয়ে পাউরুটি ভেজে নিলো। আমি আর কিছুই বললাম না। কিছু বললে তো আর সোজা জবাব দিবে না, বলেই বা লাভ কি।
সকালের খাবারের মেনুতে আলু ভর্তা আর ডিম ভর্তা। সাথে গরম ভাত। সকালের হিসাবে খুব ভালো খাবার। আর সেই সাথে সোহাগের পাউরুটি।
খাওয়ার সময় দুইগাল মুখে দিতেই আমার কেমন বমি আসতে লাগলো। অসুস্থ হলে আমি কিছুতেই ভাত খেতে পারি না এটা ছোট বেলা থেকেই হয়ে আসছে আমার সাথে। সোহাগ আমার সামনে থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে গেলো। তারপর অন্য একটা প্লেটে পাউরুটি আর একটা ডিম সিদ্ধ দিয়ে বললো, ” এগুলো খেয়ে নাও। আমি জানি তুমি ভাত খেতে পারবে না। ”
উরি উরি আমার বরটা কি কেয়ারিং! আমি মুচকি হেসে বাধ্য মেয়ের মতো খাবারগুলো খেয়ে নিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এতে আর বমি আসছে না। নিজের শরীরের গতিবিধি আমি নিজেই বুঝতে পারি না৷ খাওয়া শেষ হলে সোহাগ জোর করে ঔষধ খাইয়ে দিলো। জ্বর নেই তবুও ঔষধ খেতে হবে, না হলে নাকি আবার জ্বর আসবে।
সকালের সব কাজ শেষ করে সোহাগ অফিসে যাওয়ার সময় সুমনা আর বিল্ডিংয়ের সকলে আমাদের বাসায় আসলো। সুমনা কেঁদে কেঁদে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলেছে।
সুমনা দৌড়ে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরলো।
–” ভাবি আমার গর্ভে আপনার স্বামী বাচ্চা। আপনি দয়া করে আমার উদ্ধার করেন। আমি আপনার চাকরানী হয়ে থাকবো। ”
আমি হতভম্ব হয়ে সকলেই দিকে তাকিয়ে রইলাম। সোহাগেরও আমার মতো অবস্থা।
হঠাৎ সোহাগ রাগী গলায় বললো, ” এই আপনি কিসব বাজে কথা বলছেন? আমি আজ পর্যন্ত আপনার হাত ধরিনি। আমার সন্তান আপনার গর্ভে কি করে থাকতে পারে? তাছাড়া আমার কি বউ নেই নাকি?”
সোহাগের কথা শুনে একটা মহিলা ব্যঙ্গ করে বলে উঠলো, ” যে দিনকাল পড়েছে তাতে এসব অস্বাভাবিক কিছু নয়। মোনালিসা দেখো তোমার বর তোমার কপাল পোড়ালো। ”
মহিলার কথায় সোহাগের কেমন লেগেছে জানি না কিন্তু আমার প্রচুর পরিমানে রাগ হচ্ছে। সোহাগ কখনো এ কাজ করতে পারে না। আমি কর্কশ গলায় বললাম, ” আমি বিশ্বাস করি না সোহাগ এমনটা করতে পারে। সুমনা ভাবি চলেন আপনাকে চেকাপ করিয়ে দেখবো আপনি আদো অন্তঃসত্ত্বা কিনা!”
সুমনার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। সোহাগ কৃতজ্ঞ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশের সকলেই আমার কথার সাথে সহমত হলো।
চলবে